1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৬:০৬ অপরাহ্ন

ধারাপাত নামতা (পর্ব -এক), ( পর্ব -দুই) ও (পর্ব:তিন) – – – ফারহানা ফ্লোরা

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩
  • ১৬৯ বার
ধারাপাত নামতা(পর্ব -এক)
যেদিন প্রথম আমি শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি, সেদিন ভাবতেও পারি নি উপজেলার এত ভিতরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।বাসা থেকে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ডে হেঁটেই এসেছিলাম,এরপরে বাসে, সীট পাইনি।জীবনে প্রথম বাসের হাতল ধরে ঝুলে বাসজার্নি করা,এরপরে প্রায় ১২/১৩ কিলোমিটার বাসে এসে অত:পর ভ্যানযোগে রোওয়ানা দেয়া।ভ্যানওয়ালাকে বলেছিলাম “মাহানপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ” চিনেন? তিনি জানালেন এই নামে অত্র এলাকায় কোনও স্কুল নেই।প্রথমে হতাশ হলাম।এরপরে আমি জানালাম, দাদা,আমি তো গতকাল খবর নিয়েছি, এই এলাকাতেই এই নামে স্কুল রয়েছে।উনি ইতস্তত করে বললেন” ভগবানের নাম নিয়ে উঠেন আপা ভ্যানে,দেখি একটা স্কুল আছে অনেক ভিতরে”… আমি কথা না বাড়িয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে বসলাম ভ্যানে।গল্পে গল্পে জানতে পারলাম ভ্যান ওয়ালার নাম ভরত রায়। তার এক ছেলে এক মেয়ে,বউ ভারী লক্ষী মেয়ে।অনেক গল্প হয়ে গেল কিন্তু রাস্তা শেষ হয় না কেন? গ্রামের রাস্তায় ঢুকেছি প্রায় ২৫ মিনিটের মতো,চলছে তো চলছেই।রাস্তার দুপাশে ভুট্টা ক্ষেত,আলু আর গম।পুকুরের পানিতে পাট জাগ দেয়া,পুকুরের পাশ দিয়ে যেতেই ভ্যাপসা গল্প নাকে এলো।আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম” দাদা,সত্যি কি স্কুল আছে? না-কি অযথা খোঁজাখুঁজি করছি?”…ভ্যানওয়ালা জানায় অনেক ভিতরে একটা স্কুল আছে সেই স্কুলের নাম ” পানুয়াপাড়া”.. আমি তো খুঁজছি “মাহানপুর -২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় “… ভ্যানওয়ালা নিয়ে যাচ্ছে “পানুয়াপাড়া স্কুলে”… আমি তো রীতিমতো রেগে গিয়ে বললাম দাদা,আপনাকে কি আমি পানুয়াপাড়া স্কুলের নাম বলেছিলাম? ভরত দা পিছনে ফিরে একগাল হেসে বল্ল” আপা,আপনি স্কুল টা দেখলেই বুঝতে পারবেন,স্কুলের ভাল নাম সেটাই আপনি যেটা বলেছেন,এই স্কুলে কেউ চাকরি করতে আসে না আপা,অনেক দূর তো,অনেক আপা আসে,চলে যায়।শুধু হেডস্যার আছেন,উনার বাড়ী পাশের গ্রামেই। আর একজন আপা আছেন মুনিরা লায়লা নাম,উনার বাড়ীও পাশের গ্রামে।আপনি তো মনেহয় বেশিদিন এই এলাকায় টিকতে পারবেন না আপা।”আমি তার কথা শুনে একটু রাগই হলাম।বললাম” টিকতে পারব না মানে?আমি তো এখনো স্কুলটাই দেখলাম না,আমি নতুন চাকরি পেয়েছি,কত্ত আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে চাকরি তে জয়েন করতে যাচ্ছি আর আপনি আমাকে এরকম হতাশাজনক কথা শুনাচ্ছেন,আগে আমাকে যেতে দিন,কথা না বলে দয়া করে জানান এত ভিতরে আদৌ কোনও স্কুল আছে কি-না, নাকি আমরা ভুল পথে এগোচ্ছি?”