1. press.sumon@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন

শিশির বিন্দু – – – খাদিজা আরুশি আরু – পর্বঃ ০১,পর্বঃ ০২,পর্বঃ ০৩ এবং পর্বঃ ০৪ “শেষ” –

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১২ জুন, ২০২২
  • ২৯৮ বার
পর্বঃ ০১
কোন এক বিষন্ন প্রাতে তার সঙ্গে আমার প্রথমবার দেখা হয়েছিলো, বড়ই সাদামাটা সাক্ষাৎ। আমি সবে লঞ্চঘাট থেকে সিএনজি করে বাড়ি ফিরেছি, ড্রাইভারের কাছে পাঁচশো টাকার খুচরো ছিলো না। এত সকালে কোন দোকানপাটও খোলা নেই, আমাকে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি এলেন। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
-“মামা, কোনো সমস্যা? কাকভোরে রাস্তাঘাটে আপদ ঘাড়ে করে দাঁড়াই থাকলে তো মানুষ অন্য কিছু ভাববো।”
একজন অপরিচিত মেয়েকে আপদ বলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন, অথচ আমি নির্বিকারই রইলাম। একজন অযাচিত লোক আমাকে আপদ বললেই তো আর আমি আপদ হয়ে গেলাম না। ড্রাইভার মামা সংক্ষেপে সবটা খুলে বললেন ওনাকে, উনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ালেন তারপর হনহন করে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। মিনিট না গড়াতে অবশ্য ফিরেও এলেন… আমার হাতে ধরা পাঁচশত টাকার নোটটা কেড়ে নিয়ে সেখানে একশত টাকার কচকচে পাঁচটা নোট ধরিয়ে দিয়ে আগের মতোই হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। তার এই নির্বিকার ভাব, সাহায্য করেও ধন্যবাদ না নেয়া, নিজ থেকে পরিচিত হবার চেষ্টা না করা আমাকে অবাক করেছিলো, বেশ কিছুক্ষণ তার যাবার পথে তাকিয়ে রইলাম আমি। পরমুহূর্তে ভাড়া মিটিয়ে মূল ফটক দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। অন্য সময় হলে হয়তো লোকটাকে নিয়ে আগ্রহ কাজ করতো কিন্তু সে মুহূর্তে একজন আগুন্তুককে নিয়ে ভাবার সময় আমার হাতে নেই। বাবাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে। দু’দিন আগে হোস্টেলে ফোন করে আমাকে জানানো হয়েছে, বাবা অসুস্থ। তাও সাধারণ অসুখ নয়, গুরুতর অসুখ। ফোনে বলা সম্ভব নয়, আমি এসেই যেনো বিস্তারিত শুনি। সেই থেকে মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা উপশিরায় বাবা নামক মানুষটির জন্য চিন্তারা চষে বেড়াচ্ছে। কলিংবেল বাজাতেই ভেতর থেকে আয়না বানুর কণ্ঠ শোনা গেল। আয়নাবানু আমাদের বাসার বহু পুরোনো কাজের লোক, মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের বিয়ের সময় নানুবাড়ি থেকে আয়না বানুকে মায়ের সঙ্গে দেয়া হয়েছিলো। তারপর এ বাড়িতেই থিতু হন আয়না বানু, আমি তাকে ডাকি আয়না নানু। দরজা খুলেই আয়না নানুর মাথায় হাত, চিৎকার করে আমার চারদিকে ঘুরছেন আর বলছেন,
-“ও আমার আল্লাহগো, পরীর মতো মাইয়াডা এতো শুকাইলো কেমনে? দেইখা তো চেনাই যায় না। হায় হায় চোখও দেখি ভিতরে হান্দাই গেছে। ও নাফিসার মা, তাড়াতাড়ি আসো, দেখো তোমার মাইয়া নিজের কি সর্বনাশ ঘটাইছে। এই সুরত লইয়া সে যাইবো স্বামীর ঘর করতে, স্বামী তো ফিরাও তাকাইবো না।”
আমি প্রতিবার আসার পর আয়না নানু এভাবেই আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে হাহুতাশ করেন। তিনি শুদ্ধ ভষায় কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন তবে মাঝে মাঝে কিছু আঞ্চলিক শব্দ আপনাআপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, সুতরাং তার কথা শুদ্ধ-অশুদ্ধের মাঝামাঝিতেই রয়ে যায়। তার ধারনা প্রতিবার বাড়ি থেকে যাবার সময় আমি বেশ রিষ্টপুষ্ট হয়ে যাই এবং ফিরি একেবারে রোগা হয়ে। তবে এবারের আফসোসটা অন্যবারের তুলনায় আলাদা, আমার চেহারা নিয়ে আগে কখনো আয়না নানুকে এতোটা উদ্বিগ্ন হতে দেখি নি। তাছাড়া স্বামীর বাড়িতে যাবার কথাই বা আসছে কেনো? কোন এক অজানা শঙ্কায় আমার মন সংকচিত হলো, আমি চুপচাপ বাসার ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমার অনুপস্থিতিতে আমার ছোট বোন নাঈমা থাকে এ ঘরে। আমাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো সে, আদুরে গলায় বললো,
-“আপু, বিয়ে করা কি খুব জরুরি? বিয়ে না করলে বাবা-মা অসুস্থ হয়ে যায়?”
নাঈমার প্রশ্নে অবাক হলাম, ওর বয়স সবে ছয়ে পড়েছে, ওর দ্বারা এ প্রশ্ন করা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এমন কিছু দেখেছে যার জন্য এ প্রশ্ন তার মাথায় এসেছে। আমি নাঈমাকে কোলে তুলে নিলাম, খাটে নিজের পাশে বসিয়ে বললাম,
-“হঠাৎ এ প্রশ্ন করছিস কেনো? কিছু হয়েছে?”
