1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ন

#স্মৃতিবিলাস, — পর্ব-৫,পর্ব – ৬,পর্ব – ৭ এবং পর্ব – ৮ @জিনাতুননেছা জিনাত(শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক)

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৯ জুন, ২০২১
  • ৫০১ বার
 পর্ব-৫
এবাদাতের ক্ষেত্রে যে এমন প্রতিযোগিতা হতে পারে, ভাবিনি কখনও! যদিও এ আমার একান্ত অনুভূতি, তবে চোখে দেখা সে দৃশ্যের কাছে আমার ভাবনার গভীরতা নিমিষেই হার মেনেছে ।
দু’বছর আগে প্রথমবার যখন মক্কা-মদিনায় এসেছিলাম, এখানকার সবকিছু দেখে তখন খুব বিস্মিত হয়েছিলাম । ভেবেছিলাম প্রথমবার বলেই বোধহয় এমন হচ্ছে আমার । কিন্তু না, দু’বছর পরেও আমার বিস্ময় একটুও কমেনি বরং বেড়েছে অনেকগুণ ।
আমার শ্বশুর বাবা, শাশুড়ি মা, অনু আর আমি এই চারজনে ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে আরব দেশে এসেছি, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ তারিখে । দশ দিনের কর্মসূচি, উদ্দেশ্য এবাদাত করা আর মাঝে মাঝে পবিত্র জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়ানো । যাত্রার শুরু থেকেই বেশ মজার সময় কাটছে আমাদের । এর আগে বাবা-মা কে সাথে নিয়ে এভাবে দেশের বাইরে যাবার সুযোগ হয়নি কখনও । মা-বাবাও সময়টা বেশ আনন্দেই পার করছেন । উনাদের যাতে হাঁটাহাঁটির কষ্টটা কম হয়, এজন্য আমরা Makkah Hilton Tower এ উঠেছি । এই হোটেলটা একেবারে মসজিদের সীমানা ঘেষে গড়ে উঠেছে ।
১৩ এপ্রিল রাত সাড়ে এগারোটায় রওনা হয়েছি বাংলাদেশ বিমানে । বিমান যথাসময়ে অর্থাৎ স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় অবতরণ করেছে ঠিকই কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে অন্যখানে । আমাদের ব্যাগগুলোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সৌদি বিমান বন্দরের অভিযোগ কেন্দ্রে গিয়ে অভিযোগ করা হলো । জানা গেলো যে, ট্যাগ খুলে যাবার কারণে কিছু ব্যাগ অন্য বিমান বন্দরে চলে গেছে, আমাদেরটাও তার মধ্যে থাকতে পারে ।
শুরু হলো অনাকাঙ্খিত অপেক্ষা । সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা করে পার হতে লাগলো সময়গুলো । সময় তার নির্দিষ্ট গতিতে পার হয়ে গেলেও আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যেন কিছুতেই আর সময় যাচ্ছে না, মনের মধ্যে ঘড়ির কাটা যেন থমকে আছে । সবাই যখন বিরক্তির শেষসীমায় অবস্থান করছে তখন খবর এলো, অভিযোগকারীদের পঁচিশটি ব্যাগ ফেরত এসেছে, তার মধ্যে আপনাদেরটাও থাকতে পারে । ততক্ষণে প্রায় পাঁচ ঘন্টা কেটে গেছে, ক্ষুধাও চরম আকার ধারণ করেছে । রুটি আর কলা দিয়ে কোনোমতে সকালের নাস্তা শেষ করা হলো । হঠাৎ দেখলাম, বেশ খানিকটা দূরে বেল্টের ওপর আমাদের ব্যাগগুলো যেন পূর্নিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে !
ততক্ষণে আমাদের জন্য ভাড়া করা নির্ধারিত গাড়িটি এসে দেরী দেখে ফিরে গেছে । অন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা মক্কায় আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি । পড়ি মরি করে হোটেলে ব্যাগ রেখে প্রায় ছুটে গিয়ে বায়তুল্লাহর সামনের রাস্তায় জামাতের সাথে জোহরের নামাজ আদায় করি । প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেই বাবা-মাকে সাথে নিয়ে আসরবাদ তাওয়াফ শেষ করি । মাগরিবের নামাজ পড়ে সায়ী করে চুল কেটে ওমরাহ পালন শেষ করে রুমে ফিরে আসি ।
কাবা শরীফ সংলগ্ন মসজিদের বর্ধনের কাজ চলছে । তাই অনেক গেট বন্ধ রাখা হয়েছে, এ কারণে সবখানেই প্রচন্ড ভিড় । এর মধ্যেও সব বেলাতেই আমরা মসজিদের ভেতরে নামাজ পড়ার চেষ্টা করেছি । তাওয়াফ করেছি, কাবাঘরকে ছুঁয়ে মনের সব আবেগ মিশিয়ে স্রষ্টার কাছে আকুতি জানিয়েছি, অভিযোগ করেছি, করুণা চেয়েছি তাঁর কাছে যিনি তার এই অধম বান্দাকে দাওয়াত দিয়ে মেহমানের সম্মান দিয়েছেন । তিনি শ্রেষ্ঠ, তিনি মহান, তিনি ক্ষমাশীল ! তাঁর কাছে বলা যায় নিজের অপারগতার সকল কথা অকপটে, তাঁর কাছে চাওয়া যায় নির্দ্ধিধায় সবকিছু । মনে প্রশান্তি হয়, তিনি যেন সেসব কথা শুনতে পেয়ে নিমিষেই পূরণ করে দেন মনের অপূর্ণ সাধ !
