মাহেরা! এই নিস্তেজ, নিস্তব্ধ বিকালে একা ছাদে দাড়িয়ে কেন বোনু? পাঁচ মাসের ভারী পেটটা নিয়ে পা টিপে টিপে হেটে মাহেরার পাশে এসে দাড়াতে দাড়াতে কথাগুলো বলল নায়েলা।
গ্রামের সুন্দর, নির্মল প্রকৃতি দেখছিল মাহেরা। হঠাৎই নায়েলার কথায় হেমন্তের সুন্দর সাজ সাজ প্রকৃতি দেখাই ব্যাঘাত ঘটল। বোনের দিকে ফিরে বিরষ কন্ঠস্বরে বলল,
~দেখ না, কি সুন্দর প্রকৃতি। এসবই দেখছিলাম। মন খারাপের সময় একান্তে প্রকৃতিবিলাস করতে মন চাই। সুন্দর অন্তরীক্ষে পলকহীন তাকিয়ে থাকতে মন চাই। এসবে কত যে আনন্দ খুজে পাই তোমায় বোঝাতে পারব না আপু।
~একেক জনের আনন্দ, ভালো লাগা একেক রকম। এইযে তোর যেমন মন খারাপে প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, তেমনি অনেকের মন খারাপের সময় খেতে ভালো লাগে, শপিং করতে ভালো লাগে, কারোও আবার ঘুরতে যেতে ভালো লাগে। ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ সবার কাছেই অন্যরকম। তা আমার কিউট বোনুটার হঠাৎ মন খারাপ কেন?
~এমনি আপু। তেমন কিছু না। আমার তো মাঝেমাঝেই মুড সুয়িংয়ের রোগ আছে। আজও হয়তো সেজন্যই মন খারাপ। নিতু ফোন দিয়েছিল, শুনলাম রিনির নাকি মেয়ে হয়েছে! ভালোই আছে তাহলে। কিন্তু, আমার কি দোষ ছিলো বলতো আপু? বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো আমার স্কুল জীবনের। নিতু আর ওর মধ্যেই আমার বন্ধুত্বের সীমাবদ্ধতা ছিলো। বিনা নোটিশে ভেঙে গেল সেই বন্ধুত্ব। ওর কোন ক্ষতি করেছিলাম বলে তো মনে হয় না। আমাকে এভাবে অপমান কেন করল? স্বাভাবিকভাবে বললেই পারতো। সে আমাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বি ভেবেছে। অথচ আমি তাকে বোনের মত বন্ধু ভাবতাম। কথাগুলো বলতে বলতে মাহেরার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরল চিবুকে।
এতক্ষণ মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় মাহেরার বলা কথাগুলো শুনছিল নায়েলা। মন ভারী হল তারও। আহা ছোট্ট বোনটা তার কোন দোষ না করেও কতটা কষ্ট পাচ্ছে। ভালো মানুষেরা এভাবেই বুঝি কষ্ট পাই। বোনকে কোমল, শান্ত কন্ঠস্বরে সান্ত্বনা দিতে বলল,
~আমার বোনটাকে আমি স্ট্রং বলেই জানতাম। সে কেন ফালতু একটা বিষয় নিয়ে চোখের মূল্যবান অশ্রু নির্গত করছে? চোখ থেকে এক ফোটা পানিও যেন না পড়ে। জীবনে চলতে গেলে বহু মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে আমাদের জন্য মঙ্গল কামনা করে এমন মানুষের সংখ্যা থাকে খুবই অল্প। কিন্তু আমাদের ক্ষতি করার মানুষের অভাব থাকে না। আর কিছু মানুষ আছে দুমুখ সাপ! এরা আমাদের সাথে এমনভাবে মিশে বোঝাই যায় না কিভাবে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা এদের দ্বারা হয়। তোর ওই বান্ধবীকে আমার তেমনটাই মনে হয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। আল্লাহ্ না করুক এই মেয়ের দ্বারা তোর এর থেকে বড় কোন ক্ষতিও হয়ে যেতে পারত। তাই ওসব কথা না ভেবে, সামনের দিনগুলোর দিকে নজর দে। আল্লাহ্ তোকে উত্তম জীবনসঙ্গী দান করুন। আল্লাহর জীবন বিধান মেনে চল দেখবি জীবন সুন্দর।
