1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৩:০৫ পূর্বাহ্ন

# হৃদয়ের_কথা_বলিতে_ব্যাকুল ***************************** ফারজানা ইসলাম

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ২২১ বার
রঞ্জনা মন খারাপ নিয়ে কাজ করছে । যেটুকু জিনিসপত্র গোছানো বাকি ছিল, সেগুলো এই শেষবেলায় গুছিয়ে নিচ্ছে । কেন যে এতো মন খারাপ হচ্ছে, রঞ্জনা নিজেও বুঝতে পারছে না । ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তো সেই কবেই নিয়েছে তারা । এতোদিন তো এই দিনটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে, তাহলে এখন তার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন ! হাতের শালটা ভাঁজ করে বিছানায় রেখে সে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল । হুহু করে মাঘ মাসের হিমেল বাতাস ঢুকছে উত্তরের জানালা দিয়ে । জানালার কাছে এসে দাঁড়াতেই বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগল রঞ্জনার চোখেমুখে আর গায়ে একেবারে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল । এই অসময়ে বৃষ্টি দেখে রঞ্জনা খুব অবাক হলো । জানালা বন্ধ করার বদলে হাত দু’টো বাইরে বের করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে ।
আগামীকাল এ বাড়িতে তার শেষ দিন । তাসিনের সাথে সব সম্পর্ক চুকেবুকে যাবে কাল । তাসিন আর রঞ্জনা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল আজ থেকে দু’বছর আগে । তখন রঞ্জনার পরিবার বিয়েতে রাজি ছিল না । আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, দুই পরিবার থেকে ওদের একত্রিত করার শেষ চেষ্টা চলছে ; কিন্তু এখন রঞ্জনা আর তাসিন কেউ কারো ছায়া মাড়াতে রাজি নয় । অগত্যা বিচ্ছেদেই সমাধান খুঁজে নেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে ।
জানালার কাছে দাঁড়িয়েই রঞ্জনা রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খুটখাট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে । তাসিন কিছু করছে বোধহয় । আজ রঞ্জনা রান্নাঘরে ঢোকেনি । তাসিন দুপুরে চাল-ডাল-মশলা দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছিল রাইস কুকারে, সাথে ডিম ভাজা । টেবিলের দু’মাথায় বসে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করেছে দু’জন । রঞ্জনা বুঝতে পারছিল তাসিন তাকে কিছু বলতে চাইছে ; কিন্তু দু’জনেরই এতোটা অভিমান আর তিক্ততা জমা হয়েছে যে শেষ পর্যন্ত কেউই কিছু বলল না ।
তাসিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, বাইরে হাত বের করে আছো কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে, সরে এসো ।
রঞ্জনা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল । তাসিনের কথা শুনতে তার বয়েই গেছে । কেন শুনবে সে ? কাল থেকে যার সাথে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তাকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার কোনো মানেই হয় না ।
পেছন থেকে টেনে রঞ্জনাকে জানালার কাছ থেকে নিয়ে এলো তাসিন । চোখাচোখি হতেই তাসিন বলল, ঠান্ডা লেগে যাবে । হাতগুলো মুছে নাও । তারপর বিছানার পাশে লাগেজের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার গোছানো শেষ হয়েছে?
হুম ।
আমি কোনো হেল্প করব ?