হাজার হাজার মানুষ সারাক্ষণ তাওয়াফ করছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বেলায় এক জামাতে নামাজ পড়ছে, কি যে বিস্ময়কর ব্যাপার, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় ! রাতের আযানটা যেন খান খান করে দেয় রাতের নিরবতাকে । সেই উদাত্ত্ব আহবানকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কাউকে দেননি । ইমাম সাহেব যখন নামাজ পড়াতে শুরু করেন, মনে হয় মনের সমস্ত আবেগ মিশিয়ে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ভেঙে ভেঙে কি মধুর সুর ঢেলে দিচ্ছেন তাতে, প্রাণের সব আকুতি মসজিদের প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে বারবার, ভালোলাগা অনুভূতি শিহরণ তোলে দেহের প্রতিটি লোমকূপে । নামাজ পড়তে আসার এবং নামাজ শেষে ফিরে যাবার দৃশ্যটা দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে । যারা এটা কখনও দেখেনি, তাদেরকে কোনদিন সেটা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর ক্ষমতা কোন শক্তিমান সাহিত্যিকের পক্ষেও অসম্ভব একটা ব্যাপার ।
এখানে প্রতিটি মুহুর্ত কাটে এবাদাতের মাধ্যমে । ঘর-সংসার, ইহলৌকিক কোনো বিষয়ই মাথায় আসার সুযোগ পায় না । সমস্ত দেহমনে কেবল তাঁরই নামের যিকির । এক ধরণের সুষম প্রতিযোগিতা চলে সবার মনের মাঝে, তাওয়াফ করার জন্য, কাবার সামনে প্রথম সারিতে নামাজ পড়ার জন্য, কখনওবা একটু বেশি দান সাদকার মাধ্যমে একটু বেশি নেকি অর্জনের জন্য ।
মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, ধনী গরীব নির্বিশেষে সকল হাজী একই কাজে ছুটে বেড়াচ্ছে সারাদিনমান । অথচ দেশে থাকলে নামাজের সময়টা বের করতেও অনেক সময় আমাদের কাছে দুরূহ মনে হয় ।
মনে পড়ে, পবিত্র কোরআনের একটা আয়াতে পড়েছিলাম-
“কাবা শরীফের বিশেষ মর্যাদা হচ্ছে, যে এখানে প্রবেশ করবে সে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই নিরাপদ হয়ে যাবে ।”
(সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭ )
তাই কি এই ঘরের জন্য এতো মায়া ? কেন বিদায় দিতে অন্তর কেঁপে ওঠে বারবার ? নিজের অজান্তেই চোখ ভেঙে বেরিয়ে আসে জলের অনন্তধারা ! করূণাময়ের কাছে মিনতি করি, এই অভাগাকে তোমার দয়া থেকে বিতাড়িত
করোনা, প্রভূ !
মনের মধ্যে অব্যক্ত বেদনা চেপে বিদায় নিয়ে আসি, আবার কি দেখা হবে কোনোদিন কাবার সাথে ?
(চলবে)
# পর্ব-৬
সুবিশাল রাস্তা দিয়ে ধীর লয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছোট মাইক্রোবাসটি, গন্তব্য মক্কা থেকে মদিনা । বাবা-মা (শ্বশুর-শাশুড়ি), অনু আর আমি, সব মিলে অদ্ভুত ভালোলাগা এক ভ্রমণ ।
কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঠিক কতক্ষণ বুঝতে পারছি না । হঠাৎ ঘুম ভেঙে চিৎকার করে উঠলাম, হায় হায় ! আমি যে কিছুই দেখতে পেলাম না, এই অপার সৌন্দর্য এভাবে হারালাম ঘুমের রাজ্যে ।
মা পাশ থেকে সহানুভূতি মিশিয়ে বললেন, সবই এই একই রকম, কিছুই হারাওনি তুমি ।
আমি তবু সতর্ক দৃষ্টিতে সবকিছু দেখার চেষ্টা করছি, আর যেন কিছু মিস না হয় ।সামনের দিকে সোজা তাকালে মনে হচ্ছে, দুই পাশে পাহাড়গুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন একটু ভাঁজ হলেই তাদের জরিমানা গুণতে হবে । আকাশটা বড্ড বেশি স্বচ্ছ আর সুন্দর ! নীলের মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ, তাদের কেউ কেউ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের সাথে গল্প করছে, কেউ কেউ আবার ছুটে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে, যেন প্রিয়জনকে কথা দিয়েছে, সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরবো।
প্রতিমুহূর্তে রাস্তাটা এমনভাবে বাঁক নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে এখানেই পথের শেষ, সামনে এগোনোর কোন উপায় নেই, কেবল অনন্ত আসমান আর জমিন । একটু আগেও সামনের সব পাহাড়গুলো একই রঙের ছিলো, কালো কালো বিশাল আকারের কয়লার স্তুপের মতো । মনে মনে ভাবছি, আসলেই কি এগুলো কয়লার তৈরী?
হঠাৎ ডান দিকে চোখ পড়লো, ডানের পাহাড় গুলো সব সোনালী হয়ে গেছে, শেষ বিকেলের সোনামাখা রোদ মেখে মায়াময় স্বর্নালী রূপ নিয়েছে । দ্রুত বামে তাকালাম, ওপাশটা আসমানী রঙ মেখেছে যেন । দারুণ তো! মেঘ পাহাড়ের এতো ভাব? যখন তখন মেঘ পাহাড়কে রাঙিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার নানান রঙে ।
একটু আগেই বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলাম- ‘বৃক্ষহীন, বৃষ্টিহীন এই নগরীতে নিয়মিত বসবাস করা খুব কঠিন ব্যাপার হবে, তাই না?’