~অবশ্যই জীবন সুন্দর। জীবনের সকল বক্রতাকে জয় করে তবেই সরল সুন্দর জীবনের দেখা পাওয়া যায়। আপু দোয়া করিও। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে ইসলামকে সামনে রেখে চলতে পারি।
~হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া রইল। এগিয়ে যা সামনে তোর জন্য উত্তম কিছু অপেক্ষা করছে।
~কথা বলতে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম, তুমি এই শরীরে ছাদে এসেছ কেন? কাউকে দিয়ে ডাকালেই পারতে? এখন চল নিচে যায়।
~কিচ্ছু কষ্ট হয়নি আমার । এসময় একটু আধটু হাটা প্রয়োজন। তাছাড়া আমি সবসময়ই শুয়ে বসেই কাটাই। বাবু পে’টে আসার পর থেকে কোন কাজে হাত লাগাতেই পারি না। সবাই খুব যত্ন নেই আমার।
~আলহামদুলিল্লাহ শুনে খুব ভালো লাগলো। চলো যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরীবের আজান দিয়ে দিবে।
অতঃপর আলাপনের সমাপ্তি ঘটিয়ে দুবোন নিচে নেমে এলো। মাহেরা’দের গ্রামে আসার চারদিন চলছে আজ। কাল নায়েলার শশুর বাড়ি থেকে সবাই আসবে। তাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। নায়েলার বিয়ের সময় সবার সাথে দেখা হয়েছিল ওদের, তারপর সেভাবে আর গ্রামে আসা হয়নি। তাই এবারে সময় সুযোগ বুঝে নায়েলার শশুর বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করেছেন।
কাল মেহমান আসবে। তাই সবার মধ্যেই ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। বাড়ির বড় মেয়ের শশুর বাড়ির লোকজন বলে কথা। যত্নের ত্রুটি রাখা যাবে না।
জলিলুর রহমান গ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী। সচ্ছল জীবন-যাপন তার। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেয়ে পরে সুখেই দিনযাপন করার সুযোগ আল্লাহ্ দিয়েছেন তাদের আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু অর্থ বিত্তের দিক থেকে নায়েলার শশুর বাড়ির ধারেকাছে তারা নেই। চেয়ারম্যান বাড়ি বলে কথা। কিন্তু অর্থ বিত্তের দাম্ভিক্য আত্মীয়তার জীবনে দেখতে পাননি তিনি। বড়ই সন্তুষ্ট মেয়ের শশুর বাড়ির লোকেদের প্রতি।
_______________________________________
নতুন দিনের শুরুটা রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফোটার মধ্যে দিয়ে। আজ ফজরের নামাজ আদায় করে একটা প্রানিও বসে নেই। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। মাহেরা প্রায়ই ফজরের নামাজ শেষে ঘুমাই কিছুক্ষণ। কিন্তু সেও আজ মা-চাচিদের সাথে কাজে হাত লাগিয়েছে। মেহমান আসবে বাড়িতে কোন ত্রুটি রাখা যাবে না তাদের আপায়নের।
