1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৫:৪০ অপরাহ্ন

আসুন সচেতন হই — কামরুন নাহার মিশু

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১
  • ১৭৫ বার
আমার ছোট ভাসুরের একমাত্র ছেলে শিহাব আমার মেয়ে হুমাইরা নুরের ষোলো মাসের বড়।
মাশাল্লাহ্ জন্মের পর থেকে বাচ্চাটা ভীষণ শান্ত, মিষ্টি, সুস্থ।
ওর মাকে কখনো বাচ্চাকে নিয়ে কোনো দৃশ্যমান কষ্ট করতে দেখিনি। ও কখনো রাত জেগে কাঁদেনি, খাওয়া নিয়ে কষ্ট দেয়নি। কখনো উল্টাপাল্টা প্রস্রাব, পায়খানা করে ওর মাকে কারো কাছে বিব্রত করেনি। হয়তো সবই করেছে একই ঘরে থেকেও আমরা দেখিনি।
শিহাব হয়তো ভীষণ ভালো ছেলে নয়তো ওর মায়ের সন্তান লালন -পালনের দক্ষতা। যাই হোক বাচ্চাটা ঘরের সবার চোখের মনি।
চাচ্চু, জেঠু, দাদু, চাচি,জেঠিরা সবাই বাচ্চাটাকে খুব পছন্দ করে। আসলে পরিবারের সব বাচ্চারা বড় হয়ে যাওয়ার প্রায় পনেরো বছর পর নতুন বাচ্চা এসেছিল।
আমি বাচ্চা নিয়ে কত কষ্ট করেছি। বলতে না বলতে জ্বর, পেট খারাপ, বমি, সর্দিকাশি আরও কত কি!
মাশাল্লাহ জ্বর পেট ব্যাথা তো দূরের কথা, ছেলেটা কোনোদিন একটা হাঁচি পর্যন্ত দেয়নি।
আদর্শ মা হিসাবে পরিবারের সবার কাছে ওর মা গ্রহনযোগ্য ব্যক্তি।
হঠাৎ করে তিন বছর বয়স থেকে ছেলেটার ওজন বাড়তে শুরু করল।
খাওয়া দাওয়ায় অরুচি না থাকায় সবাই ভেবেছে ওজন বাড়াটা হয়তো একেবারে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
আর ছুটাছুটি করে খেলত একেবারে কম। সবসময় রুমে বসে ইনডোর গেম যেগুলো যেমন ব্লক দিয়ে , ডো দিয়ে, পুতুল দিয়ে খেলত। সবাই ভেবেছে সে কারণে হয়তো ওজন একটু বেড়েছে। এটা একেবারে স্বাভাবিক।
শুধু সমস্যা হচ্ছিল আমার ছোট ভাসুর ওয়ার্ড কমিশনার হওয়ায় উনার কাছে বিভিন্ন মানুষ আসতো বিচার সালিস নিয়ে।
সবাই তো একরকম মানসিকতার নয়। অনেকে ওকে মুটু, মুটকু, ভোটকা এসব বলত।
এই তুই কি ভাত বেশি খাস?
আরও নানান কথা।
শিহাব তিন, সাড়ে তিন বছরের একটা বাচ্চা গুছিয়ে মায়ের কাছে নালিশও করতে পারত না।
তবে এটা বুঝতে পারত কথাগুলো ভালো নয়। ওকে অপমান করা হচ্ছে, বা ছোট করা হচ্ছে।
ও আর কোনো মানুষ আসলে বিশেষ করে যাদের সাথে বাচ্চা আছে তাদের সামনে যেত না।
ওর স্বাস্থ্য আসলে অস্বাভাবিক নয়, তবে পেটটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু উঁচু ছিল।
ওর মা কখনো খালি গায়ে কারো সামনে গোসলও করায়নি যে ঘরের কেউ দেখতে পাবে পেটটা কতটুকু উঁচু বা কতটা অস্বাভাবিকতা আছে বাচ্চাটার মাঝে।
সবসময় ওকে ঢিলেঢালা পোশাক পরাত।
আমার শাশুড়ি মাঝেমধ্যে রাগ করতেন
” শিহাবকে ভাত কম খাওয়াবে। দুধ,সেরেলাক, মাছ, মাংস এসব বেশি খাওয়াবে। বাচ্চদের পেট বড় হলে দেখতে বিশ্রি লাগে।”
আসলে আমার শাশুড়ি মনে করেছেন গ্রামের কৃমিতে পেট বড় হয়ে থাকা অনেক বাচ্চা আছে, এরা শুধু ভাত খেয়ে খেয়ে পেট বড় করছে।
শিহাবের মা ভিষণ মন খারাপ করত কারণ বাচ্চাটা দুই তিন নলার বেশি ভাত খেতও না।
একদিন আমাদের বাসায় পাশের বাসার এক মহিলা এসেছে সাথে ওর খালাত বোন ছিল।
মেয়েটা শিহাবের পেটের মধ্যে জোরে একটা গুতো দিয়ে বলল
” এই তোর পেট এত মোটা ক্যান? তুই কি ভাত বেশি খাস।”
ছেলেটা লজ্জায়, কষ্টে, অপমানে ওর মায়ের কাছে নালিশ করেছিল।
ওর মা ভীষণ রাগ করেছে ওর বাবার উপর
” তুমি এদের উপকার করে বেড়াও আর এরা তোমার ছেলেকে কী বিশ্রি মন্তব্য করেছে।”