-“তুমি বিয়ে করছো না বলে বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে। তার বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথা, সারা শরীরে ব্যথা। ডাক্তার কতো ব্যথা সারাবে বলো? কিন্তু মা বলেছে, তুমি বিয়ে করলে বাবার সব ব্যথা সেরে যাবে। আপু, বাবার সব ব্যথা সারিয়ে দাও না…”
নাঈমার কথা শুনে বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম, তবে এতোক্ষণে বাসা থেকে জরুরি তলব করার কারন উদঘাটন করতে পারলাম। আমার বড় ফুফুকে বাবা বরাবরই বেশ মান্য করতেন, সেই ফুফু ছ’মাস আগে মারা গেছেন। তখন থেকে বাবার মনে মৃত্যুভয় ঢুকে গেছে, ওনার ধারনা উনি যখন তখন মারা যাবেন। বাবা মারা গেলে আমরা ঘরে চারজন একা মেয়ে মানুষ, আমি, মা, আয়না নানু আর নাঈমা। তাই এ মুহূর্তে বাবার ধারনা আমার বিয়েই হলো সমস্যার একমাত্র সমাধান, বাবার অবর্তমানে আমার বর হবে এ পরিবারের অভিভাবক। এ নিয়ে দু’মাস আগে বাবার সঙ্গে আমার তুমুল ঝগড়া হয়েছে, ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি রাগ করে হোস্টেলে চলে যাই। তারপর আর বাড়ি ফিরি নি, কল করলে ফোনও তুলি নি। তাই হয়তো আমাকে ফেরাতে বাবার এ অসুস্থতার নাটক, কিন্তু বাবা এতো ভাবছেন কেনো, আমার বিবিএ শেষের দিকে। আমি তো চাইলেই বাবাবিহীন পরিবারের হাল ধরতে পারবো, আমাকে বিয়ে করে অন্য বাড়ির ছেলেকেই কেনো এ পরিবারের হাল ধরতে হবে! যুক্তিযুক্ত কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলেই হয়তো বাবার প্রতি অভিমানের মেঘ জমে ক্রমশ ভারী হচ্ছিলো। অভিমানে আমি বাবার অসুস্থতার কথা ভুলে গেলাম, তাকে যে আমার একবার দেখে আসা উচিত আমার মনেই পড়লো না। বাসায় ঢোকার পর থেকে মাকে একবারও দেখি নি, তাও আলাদা করে ভাবালো না। আমি নির্বিকার নিজের ঘরে পড়ে রইলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মাঝরাত, আয়না নানুর আহাজারির শব্দ এখনো আমার কানে স্পষ্ট বাজে। আমি দ্রুত পায়ে বসার ঘরে গেলাম, আয়না নানু বুক চাপড়ে কাঁদছেন, নাঈমা ঘরের এক কোণে মায়ের কোল ঘেঁষে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। আমি বাবার ঘরে গেলাম, বাবা নেই। ঘরের কোথাও বাবা নেই, পুরো ঘরটা ফাঁকা। সেই ফাঁকা অন্ধকার ঘরটা আমায় বারংবার জানান দিচ্ছিলো, কোনো ভয়াবহ ঘটনার। আমি বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের পাশে বসলাম, শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
-“বাবা কোথায় মা?”
এই একটা প্রশ্নে আমার সবসময় বিপদে শান্ত থাকা মা কাটা কলাগাছের মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কান্নার দমকে অনবরত তার শরীর কাঁপছিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উপায়ান্তর না পেয়ে ছোট্ট নাঈমাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“বাবা কোথায় নাঈমা?”
নাঈমা যেন আমার প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিলো, কাঁদতে কাঁদতে আমার দু’হাত ধরে বললো,
-“নাফিসাপু তুই বিয়ে করে নে না, তুই বিয়ে করলে বাবা চলে আসবে। তুই বিয়ে না করলে বাবা ফুফির মতো আর কখনো বাড়ি আসবে না।”
আমি স্তব্ধ হয়ে ছোট্ট নাঈমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তার কন্ঠে কি করুণ আকুতি। আমার হঠাৎ মনে হলো, বাবাকে আমার তুলনায় হাজার গুণ বেশি নাঈমা ভালোবাসে। আমার তো ব্যক্তিগত পছন্দ নেই, তবে কেনো রাজি হচ্ছি না আমি? কিসের জেদ আমার! বাবার উপর অভিমান হচ্ছিলো না, তা’ও নয়। বাবা আমায় প্যাঁচে ফেলে বিয়েতে রাজি করাতে চাচ্ছেন। আমার চিরকাল জয়ী হয়ে আসা বাবার পরাজয় সহ্য হতো না আমার, তাই নিজেই হেরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্বেচ্ছায় হার যাকে বলে… দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
-“আমি বিয়ে করবো। আজ, এক্ষুণি, এই মাঝ রাতেই বিয়ে করবো। আমার বিয়ে যদি বাবার বেঁচে থাকার ঔষধ হয় তবে তাই হোক।”
জেদের বসে বিয়ে করলাম, যখন কাজী আমাকে কবুল বলতে বললো তখন প্রথমবারের মতো আমার বরের নামটা শুনলাম, আজহার তালুকদার। পাশ থেকে আয়না নানু বললো,
-“ও নাফিসা, মুখ গোমরা কইরা থাকোনের সময় না এটা, কবুল বইলা ফালাও বইন। তোমার যে বর হইতাছে সে হইলো রাজপুত্র, তোমার বাপের ছাত্র মানুষ। বাপ-মা মরা পোলা, তোমার বাপের হাতের তালুতে মানুষ হইছে। এ পোলা তোমারে রাজরানী বানাই রাখবো, আইতে যাইতে শ্বশুর-শ্বাশুড়িরে আব্বা-আম্মা ডাইকা গলা শুকাই ফালাইবো। কবুল বলো বইন, দেরী কইরো না। তুমি যতো দেরী করবা, তার ততো অপেক্ষা করা লাগবো।”