মজিদুর রহমান ও জলিলুর রহমান গিয়েছেন বাজারে। সকালের টাটকা বাজার করতে। এদিকে নায়েলার ভাই নেমেছে পুকুরে মাছ ধরতে। গ্রামের ছেলে হওয়াই এসব ক্ষেত্রে বেশ পটু নিয়াজ। নিয়াজের সাথে মিনহাজও ছুটেছে সে দিকে দু ভাই আজ পুকুর থেকে মাছ ধরবে জাল ফেলে। নিজেদের বাড়ির সাথেই পুকুর কাটা। পিছনের দিকটাই। জনমানুষ নেই বললেই চলে। তাই মাহেরাও সে দিকে ছুটলো। মাছ ধরা দেখতে তার বেশ লাগে। আর বড় মাছ জালে বাধলে খুশিতে মুখ থেকে আটোমেটিক আওয়াজ ভেসে আসে। কিন্তু এসব সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার সময় সুযোগ কোনটাই তাদের হয় না।
পুকুরে নিয়মিত পরিচর্যা ও যত্নের জন্য বড় বড় মাছ হয় আলহামদুলিল্লাহ্। মাছ বড় হওয়ার পরে নিজেদের জন্য কিছু রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেন জলিলুর রহমান। এসবে ভাগ নেন না মজিদুর রহমান। তবে দায়িত্ব এড়িয়ে যায় না জলিলুর রহমান। প্রায়শই মাছ বিক্রি টাকা এবং সাথে অনেক মাছ পাঠিয়ে দেয় ভাইয়ের বাসায়। সময় পেলে নিজেই যায় না হলে স্ত্রী, পুত্র দিয়ে পাঠিয়ে দেন। তার ধারণা তার ভাই মধ্যম আয়ের মানুষ। সবসময় ভালো মন্দ জুটে না পাতে। পুকুরের ফরমালিন মুক্ত মাছ এবং মাছ বিক্রি টাকা দিয়ে কয়েকদিন বেশ সুন্দরভাবে চলে যাবে।
ভাইয়ে ভাইয়ে বেশ মিল তাদের। এমনটাই তো হওয়া উচিত।
পুকুরে একটার একটা জাল ফেলে বড় বড় মাছ ধরছে নিয়াজ। মিনহাজ সেগুলো তুলে বালতিতে রাখছে। পুকুরের পাড়ে দাড়িয়ে অতি আনন্দ ও আগ্রহের সাথে দেখছে মাহেরা। আজ পুকুরের এই মাছগুলো দিয়েই মেহমানদের আপ্যায়ন করা হবে। বাজার থেকে শুধু ইলিশ আর চিংড়ি আনা হবে। কারন সেগুলো তো আর পুকুরে চাষ হয় না।
বাড়ির মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পরেছে রান্নায়। সাথে দুজন হেল্পিং হ্যান্ড রেখে দিয়েছেন জলিলুর রহমান। সবসময় আমেনা বেগমই রান্না-বান্নার কাজ করে এসেছেন। তাই রুজিনা হক দায়িত্ব নিয়ে সে আজ মেয়ের শশুর বাড়ির মেহমানদের জন্য রান্না করবেন। চাচি হিসাবেও তারও কিছু দায়িত্ব আছে। শহর থেকে বাড়িতে বেড়াতে আসায় আমেনা বেগম তাকে দিয়ে তেমন কোন কাজ করাতেন না। নিজেই সব করতেন। কিন্তু আজ নিজেই সব করবেন রুজিনা হক। আমেনা বেগম তাতেও আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু আজ নাছোড়বান্দা রুজিনা সেটা কানেই নেননি। আমেনা বেগমের মুখে লেগে ছিল তৃপ্তির হাসি। যা দেখে রুজিনা বেগমও খুশি হলেন খুব। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া আদায় করতেও ভুললেন না। এমন সহজ সরল মেয়েটাকে তার বোন রুপি জা করে দেওয়ার জন্য।