প্রয়োজন নেই ।
তাসিন আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে ।
রঞ্জনা আলমারি খুলে বাকি জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে নিচ্ছে । ড্রয়ার খুলতেই অ্যালবামগুলো চোখে পড়ল । অ্যালবামগুলো এখানেই থাক । এগুলো নিয়ে সে কী করবে! ড্রয়ারটা বন্ধ করতে গিয়েও করল না । অ্যালবামগুলো বের করে বিছানায় এনে রাখলো । পাতা উল্টাতেই বিয়ের আগের ছবিগুলো দেখতে পেল । কতো কতো জায়গায় বেড়িয়েছি তারা দু’জন মিলে ! কী স্বপ্নীল ছিল সেই দিনগুলো । এরপর বিয়ের ছবি, কতো আত্মীয়স্বজন রয়েছে তাঁদের সাথে সেই ছবিগুলোয় । ছবিগুলো দেখতে দেখতে সেই সুন্দর সময়গুলোয় যেন ফিরে যাচ্ছিল রঞ্জনা । হঠাৎ ঝনঝন শব্দে ঘোর কাটলো তার । তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল । রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখল তাসিন ফ্লোরে পড়ে আছে আর ফ্লোরে পাস্তা ছড়িয়ে আছে । রঞ্জনা কাছে আসতেই সে বলল, এসো না । কাচ বিঁধবে পায়ে ।
তাসিন উঠে বসার চেষ্টা করতেই রঞ্জনা দেখল তাসিনের হাত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, কনুইয়ের কাছে কেটে মাংসটা হা হয়ে আছে । ফুটন্ত পাস্তার হাড়িটা উল্টে পড়েছে পায়ে ওপর ! রঞ্জনার ভেতরটা শিরশির করে উঠল এসব দেখে । ফ্লোর ব্রাশ দিয়ে তাড়াতাড়ি জায়গাটা কোনোমতে পরিস্কার করে তাসিনের হাত ধরে বলল, ওঠো শিগগির । অনেকটুকু কেটে গেছে ।
তাসিন তখনও বোঝেনি কনুই কেটে গেছে । সে পায়ের যন্ত্রণায় অস্থির । হাতের তালু দেখিয়ে বলল, এটাতে কিছু হবে না ।
কনুই কেটে গেছে অনেকখানি । হসপিটালে যেতে হবে এক্ষুনি ।
রঞ্জনা তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ এনে জায়গাটা পেঁচিয়ে দিল কিন্তু রক্ত বন্ধ হলো না । সে ড্রাইভারকে ফোন করে তাসিনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলো ।
গাড়িতে কেউ কোনো কথা বলল না । হসপিটালে তাসিনের হাতে আটটা সেলাই পড়ল । পায়ের চামড়া উঠে গিয়ে যা-তা অবস্থা ! ডাক্তার সময় নিয়ে সাবধানে ব্যান্ডেজ করে দিলেন জায়গাগুলোয় । ডাক্তারের কাছ থেকে বেরিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হলো । রঞ্জনার কাঁধে ভর দিয়ে তাসিন রুমে গিয়ে বসলে রঞ্জনা দ্রুত রান্নাঘরটা পরিস্কার করে ফেলল । তাসিন স্যুপ খেতে খুব ভালোবাসে । রঞ্জনা তাই স্যুপ বানানো শিখে নিয়েছে । এখন স্যুপ বানাতে গেলে দেরি হয়ে যাবে দেখে রঞ্জনা ম্যাগি প্যাকেট স্যুপ দিয়েই একবাটি স্যুপ তৈরি করে ফেলল । স্যুপের বাটি হাতে রুমে ঢুকে দেখল তাসিন চোখ দু’টো বুঁজে কাত হয়ে শুয়ে আছে । বাটিটা টেবিলে রেখে রঞ্জনা তাসিনের কপালে হাত রেখে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছ ?
হুম…
উঠে বসো, স্যুপটা খেয়ে নাও ।
তাসিন চোখ মেলে তাকালো । বাম হাতের ওপর ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে ব্যাথায় বেচারার কপালটা কুঁচকে উঠল । রঞ্জনা তাড়াতাড়ি তাসিনকে ধরে বসাল । বাটিটা এগিয়ে দিয়েও আবার নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, আমি খাইয়ে দিচ্ছি ।
লাগবে না, আমি পারব । তুমি শুধু টেবিলটা একটু কাছে এনে দাও ।
কেন আমি খাইয়ে দিলে কোনো সমস্যা ?
তাসিন আর কোনো কথা বলল না, বাধ্য ছেলের মতো খেতে লাগল । রঞ্জনা বলল, কী করছিলে বলো তো ? কী যে সব ছেলেমানুষী করো সবসময় । কী সাংঘাতিক একটা কান্ড ঘটে গেল । কী করছিলে তুমি, পড়ে গেলে কী করে ? পাস্তা খেতে ইচ্ছে করছিল, এটা আমাকে বললেই পারতে ।
আমি তোমার জন্য পাস্তা বানাতে চেয়েছিলাম । পাস্তা তুমি খুব পছন্দ করো ।
পছন্দ করি তাতে কী ? আমি কী পাস্তা খেতে চেয়েছি?