চলবে…
পর্বঃ ০২
বাবার ছাত্র! তারমানে এসব আগে থেকেই সাজানো ছিলো। আমি কানখাড়া করে আয়না নানুর কথাগুলো শুনছিলাম, আমি যে বাবার বিছানো জালে বাজেভাবে ফেঁসে গেছি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার পালানোর কোনো পথ নেই। আমি কবুল বললাম, স্পষ্ট উচ্চারণেই বললাম এবং মনে মনে পণ করলাম, আর কখনো বাবার সঙ্গে কথা বলবো না আমি। মা কিংবা আয়না নানুর সঙ্গেও না, কারন তারা বাবাকে শতভাগ সমর্থন দিয়েছেন।
বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে বাকি রাতটার জন্য আমাদের দু’জনকে এক ঘরে থাকতে দেয়া হলো। যদিও আমার গায়ে তেমন গয়না নেই তবুও আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়না খোলার নাটক করে যাচ্ছিলাম অনবরত, তাছাড়া আমার করারই বা কি আছে? বাবার প্রতি আমার যত অভিমানই থাকুক না কেনো, তার মুখটা একবার দেখার জন্য আমার মনটা অস্থির হয়ে ছিলো। হয়তো বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে থাকা আজহার নামক মানুষটা বাবার জন্য আমার মনের অস্থিরতা টের পাচ্ছিলো, ক্ষীণস্বরে বললো,
-“স্যার ভালো নেই নাফিসা। হাসপাতালে যাবার সময় বারবার আমার হাত ধরে বলছিলেন, আমার নাফুটা কি আমার সঙ্গে রাগ করেই থাকবে, মৃত্যুর আগে ওকে একবার দেখতে পারবো না? আমি কিছু বলতে পারি নি, কারন তোমার ব্যাপারে আমি এখনো নিশ্চিত নই। তবে একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছা রক্ষার্থে তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ, আমার মতো একজন অনাথকে একটা পরিবার দিয়েছ তার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ। নাফিসা, তুমি কি একবার স্যারকে দেখতে হাসপাতালে যাবে? ওনার ভেতর মৃত্যুভয় ঢুকে গেছে, আমার মনে হয় না উনি বেশিদিন বাঁচবেন। বেশিদিন বলছি কেনো, হয়তো কয়েক ঘন্টায়ও…”
আমি বসা থেকে উঠে মানুষটার গালে সজোরে চড় বসালাম, আমার বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলার সাহস হয় কি করে তার? তাছাড়া এ লোকটাই সকালে আমাকে আপদ বলেছিলো, আসলে আমি তো আপদই। তাইতো বাবা নিজের ঘাড় থেকে আপদ নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। চড় খেয়ে মানুষটা ম্লান হাসলো, হালকা কাশলো, গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-“স্যার ঠিক বলতেন। তুমি ওনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো। যাও নাফিসা, একবার দেখে আসো মানুষটাকে। নতুবা সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে।”
আমি কিছু বললাম না, মায়ের থেকে ঠিকানা নিয়ে ফজর নামাজ পড়েই বাবাকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। বাবার শুকনো মুখটা দেখে আমার সাজানো পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেলো। কি হাল হয়েছে মানুষটার… আমি এগিয়ে গিয়ে তার কপালে হাত রাখলাম, পিটপিট করে চোখ খুললো বাবা। আমাকে দেখে তার চোখের কোন বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি হাত বাড়িয়ে মুছে দিলাম সে অশ্রু। বাবা কাঁপা হাতে আমার দু’হাত আঁকড়ে ধরলেন। ভাঙা ভাঙা শব্দে যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হলো, “আজহার খুব ভালো ছেলে, তোমাকে সে ভালো রাখবে মা। তুমি মন খারাপ করো কেনো? বাবা কি তোমার খারাপ চাই? সে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র ছিলো, আমরা যে বাড়িটায় ভাড়া থাকি বাড়িটা তার দাদার। ছেলেটার কেউ নাই, তার দরকার ছি্ল একটা পরিবারের আর তোমাদের দরকার ছিলো অভিভাবকের। তুমি মন ছোট করো কেনো, সে তোমাদের ভালো রাখবে।” আমি কিছুই বলতে পারি নি, একটুখানি কাঁদিও নি। নিরবে কেবল বাবার কথাগুলো শুনেছি। তারপর হাত ছাড়িয়ে হাসপাতালের করিডরে এসে বসেছি। আমার সে মুহূর্তে নিজেকে অনুভূতিশূণ্য মনে হচ্ছিলো, বাবার অহেতুক জেদের জন্য আমার হুট করে বিয়ে করা, বাবার হঠাৎ এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়া সব মিলিয়ে আমি যেনো এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছিলাম। একবার মনে হচ্ছিলো এইটা বুঝি স্বপ্ন, এক্ষুণি ঘুম ভাঙলে দেখবো আমি হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে আছি। যখন নার্স আর ডাক্তারদের আইসিইউ এর দিকে ছুটে যেতে দেখলাম, একজন নার্সকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে শুনলাম, “আমিনুল হকের বাড়ির লোক কে?” যা বুঝার তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। এক পা’ও নড়তে পারি নি, পাথরের মুর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা তখন চরকির মতো ঘুরছে, আমি সেই আলো-আঁধারির খেলার মাঝে দেখলাম আজহার নামের লোকটি দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে। তার গায়ে সফেদ পাঞ্জাবী, কি পবিত্র লাগছে তার মুখটা। উনি এসে নার্সের সঙ্গে কি যেন কথা বললেন, তার কিছুই আমার কানে গেলো না। আমার সামনে পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো, আমি লুটিয়ে পড়লাম কারো বাহুতে…