একটা সংসারে শাশুড়ির পাশাপাশি জায়েরও কম গুরুত্ব থাকে না। সেখানে কিছু জা নামক অসাধু মানুষের জন্য সংসারে শান্তি আসে না। থাকে একে অপরের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ। আর জা নামক সম্পর্কের মানুষটা যদি ভালো হয়, তবে সদ্ব্য বিয়ে হয়ে আসা বধূটিরও নতুন পরিবেশ সহজ হয়ে যায়।
আমেনা বেগমের অনেকগুলো ভাই থাকলেও বোন ছিল না। তাই হয়তো জাকে নিজের বোনের মতই জ্ঞান করে।
এদিকে আমেনা বেগম সল্প শিক্ষিত নিম্নবিত্ত এক পরিবারের মেয়ে হলেও শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের রুজিনা হক বড় জা বড় বোন ছাড়া নিচু নজরে দেখেননি।
পাচঁ বছর পরে________________
ছেলের পেছনে অতি বিরক্তের সহিত খাবার নিয়ে ছুটছে মাহেরা। তিন বছরের ছেলে তার, কিন্তু মুখে খাবার দিতেই চাই না। জোর করে খাওয়াতে হয়। খাবার খাওয়াতে গেলে বাড়িময় ঘুরতে হয় ছেলের পেছনে। মুখে খাবার নিয়ে বি*চ্ছু ছেলে চিবুতে চাই না। কত ঢং সং করে খাওয়াতে হয়। কিন্তু বাবার হাতে ঠিকই খেয়ে নেই, বাধ্য ছেলের মত। বাবা যে আনাড়ি হাতে তাকে খাবার খাওয়ায়, বাচ্চা ছেলেকেও লোকটার খাওয়ানোর সাধ্য নেই। তাও ছেলের বাইনা বাবার হাতে খাওয়ার। কিন্তু তাকে খাওয়ানোর মত সময় বাবার ছুটির দিন ছাড়া হয় না। কে বোঝাই একে।
~আর একবার নাও সোনা! তাহলেই তো প্লেটের খাবার শেষ হয়ে যায়। আর খেতে বলব না তোমায়। এদিকে এসো আমাকে আর দৌড় করিও না। রেগে গেলে পিঠ আস্ত রাখব না। ফাজিল ছেলে।
~কে মারবে আমার ছেলেকে?কার এত সাহস দেখি? সোজা বাপের বাড়ি রেখে আসবো।
স্বামীর কথায় রাগান্বিত মুখশ্রি নিয়ে পেছন ফিরে মাহেরা। এই এক লোক ওনার জন্য ছেলের গায়ে ফুলের টোকাও দেওেয়া যাবে না।
~রেখে আসেন আমাকে সেটাই উত্তম হয়। আপনাদের বাপ-ছেলের যন্ত্রনায় আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
~আমরা শুধু যন্ত্রণা দেয়? ভালোবাসা দেয় না? তোমাকে ভালো না বাসলে ছেলের মা হতে পারতে?
ইমতিহানের এমন লাগামহীন কথায় মাহেরার কাশি উঠে গেছে। হালকা কেশে দ্বিগুন তেজ ভরা কন্ঠস্বরে উত্তর দিল,
~আসতাগফিরুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা আপনার কি বোধজ্ঞান সব লোপ পেয়েছে? কিসব বলছেন? ছেলে রুপে, পাশের রুমে মা-বাবা তারা শুনলে কি হবে, সে খেয়াল আছে আপনার?
ইমতিহানের নির্বিকার উত্তর,
~শুনলে শুনবে তাতে কি? আমি আমার কিউট বউটাকে বলেছি পররনারীকে তো আর বলিনি?
~হয়েছে! আর বলতে হবে না। এবার গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন তারপর নামাজে যেতে হবে।
~যাচ্ছি। শুধু অর্ডার মহারানির।
~আমাদের যে আজ ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে সে খেয়াল আছে না ভুলে গিয়েছেন? ইব্রাহিম তখন থেকে বলছে, পাপা কখন আসবে আর সে কখন ঘুরতে যাবে?
