1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৭:১৬ পূর্বাহ্ন

# মুখোশ ### তানজিনা আফরিন টুম্পা

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ, ২০২১
  • ৩২৪ বার
তন্নি আজকে ওর ছোট খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছে। খালা রান্না করছে,তন্নি ওর খালাতো বোনের সাথে কথা বলছে।অনেকদিন পর আজকে বোনের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
একটু পর খালা ওদেরকে খাওয়ার জন্য ডাকল।খালা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে।ভাত,ডিম ভুনা,চিংড়ি দোপেয়াজা,মুরগীর গোশত রান্না করেছে খালা আর সব খাবার সাজিয়ে ওদেরকে খাওয়ার জন্য ডাকলো।খালা তন্নিকে খেতে বলল।
তন্নি খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে কি দিয়ে শুরু করবে।
খালা:কিরে,শুরু কর।তোর জন্যই এত কিছু করলাম।
তন্নি:তুমিও বসো খালামুনি। একসাথে খাই সবাই।
অনি:আরে,মা তো বাবার সাথে খাবে।তুই আর আমি চল খেয়ে নেই।এরপর বাইরে যাব।
খালা:অনি ঠিক বলেছে।আমি তোর খালুর সাথে পরে খেয়ে নিবো।তোরা খাওয়া শুরু কর।
তন্নি একটু হেসে খাওয়ার জন্য প্লেটটা নিল।অনেক ভেবে চিংড়ি দিয়ে খাওয়া শুরু করল আর ওমনি খালা ডিম দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল।
খালা:কিরে,ডিম দিয়ে খেয়ে দেখ,ভালো লাগবে।
তন্নি:না খালামুনি, আমি ডিম দিয়ে খাবো না।শুধু চিংড়ি দিয়েই খাবো।
অনেক বলেও খালা তন্নিকে ডিম দিয়ে খাওয়াতে পারল না।খালা কত বলল ডিম,ডাল নেয়ার জন্য কিন্তু তন্নি আর কিছু নিল না।খালা আর কিছু বলল না।
তন্নির চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে,আজ কতদিন পর চিংড়ি দিয়ে ভাত খেলো।বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।
করোনার সময়ে হুট করেই তন্নি জবটা ছেড়ে দিলো।ট্রান্সফার ইস্যু ছিল,এতদিন একটা জায়গায় জব করেছে কিন্তু কেউ একটু সাহায্য করল না।তাই কিছু না ভেবেই জবটা ছেড়ে দিয়েছিল।আর করোনা শুরু হয়ে গেলো।আর জব মার্কেটের যে অবস্থা,ভালো কোন জব অফার আর পেলো না।বেকার বসে আছে। বাবার বয়স হয়েছে,রিটায়ার করেছে বহুদিন হলো।মায়ের শরীরটাও বেশি ভালো না।এই দুইজনকে নিয়েই তন্নির বেচেঁ থাকার লড়াই চলমান।এতদিন সংসারের হাল ধরেই ছিল,হুট করেই জব না থাকায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
অনি:কিরে,তুই কি চিংড়ি দিয়েই খাবি?অন্য কিছু দিয়ে ট্রাই কর।
তন্নি:হা,খাচ্ছি।আচ্ছা অনি,তোকে বলেছিলাম না,আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে।তুই তো ভালো জায়গায় জব করছিস।দেখনা বোন কিছু করতে পারিস কিনা।
অনি:ওহ,মনে আছে আমার তোর কথা।আসলে কি জানিস,আজকাল জব পাওয়া অনেক কস্ট।আমি বড়জোর তোর সিভি জমা দিতে পারব।এর থেকে আসলে বেশি কিছু করা পসিবল না।