ওমা ! কিছুক্ষণ পরেই অনু বললো, “দেখো দেখো বৃষ্টি ।”
তাকিয়ে দেখি গাড়ির সামনের গ্লাসের উপর কয়েক ফোটা জলের কণা টপটপ করে ঝরে পড়ছে, যেন বিদ্রুপ করে আমায় বলছে- ওভাবে কেন ভাবছো, আমাদের এখানেও বৃষ্টি হয় ।
যদিও শব্দহীন বৃষ্টির কণাগুলো মাটিতে পড়ার আগেই যেন গরম বাতাস তাদের ছিনিয়ে নিলো । খানিক পরে চোখে পড়লো কয়েকটা ছোট খাট খেজুর বাগান । বুঝলাম, একেবারে বৃক্ষহীন, বৃষ্টিহীন নয় । আর কম বলেই একধরণের বিরল সৌন্দর্য রয়েছে তাদের মাঝে । চলতি পথে দু’একটা নগরীর দেখা পেলাম, পাহাড়ের কোল ঘেষে গড়ে উঠেছে, তাই হয়ত ঐ বিশাল পাহাড়ের পাশে ঘরবাড়িগুলোকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হলো।
সূর্য থেকে যেনো আগুন ঝরে পড়ছে । দূরের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা ।পুরো আকাশটা সোনারঙে সেজেছে ।চোখের পলক ফেলতে ইচ্ছে করছে না, প্রতিটি মুহুর্ত রঙ বদলে নতুন রূপে সাজছে । ওয়াও, এখন আবার রক্তিম আভা যেনো পুরো মরু পথটাকে রক্তিম করে তুলেছে!
সন্ধ্যা নেমে আসছে, চারপাশটা এখন ছাই রঙা লাগছে । কিছু দূরে বাতি জ্বলে উঠছে, আমরাও প্রায় এসে গেছি আমাদের গন্তব্যে । হঠাৎ করেই মনটা খুব বিষন্ন হয়ে গেলো, মরুর বুকে ছুটে চলা বিকেলটা এভাবে শেষ হয়ে গেলো? আর কি কোনদিন দেখা হবে, এমন রূপময় কোন বিকেলের সাথে !
***
সোনার মদিনা ছেড়ে চলে যাওয়া কী যে ভীষণ কষ্টের, তা সত্যিই বর্ণনা করার সাধ্যি আমার নেই । তবু স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা…।
সন্ধ্যা ছয়টায় হোটেল ছেড়ে দিতে হবে, আসর নামাজ শেষে দ্রুত রুমে এসে সব গুছিয়ে নিলাম । বাবা, মা, অনু সবার চোখে মুখে বিষন্নতার ছায়া । মনে পড়লো প্রিয় একটি কবিতার লাইন-
” চলে যেতে হবেই যখন জানো,
তবে কেন করেছো এ অন্ধ আয়োজন ।”
লবিতে ব্যাগপত্র রেখে মসজিদে নববীতে এবারের মত শেষ মাগরিব ও এশা আদায়ের জন্য গেলাম । নামাজ শেষ করে এসেই শুনি ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে অনেক আগেই এসে আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে । বিষন্নমনে গাড়িতে উঠলাম, চারিদিকে মন মাতানো বাতাস খেলা করছে, শীতল হাওয়ায় মনপ্রাণ জুডিয়ে যায় । ভেবে পাই না, যেখানে চারদিকে তাকালে কঠিন পাথরের বড় বড় পাহাড় ছাড়া আর তেমন কোন বৃক্ষরাজি চোখে পড়ে না, সেখানে বাতাস কিভাবে এত নির্মল হতে পারে ! ঠিক যেন বসন্তের প্রথম মাতাল সমীরণ ।
রাত নয়টায় জেদ্দা বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি । অনু সামনের সিটে বসেছে, বাবা-মা মাঝে আর আমি পেছনের তিন সিট নিয়ে একাই, সাথে বংলাদেশ থেকে বয়ে নিয়ে আসা আমার মিনি কোলবালিশ, সবখানেই সবসময়ে সে আমার সঙ্গী ছিল । পেছনে একটা কাপড়ের ব্যাগ ছিল, তার উপর মিনিটাকে দিয়ে শুয়ে পড়ি, নিমিষেই ক্লান্ত চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে । মসৃণ পথে গাড়ির নির্বিঘ্নে ছুটে চলা, মাঝে মাঝে একটু আধটু ঝাঁকুনির তালে ঘুম যেন আরো জাকিয়ে বসে চোখের পাতায় । সবার ডাকাডাকিতে অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকাই, ঘড়িতে দেখি রাত তিনটা । খাওয়ার জন্য একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামা হলো, এতরাতেও খাবারের জন্য মানুষের বিশাল লাইন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ড্রাইভার বললো, অনেক দেরী হবে এখানে । বরং সামনে ভালো কোন রেস্টুরেন্টের সামনে নামাবো আপনাদের ।
আবার যে যার নির্ধারিত সীটে বসে যাত্রা শুরু, আমি এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট না করে আবার শুয়ে পড়ি, আপন ভাবনায় বন্ধ হয়ে যায় চোখের পাতা । কিছুক্ষণ পর আবার ডাকাডাকি । এবারের রেস্টুরেন্টটা বেশ বড় তবে একটু অগোছালো মনে হলো । অর্ডার পাবার পর খাবার রান্না করে দেবে । অনু ভেতরে সবকিছু দেখে এসে বললো, “মাছের ফ্রাই, মুরগীর কাবাব হবে তবে রান্না করে দিতে একটু সময় লাগবে ।”
আমার তখন ‘সবার উপরে ঘুম সত্য, তাহার উপরে নাই’ এমন অবস্থা । আমতা আমতা করে বললাম – ‘এত রাতে মাছ খেতে কি কারও ভালো লাগবে ?’