যখন চোখ খুললাম তখন আমি নিজের ঘরে, আমার মাথার কাছে আয়না নানু বসা। বসার ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। আমি এক পা, দু’পা করে বসার ঘরে এলাম, আমার বাবার নিথর দেহটা চোখের সামনে পড়ে আছে। আমি কাছে গেলাম না, শেষবারের মতো ছুঁয়েও দেখলাম না। মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, আমার মনে হচ্ছিলো বাবা ঘুমোচ্ছে। এক্ষুণি জেগে সবাইকে ধমকে বলবেন, “এভাবে কাঁদছো কেনো? তোমাদের জ্বালায় তো আমি শান্তিমতো ঘুমোতেও পারবো না।” আর আমি ফিক করে হেসে বলবো, “এতো ঘুমিয়ে কি হবে বাবা? বেলা তো কম হলো না।” এ নিয়ে বাবা আর আমার মাঝে দু’দফা বাকবিতণ্ডাও হবে আর প্রতিবারের মতো যুক্তিতর্কে জিতে যাবে বাবা। বাবার চুপচাপ শুয়ে থাকা আমার চোখে সুঁচের মতো বিঁধছিল, আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবাকে দাফন করার আগে সবাইকে একবার দেখানো হচ্ছিলো। মা, আয়না নানু, আজহার নামক লোকটা সবাই আমাকে ডাকতে এসেছিলো, আমি যাই নি। কাফনে মোড়ানো বাবাকে দেখতে একদম ইচ্ছা করছিল না আমার। আমাকে কেউ জোরও করে নি।
বরাবর ছিঁচকাঁদুনে আমি বাবার মৃত্যুতে শক্ত পাথর হয়ে গেলাম, একটু কাঁদলাম না। বরং পরদিন সকালে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আজহার লোকটার জন্যই কি না কে জানে, আমাকে কেউ কিছু বললো না। বাড়ির সকলের সঙ্গে একটা শীতল মনোযুদ্ধ চলছিলো আমার, তারাও আমাকে কিছু বলতেন না, আমিও তাদের কিছু বলতাম না। তবে নাঈমা প্রায়ই বসার ঘরের ল্যান্ডলাইন থেকে কল করতো। কল করেই নানা অভিযোগ দিতো, মায়ের নামে, আয়না নানুর নামে। অবাক করা ব্যাপার হলো, একমাত্র আজহার নামের মানুষটার সুনাম করতো নাঈমা। সবসময় বলতো, মানুষটা ভীষণ ভালো, একদম বাবার মতো। আমি কখনো শুনতাম, আবার কখনোবা না শুনার ভান করে থাকতাম। কোনো এক সকালে আজহার আমার হোস্টেলে এলেন, বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন,
-“নাফিসা, বাড়ি চলো। মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবা যাবার পর তুমি আর বাড়ি যাও নি। ওনাদের তোমার প্রয়োজন।”
-“আর আপনার?”
প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি, তবে কোনো উত্তর দেন নি। আমি সেবার বাড়ি ফিরে গেলাম, কারো মন ভালো করতে নয়, বাড়ির পরিস্থিতি দেখতে। বাড়ি পৌঁছে বেশ চমকে গেলাম আমি, বাসার সবকিছু আগের মতোই আছে কেবল আমার ঘরটা ছাড়া। আমার ঘর এখন অন্য একজনের দখলে, পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলো তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে স্পষ্টভাবে। আমি আয়না নানুকে ডেকে বাজখাঁই গলায় বললাম,
-“আমার ঘরটা এমন গোয়ালঘর হয়ে আছে কেনো? কোন মানুষ এ ঘরে থাকতে পারে?”
আজহার দ্রুত ঘরে ঢুকলেন, তার ছড়িয়ে থাকা জামা প্যান্টগুলো গোছাতে গোছাতে বললেন,
-“ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে আনতে চলে গিয়েছিলাম। ঘর গুছাতে মনে নেই, তাছাড়া এ ঘরে কেউ আসে না। আমিই গুছিয়ে রাখি। তুমি একটু বাহিরে বসো, আমি এক্ষুণি সব গুছিয়ে দিচ্ছি।”
আমি নিরবে বেরিয়ে এলাম, আয়না নানু মুখ ঝামটা মেরে বললো,
-“জামাইরে এমনে বকলা কেন বইন? তুমি জানো সে সারাদিন কতো কাম করে? ঘরের কাম, বাইরের কাম সবই তো সে করে। এইতো এখন আবার যাইবো দোকানে দোকান থেইকা অফিসে। এই মানুষটারে এতো খাটানের মানে হয়?”
আমি অবাক চোখে আয়না নানুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, এইযে এতোমাস পর আমি এলাম, আয়না নানু একটুও আমাকে খেয়াল করলেন না! কিছুক্ষণ পর মা এসে শান্তস্বরে বললেন,
-“ছেলেটাকে আর কতো জ্বালাবি? আমাদেরই ভুল, মানুষ চিনতে ভুল করছি আমরা। তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ছেলেটার জীবন নষ্ট করলাম। এমন নামাজি, ভদ্র, কর্মঠ ছেলের কদর তো তুই করতে পারবি না। তোর দরকার ছিলো দিনরাত ঝাটাপেটা করে এমন জামাই, তাহলে তুই লাইনে থাকতি। মেয়ে মানুষের এতো তেজ কিসের?”