… ভ্যানওয়ালা নীরবতা পালন করছে।আমি গ্রামের ভিতর ঢুকে পড়লাম।শান্ত,ছায়াঢাকা সবুজ একটা গ্রামের ভিতরে ঢুকে ধানের গন্ধে,লাউ শিমের ঝুলানো লতা দেখে মনে মনে ভাবছিলাম ভুল পথে এলে এসেছি,কিন্তু জায়গাটায় কেমন যেন মায়া মায়া ভাব আছে।অত্র স্কুলের সভাপতি গ্রামের শান্তপথে দাঁড়িয়ে ছিলেন হয়তো আমারই জন্য।মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক, মাথায় সাদাকালো চুল,মুখে স্নিগ্ধ হাসি।ভ্যানওয়ালাকে স্লো করতে বলে আমার উদ্দেশ্যে বললেন” আসতে কোনও অসুবিধা হয় নি তো মা?,জানি তুমি শহর থেকে আজ আসবে,ভাল একটা কিন্ডারগার্টেনে তুমি শিক্ষকতা করতে,তোমার অপেক্ষায় পুরো গ্রাম আজ তাকিয়ে আছে পথপানে।যাও মা,সামনেই তোমার স্কুল।”… এত সুন্দর করে, এত গুছিয়ে, এত মায়াময় কন্ঠে বাবা বয়সী কেউ আমাকে ” মা”.. সম্বোধন করবে ভাবতেও পারিনি,মন টা যেন ভরে গেল।মনে হল যেন আকন্ঠ কোনও মধুর পানিয় পান করে সবে তৃষ্ণামুক্ত হলাম।ভ্যানওয়ালা সামনে চলতে শুরু করলে আমি জিজ্ঞেস করলাম” উনি কে দাদা?”… ভরত দা উত্তর দিল” উনি মাধব কাকা,উনি ওই স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন, এখন রিটায়ার্ড করছে।”… আমি ওহ সূচক শব্দ করলাম।আরেকটু সামনে এগোতেই দেখি গ্রাম বাংলার চিরচেনা দৃশ্য… মহিলারা দল বেঁধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আমার ভ্যানের আসার জন্য অপেক্ষারত।কাছে আসতেই ভ্যানওয়ালা গতি থামিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বল্ল” তোমার নয়া আপা”… মানে হল আপনাদের নতুন আপা এসেছে।মহিলারা হাসিমুখে আমাকে শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানাচ্ছেন,কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে স্পর্শ করার জন্য।আমি হাত বাড়িয়ে যেটুকু ছোঁয়া যায়,হাত নেড়ে হাসিমুখে স্কুলের দিকে এগোতে বললাম।আরেকটু সামনে গিয়েই দেখলাম পানুয়াপাড়া স্কুল… যার নাম মাহানপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,যেই নাম টা নিয়োগ আদেশ এ ছিল। বিদ্যালয়ের নির্মান অথবা সংস্কার কাজ চলছিল।অবশেষে আমার প্রথম যোগদানের বিদ্যালয়টি খুঁজে পেলাম।
ধারাপাত নামতা( পর্ব -দুই)
স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ কাজ চলছিল তাই পাশে টিন শেডের তিন টি অস্থায়ী কক্ষে পাঠদানের কাজ চলছিল।প্রথম,দ্বিতীয় আর পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছিল।প্রধান শিক্ষক একাই স্কুলে ছিলেন।অন্য আরেক সহকারী সি ইন এড প্রশিক্ষণে ছিলেন আর আমার জন্য পদটি শূন্যপদ ছিল।