ও বললো-“তাহলে বার্গার খাবে ? “
‘হুম, তা খাওয়া যেতে পারে । ‘
আমরা মাঝরাতে বার্গারের জন্য অপেক্ষা করছি, বেশ কিছুক্ষণ বাদে অনু ফিরে এলো স্যুপ নুডুলস আর চা নিয়ে । ড্রাইভারসহ পাঁচ জন মিলে গোগ্রাসে সেটাই খাওয়া হলো । পুনরায় যাত্রা শুরু…।
আমার অবস্থা এবারও আগের মতো । ভোররাত প্রায় চারটার দিকে জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছি । ধীরগতিতে ইমিগ্রেশনের নিয়মকানুন শেষ করে সাড়ে পাঁচটায় ভেতরে প্রবেশ করি । বাবা মাকে সাথে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করি । তারপর বাংলাদেশ বিমান ছয়টার সময়সূচি ভেঁঙ্গে পৌঁনে সাতটায় যাত্রা শুরু করে ।
মনখারাপের একটা বিশাল পাহাড় বুকের উপর চেপে আছে, যেন জান্নাতের সুখ-শান্তি ফেলে আবার ফিরে যাচ্ছি দুনিয়ার কর্মব্যস্ত জীবনে !
(চলবে)
পর্ব – ৭
আমার সামাজিক সত্ত্বা বিকাশে মহামূল্যবান সেই বাহনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে একটু না বললে অনেক মূল্যবান স্মৃতিই জীবনপথের ভিড়ে হয়ত পথ হারাবে ।
আমাদের মূলত দুটি সত্ত্বা- একটি প্রাকৃতিক, অপরটি সামাজিক । প্রাকৃতিক উপায়ে মানুষের সৃষ্টি, আমরা তাই প্রথমত প্রকৃতির অংশ, এরপর সমাজের অংশ । শিক্ষার মাধ্যমে আমরা প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রপঞ্চগুলো সম্পর্কে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারি ।
আমরা যেভাবে যতখানি সামাজিক হয়েছি, যেমন: খাবার খাওয়া, পোশাক পরা, গুছিয়ে কথা বলা ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে সামাজিক হওয়ার পেছনে শিক্ষা প্রক্রিয়া কাজ করছে, যে কোন উপায়েই হোক না কেন আমরা সবকিছু এই প্রক্রিয়ায় শিখেছি । সামাজিকীকরণের পেছনে শিক্ষা প্রক্রিয়া গভীরভাবে কাজ করছে । এই শিক্ষার পেছনে প্রত্যেকের জীবনেই কতগুলো বাহন কাজ করে থাকে- পরিবার, বিদ্যালয়, সমবয়সী দল, গণমাধ্যম, ধর্ম, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি ।
পরিবারের কথা বলতে গেলে প্রথমে বাবা-মায়ের কথাই চলে আসে আবার, নয় ভাই-বোনের বিশাল সংসারে বাবা আমাদের সময়োপযোগী আর্থিক সহায়তা দিতে না পারলেও মানসিকভাবে অনেক শক্ত করে মানুষ করেছেন । আট বছর বয়সে এতিম হয়ে যাওয়া একটা শিশু কিভাবে সেই ছোট্টবেলায় দুটো ছোট ভাই-বোনকে আগলে রেখেছে, বিধবা কিশোরী মাকে বেঁচে থাকার সাহস যুগিয়েছে, সমস্ত কিছু সামলে রেখে নিজেও শিক্ষা-দীক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল, আব্বার জীবনের সেই সব বাস্তব গল্পগুলোই আমাদেরকে এক অদৃশ্য আলোর পথ দেখিয়েছে ।
মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না, তবে অনেক ভালো কিছু গুণ ছিল । সবচেয়ে বড় দুটো গুণ যা আমাদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে অনেকখানি সহায়তা করেছিল বলে মনে হয় তা হলো- তিনি আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সবসময় গুরুত্ব দিতেন, আমাদের যে কোন পরীক্ষার সময় মা রোজা রাখতেন । আর আমাদের ভালো-মন্দ কোন বিষয়ই আব্বার কাছে লুকিয়ে রাখতেন না । পাশের দারোগা বাড়িতে মাঝেমাঝে সাদাকালো টেলিভিশনে নাটক-সিনেমা দেখতে যেতাম, সেটাও আব্বাকে বলে দিতেন, যার ফলে পড়া ফাঁকি দিয়ে কোনকিছু করার প্রশ্নই ছিল না আমাদের । নির্দিষ্ট নিয়মে সকাল-সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসতে হতো । তিন-চারজন ভাইবোন সবসময় একসাথে পড়াশুনা করেছি, যার কারণে শেয়ারিং বা কেয়ারিং এর মতো বিষয়গুলো ছোটবেলাতেই খুব ভালোভাবে শিখেছিলাম । এক টেবিলে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে তিন বোন পড়তাম । এমনকি পুরনো বইগুলো রেখে দেওয়া হতো, আমি সবসময় ইমিডিয়েট বড় দুইবোনের রেখে দেওয়া পুরনো বইগুলোই পড়েছি, নতুন বইয়ের একটা আফসোস ছিল মনের ভেতর, তবে সেটা বলে কাউকে কখনও কষ্ট দিয়েছি বলে মনে পড়ে না । বড়জোর আবদার করে বাজার থেকে প্যানোরোমা কিনে আনা হতো, সেটা দিয়ে মলাট করে নতুন একটা আবহ সৃষ্টি করতাম ।