~হ্যাঁ জানা আছে ইব্রাহিমের তাড়া বেশি নাকি তার মায়ের! এটুকু বলে ফিক করে হেসে দিল ইমতিহান তারপর দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুম ছেড়ে নিজের রুমের দিকে গেল।
ইমতিহানের এমন খোচা দেওেয়া কথায় মাহেরা প্রতিত্তোরে কিছু বলার পূর্বে তার মুখের মিষ্টি হাসি দেখে চুপ করে গেল। বড্ড ভালোলাগে মানুষটার হাসি।
যে মানুষগুলো কম হাসে, কম কথা বলে এদের হঠাৎ হঠাৎ হাসি খুব সুন্দর লাগে। ইমতিহানও এমন একজন। প্রয়োজন ছাড়া তিনি হাসেন না। আর যখন হাসে খুব সুন্দর লাগে।
_____________________________
নায়েলার শশুর বাড়ি থেকে মেহমান এসেছিলেন। তারমধ্যে ছিলো নায়েলার ছোট চাচা শশুর। তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। হলদে ফর্সা ও লম্বা গড়নের মাহেরারকে দেখে তার একমাত্র পুত্রের বধূ করতে বাসনা জেগেছিল। এ বিষয়ে বড় ভাই চেয়ারম্যান লুৎফর চৌধুরীকে বলেন। তিনিও সম্মতি জানিয়েছেন। কারন নিজের ছেলের জন্য এ বাড়ি থেকে যে মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছিল, অত্যন্ত ভালো মনের একটা মেয়ে। তাছাড়া মজিদুর রহমান ও তার পরিবারকে মন্দ লাগেনি তার। তাই ছোট ভাই আমিন চৌধুরীর কথায় সম্মতি দেন। বড় ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে তিনি সবাইকে অবগত করেন। ভাই তার চেয়ারম্যান মানুষ গোটা এলাকা চড়িয়ে খাও’য়া মানুষ নিশ্চয়ই মানুষ চিনতে ভুল করবেন না।
মজিদুর রহমান বড়ই অবাক হয়েছিলেন এমন প্রস্তাবে। কিন্তু রুজিনা হক অবাক হলেও অবাকাতে কাটিয়ে বড্ড খুশি হন তিনি। তার মেয়ে যে বড়ই নম্র,ভদ্র,শুশ্রী এমন ঘর থেকে প্রস্তাব আসতেই পারে।
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার টাকায় বাড়ি-গাড়ি সব আছে। দেখতে সুদর্শন। সেও যথেষ্ট ভদ্র। তাছাড়া গ্রামেও আসেন মাঝেমধ্যে বেড়াতে। দুবোন এক বাড়িতে বিয়ে হলে একসাথে থাকতে পারবে। সুখে দুঃখে একে অন্যকে পাশে পাবে। তাই আর আপত্তি জানাইনি কেউ। সকলের সম্মতিতে মাহেরা-ইমতিহানের বিয়েটা হয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ্।
তারপর থেকেই মাহেরা ঢাকাতে শশুর বাড়িতে থাকে। মাঝেমধ্যে বাপের বাড়িতে যাওয়া হয়। গ্রামেও সবার সাথে যাওয়া হয় বছরে দু একবার।
নায়েলা স্বামী সন্তান নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ্ সুখেই আছে। নিতুর বিয়ে হয়ে গেছে। এক ইতিলিয়ান প্রবাসির সাথে বর্তমানে ওখানেই আছে স্বামী, সন্তান নিয়ে।
মাহেরার সাথে মোটামুটি সবারই যোগাযোগ হয়। হটাৎ একদিন রিনি এসেছিল মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে । মাহেরার কাছে ক্ষমা চাইতে। মাহেরা মুখে ঠিকই বলে দিয়েছে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি ক্ষমা করতে পেরেছে? তবে সে যথাসম্ভব চেষ্টা করবে দুই অকৃজ্ঞকে ক্ষমা করতে। বাকিটা আল্লাহ্ ভালো জানেন।