চলবে…
পর্বঃ ০৩
মা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন। নাঈমা সবে স্কুল থেকে ফিরেছে, দৌঁড়ে সে আমার ঘরে চলে গেলো। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, আজহার নাঈমাকে দেখে কাজ বন্ধ করে বিছানার কোনে বসলো। নাঈমা তার পাশে বসে আনন্দে হাত নেড়ে নেড়ে স্কুলের গল্প করছিলো। নাঈমার চোখে মুখে সে কি আনন্দের ছটা… আমি মুগ্ধ নয়নে ওদের দুজনকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজহার নামক মানুষটার মাঝে কিছু একটা আছে। যা তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে। এই যে আমার বাড়ির প্রতিটা মানুষ তাকে ভালোবাসছে, তার নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে। আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আজহার নামক লোকটাকে। কিছু মানুষ থাকে না? যাদের সব ভালো, আজহার মানুষটাও তেমন। ফজরের আযান দিলে নামাজ পড়ে হাঁটতে যায়, বাড়ি ফিরে নাস্তা করে দোকানে যায়। দোকান থেকে অফিস। মাগরীবের পর বাড়ি ফিরে নাঈমার সারাদিনের গল্প শুনে, মায়ের শরীরের খোঁজ নেন, আয়না নানুর সঙ্গে কি সব আলাপ করেন। রাতে খাবার পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে একটা সাদা মলাট মোড়ানো ডায়েরীতে খসকস শব্দ করে কি সব লেখেন। লেখা শেষে সে ডায়েরী লুকিয়ে তারপর ঘুমান। মাঝে মাঝে আবার ডায়েরীর জায়গা বদলও করেন। আমি অবশ্য এ কয়দিনে ডায়েরী লুকোনোর সব জায়গাগুলোই চিনে নিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবার হোস্টেলে ফিরে যাবার সময় ওনার ডায়েরীটা চুরি করে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমিও দেখি, রাত জেগে কি সব হাতি-ঘোড়া লেখা হয় এ ডায়েরীতে…
মোটামুটি পনেরো দিন বাড়িতে থাকার পর আমি গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, আজহার আমাকে বাসে তুলে দিয়ে গেলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উনি নিজের জন্য কখনোই আমার কাছে কিছু চান না। তবে এবার উনি চাইতে বাধ্য, ওনার রাত জাগার সঙ্গী ডায়েরীটাতো আমার কাছে। হোস্টেল পৌঁছতেই আমার পাশের বিছানার মিনতি এসে বললো,
-“বাড়ি গিয়ে এতোদিন থাকলি কেনো এবার নাফু? ইনকোর্সের তারিখ দিয়ে দিলো, কবে পড়বি, আর কি করে পরিক্ষা দিবি?”
খবরটা শুনে যেন মাথায় বাজ পড়লো, কতোশত পড়া বাকি, অথচ সময় খুবই কম। আমি যেনো অকুল পাথারে পড়লাম। ইনকোর্স, পড়া এসবের চিন্তায় আজহার সাহেবের ডায়েরীর কথা আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। মনে পড়লো ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য ব্যাগ গোছানোর সময়। এতোদিনে ধুলো পড়ে ডায়েরীর মলাটের সাদা রঙটা কেমন ফিঁকে হয়ে গেছে। সবাই ঘুমানোর পর টেবিল ল্যাম্পের আলোতে পড়তে শুরু করলাম ডায়েরীটা। প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নাম লিখেছে মানুষটা। কি সুন্দর হাতের লেখা, এ মানুষটার সবকিছুই এতো ভালো কেনো? এই যে হাতের লেখাটা, তাও কি সুন্দর। পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“বরাবরই আমি মন্দভাগ্যের মানুষ। অন্তত বাবা, মা আর দাদু মারা যাবার পর এটাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু আমার সব ভাবনাকে মিথ্যে প্রমান করলেন আমিনুল স্যার। কেমন করে যেনো এই চালচুলোহীন আমার মাথার উপর বটবৃক্ষের মতো ছাউনি হয়ে গেলেন তিনি। ওনার বড় মেয়ে নাফিসা, মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আসলে স্যারের মুখে সবসময় মেয়েটার সুনাম শুনতে শুনতে আজকাল তাকে আমি হিংসে করতে শুরু করেছি। কাউকে না দেখে হিংসে করা কেমন না!”
মুচকি হাসলাম আমি, আমাকে হিংসে করার কি হলো? মাথা খারাপ নাকি… পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
“আজ সকাল থেকে সব কেমন এলোমেলো লাগছে। ছোট চাচা চান আমি তার সঙ্গে ইউএসএ থিতু হই কিন্তু আজহার স্যারের মতো পিতৃতুল্য মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ে যাই কি করে? চাচা বলেছেন, স্যার আমার ভালো চাইলে নিশ্চয়ই আমাকে চাচার সঙ্গে যেতে বলবেন। উনি বলেছেনও তাই কিন্তু…”
আমার মনে হলো, আমি বাবাকে যতোটা মান্য করি নি তার থেকে বেশি মান্য করেছেন এই লোকটা। এতোটা যে, তার কথায় দেশও ছাড়তে পারেন।
“যাবার আগে স্যারকে বললাম, আমাদের বাড়িতে থাকতে। দাদুর শেষ স্মৃতি, যারতার হাতে তো ফেলে যেতে পারি না। স্যার রাজি হলেন তবে সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলেন। উনি প্রতিমাসে ভাড়া দেবেন আমাকে। আমি মানা করলাম, উনি বললেন দেখা যাবে। কিন্তু আমি জানি ওনার সেই দেখা যাওয়ার মানে উনি ভাড়া দেবেনই। মানুষটার প্রবল আত্মসম্মানবোধ তার প্রতি আমার সম্মান প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।”
বাবা আর তার আত্মসম্মানবোধ, আমার থেকে ভালো কে জানে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার শক্ত সমর্থ্য বাবার এ সুপ্ত কোমল দিকটা আমি কোনোদিন দেখতেই পাই নি। একজন অভিভাবকহীন মানুষকে কতো সুন্দর পথ দেখাচ্ছিলেন তিনি!