সকালবেলা পড়া শেষে মাকে কিছুটা সময় ঘরের কাজে সাহায্য করতে হতো । পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বড়রা ছোটদের কাজ করে দিত । সেই অনুযায়ী আমার কাজ ছিল ছোট ভাইটাকে নিয়ে খেলাধুলা করা, পড়াশুনা করানো ইত্যাদি । সে দায়িত্ব অবশ্য বড় হয়েও পালন করেছি । বিয়ের পরও প্রায় দশটি বছর ও আমার কাছে থেকে লেখাপড়া করেছে, একেবারে সংসার হবার পর আলাদা জীবনযাপন শুরু করেছে । মাঝেমাঝে উঠোন ঝাড়ু দেওয়া, হাঁস-মুরগী বা গরুর খাবারও তৈরী করে দিতে হতো । সন্ধ্যার নিয়মিত কাজ ছিল হাঁস-মুরগীগুলোকে তাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ওজু করে নামাজ পড়া । পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি থাকার কারণে যে কোন বিষয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলার বিষয়টি মা খুব ভালোভাবে আয়ত্ব করতে শিখিয়েছিলেন । পরিবারে বাবার জায়গাটা যে অনেক সম্মানের সেটা মায়ের কাছেই শিখেছি, আব্বার গামছা বা স্যান্ডেলকেও আলাদা গুরুত্ব দেয়া হতো, কেউ সেগুলো ধরার সাহসও পেতাম না । খুব মনে পড়ে, বড় বড় কাঠের চুলায় আমাদের বাড়িতে রান্না হতো, জ্বালানী কাঠ শুকিয়ে রান্নাঘরের পাশে আর একটি ঘরে বোঝাই করে রাখা হতো । গোয়াল ঘরে বা টালি দিয়ে বানানো শোবার ঘরের চালে কাঠ শুকাতে দেয়া হতো, বর্ষাকালে যদি কখনও মাঝরাতেও বৃষ্টি হতো, মা কিভাবে যেন ঠিক টের পেয়ে যেতেন । অমনি আমাদের ডেকে বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, না হলে সব কাঠ ভিজে যাবে ।’
ঘুমের ঘোরে কথা ঠিকমত না বুঝলেও ডাকার সাথেসাথে উঠে যেতাম, সবাই মিলে খুব দ্রুত সব কাঠ নামিয়ে ঘরে বা বারন্দায় এনে রাখা হতো, রোদ উঠলে আবার শুকাতে দেয়া হতো । এখন অনেক বড় বাচ্চাদেরকেও দেখেছি, ঘরের কাজের বিষয়ে খুব কম জ্ঞান থাকে, অথচ মা আমাদেরকে সব শিখিয়েছিলেন । মা নিজেও রাতদিন কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকতেন । সকালে নাস্তার পরপরই গরুর দুধ দোয়াতেন নিজে হাতে, নিয়মিত রান্নাবান্নার পাশাপাশি পিঠা পায়েসও তৈরী করতেন প্রায়ই । আব্বা খেতে খুব পছন্দ করতেন, আমাদের বলতেন, ‘ শোনো, খাবার কখনও বেছে খাবে না, শুধু একটা বিষয়ে খেয়াল রাখবে, খাবার হালাল কি না । ব্যস! আর কোনো সমস্যা নেই । আমরা নিজেরা যেহেতু একটা দানাও তৈরী করতে পারি না, সুতরাং খাবার নিয়ে এত পছন্দ-অপছন্দ আমাদের মানায় না ।’
দীর্ঘদিনের চেনাজানা সেই পরিবার ছেড়ে এখন আমার নিজের একটা পরিবার হয়েছে । আমর হাজব্যান্ড উচ্চশিক্ষিত, বিনয়ী, নিরহংকারী, সাহায্যকারী একজন মানুষ । সে যখন জেনেছে যে, আমার পড়াশুনার খুব আগ্রহ, তখন এ ব্যাপারে আমাকে সবরকম সহায়তা করেছে । তার অতি উৎসাহে বিয়ের পরে বি.এড করেছি, এম.এড করেছি । এরপরও এম.ফিল, পিএইচডি করার ব্যাপারেও উৎসাহ দিয়েছে । আমি তার কথায় কেবল হেসেছি । ও বলেছে, ‘হাসছ কেন? তোমাকে দিয়ে সবই সম্ভব, তুমি অবশ্যই পারবে ।’
যদিও ক্যান্সার নামক মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবার পর পড়াশুনার সেই স্বপ্নটুকু আর পূরণ করা সম্ভব হয়নি, তবুও ‘তুমি পারবে’- এই একটি কথা একজন মানুষের মধ্যে কত বড় অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে, আমি তার বাস্তব উদাহরণ । আমার বয়স বা পেশার সাথে এখন হয়ত অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বিষয়ে নজর দেয়া ঠিক নয়, তবুও আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করি এখনও, নির্বাচিত হতে ভালো লাগে । নিজেকে যাচাই করি, প্রকৃত প্রতিযোগিতা তো আসলে নিজের সাথেই । নিজের সেরাটা দেখতে ইচ্ছে করে, আর এই ইচ্ছে থাকলেই বোধহয় মানুষ অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে ।
মাস্টার্স শেষ করার দীর্ঘদিন পর ঢাকায় আসি । নতুন শহরে সংসার শুরু হয় । ততদিনে বিদ্যেবুদ্ধি যা ছিল মাথায়, সবই ভোলার পথে । আমার হাজব্যান্ড এর অকৃত্রিম, নিঃশর্ত উৎসাহ উদ্দীপনার কারণে আবার পড়াশুনার মাঝে ফিরে আসি, চাকরি পাই ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে ।
একটা শিশুর সমাজে বেড়ে ওঠা, শিক্ষ-দীক্ষা, চাকরি, সামাজিকীকরণ সবকিছুর পেছনে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ভূমিকাই মুখ্য । সকলের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, পরিবারের শৃঙ্খলাবোধ সবকিছুই অপরিহার্য ।পাশাপাশি আর্থিক ব্যাবস্থাপনার ব্যাপারটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই । এই অভিজ্ঞতা আমার নিজের জীবন থেকেই সঞ্চয় করেছি ।
সামাজিক সত্ত্বা বিকাশে পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । শিশুরা প্রথম যখন বিদ্যালয়ে যায়, তখন তাদের কাছে সেটা খুব মজার জায়গা । ধীরেধীরে সবার সাথে মিলেমিশে চলা, খেলাধুলা করা এমন অনেক বৈশিষ্ট্য আয়ত্বে আসে । বিদ্যালয়ে শিশুরা নৈতিক শিক্ষা লাভ করে, শিক্ষক তাদের কাছে আদর্শ । মা-বাবার কথা অনেক সময় বাচ্চারা শুনতে চায় না, কিন্তু শিক্ষকদের সব কথা শোনে, বোঝার চেষ্টা করে, বিশ্বাস করে ।