________________________________
হঠাত ফোনের রিংটনের আওয়াজে মাহেরার ভাবনায় ছেদ পরে। ব্যস্ত হস্তে ফোন হাতে নেই। পরিচিত, কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে ফোন আসায় মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার।
ফোনটি করেছিল মাহেরার ননদ। ইমতিহান, মিষ্টি দু ভাইবোন। মাহেরার বছর দুয়েকের বড় হবে মিষ্টি কিন্তু দুজনের ভাব বান্ধবীর মত। দুবোন বললেও ভুল হবে না। তারা ননদ-ভাবী কম বন্ধু+বোন বেশি। সবথেকে পছন্দের মানুষের তালিকায় মিষ্টি অন্যতম। ইসরাক নামক সুদর্শন ডাক্তারের সাথে মাহেরার বিয়ের পরের বছরেই মিষ্টি নামক মিষ্টি কন্যাটির বিয়ে হয়ে যায়।
মিষ্টির সাথে কথা বলা সময়টি মুখ থেকে হাসি সরেই না মাহেরার। মেয়েটার নাম যেমন মিষ্টি তেমন তার প্রতিটা কাজও খুবই মিষ্টি।
মিষ্টি ফোন করে জানালো সে দ্বিতীয়বারের মত কনসিভ করেছে আলহামদুলিল্লাহ্। মিষ্টি-ইসরাক দম্পতির পূর্বেও এক কন্যা সন্তানের জনক, জননী হওয়ার সুযোগ আল্লাহ্ তাদের দিয়েছেন। আবারও আল্লাহর অশেষ রহমতে সন্তানের পিতা-মাতা হতে চলেছেন তারা। মাহেরার এহেন খুশির সংবাদ শুনে খুশি যেন সরছেই না। বারবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছে সাথে অনাগত সন্তান ও মিষ্টির নিরাপত্তার জন্য দোয়াও করতে ভুলছে না।
কথা বলা শেষ হতেই সুন্দর, সুখের, খুশির সংবাদটি দিতে ছুটলো রুমে। আগে তার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে জানাতে হবে। তারপর বাকি সবাইকে। লজ্জাবতী মিষ্টি মাহেরাকেই দায়িত্ব দিয়েছে খবরটা বাকি সবাইকে জানাতে। তার নাকি ভিষন লজ্জা লাগছে।
মাহেরা বুঝতে পারে না মিষ্টির এত লজ্জা আসে কিভাবে? এত খুশির সংবাদ তার নাকি সবাইকে দিতে লজ্জা লাগছে। কোই সে তো এত লজ্জা পাই না। হঠাৎই মনে পরলো তার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ভাষ্যমতে সে অতিশয় লজ্জশীল রমনী। ভেবেই একদফা লাল, নীল হচ্ছে লজ্জায়।
~কি গো! ভর দুপুরে তোমার হঠাৎ এত লজ্জা আসল কোথা থেকে। এ কোনায় দাড়িয়ে লজ্জায় লাল, নীল হওয়ার কারন খুজে পাচ্ছি না। জানো তো মাহেরা! আমি ভেবে পাই না এক ছেলের মা হওয়ার পরেও তোমার এত লজ্জা আসে কোথা থেকে? ঝটপট বলে ফেল কি হয়েছে?
হঠাৎই ইমতিহানের অনর্গল কথাগুলো বলাই লজ্জায় ও ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে মাহেরার। তাই সে লজ্জা ঢাকতে ও বলে উঠল,
~আপনার ভাষ্যমতে আমি লজ্জাশীল তাই আমার লজ্জা দশ বাচ্চার জন্মের পরেও ভাঙবে না। আমি এমনই থাকব। আপনি হয়তো জানেন না,
“লজ্জাশীলতা নারীর আসল গহনা ” {হযরত ফাতেমা (রা:)}
~জানি তো! আর আমার তো ভালোই লাগে লজ্জাবতী বধূটির লজ্জা ভাঙাতে। তা লজ্জা পাওয়ার কারন কি? দিন দুপুরে বাসর করার সখ জেগেছে নাকি? ওকে নো প্রবলেম। আমি রেডি তোমার জন্য লজ্জাবতী! শেষের বাক্যদয় দুষ্টু হেসে মাহেরাকে বলল।
মাহেরা এহেন লাগামহীন কথায় হা হুতাশ করে বলল, ইব্রামিহের পাপা আপনার এ কি অবনতি হচ্ছে? দিনে দুপুরে কিসব বলছেন? লজ্জায় আমি মরেই যাচ্ছি। রাখেন আপনার সব আজায়রা কথা। ছিঃ!