হেড স্যারের সাথে দেখা করতেই উনি বললেন ” এসো, তোমার কাজ বুঝে নাও, আমি অফিসের কাজে শিক্ষা অফিসে যাব।” আমি সালাম দিয়ে স্যারের দেখানো শূন্যস্থানে আমার নাম স্বাক্ষর করলাম।স্যার শিক্ষা অফিসে চলে গেলেন,তখন বেলা এগারোটা। আমি একা একটি স্কুলে, তিনটি কক্ষে ক্লাস,বুঝতে পারছিলাম না কি করব।মাঠে নেমে সকল ছাত্রছাত্রীদের ডাকলাম।সবাই দৌড়ে ছুটে এলো এটা বলতে বলতে ” নতুন আপা,নতুন আপা,চল সবাই মাঠে চল”… আমাকে ঘিরে সবাই দাঁড়ালো,বিস্ময়ের চোখে আমাকে দেখতে লাগলো,আমি বললাম” একটু ফাঁকা হয়ে দাঁড়াও তো আমরা একটা খেলা খেলব।”… ছেলেমেয়েদের কৌতুহল যেন আরো বেড়ে গেল।আমি বললাম সবাই আমাকে ঘিরে হাত ধরে বড় একটা বৃত্ত হয়ে দাঁড়াও।সবাই কথা মত কাজ করলো। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা একটু এলোমেলো করছিল,পঞ্চম শ্রেণির কিছু চৌকস ছেলেমেয়ে ছিল তারা ওদের হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছিল।সবার দাঁড়ানো শেষে আমি বললাম ” আমার কিছু সাদা কাগজ,একটা কলম লাগবে,তোমাদের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির একজন বৃত্ত থেকে বের হয়ে কাগজ আর কলম নিয়ে এসো।”… বলা মাত্র কাজ হল,বাকিরা সবাই আগ্রহ নিয়ে আমাকে খেয়াল করছিল,আমি কি করতে চাচ্ছি,প্রথম দিন স্কুলে এসেই কি খেলতে চাচ্ছি,নানা রকম প্রশ্ন তাদের মনে খেলা করছিল।সৌরভ নামে এক ছাত্র সাদা কাগজ আর কলম নিয়ে এলো।আমি গোল হয়ে দাঁড়ানো সকল ছাত্রছাত্রীদের এক এক করে নাম লিখলাম বড় বড় করে,সাথে আমার নাম ও লিখলাম।এরপরে যার যেটা নাম সেটা স্ট্যাপলিং করে স্কুলের পোশাকে গেঁথে দিলাম,এরপরে আমার নামটাও স্ট্যপলিং করে আমার পোশাকে সেঁটে দিলাম।সবাই নিজ নিজ নাম নিজ নিজ পোশাকে সেঁটে থাকতে দেখে খুশি হল।এরপর আমি বললাম এবার আমরা হাতে তালি দিয়ে সবার নামগুলো বলব।এই খেলার নাম হল “বন্ধু তোমাকে চিনি “.. আমরা যদি সবাই সবার নাম বলতে না পারি,তাহলে কি আমরা বন্ধু হতে পারব?প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম তাদের কে।তারা একসাথে বলে উঠল ” না আপা”.. হ্যাঁ, এ কারনেই আমরা নাম বলার খেলা খেলব।প্রথমে আমার নাম সবাই বলব আর হাতে তালি দিব, আমার ডানপাশে যার নাম এরপরে তার নাম বলব,তার ডানপাশে যার নাম তারপর তার নাম বলব,এভাবে পর্যায়ক্রমে সবার নাম বলা শেষ হলে খেলা টি শেষ হবে।সবাইকে একসাথে নাম বলতে হবে আর হাতে তালি দিতে হবে।যে পরে নাম বলবে বা পরে হাতে তালি দিবে সে খেলা থেকে আউট হয়ে যাবে,সে বৃত্ত থেকে বের হয়ে দূরে গিয়ে বসে থাকবে।এই নির্দেশনা দিয়ে আমি আরেকবার বললাম ” এবার তোমরা দেখ,আমি শুরু করছি,প্রথমে হাতে তালি দিলাম তিন বার ছন্দে ছন্দে বললাম আমার নাম ফারহানা,ফারহানা,পরের বন্ধু শিউলি,শিউলি,পরের বন্ধু পারভিন পারভিন,পরের বন্ধু রনি রনি… এভাবে আমার নাম দিয়ে শুরু হবে,আমার ডানপাশে যার নাম আছে তার নাম হবে।সবার নাম দুইবার করে উচ্চারণ করতে হবে,হাতে তালি দিয়ে দিয়ে ছন্দ মিলিয়ে বলতে হবে। খেলাটি কেমন লাগছে তোমাদের?”…ছাত্রছাত্রীরা একসাথে বলে উঠল” খুব ভাল লাগছে আপা”… আমি বললাম ” এবার তাহলে খেলাটি শুরু করি?”…