কাল তুমি চলে যাচ্ছো । আর কোনোদিন হয়তো তোমার জন্য পাস্তা বানানো হবে না, তাই…
কথাটায় এমন কিছু ছিল যে রঞ্জনার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল । চামচটা বাটিতে রেখে তাকালো তাসিনের দিকে । তাসিন চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, একহাতে পাস্তার প্যানটা ছিল, অন্য হাতে তেলের জারটা ধরতে গিয়েই হাত ফসকে নীচে পড়ে গিয়ে ভেঙে খানখান । আমিও হঠাৎ ব্যালান্স ঠিক রাখতে না পেরে পড়ে গেলাম আর এই কান্ড ঘটলো । সরি রঞ্জনা, আমার জন্য তোমার ঝামেলা হয়ে হয়ে গেল । এবার তুমি যাও, রেস্ট নাও ।
রঞ্জনা তাসিনের হাতে ওষুধ দিয়ে বলল, ওষুধ খাও । আমার রেস্টের চিন্তা তোমার করতে হবে না । আমি ঠিক আছি ।
অনেক রাত হয়ে গেছে, সকালে তোমাকে যেতে হবে ।
এক মুহূর্ত কিছু চিন্তা করে রঞ্জনা বলল, আমি কাল যাচ্ছি না ।
মানে কী ! কেন?
তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমি যাব না ।
আমার জন্য ভেবো না । আমি ঠিক সব ম্যানেজ করে নেব ।
চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে যাও । আমি আছি এখানে ।
তুমি এ রুমে থাকবে !
রঞ্জনা কথাটার উত্তর না দিয়ে বলল, আমি চেঞ্জ করে খেয়ে আসি । তুমি শোও ।
রঞ্জনা দরজার কাছে পৌঁছেতেই তাসিন ডাকল, রঞ্জনা…
বলো ?
থ্যাংক ইউ ।
কিসের জন্য ?
কিছু না, যাও ।
রঞ্জনা আর দাঁড়াল না । নিজের রুমে এসে চেঞ্জ করে নিল । ছয়মাসের বেশি হয়ে গেছে তারা দু’জন আলাদা রুমে থাকছে । এর মধ্যে একদিনও কেউ কারো রুমে উঁকি দেয়নি । ড্রইংরুম আর ডাইনিংয়েই প্রয়োজনীয় কথা হয় ওদের । রঞ্জনার এক-আধবার মনে হয়েছে সরি বলার কথা । পরক্ষণেই মনে হয়েছে, কই তাসিনও তো সরি বলতে পারতো । সে তো বলল না, তাহলে রঞ্জনা কেন সেধে সরি বলতে যাবে ? তাসিনও ঠিক এই ভাবনা থেকেই সরি বলেনি রঞ্জনাকে । রঞ্জনার জন্মদিনে কেক এনে টেবিলে রেখে দিয়েছিল তাসিন । সাদামাটাভাবে উইশ করায় রঞ্জনাও কেক কাটেনি । পরদিন বুয়ার বাড়িতে সেই কেক কাটা হয়েছিল । দু’জনার ইগো ভালোবাসার থেকে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে দিনদিন, তাই উকিল ছয় মাসের সমঝোতা পিরিয়ড দিলেও তাতে ফল হয়েছে শূন্য ।
রঞ্জনা খাবার টেবিলে রেখে একবার উঁকি দিল তাসিনের রুমে । একটু আগেও ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল বেচারা, ঘুমের ওষুধের কারণেই বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে । রঞ্জনা এসে চেয়ারে বসে খাবারের প্লেটটা কাছে টেনে নিল । পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে তার স্মৃতি ছড়ানো । বিয়ের পর নিজে হাতে পুরোটা ফ্ল্যাট সাজিয়েছে সে । ঘুরে ঘুরে শখের সব জিনিস কিনে মনের মতো করে সাজিয়েছিল দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটটা । তখন কী সে ঘুনাক্ষরেও জানতো, এই ঘর এতো তাড়াতাড়ি খেলাঘর হয়ে যাবে ! দোষটা কার বেশি, এটা জানে না রঞ্জনা । বিয়ের পর শুরুতে দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মতো । তারপর যে কী হলো ! রঞ্জনার অফিস, ওর বন্ধু সবকিছু নিয়ে তাসিনের অভিযোগ দিনদিন বাড়তে লাগল । রঞ্জনাও খুব বিরক্ত হতো তাসিনের বন্ধুদের ওপর । বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে তাসিনের সময়-জ্ঞান লোপ পেয়ে যায় । রঞ্জনা না খেয়ে বসে থাকতো অনেক রাত অবধি । তাসিন ফিরে বলতো, আমি তো খেয়ে এসেছি, তুমি কেন না খেয়ে বসে আছো ? আমি বসছি, তুমি খেয়ে নাও ।