কারণ ওরা জায়গা জমি সংক্রান্ত একটা ঝামেলার মিমাংসা করার জন্য ভাইয়ার কাছে এসেছিল।
ভাইয়া কি মনে করে মোটেও রাগ করেননি।
তিনি পরের দিন সবাইকে কিছু না বলে বাড়ির সামনের হাসপাতালের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল শিহাবকে।
ডাক্তার হেসে বলেন
” কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া। পেট উঁচু থাকতেই পারে। সাইকেল চালাতে দেবেন। দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে দেবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ডাক্তারের পারিবারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমাদের পরিবারের। তিনি প্রায় বাসায় আসতেন। আমাদের বাচ্চাদের খুব আদর করতেন।
ভাইয়া তারপরও কি মনে করে ডাক্তারকে অনুরোধ করলেন পেটের একটা আল্টা করানোর জন্য। ডাক্তার ভাইয়ার কথা ফেলেননি। তাৎক্ষণিক একটা আল্টা করলেন।
হঠাৎ ডাক্তারের হাসিখুশি মুখ বিকৃত হতে শুরু করল। তিনি ঘামতে শুরু করলেন।
ভাইয়া আন্দাজ করতে পারছেন শিহাবের পেটে কোনো সমস্যা যেকারণে মুহূর্তে ডাক্তারেরর এটিটিউডে পরিবর্তন এসে গেছে।
ভাইয়া জানতে চাইলেন
“কী সমস্যা?”
ডাক্তার সমস্যার কথা না জানিয়ে বললেন
” চলেন তো পাশের হাসপাতালে যাই। আমার আল্টা মেশিনে ডিস্টার্ব করছে।”
ভাইয়া এতক্ষনে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন।
তিনি হেসে উঠে বললেন
“তাহলে আর কষ্ট করে পাশের হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। আমি অন্যদিন এসে করিয়ে নেব।
আজ না হয় উঠি।”
ডাক্তার ভাইয়ার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে অনেকটা উড়িয়ে শিহাবকে নিয়ে পাশের হাসপাতালে চলে গেলেন।
দুটো হাসাপাতালই রাস্তার এপার ওপার। ভাইয়া ঘটনার আকস্মিকতায় হতবম্ব হয়ে রইলেন।
ডাক্তার পাশের হাসপাতালে আল্টা করেও দেখলেন সেইম সমস্যা।
শিহাবের পেটের মধ্যে একটা টলটলে পানির থলে। যেটার আকৃতি অনেকটা ফুটবলের কাছাকাছি। পানির থলেটা তার বাম কিডনিকে ঢেকে রেখেছে।
ডাক্তার নিজেই হতবিহবল হয়ে পড়েছেন এটা আবিষ্কার করে। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুটো আল্টা মেশিনে চারবার করে আল্টা করেছেন।
ভাইয়া সমস্যা কিছু আছে কি-না জানার জন্য উদগ্রিব হলেন।
ডাক্তার শিহাবকে বাড়ি রেখে এসে পরে দেখা করতে বললেন তার সাথে।
ভাইয়া কোনোমতে শিহাবকে বাড়ি রেখে হুমাইরার আব্বুকে নিয়ে ছুটে গেলেন হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে।
ডাক্তার পুরো বিষয়টা খুলে বললেন। তবে আশ্বস্ত করলেন ভয়ের কিছু নেই। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।
তিনি স্কয়ার হাসপাতালের একজন ডাক্তারকে রেফার করলেন।
একদিনও অপেক্ষা না করে ভাইয়া রাতেই ছুটে গেলেন ঢাকায়। পরেরদিন সকালে ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার সিটি স্কিনসহ দিনভর নানান এগজামিন করালেন।
ঐ হাসপাতালে আমার মেজ ননশের ভাগ্নেও ডাক্তার, তিনিসহ ছিলেন।
পরে টেস্টের রিপোর্ট পেয়ে জানা গেল শিহাবের একটা কিডনির ৯০% অকেজে হয়ে গেছে। বাকিটাও আক্রান্ত প্রায় ১০%।
আমাদের পরিবার বিশ্বাসই করতে পারেনি কথাটা। যে ছেলের জীবনে কখনো জ্বর হয়নি, পেট ব্যাথা বলেনি। মোটকথা কোনো দৃশ্যমান সমস্যাই ছিল না, সে ছেলের কীভাবে, কখন এত মারাত্মক রোগ হলো!