বাগেরহাট হাই স্কুলে ( বর্তমান নাম- বাগেরহাট কলেজিয়েট স্কুল ) দশ বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করি । স্যার আপারা বেশ ভালো জানতেন । পড়াশুনায়ও প্রথম সারিতে ছিলাম, তাছাড়া আব্বা ছিলেন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক । অনেক স্যার আমাকে ছোটমা বলে ডাকতেন । ১৯৯০ সালে এস.এস.সি পরীক্ষার ফল বিপর্যয় হয়েছিল, ঐ বছর আমার স্কুল থেকে সম্ভবত চারজন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ।
বাগেরহাট সরকারী পি সি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি । অনেক শিক্ষকের পড়ানোর কৌশল এখনও চোখে লেগে আছে । মোজাফ্ফর স্যার রসায়ন পড়াতেন , বিজ্ঞানীদেরকে উনি সাহেব বলে সম্মোধন করতেন; যেমন- ডালটন সাহেব এটা আবিষ্কার করেছেন, নিউটন সাহেব ওটা তৈরী করেছেন, এভাবে বলতেন । আমরা খুব মজা পেতাম । মনে হতো স্যার নিজেও বোধহয় ঐ সব বিজ্ঞানীদের বন্ধুমানুষ । আমি নিজে ক্লাসে এভাবে বলে দেখেছি, আমার শিক্ষার্থীরাও বেশ মজা পায় । জলি স্যার জীববিজ্ঞান পড়াতেন, ২৮ বছর আগের কথা, তখনই দেখতাম স্যার রঙিন চক ব্যবহার করে কোষ বিভাজন পড়াতেন । স্টিলের একটি পয়েন্টার থাকতো স্যারের পকেটে, যেটাকে ছোটবড় করে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতেন । তের বছর পরে আমি শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেবার পর অমন একটি পয়েন্টার অনেক খুঁজেছি, অবশেষে মিলেও ছিল, পুরনো টেলিভিশনের গায়ে ব্যবহৃত অ্যান্টেনা ভেঙে পয়েন্টার তৈরী করেছিলাম ।
অনার্স-মাস্টার্স এর দীর্ঘ প্রায় আটটি বছর পার করেছি সরকারী বি.এল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে । ওখানকার অনেক শিক্ষকদের পড়ানোর কথা মনে থাকবে চিরকাল । ডঃ মুত্তালিব স্যার জীববিজ্ঞান পড়াতেন, অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলতেন তিনি । প্রথমবর্ষের শেষদিকে উনি মারা গেলেন, মনে হতো আর বোধহয় পড়াশোনাটা শেষ করা হলোনা, খুব বেশি ভেঙ্গে পড়েছিলাম ।
কুমিল্লা সরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড করি । সদ্য শুরু হওয়া সংসারের ঝামেলা সামলে পড়াশুনা করা একটু চাপ-ই ছিল, সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কলেজে থাকতে হতো । মনে হতো, যেন নতুন করে স্কুলে ভর্তি হয়েছি । কিন্তু ওখানকার নিয়ম-শৃঙ্খলা, শিক্ষকদের আন্তরিকতা যে কোন শিক্ষার্থীর জীবনের চলার পথের পাথেয় । মৃণাল স্যার, তারেক স্যার, সওগাত স্যার, ফাহমিদা ম্যাম, মাহফুজা ম্যামসহ অনেককেই বেশ কাছের মানুষ মনে হয়েছিল ঐ সংক্ষিপ্ত সময়েও । যেমন ভালো পড়াতেন, তেমনি অমায়িক ব্যবহার । পড়াশুনার পাশাপাশি ভবিষ্যত কর্মজীবনের জন্য পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা মূলত ওখান থেকেই পেয়েছি ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর ডিপার্টমেন্ট থেকে এম.এড সম্পন্ন করেছি । দুই বছরে দশটি কোর্সে যে দশজন শিক্ষকের সাহচর্যে এসেছিলাম, তাদের প্রত্যেকেই অনেক জ্ঞানী, পন্ডিত, ভালো মনের মানুষ ছিলেন, সেকথা বলার কোন অবকাশ নেই, তাঁদের ভালো গুণগুলোকে আয়ত্ব করার চেষ্টা করেছি, সেগুলো আবার নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করার ইচ্ছেপোষণ করেছি সবসময় ।
শিশুর সামাজিক সত্ত্বা বিকাশে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য । নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলা, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা… প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিদ্যালয়ের কাছে আমরা ঋণী । মায়ের কথাও অনেক সময় শিশু অবিশ্বাস করে, কিন্তু শিক্ষককে কখনও নয় । কিছুদিন আগে অভিভাবক সমাবেশ শেষে একজন মা কাছে এসে বলেছিলেন, ‘ আমার মেয়ে কোন সবজি খেতে চায় না । আপনাকে সে খুব পছন্দ করে, আপনি বলে দিলে সে একটু হলেও খেতে পারে ।’
অবিশ্বাস্য হলেও জেনে আনন্দিত হয়েছিলাম, আমি বুঝিয়ে বলার পর থেকে সেই মেয়েটি সবজি খেতে শুরু করেছে ।
পরিবার শিশুকে যা না দিতে পারে, বিদ্যালয় থেকে তার চেয়েও অনেক বেশি লাভ করার সুযোগ থাকে ।