“ইএসএ আসার পর থেকে মনটা কেমন করছিলো। অথচ আশেপাশে সব আমার আপন লোক। চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোন। অথচ আমি অস্থির হয়ে পায়চারী করছি। আমার এ অস্থিরতার কারন টের পেলাম পরদিন আজহার স্যারের ফোন পেয়ে। এই ভিনদেশে আমার মন কেমন করছিলো বাংলাদেশে বসা আজহার স্যারের জন্য। ফোন পেয়ে আমি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছি। যে আমি দাদুর মৃত্যুর পর কোনোদিন কাঁদবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেই আমি কাঁদলাম। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো, ফোনের ওপাশে বসে স্যারও কাঁদছেন। মানুষটা আমায় এতো ভালোবাসে কেনো? স্যার ফোনে বলেছিলেন, “কাঁদলে হবে বেটা? মানুষ হতে হবে না? তোকে তো আমি পড়াশুনা করে অনেক বড় হবার জন্য ভিনদেশে পাঠিয়েছি। বুড়ো বয়সে তুইই তো হবি আমার অন্ধের যষ্টি।” আমার কি হলো কে জানে, আমি সেদিন থেকে প্রতিনিয়ত নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করতে লাগলাম। পড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করতাম, সে চাকরির টাকা দিয়ে নিজের পড়ার খরচ বাঁচিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেগুলোর কথা শুনেই স্যার বললো, ঢাকায় দোকান কিনতে। হয়তো আমার দেশে ফেরাটা নিশ্চিত করতেই এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজি হয়ে গেলাম, স্যারকে টাকা পাঠানোর পর অনেক খুঁজে সবচেয়ে ভালো দোকানটা আমার জন্য কিনলেন।”
এ লোকটা কর্মঠ জানতাম, কিন্তু এতোটা! তার উপর বাবার প্রতি তার ভক্তি তো চুড়ান্ত পর্যায়ের। আমার হঠাৎ মনে হলো, আমি বাবার মেয়ে হয়েও বাবাকে ততোটা বুঝি নি যতোটা উনি বুঝেছিলেন। নিজের অজান্তেই ওনার প্রতি সুপ্ত শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো।
“স্যারের সঙ্গে প্রতিদিনই নিয়ম করে আমার কথা হতো। একদিন স্যারের কণ্ঠটা কেমন বিষন্ন শোনালো। আমার বরাবরের চেনা স্যার কেমন ভোজবাজির মতো নিমিষে মিয়িয়ে গেলো। আমি তখন স্যারের চিন্তায় অস্থির। অনেক জোরাজুরির পর সব সংকোচ ভুলে স্যার বললেন, “আজহার, তুমি হয়তো ভাববা স্যার তোমার সরলতার সুযোগ নিতেছি। আসলে বাবা, স্যারের বয়স হইতেছে তো তাই মনের মধ্যে নানা কু’ডাক দেয়। মনে কষ্ট নিও না তুমি। দেশে ফিরা আসো বাবা, আমার মেয়ে বলে বলতেছি না, নাফিসা আমার সোনার টুকরা মেয়ে। রূপে, গুণে কোনো কমতি নাই। রাগটা একটু বেশি তবে তুমি ঠিক মানাই নিবা আমি জানি। বাবা কি রাগ করলা?” স্যার সবসময় আমার ভালো চেয়েছেন। ভালো শিক্ষা, ভালো পরিবার, ভালো দোকান, ভালো চাকরি। তবে এতোটা ভালো চাইবেন ভাবতে পারি নি। স্যারকে বাবা ডাকার লোভে কিংবা একটা পরিবার পাবার লোভে আমি নাফিসাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। স্যার অবশ্য আমি রাজি হবার পর নাফিসার একটা ছবি ফ্যাক্স করেছিলেন। মেয়েটাকে দেখে তো আমার মাথা ঘুরার অবস্থা, এতো মিষ্টি হাসির মেয়ে হয়? সেদিন থেকে আমার দেশে ফেরার অপেক্ষা শুরু, আমার স্বপ্নবধূকে প্রথমবার দেখার অপেক্ষা…”
স্বপ্নবধূ, কেনো যেনো শব্দটাকে বেশ মিষ্টি মনে হলো। এক মিষ্টতাপূর্ণ অনুভূতি আমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেলো। অনেক তেতো খাবার পর একটুখানি মিষ্টি মুখে পড়লে যে অনুভূতি হয়, ঠিক তেমন।
“আমার স্বপ্নবধূকে দেখার স্বপ্ন বুকে করে আমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম, কিন্তু আমার জন্য তখন এক অন্য পরিক্ষা অপেক্ষা করছে। একদিকে স্যারের শারিরীর অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে, অন্যদিকে আমার স্বপ্নবধূ রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। সে আমাকে বিয়ে করবে না… বড্ড অভিমান হলো, একজন মানুষকে না দেখে মুখের উপর মানা করে দিলো? তুমি এতো পাষাণ হৃদয়ের স্বপ্নবধূ? স্যার অবশ্য আশ্বস্ত করলেন আমাকে, যে করেই হোক নাফিসাকে উনি ফেরাবেন। ফেরালেনও… স্যারের তখন অবস্থা খুব খারাপ, উনি হাসপাতালে ভর্তি। আমি তখন দিনরাত এক করে স্যারের সেবাযত্ন করছি, হাসপাতালে রাত জাগছি। সেদিন সকালে টাকা নিতে বাড়ি এসেছি, শরীর ম্যাজম্যাজ করছিলো বলে গোসল সারলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি নাফিসা শুকনো মুখে সিএনজির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিচে নামলাম এবং সে মুহূর্তে নাফিসার প্রতি আমার অভিমানটা শত সহস্রগুণ বেড়ে গেলো। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম না, চুপচাপ সিএনজি ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে প্রস্থান করলাম। তার সহবোধের নমুনা দেখে অবাক না হয়ে পারি না, আমি না হয় চলে আসছিলাম কিন্তু সে আমাকে পিছু ডেকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না! স্যারের অবস্থা রাতে আরো খারাপের দিকে গেলো, বাসায় ফোন করে জানাতেই আয়না নানু চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলেন। আন্টি অবশ্য কিছু বলেন নি, শান্ত ছিলেন। তার এক ঘন্টা পর কল করে আন্টি আমায় দ্রুত বাসায় যেতে বললেন। বাসায় যাবার পর কাজী ডাকতে বললেন। আমি তখন হতবম্ব.. স্যারের এ অবস্থায় বিয়ে! তবুও আন্টির তাড়াতে সব হলো। শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে হলো আমার আর নাফিসার। একটা কবুল বলাতে নাফিসা আমার বউ হয়ে গেলো। আমার স্বপ্নবধূ, আজ থেকে আমার সত্যিকারের বউ। আন্টিকে আজ থেকে আমি মা ডাকার অধিকার পেলাম। বিশেষ করে স্যারকে বাবা ডাকার অধিকার পেয়ে আমার খুশির অন্ত ছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম স্যার আর নাফিসার সম্পর্ক ঠিক করবো। করলামও, কিন্তু প্রথম রাতেই বউয়ের চড় খেয়ে।”
চলবে…
পর্বঃ ০৪
ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো, মনে হলো চড় মারাটা আসলেই বেশি বেশি ছিলো। ঠিকই তো, সেদিন না গেলে বাবার সঙ্গে শেষবার কথা বলা হতো না।
“আমাদের বিয়ের পরদিন স্যার মারা গেলেন, মানুষটার মুখটায় কি অদ্ভুত দীপ্তি! বুঝতে পারছিলাম, সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তবেই তিনি চোখ বুজেছেন। তার পরদিন সকালে নাফিসা হোস্টেলে ফিরে গেল, স্যারের মৃত্যুতে তার এ প্রতিক্রিয়াহীনতা সত্যিই অবাককরা। স্যারের মৃত্যু শোক, নাফিসার অবহেলা সব মিলিয়ে পুরো পরিবারটা কেমন মরা গাছের মতো নেতিয়ে পড়লো। আমি শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরলাম। একদিন মা এসে আমাকে একটা একাউন্টের কার্ড দিলেন, বললেন, স্যার এতো বছরের বাড়িভাড়ার টাকা এ একাউন্টে জমা করেছেন আমার জন্য। আমি নিতে চাই নি কিন্তু মা যখন বললো, “ছেলের জন্য বাবা কিছু রেখে গেলে না করতে হয় না।” সত্যিই এ কথার পর আমি আর না করতে পারি নি। তবে টাকাটা আমি খরচ করেছি গ্রামে স্যারের নামে মসজীদ করতে গিয়ে। স্যার সম্ভবত নিজের সবটা সঞ্চয়ই আমাকে দিয়ে গেছেন নতুবা এতো টাকা তো বাড়া হবার কথা নয়…”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সত্যিই বাবা তার সবটা সঞ্চয় আজহার সাহেবকে দিয়ে গেছেন। সে সঞ্চয়ের বিনিময়ে দিয়ে গেছেন তার পরিবারের দায়ভার। বাবার সিদ্ধান্ত কতোটা সঠিক ছিলো তা আজ বুঝতে পারছি, বাবা সঠিক হাতেই তার পরিবারের খুঁটি দিয়ে গিয়েছিলেন।
“নাফিসা নেই, কিন্তু পুরো ঘরের পরতে পরতে তার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। সে স্মৃতি বুকে ধারন করেই আমি আমার স্বপ্নবধূর মানভঞ্জনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। আশায় থাকলাম সে আসবে, আমার সঙ্গে সব বোঝাপড়া শেষ করে সংসার জীবনের শুভ সূচনা করবে। সে এলো কিন্তু আমাদের সংসার জীবনের শুভ সূচনা হলো না। যেমন নির্বিকারভাবে এলো তেমন নির্বিকারভাবেই দিন কাটতে লাগলো। কাল আমার স্বপ্নবধূ চলে যাবে। সে যদি এমন নির্বিকারভাবে ফিরে যায়, আমার ধৈর্য্যে যদি না কুলোয়, যদি আমার দিশেহারা লাগে তখন কি হবে? আমার ছটফটানি, আমার মন কেমন করা, কিছুই কেনো তার মনে দাগ কাটে না? আমার দিকে কেনো তাকায় না সে, করুণা করেই হোক, একটু তাকাতো। এ পরিবারের সবাই আমায় কতো ভালোবাসে, সে কেনো একটু ভালোবাসতে পারে না? কেনো?”
ডায়েরীরতে আর কিছু লেখা নেই, কারন সেদিন রাতে উনি ঘুমোনোর পরই আমি ডায়েরীটা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম। নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হতে লাগলো। কতোটা অন্যায় করেছি আমি, নিজের সঙ্গে, ওনার সঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে। ডায়েরীর মাঝের দিকে ভেতর থেকে একটা ছবির কোনা বেরিয়ে আছে। ছবিটা হাতে নিলাম। ডায়েরী উল্টে দেখি সেখানে লাল কালিতে কিছু লেখা। পড়তে শুরু করলাম,
“নাফিসা, আমার স্বপ্নবধূ। মেয়েটার অনেক সুনাম শুনেছি, আজ নিজ চোখে দেখলাম তাও ছবিতে। কি মিষ্টি হাসি। আমি ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছি, নাফিসাকে আমি কোনো কাজ করতে দেবো না। বিদেশে থেকে রান্নাবান্না আমি তার তুলনায় ভালো পারি বলেই আশা করি। তাকে নিয়ে আমি বিশ্ব ঘুরবো তবে প্রথমে বাংলাদেশ ঘুরবো। জন্মভূমিকে না দেখে ভিনদেশ দেখার মানে হয় না। নাফিসার যখন যা লাগবে মেয়েটা আমার কাছে আবদার করতে পারবে। বিয়ের পর মেয়েটাকে একটা পরামর্শ দিতে হবে। এমন চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষকে পাগল করার মানে কি? একটু পর্দা করলেও তো পারে। তার সৌন্দর্য্য তো কেবল আমার জন্য হবে। আমার স্বপ্নবধূকে আমি মনভরে দেখবো, সারাদিন দেখবো। উঠতে বসতে বউ বলে ডাকবো। স্বপ্নবধূ কবে তুমি আমার সত্যিকারের বউ হবে?”