তারা শিওর হওয়ার জন্য এপোলোতে, ইউনাইটেডে আরও ডাক্তার দেখালেন, সবাই একই সমস্যার কথা বললেন।
তারা একসপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট করে পনেরো দিনের মধ্যে নিয়ে গেলেন চেন্নাই।
শিহাবের একটা মেজর অপারেশন হলো, তারা তিনমাস চেন্নাই থেকে ওকে মোটামুটি সুস্থ করে বাড়ি ফিরলেন।
এবার ছয়মাস পর পর চেকাপ করার জন্য ইন্ডিয়ায় যেতেন।
আলহামদুলিল্লাহ পেটের বামপাশে বড় সাইজের একটা কাটার দাগ ছাড়া ছেলের আর কোনো সমস্যা নেই। সে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে খায়, ঘুমায়, খেলে।
তবে ডাক্তার ছুটাছুটি করতে নিষেধ করেছিলেন, কারণ একটা মেজর অপারেশন হয়েছিল।
একবার একবছর পর যেতে বলেছিলেন, কোনো একটা সমস্যার কারণে তারা চৌদ্দ মাসেও যেতে পারেননি। তবে ডাক্তারের সাথে ফোনে যোগাযোগ ছিল। পনেরো মাসের সময় গতবছর এইসময় লকডাউনের আগে আবার ওকে চেন্নাই নিয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার এবার আবার অনেকগুলো টেস্ট করে বললেন যে কিডনিটা ভালো ছিল সেটাও নাকি এবার আক্রান্ত হয়ে গেছে মারাত্বকভাবে।
আবারও ডানপাশে ওর মেজর অপারেশন করতে হবে। বাধ্য হয়ে ছেলের জীবন রক্ষা করার জন্য ভাইয়া চেন্নাইর এপোলো হাসপাতালে শিহাবের পেটের ডান পাশে দ্বিতীয় অপারেশন করালেন।
আলহামদুলিল্লাহ শিহাব এখন ভালো আছে। ওর ওজনও এখন আগের মতো নেই। সে এখনো আগের মতো মিষ্টি, ভালো, সুন্দর একটা বাচ্চা।
সিমানকে করা তার বন্ধুদের বডি শেমিংয়ের কথা শোনায় শিহাবের কথা মনে পড়ে গেল।
আমার ছোট ভাসুর মানে শিহাবের আব্বুসহ আমাদের সবাই ঐ মেয়ের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ঐ মেয়েটা যদি ঐদিন শিহাবকে এভাবে না বলত শিহাবের মা কষ্ট পেত না। শিহাবের মা কষ্ট না পেলে তার বাবাকে বলত না। তার বাবাও হয়তো এত ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখাত না।
তারপর জানি না কী হতো।
সবই হয়তো আল্লাহতাআলার একটা সাজানো পরিকল্পনা ছিল। আমাদের জান বাচ্চাটা এভাবেই সুস্থ হবে।
এই গল্প বলার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই বডি শেমিংকে সাপোর্ট করা নয়।
এটা একটা ঘৃণিত, নিন্দনীয় জঘণ্য অপরাধ। কেউ দুষ্টামি করেও কাউকে কালো, মোটা, ঘাটো বলে বডি শেমিং করলে, সাথে সাথে তাকে আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে হবে।
সাথে পরিবারের বড়দেরও তাদের সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। একজন মানুষ যেন কোনোভাবেই অন্য মানুষকে অপমান করে কথা না বলে।
আসুন আমরা সবাই সামিনের জন্য দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। আমিন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..