তাসিন সামনের চেয়ারে বসলেও রঞ্জনার ততক্ষণে খাবার ইচ্ছেটা একদম মরে গেছে । কেন রঞ্জনা খাবে না, এই নিয়ে শুরু হতো কথা কাটাকাটি । তারপর অভিমান করে কথা বলা বন্ধ ।
একবার দু’জনের ঝগড়া হলো পাঞ্জাবি নিয়ে । রঞ্জনা মেরুন রঙের একটা পাঞ্জাবি কিনেছিল তাসিনের জন্য । তাসিন সেটা দেখে দুষ্টামি করেই বলেছিল, তোমার রুচির এমন বারোটা বাজলো কী করে রঞ্জনা ! এটা পরলে আমাকে নির্ঘাত গরুর ব্যাপারী মনে হবে ।
গরুর ব্যাপারী কী মানুষ না ? আর এটা কী এতোটাই খারাপ দেখতে ? আমি কতো খুঁজে তারপর এটা কিনেছি ।
আচ্ছা রেখে দাও, এবার হাটে গরু কিনতে যাওয়ার সময় এটা পরেই যাব ।
রঞ্জনা আর সহ্য করতে পারেনি । কাঁচি এনে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কেটে পাঞ্জাবিটা টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল । তাসিন ওকে থামাতে গেলে রঞ্জনা চিৎকার করে উঠেছিল তাসিনের ওপর । সেই রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল দু’জন । পরদিন অফিসে যাওয়ার সময়ও কথা হয়নি ওদের । অফিস থেকে ফিরে রঞ্জনা সব কাজ গুছিয়ে খাওয়া শেষ করে অপেক্ষা করছিল তাসিনের ফেরার । তাসিন ফিরলে দরজা খুলে দিয়ে সে ঘুমাতে যাবে । রাত এগারোটায় তাসিনের বন্ধুর বউ রয়া ফোন করে বলল, ভাবী আপনি কেন আসলেন না বলেন তো ? সবাই মিলে আসলে অনেক আনন্দ করা যেত । তাসিন ভাইকে আমি বকা দিয়েছি একা একা চলে এসেছেন বলে ।
রঞ্জনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনারা কোথায় ভাবী?
আমরা কোথায় মানে! আমরা তো এখন কুয়াকাটা আছি । আপনি জানেন না? এই তাসিন ভাই আপনি ভাবীকে বললেননি!
হতভম্ব রঞ্জনা এরপর ফোন রেখে দিয়েছিল । খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিল সেদিন । তাসিন ফিরে আসার পর পুরো একমাস কেউ কারো সাথে কথা বলেনি ওরা । দু’পরিবার থেকে দু’জনকেই বকাঝকা করা হয়েছে, বোঝানো হয়েছে কিন্তু ওরা যেন ঠিক করেই নিয়েছিল, কারো কোনো কথাই কানে তুলবে না । এরপরই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত আর আগামীকাল রঞ্জনার চলে যাওয়ার কথা । এরমধ্যেই তাসিনের এই দুর্ঘটনা ঘটে গেল । রঞ্জনা ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারে কিন্তু তাসিনকে এভাবে ফেলে কেন যেন তার যেতে মন চাচ্ছে না ।
*******
তাসিনের অফিসে জানিয়ে দেয়া হয়েছে আর রঞ্জনাও ওর অফিসে ছুটির জন্য দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছে । এদিকে রঞ্জনার বাড়ি থেকে গাড়ি এসে ফিরে গেছে । মা ফোন করতেই রঞ্জনা বলল, মা আমি এখন আসতে পারব না, তাসিন কাল রাতে রান্নাঘরে পড়ে গিয়ে খুব ব্যাথা পেয়েছে । পা পুড়ে গেছে, হাত কেটে গেছে ।
এতো কিছু কখন হলো , কই আমাদের কিছুই জানাওনি তো !