ডায়েরীটা বন্ধ করে ব্যাগে রাখলাম, ফজরের আজানের পরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাড়ি ফিরে দেখি এক হইহই রইরই ব্যপার। বাবা প্রতি বছর রোজাতে একদিন এলাকাল সবাইকে বাড়িতে ডেকে ইফতার করাতেন। বাবার মৃত্যুর পর এমন দায়িত্ব কাঁধে নেবার মতো সাহস বা শক্তি কোনোটাই এবাড়ির কারো মাঝে নেই। সুতরাং আমার ধারনা ছিলো এ পরম্পরার ইতি ঘটবে বাবার মৃত্যুর পরই। আজাহারকে দেখা গেলো আয়োজনের বিশেষ ভূমিকাতে। আমাকে দেখে নাঈমা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো, আজহার কাজের ফাঁকে একবার সম্ভবত চোখ তুলে তাকালেন, তারপর আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মা, আয়না নানু তারাও নানা রকম কাজে ব্যস্ত। আমাকে দেখে হেসে জড়িয়ে ধরলেন। মা বললেন,
-“দ্রুত গোসল সেরে কাজে লেগে পড়তো নাফু, দুপুরের পর থেকেই তো লোকজন আসা শুরু হবে। ছেলেটার কান্ড দেখেছিস? তোর বাবা যাদের যাদের ডাকতো খুঁজে খুঁজে সবাইকে বের করে ডেকেছে। আমি ভেবে পাই না, তোর বাবার নাড়ি নক্ষত্র এ ছেলে এমন মুখস্ত করলো কি করে! অদ্ভুত কান্ড।”
ইফতারের পর সবাই সবার মতো বাড়ি ফিরে গেলো। ক্লান্ত আফজাল সাহেব গোসল করে বের হয়ে ঘরে আমাকে দেখে যেন থমকালেন। অবাকস্বরে প্রশ্ন করলেন,
-“তুমি সত্যিই এসেছ নাফিসা?”
আমি মুচকি হেসে তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-“বিশ্বাস না হলে ছুঁয়ে দেখুন।”
উনি অবশ্য ছুঁলেন না, তবে হাবভাব দেখে মনে হলো আমার উপস্থিতি বিশ্বাস করেছেন। বিছানায় একহাত দুরত্বে আমার পাশে বসলেন তিনি, ক্ষীণস্বরে বললেন,
-“তখন তোমাকে দেখে ভাবলাম ভুল দেখছি। হয়তো আমার ভ্রম তুমি। এখন দেখছি সত্যিই এসেছ। তা কতোদিন থাকবে? ঈদের পরেই ফিরে যাবে?”
আমি মুচকি হেসে ওনার গা ঘেষে বসলাম, বললাম,
-“ভাবছি এবার আর যাবো না। একেবারে পরিক্ষার সময় গিয়ে পরিক্ষা দিবো।”
আমার দিকে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আফজাল সাহেব। হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না আমার কথা। তাই আমি আবার বললাম,
-“আমি চলে গেলে তো কেউ একজন তার স্বপ্নবধূর শোকে ডায়েরীর পাতায় পাতায় অভিমান ঝরায়।”
আফজাল সাহেব সম্ভবত এতোক্ষণে তার ডায়েরীর সঠিক হদিস পেলেন, তিনি মাথা নিচু করে এক হাতে আরেক হাতের নখ খুটতে লাগলেন। আমি ওনার পাশে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলাম। বেশ ভূমিকা নিয়ে বললাম,
-“শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে করেই এতো জল্পনা কল্পনা করে ফেললেন? আইনি কাগজপত্র সামলাবে কে? বলি বিয়ের রেজিস্টার ছাড়া আজকাল বিয়ে সম্পন্ন হয়?”
উনি মিনমিন করে বললেন,
-“দ্রুতই করে ফেলবো।”।
একটু ইতস্তত করলেন সম্ভবত। তারপর বললেন,
-“আমার ডায়েরীটা আমাকে ফেরত দেবে?”
-“দেবো, তবে এক শর্তে।”
-“কি শর্ত?”
-“ডায়েরী লুকোনো যাবে না। নির্দিষ্ট জায়গায় থাকবে। আমার যখন মন চাইবে আমি পড়বো।”
-“তুমি তো পড়েছো।”
-“আবার পড়বো, বারবার পড়বো।”
উনি চুপ হয়ে গেলেন, মেঝেতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। আমি সটান তার কোলে শুয়ে পড়লাম। উনি এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলেন, হয়তো আমার দিকে তাকানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিলেন না। আমি চোখ বুজে গম্ভীরস্বরে বললাম,
-“আমাকে গল্প শোনাবেন?”
-“কিসের গল্প?”
-“আমার বাবার গল্প। আমার বাবার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় আপনি। আপনার সামনে বাবা যেভাবে উন্মুক্ত পুস্তকের মতো উপস্থাপন করেছেন আমাদের বেলায় তার ঠিক উল্টো। তাই বাবার সেই বিশেষ দিকটি আমি জানতে চাই, আমার বাবাকে আমি নতুন করে চিনতে চাই।”
উনি সারারাত বসে বসে আমাকে বাবার গল্প শোনালেন, বাবার মৃত্যুর প্রায় সাতমাস পরে আমি প্রথমবার বাবার জন্য কাঁদলাম। মন খুলে কাঁদলাম, উনি পুরোটা সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন। ফজরের আজানের পর নামাজ পড়া হলে বললেন,
-“নাফিসা, স্যারের একটা প্রিয় জায়গায় যাবে?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম, তারপর ওনার হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে চললাম। বাবা যে কলেজে চাকরি করতেন তার পাশেই একটা কচুক্ষেত। কচুপাতায় ভোরের শিশির পড়ে আছে। কি মনোরম সে দৃশ্য। আজহার আমার একহাত শিশিরে ছুঁয়ে দিতেই আমি শিউরে উঠলাম। সামান্য শিশির বিন্দুতে কি অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি! আজহার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিশির দেখলো আর আমি আজহারকে। মানুষটাও তো এই শিশির বিন্দুর মতো, কেমন অদ্ভুতভাবে সবার মন ছুঁয়ে যায়। প্রথমবার দেখা হবার পর কে ভেবেছিলো সেই এক ঝলক দেখা আগন্তুক আমার জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে যাবেন! তবে শিশির বাষ্প হয়ে যাবার পরও যেমন কচু পাতায় শুকনো দাগ রয়ে যায় তেমন আজহার নামক মানুষটার ভালোবাসার দাগ আমার মনে থেকে যাবে আজীবন। আজহারের স্বপ্নবধূ তার বাহুডোরে আজীবনের জন্য বন্দি হয়ে রইবে…
“শেষ”
May be an image of 1 person and text

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..