সামাজিক সত্ত্বা বিকাশে সমবয়সী দলের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । শিশু যাদের সাথে মেলামেশা করে তারা যদি ভালো মনমানসিকতার হয়, তাহলে সে অনেক কিছু শিখতে পারে । আর যদি খারাপ হয় তাহলে বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে ।
স্কুল পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত আমার সার্কেলটা বরাবরই ভালো ছিল…।
(চলবে)
পর্ব – ৮
স্কুল পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত আমার সার্কেলটা বরাবরই বেশ ভালো ছিল। যদিও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার, তবুও মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বন্ধুবান্ধব-ই ছিল বেশি । সবাই ভালোভাবেই মিশত । যাদের সাথে মেলামেশা করতাম, তারা লেখাপড়ায়ও মনোযোগী ছিল ।কোনকিছু শেখার ক্ষেত্রে সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল ঠিকই কিন্তু তারপরও সবাই সবার প্রতি সহানুভূতিশীল ও বন্ধুসুলভ ছিল ।
স্কুল জীবনে যেহেতু আমি পড়াশুনায় প্রথম দিকেই ছিলাম, স্যার আপারা খুব ভালোবাসতেন । তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, আদর্শ শিশু বিদ্যালয় থেকে ফাল্গুনী এসে ভর্তি হলো আমাদের স্কুলে । ওর হাতের লেখা ছিল চমৎকার । অল্পদিনেই সবার নজরে চলে এলো সে, তার হাতের লেখার সে কি প্রশংসা! আমার লেখা তখন খুব বেশি ভালো ছিল না । ওর সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম, ফণি স্যারের কাছে নাকি অনুশীলন করে এমন হয়েছে । মনেমনে জিদ করলাম, আমার হাতের লেখাও অমন সুন্দর করতে হবে । অল্পদিনের প্রচেষ্টায় আমার লেখাও ভালো হয়ে গেল । নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত “হস্তাক্ষর প্রতিযোগিতায়” জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়ে খুলনাতে গিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম ।
ছোটবেলা থেকেই চুলচেরা হিসাবের মধ্যে বড় হয়েছি । দামী জামাকাপড় পরার কোন সুযোগ ছিল না, দুই ঈদে কেবল দুটো নতুন জামা বানিয়ে দিতেন আব্বা । তবে আমাকে সাথে নিয়ে বাজারে গিয়ে পছন্দ করতে দিতেন । আমার ইমিডিয়েট বড় দুইবোনের যাবার কোন অনুমতি ছিল না । ওরা আমাকে নানারকম ডিজাইন দেখিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠাত, কারণ তিনজনের জন্য একই কাপড় এবং ডিজাইন বরাদ্দ হতো, স্যান্ডেলও । একবার কোন এক সমস্যার কারণে আব্বা বললেন, “এবার ঈদে যে কোন একটা জিনিস নিতে হবে, জামা অথবা স্যান্ডেল ।”
আমার তখন স্যান্ডেলের প্রয়োজনটাই বেশি ছিল । আমি বললাম স্যান্ডেলই নেবো । আব্বা তবুও বললেন, “এখনও সময় আছে, চিন্তা করে দেখো । ওটা তো পায়ের নিচে থাকবে, কেউ খেয়াল করবে না কিন্তু পুরনো জামা পরে কি ঈদের দিন থাকতে পারবে?”
আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম । মনে আছে, সে বছর ঈদের দিন আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে নিরবে কেঁদেছিলাম! যা হোক, অনার্স লাইফে আমি বি.এল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মন্নুজান হলে থাকতাম । সেখানে নানান পরিবেশের এবং পরিবারের অনেক মেয়ে থাকত । তাদের দেখে অনেককিছু শিখেছি । মায়া নামে একজন সিনিয়র দিদি ছিলেন, বেচারার ঠিক তিন সেট জামা ছিল, দুই সেট ঘরে পরতো আর এক সেট পরে প্রতিদিন ক্লাসে যেত । দিদির রুমমেটরা তাকে কাপড় কিনে দিতে চাইলেও উনি নিতেন না।এটা জানার পর আর কখনও আমার অভাববোধ হয়নি।
১৯৯৩ সালের কথা, আমার মিলচার্জ ছিল তখন প্রতিদিন ১৭ টাকা, সকালের নাস্তা ৪ টাকা, দুপুর ও রাতের খাবার ৬.৫০টাকা করে । সে হিসাবে মাসে খাবার খরচ ছিল ৫১০ টাকা, সিট ভাড়া ৫০ টাকা, ৪০ টাকা হাতখরচসহ আব্বা আমাকে মাসে ৬০০টাকা দিতেন । সেটা দিয়েই সব প্রয়োজন মিটিয়েছি । কখনও যদি বন্ধুদের কোন গিফট দেবার প্রয়োজন হতো, তখন সকালের মিল অফ করে দিতাম । পাঁচ-ছয় দিনের নাস্তার টাকা জমিয়ে তখন ২০-২৫ টাকায় অডিও ক্যাসেট কেনা যেত । এটাই ছিল জনপ্রিয় উপহার । মাঝেমাঝে প্রিয় গানগুলো বাছাই করে সেগুলো মিলিয়ে অডিও ক্যাসেট তৈরী করা হত । খুব কাছের বন্ধুদের জন্য আরও একটু কষ্ট করে বই কেনা হতো । বাড়িতে চিঠি পাঠাতাম ৫০ পয়সার পোস্ট কার্ডে অথবা ১ টাকার খামে ।
আব্বা প্রতি সপ্তাহে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, বাড়ি থেকে মা হাতের কাছে যা পেতেন, পাঠিয়ে দিতেন । যাবার সময় আব্বা জিজ্ঞেস করতেন, “ টাকা লাগবে তোমার?”