জানানোর কী আছে ? ওর সাথে আমার সবকিছু চুকেবুকে গেছে ।
চুকে গেলে তুমি এখনও পড়ে আছো কেন? চলে এসো।
এভাবে একটা মানুষকে ফেলে চলে আসা যায় মা ?
ওর চিন্তা ওকে করতে দাও, তুমি চলে এসো । ওকে দেখার অনেক লোক আছে ।
কোথায় লোক আছে ? আব্বা-আম্মা তো আরও এক মাস পরে আসবেন কানাডা থেকে । ওকে দেখে রাখবে কে ?
তোমার ওসব নিয়ে ভাবনার কী আছে ! তোমরা তো দু’জন দু’জনকে সহ্যই করতে পার না । তাহলে এখন এতো স্নেহ, ভালোবাসা এলো কোত্থেকে ?
মা রাখছি । যখন আমার সময় হবে, আমি বাসায় চলে আসব । তোমরা টেনশন করো না ।
ঠিক আছে আমি আর তোমার বাবা আসছি বিকেলে ।
তোমাদের আসতে হবে না । কিছু প্রয়োজন হলে আমি জানাবো । রাখছি মা ।
********
রঞ্জনা ক’দিন ধরে তাসিনের রুমেই থাকছে । ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গিয়ে ব্যাথায় তাসিনের ঘুম ভেঙে যায় । কখনও পানির তেষ্টা পাওয়ায় নিজে থেকে উঠে পানির জগ থেকে পানি ঢেলে খাওয়ার চেষ্টা করে । রঞ্জনাকে কোনো কিছুর জন্যই বলে না সে । রঞ্জনা তাই চেষ্টা করে সারাক্ষণ ওর কাছাকাছি থাকতে ।
রঞ্জনা তাসিনের সামনে কফির কাপ রেখে চা’য়ের কাপ নিয়ে মুখোমুখি বসল । তাসিন বলল, আমাকেও চা দিতে ।
তুমি চা পছন্দ করো না ।
তুমি যে ক’দিন আছো, আমাকে চা-ই দিও । তুমি যখন থাকবে না, তখন আবার কফি খাবো ।
রঞ্জনা হাসল, কিছু বলল না ।
তাসিন বলল, রঞ্জনা তোমার মনে আছে, আমরা গতোবার দার্জিলিং থেকে ফেরার সময় অনেক চা-পাতা কিনেছিলাম কিন্তু ভুলে হোটেলে রেখে চলে এলাম ।
হুম ।
তোমার ইচ্ছা ছিল সিকিম যাওয়ার । আমরা ঠিক করেছিলাম বছর শেষে সিকিম যাব অথচ দেখো আমাদের একসাথে আর সিকিম যাওয়া হলো না । তুমি সিকিম যেও রঞ্জনা । তোমার বরকে আগে থেকেই বলে রেখো তোমাকে যেন সিকিম নিয়ে যায় ।
আমার বর !
তুমি কী সারাজীবন একাই থাকবে ?
বাজে কথা বাদ দিয়ে কফিটা শেষ করো । ঠান্ডা করে ফেললে তো । আবার করে আনবো?
অসুবিধা নেই , খেতে পারব ।
তুমি ঠান্ডা চা , কফি খেতে পার না ।
তুমি না থাকলে ওসবেও অভ্যস্ত হয়ে যাব ।
রঞ্জনার ভীষণ কান্না পায় কথাটা শুনে । কথা ঘুরিয়ে বলে, আম্মা’র আলমারির চাবি আমার কাছে রাখা ছিল । আমি কোনার ক্যাবিনেটের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি । আম্মা আসলে দিয়ে দিও ।
হুম ।
সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে । এখন একটু রেস্ট নাও । দুপুরে কী খাবে বলো ?