তন্নি:ওহ,আচ্ছা।তন্নির চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে বার বার।খালার বাসায় আসার কারন ছিল যদি বোনের সাথে কথা বলে একটা কাজ পেতে পারে সেই আশায়।সব আশা গুড়েবালি।আসার সময় মাটির ব্যাংক ভেংগে মা কিছু টাকা দিয়েছিল,সেই টাকায় কোনরকম বাসে করে এসেছে।রিক্সায় আসা-যাওয়ার পথটুকু হেটে এসে টাকাটা জমিয়ে ভেবেছে যাওয়ার সময় কিছু সবজি কিনে নিয়ে যাবে।গলা দিয়ে খাবার নামছে না তন্নির।বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে বারবার।চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার পরে সংসারে অভাবের তাড়নায় শুধু ডিম,ডাল আর ভাত খেতে খেতে ভালো খাবারের কি স্বাদ সেটা ভুলেই গেছে।
খালা তো আর জানে না সে কথা,কেউ জানেনা।সবাই জানে কষ্টে আছে কিন্তু ভেতরের কথা তো আর কেউ বুঝে না।আবার কে জানে হয়তো বুঝেও না বুঝার ভান করে।তন্নির শুধু মনে হচ্ছে আজকে মা-বাবা সাথে থাকলে পেট ভরে চিংড়ি দিয়ে ভাত খেতে পারতো।কতদিন ভালো কিছু খায় না।বাবা ডিম,আলুভর্তা দিয়ে খেতে পারে না।ঝাপসা চোখে খাবারের দিকে তাকিয়ে তন্নির গলা দিয়ে আর খাবার নামতেই চায় না।
খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ থেকে তন্নি খালার বাসা থেকে বের হয়ে আসলো।বাজারে গিয়ে আজকে কিছু কিনে নিয়ে যাবে সেজন্য।সিড়ি দিয়ে নেমেই বুজলো ভুলে মোবাইল রেখে চলে এসেছে।উপরে উঠে কলিংবেল বাজানোর আগেই বাইরে থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে খালা আর অনির কথোপকথন।
খালা:আপদ বিদায় হয়েছে।ভাগ্য ভালো যে টাকা চায় নাই।আমি তো ভেবেছিলাম টাকা না চেয়ে বসে।
অনি:উফফ মা,সি ইজ জাস্ট আ পেইন।আমি একটা ভালো জায়গায় জব করি তো কি ওর মত মেয়েকেও আমি আমার অফিসে জব দিবো?নো ওয়ে।দেখা হলেই খালি জবের ব্যবস্থা করে দে।অসহ্য লাগে আমার।
খাল:একদম না।ভাগ্যিস তোর বাবা ছিল না।উনার তো আবার দিল দরিয়া।
অনি:আই জাস্ট হেইট হার মা।বাবা সবসময় আমাকে ওর সাথে তুলনা করত।আমিও তাই ওকে বুঝাতে চাই যে আমি ওর থেকে সব কিছুতেই বেটার।
খালা:আরে তোর বাবা তো জানিস কেমন।তবে আমার কথামত তুই তোর রাহাত আংকেলের মনো চাহিদা পূরন করেছিস বলেই কিন্তু এত্ত ভালো একটা জায়গায় জব পেয়েছিস।
অনি:ইয়েস মা,সেটা আমি জানি।আর এইজন্য আমি উনাকে কখনো নিরাশ করব না।তাইতো আজকে সন্ধায় আসতে বলেছি।
খালা:আমি জানি আর এই জন্যই খাবার আগে থেকেই রান্না করে ফেলেছি।তোরা তো বাইরের খাবার খাবি আর তোর বাবা তো ঘরের খাবার ছাড়া কিছু খেতে চায় না।
অনি:হুম,ভাগ্যিস তন্নি আগেই চলে গেছে নাহলে ওকে নিয়ে আবার শুধু শুধু বাইরে গিয়ে টাইম নষ্ট করতে হত।
খালা:আসলেই, যা তুই রেডি হয়ে নে।আমিও একটু হালকা পাতলা রেডি হই।বলেই দুইজনে মিলে অট্টহাসিত ফেটে পড়লো।আর এদিকে বাহির থেকে সব শুনে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তন্নি।নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।এতক্ষন যা শুনলো এরপর আসলে আর কিছু বলার থাকে না।চোখ থেকে নোনা জল অবাধে গড়িয়ে পরছে আর চিবুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।তবু অনেক কষ্টে নিজের চোখ মুছে কলিংবেল বাজালো।খালা দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে সেটা উনার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