‘না’, সহজ উত্তর দিয়ে আব্বাকে বিদায় দিতাম । গেস্টরুমে অন্য কোন রুমমেট বা আপুরা থাকলে, বলতো – টাকা তো দরকার তোমার, বললেই পারতে ।
হেসে বলতাম, খুব একটা সমস্যা তো হচ্ছে না ।
ততদিনে সংসার খরচ কিছুটা কমলেও আব্বা চাকরি থেকে অবসরে চলে যান । আমার আর ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ তখনও চলছিল । বড় ভাইয়ের সংসারটাকেও চালিয়ে নিতে হতো আব্বাকেই ।
আমার রুমমেট ছিল বুলবুল । ওর মা ওকে হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে পড়ার খরচ দিত । বিষয়টি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলাম । একবার গিয়েছিলাম ওর মাকে দেখতে, মাটির ছোট একটা জীর্ণ কুটির, তারই বারান্দায় বসে খুব কাঁশছিলেন, অ্যাজমা ছিল উনার । বাড়ি গিয়েই সমস্ত কাজ শুরু করতে হতো বুলবুলকে, তার পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে গেছে, স্বপ্ন ছিল- ভালো চাকরি পাবে, মা সুস্থ হবে । শুনেছি বুলবুল একটা ভালো চাকরি পেয়েছে, তবে ওর চাকরি পাবার আগেই মা পৌঁছে গেছেন শেষ ঠিকানায়!
বড় আপুদের মধ্যে পান্না, মুক্তি, ডল, মনি… ওরা আমাকে খুব আদর করতো । একবার আমার প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল, জ্বর কমানোর জন্য আমাকে আনারস খাইয়েছিল । কেউ একজন দুধ খেতে দিয়েছিল । সম্ভবত মারাত্মক অ্যাসিডিটি হয়েছিল, ওরা ভেবেছিল আমি বোধহয় সে রাতেই মারা যাবো । হল সুপারের অনুমতি নিয়ে সেই রাতে ওরাই আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল ।
যখন সময় ছিল, বাইরে ঘোরার বয়স ছিল, তখনও খুব বেশি বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয়নি, কারণ হলে ছোট-বড় যাদের সাথে মিশেছি সবাই খুব ভালো ছিল । বি.এড করার সময় রুপা, অনু, শিমুল, মুনা আর আমি একসাথে থাকতাম সবসময়, সবাই “ফাইভ স্টার” বলে ডাকতো । ওরা সবাই বয়সে আমার চেয়ে একটু হলেও ছোট ছিল কিন্তু মনমানসিকতায় একইরকম । খুব সংক্ষিপ্ত সময় আমরা একসাথে ছিলাম কিন্তু ওদের সহযোগিতার কথা কখনও ভোলার নয় ।
এখন সহকর্মীদের কাছ থেকেও অনেককিছু শিখছি, শেখার সত্যিই কোন শেষ নেই, বয়সও নেই ।
ছেলেবেলা থেকে বন্ধু নির্বাচনে খুব খুঁতখুঁতে মনোভাব ছিল আমার, এখনও আছে । যাকে ভালো লাগে না তার সাথে মিশতে পারি না, চেষ্টাও করি না, তাকে আমার প্রয়োজন হলেও নয় । এটা ভালো না কি মন্দ অভ্যাস জানিনা, তবে সমবয়সী দল নির্বাচনে পছন্দ-অপছন্দ থাকার কারণে ফেলে আসা জীবনের দীর্ঘ সময়ে কারও কাছ থেকে খুব বেশি ক্ষতির কিছু ঘটেনি কখনও ।
বেড়ে ওঠার সেই ক্ষণে গণমাধ্যম বলতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুর সাথে আমার সংযোগ ছিল না, কাঠের তৈরী বড় একটা রেডিও ছিল আব্বার, খবর শুনতেন । আমরা সুযোগ পেলে গান শুনতাম । পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে কোন কিছু পেলেই পড়তে ভালো লাগত । বাদামের ঠোঙা, রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজ যাই পেতাম গায়ের লেখাগুলো পড়ে ফেলতাম । খবরের কাগজে (ইত্তেফাক /ইনকিলাব) সপ্তাহে একদিন শিশুদের জন্য একটা পাতা বের হতো, সেটা নিয়ে সবাই টানাটানি করতাম, ছড়া, কার্টুন পড়া হতো । আরও একটু বড় হবার পর বিজ্ঞানবিষয়ক লেখাগুলো নিয়ম করে পড়তাম, শব্দের খোলগুলো নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতাম । বাড়িতে টিভি না থাকায় পেপার পড়ার অভ্যাসটা ভালোভাবে গড়ে উঠেছিল । সমাজের বিভিন্ন অসংগতিপূর্ণ খবরগুলো খুব ব্যথিত করতো! মাঝেমাঝে লেখালেখি করতাম চিঠিপত্র কলামে…।
(চলবে)
স্মৃতিবিলাস (অষ্টম পর্ব)

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..