তোমার কষ্ট করে রাঁধতে হবে না । অর্ডার করে আনিয়ে নেব ।
আমি যখন থাকব না, তখন অর্ডার করো । এখন বলো কী খাবে ?
ঝাল ঝাল গলদা চিংড়ি খেতে ইচ্ছা করছে । সাথে ভাত আর ধনে পাতা দেয়া আলুর ভর্তা । চিংড়ি আছে বাসায়?
না থাকলেও সমস্যা নেই । রাকিব ভাইকে দিয়ে আনিয়ে নিচ্ছি ।
রঞ্জনা বেরিয়ে গেলে তাসিন বালিশে হেলান দিয়ে বসল । আর সাতদিন পর হয়তো রঞ্জনা চলে যাবে । এই শেষবেলায় এসে কেন এতো মায়া বাড়ছে ওর প্রতি ! কেন শুধু মন চায় রঞ্জনা সারাক্ষণ ওর পাশে বসে থাকুক ? সে কিছুতেই চায় না মায়ায় জড়াতে । তাহলে রঞ্জনা চলে যাওয়ার পর ভীষণ কষ্ট হবে । রঞ্জনাকে সে অনেক কষ্ট দিয়েছি । এবার রঞ্জনা নতুন করে জীবনটাকে সাজিয়ে নিক ।
***********
তাসিনের পায়ের পোড়া জায়গাটা এখন কিছুটা ভালো হয়েছে, তবে পুরোপুরি সারতে এখনও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে । হাতের কাটা জায়গাটা বেশ ভালোভাবে জোড়া লেগেছে । বাসায় ফিরে এসে তাসিন বলল, এখন তো অনেকটুকু সুস্থ হয়ে গেছি । তুমি কাল থেকে অফিসে যাও ।
যাব ।
রঞ্জনা এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়ায় তাসিনের মন খারাপ হলো । এই যে রঞ্জনা গত দশদিন সারাক্ষণ ওর সাথে ছিল, এতে সে নতুন করে রঞ্জনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে । রঞ্জনা চলে গেলে তার খুব কষ্ট হবে ।
রঞ্জনা অফিস গেল না ঠিকই কিন্তু মনে মনে ঠিক করল, শুক্রবারের আগে সে এখানে থেকে চলে যাবে । শুক্রবার তাদের বিয়ের দ্বিতীয় বার্ষিকী । ঐ দিনটায় এখানে থাকলে বরং কষ্ট বাড়বে । বুধবার রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাসিনকে ওষুধ খেতে দিয়ে রঞ্জনা বলল, তুমি তো এখন আগের চেয়ে ভালো আছো ।
হুম ।
আমি ভাবছিলাম কাল চলে যাব ।
কালই !
হুম । শনিবার থেকে অফিস করতে হবে । রাকিব ভাই তো আছেই । কোনো কিছু লাগলে ওকে বলো । বুয়া দু’বেলা রান্না করে দিয়ে যাবে । তোমার কিছু করতে হবে না । তাছাড়া আব্বা-আম্মা তো চলেই আসবেন এরমধ্যে । তুমি শুধু মনে করে সময়মতো ওষুধগুলো খেয়ে নিও ।
তাসিন চুপ করে রইল ।
কী হলো কিছু বলছো না যে ?
কী বলব ?
কিছুই বলার নেই ?
তাসিন উদাস নয়নে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে ।
রঞ্জনা বলল, নিজের প্রতি খেয়াল রেখো । আব্বা-আম্মার দিকেও খেয়াল রেখো ।
তুমিও নিজের খেয়াল রেখো । রাতে না খেয়ে থেকো না । অল্প কিছু হলেও খেয়ে নিও ।
হুম ।
রঞ্জনা তোমার কিছু লাগবে?
কিছু মানে ?