~আরে যাচ্ছো কোথায়? তুমি হয়তো জানো না আমার রাজপুত্রের রাজমাতা তার ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শুধু তার সামনেই লাগামহীন পুরুষ। বাকি সবাই তাকে গম্ভীর, কঠোর, সল্পভাষী ইমতিহান বলেই জানে।
~আমি জানি তো। আমাকে এক্সপ্লেইন করে বলা লাগবে না। আমি কি জানবো না আমার সুদর্শন মানবটার ভেতর বাহির। খবরদার এ লাগামহীন, লজ্জাহীন ইমতিহান যেন শুধু মাহেরার কাছেই থাকে। আসল কথা শুনেন? মিষ্টি আবার কনসিভ করেছে আপনি মামা হতে চলেছেন।
~ আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্ কি বল? এত খুবই খুশির সংবাদ। আগে বলবা না? আম্মু-আব্বুকে জানিয়েছ?
~না! আপনাকে সর্বপ্রথম জানালাম। আপনি চলেন সবাইকে বলবেন!
~ শুনেন? আজ ঘুরতে যাওয়া ক্যানছেল করেন। আমরা মিষ্টির শশুর বাড়িতে যাব। ওর সাথে এ মুহূর্তে দেখা না করলে একটুও ভালো লাগবে না। যাবেন তো?
~ ইনশাআল্লাহ অবশ্যই যাব। তুমি এত বুঝদার কবে হলে মাহেরা? আমরা পুরো পরিবার খুব ভাগ্য করে তোমার মত একজনকে পেয়েছি।
~আমার এত এত অপূর্ণতাকে জেনেও এতটা আগলে রাখেন সবাই আমাকে এতটা ভালোবাসেন সেই পরিবারের জন্য এটুকু কিছুই না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।
~ নিজের শক্তপোক্ত বক্ষে প্রিয়তমা স্ত্রীকে কোমলতার সহিত আলিঙ্গনে আগলে নিল ইমতিহান। এই তো তার হৃদপিণ্ড, ভালোবাসা, চক্ষুশীতলকারীনী। মনে মনে আল্লাহকে লাখো শুকরিয়া জানাচ্ছে সে।
অনদিকে মাহেরাও আবেগে চোখের পানি ছেড়ে দিল। সেও মহান আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানাচ্ছে উত্তম মানুষটার সাথে সে যেন দুনিয়া ও আখিরাতে এক সাথে থাকতে পারে।
হঠাৎই ইব্রাহিমের আগমন ঘটায় ব্যাঘাত ঘটলো তাদের সুন্দর পবিত্র মুহুর্তের।
কি করছো পাপা? মামনিকে ওভাবে দাড়িয়ে কোলে নিয়েছ কেন?
~ ওটাকে দাড়িয়ে কোলে নেওয়া বলে না পাপা! তুমি যখন বড় হবে, তখন বুঝবে কি বলে? ঠিক আছে। এবার চল আমরা দাদুর রুমে যায়।
মাহেরা বাবা-ছেলের অদ্ভুত কথাপকথন শুনে মুচকি হাসে।
আসসালামু ওয়ালাইকুম..
আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত গল্পটা এভাবে শেষ করে দেওয়ার জন্য। আজই আমার ছোট্ট সময়ের লেখালেখি জীবনের শেষ দিন। অপ্রত্যাশিতভাবে আমার অনুমতির অনুমোদন শেষ হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। পরিস্থিতির জন্য বাধ্য হয়ে এভাবে গল্প শেষ করতে হলো,সাথে বিদায় নিতে হল আমার সখের লেখালেখি থেকে। আল্লাহ্ চাইলে কোনদিন হয়তো আসব ফিরে। আমাকে এবং লেখনী দুটোই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। দোয়া ও কৃতজ্ঞতা রইল। ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমার জন্য। জাযাকাল্লাহ্। আল্লাহ্ হাফেজ….
Leave a Reply