তন্নি:আমার ফোনটা ভুলে রেখে গিয়েছিলাম।সেটা নিতে এসেছি।
খালা:ওহ হো,তাই বল।ভেতরে আয়।
তন্নি:না,তুমি আমার ফোনটা দিয়ে দাও,চলে যাবো।
খালা ফোন আনার আগেই অনি ফোন নিয়ে এসে হাসি দিলো।কিন্তু তন্নি হাসলো না।তন্নি অনেকক্ষণ দুজনকে ভালোমত দেখে ভাবতে লাগলো কিভাবে পারে এরা।আমার সামনে এত্ত ভালো কথা আর পেছনে উনারা আমাকে কি ঘৃনা করে।ওদেরকে চুপচাপ দেখে আর কিছু না বলেই তন্নি বের হয়ে আসল।পেছনে ফিরে তাকালে হয়তো দেখতে পেতো অবাক হয়ে অপ্রস্তুত চেহারা নিয়ে দুজন নারী তন্নির গমন পথে চেয়ে রয়েছে।
বাইরে এসে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় হেটে যেতে লাগলো।আজ চোখদুটো কোন বারন শুনবে না।না শুনুক,নোনা জলের অবাধ নিঃসরনে যদি মনের কষ্ট হালকা হয় তাও ভালো। মনের জ্বালা মিটে যাবে,কিন্তু যে ক্ষত হয়েছে সেটা কি করে সারবে?এই প্রশ্নের উত্তর তন্নির জানা নেই।
বাসে করে এসে বাজারের দিকে নামলো তন্নি।কিছু সবজি কিনে নিলো আর নিজের কিছু জমানো টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে একটা মুরগী কিনে নিল।আজ নিজ হাতে রান্না করে মা-বাবাকে খাওয়াবে।
বাসায় ঢুকতেই মায়ের হাসি মাখা মুখ দেখে তন্নির মনটা ভরে গেলো।
মা:কিরে,তোর মুখ চেহারা এত্ত ফোলা কেনো?বাইরে কি অনেক গরম?চেহারাটা শুকনা লাগছে।
তন্নি:হুম
মা:এত্ত চুপ কেনো?আর বাজার করার টাকা পেলি কোথায়?অনির মা দিয়েছে তাই না?
তন্নি কিছু বলতে পারল না।মায়ের চোখদুটো চিকচিক করছে খুশিতে।ভাবছে নিজের বোন হয়তো ওদের কষ্টের কথা ভেবে সাহায্য করেছে।আদতে কেউ কোন সাহায্য করে নাই,করে না আর করবেও না সেটা তন্নি জানে।কিন্তু এই মূহুর্তে মায়ের এই খুশি মাখা মুখ দেখে তাকে সত্যি কথাটা বলার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও সেটা মাটিচাপা দিয়ে দিলো তন্নি।হেসে বলে উঠলো-
তন্নি:তো আর কে দিবে?খালা আমাকে কত আদর করলো আর টাকা দিয়ে দিলো যেন তোমাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাই।
মা:আমি জানতাম,আমার বোন আমার দুঃখ বুঝবে।বলেই শাড়ির আচঁল দিয়ে চোখদুটি মুছলো আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।তন্নি মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর ভাবতে লাগলো।এই পৃথিবী আসলেই অনেক রহস্যময়।সবাই মুখোশের আড়ালে নিজের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে।সে নিজে মুখোশ পড়ে নিজের কষ্ট ভুলে মিথ্যা বলে মাকে সান্তনা দিলো,খালা আর অনি মিথ্যা মুখোশের আড়ালে নিজেদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখলো আর আমার জন্মদাত্রী মা যে কিনা সবটা জানে যে উনার বোন কখনো এমন সাহায্য করবে না আর করেও নি তবুও সে মনে করে যে একদিন করবে।আর সবসময় এই ভুল ধারনা নিয়েই মিথ্যা অভিনয়ে সুখী থাকার নাটক করে।
আমরা কি কখনো এই মুখোশের আড়াল থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে আসতে পারব না….

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..