টাকাপয়সা ।
না লাগবে না । তুমি এবার একটু গোছানো জীবন শুরু করো, তাহলে আম্মার কষ্ট কম হবে । তোমার জন্য না খেয়ে রাত জেগে বসে থাকতে কষ্ট হবে ওনার ৷
তাসিন বলল, কথা দিলাম মা’কে কষ্ট দেব না ।
অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো ।
কথাটা বলে ক্লান্ত পায়ে রঞ্জনা নিজের রুমে এসে ঢুকলো । সবকিছুই গোছানো হয়ে গেছে । শুধু রাত পোহানোর অপেক্ষা । বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজতেই দমবন্ধ একটা অবস্থা তাকে চেপে ধরল । তাসিনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার । কালকের সকালটা আসলে সে যেন সত্যি বেঁচে যায় । গত পনেরো দিনের ঘটনা তার জীবনে না ঘটলে কী এমন ক্ষতি হতো ? চলেই যখন যেতে হবে, কেন মিছে মায়ার জড়িয়ে গেল আবার ?
লাগেজগুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছে রাকিব । রঞ্জনা ড্রাইভার রুহুলকে ফোন করে বলল, রুহুল ভাই আপনি একটু অপেক্ষা করেন । আমি কিছুক্ষণ পর নামছি ।
রঞ্জনা তাসিনের রুমে ঢুকলো । সকাল থেকে
তাসিন একটা কথাও বলেনি তার সাথে । ওকে দেখে খুব অস্থির মনে হচ্ছে । মোবাইল হাতে নিচ্ছে আবার রেখে দিচ্ছে । ল্যাপটপে চোখ পড়তেই রঞ্জনা স্ক্রীনে নিজের ছবি দেখতে পেল! গতকালও স্ক্রীনে পাখির ছবি দেখেছে সে । রঞ্জনা বলল, আমি যাচ্ছি তাহলে ।
তাসিন ম্লান হেসে বলল, ভালো থেকো ।
তুমিও । ওষুধের বক্সটা ওয়ারড্রবের ওপরে রাখা আছে ।
আচ্ছা ।
এ সপ্তাহে বাজার লাগবে না । সবকিছু আছে । আমি বুয়াকে বলে দিয়েছি কী রাঁধতে হবে , আব্বা-আম্মা যেদিন আসবেন সেদিন রাকিব ভাইকে বাজারে পাঠিও ।
হুম ।
যাই তাসিন ।
হুম ।
হুম ছাড়া আর কিছু বলবে না ?
তাসিন চুপ করে রইল ।
রঞ্জনা বেরিয়ে এলো রুম থেকে । শেষবারের মতো পুরো ফ্ল্যাটটা একবার দেখে নিল । বারান্দার গাছগুলোয় গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা ফুটে রয়েছে আর গ্রিলে ঝোলানো টবে অর্কিড ফুটেছে । রঞ্জনা ফুলগুলোয় হাত বুলিয়ে দিল । চোখের কোনের পানিটুকু মুছে নিয়ে হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিল । দরজার হ্যান্ডেলে হাত দিতেই তাসিনের ডাক শুনে পিছে তাকালো সে । বলল, কিছু বলবে ?
যাচ্ছো?
হুম ।
না গেলে হয় না ?
রঞ্জনা তাসিনের চোখে চোখ রেখে বলল, কার জন্য থাকব?
খুব কষ্ট হচ্ছে রঞ্জনা । বিশ্বাস করো খুব কষ্ট হচ্ছে । পনেরো দিন আগে যখন চলে যাচ্ছিলে তখন হয়তো এতোটা কষ্ট হতো না কিন্তু আজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।
রঞ্জনা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ।
তাসিন বলল, কিছু বলো ।
কী বলব?
তোমার কষ্ট হচ্ছে না ?
না ।
আমি তোমার মুখে কষ্ট দেখতে পাচ্ছি ।
তুমি এখনও আমাকে বুঝতে পার !
ফিরে এসো রঞ্জনা । আবার নতুন করে শুরু করব দু’জন মিলে । কিছু ভুল তুমি ক্ষমা করে দিও, কিছু ভুল আমি শুধরে নেব । তোমাকে ছাড়া থাকতে চাই না আর ।
দরজার কাছ থেকে সরে এসে রঞ্জনা ফোনটা বের করল । ফোন করে বলল, রুহুল ভাই লাগেজগুলো ওপরে দিয়ে যান । না, না আজ যাব না । অন্য কোনোদিন । হুম ঠিক আছে ।
তাসিন ক্রাচে ভর দিয়ে রঞ্জনার কাছে এসে ওর হাতটা ধরে বলল, অন্যদিন না, কোনোদিনও না ।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..