বন্ধু তোমাকে চিনি” খেলাটি শেষ হতে হতে প্রায় আধাঘন্টা চলে গেল।আমরা একে অন্যের নাম জানতে পারলাম।ছাত্রছাত্রীরা আমার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো অল্প সময়ের মধ্যে।বেলা ১২ টায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছুটি হয়ে গেল।ছুটি পেয়েও যেন তাদের বাসায় যেতে মন চাচ্ছিল না।বারবার আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল আর বলছিল” আপা,কালকে কিন্তু আবার খেলা দেখাবেন।”আমি হেসে বললাম” আমি তো খেলা দেখাতে আসি নি সোনা মনিরা, একসাথে খেলতে এসেছি,তোমরা সবাই প্রতিদিন স্কুলে এসো,রোজ আমরা একবার খেলব,ঠিকাছে? এখন ভালো ছেলেমেয়ের মত রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে বাসায় চলে যাও,আগামীকাল আবার দেখা হবে।”…
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছেলেমেয়েদের যাওয়ার সাথে সাথে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির আগমন ঘটে।চরম বিস্ময় নিয়ে আমাকে তারা মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে,যেন অচিন গ্রহের অন্য কোনও প্রাণী এসেছে।পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা তাদের উদ্দেশ্যে বলে” হামার নয়া আপা রে,খুবে ভালো, আসিয়ায় খেলা করাইছে।”…. তারা আঞ্চলিক ভাষায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বলে যে উনি আমাদের নতুন আপা,উনি খুবই ভালো, প্রথমদিন এসেই উনি খেলা করিয়েছেন।”… আমি সবাইকে নিজ নিজ ক্লাসে বসতে বললাম।তৃতীয় শ্রেণিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ” আমাকে তাদের নতুন আপা হিসেবে মেনে নিতে কোনও আপত্তি আছে কি-না। “… তারা সবাই “না” সূচক মাথা নাড়ায়,মানে আপত্তি নেই।প্রথমে তাদের কাছে একটা গান শুনতে চেয়েছিলাম।সামনে কেউ আসছিল না।একজন আরেকজন কে দেখিয়ে বলে ” আপা,সুমি ভাল গান পারে”.. আমি সুমি কে ডাকি,আসে না।এরপর ননি গোপাল ভালো গান পারে,কেউ একজন বল্ল,তাকে ডাকলাম, সেও এল না।তখন আমি বললাম ” আসলে আমিও গান পারি না,তবে আমরা সবাই শিখব কেমন?”। তখন সবাই দেখলাম অনেক টা সহজ হলো। তাদের ধারণা ছিলো তারা যেটা গাইবে,সেটা যদি ভুল হয়,আমি যদি তাদের ভুল ধরি,পুরো ক্লাসের সামনে অপমানিত বোধ হতে পারে,এইভেবে আমার কাছে এসে গান গাইতে কেউ রাজি হচ্ছিল না।কিন্তু যখন
বললাম যে আমিও গান গাইতে জানি না,আমরা শিখে নিব তখন যেন সবাই আস্বস্ত হল।অত:পর তৃতীয় শ্রেণিতে বাংলা বই প্রবন্ধ দেখে দেখে দুই পৃষ্ঠা করে হাতের লেখা লিখতে বলে চতুর্থ শ্রেণিতে গেলাম।গিয়ে দেখি তারা ব্ল্যাকবোর্ডে বড় বড় করে লিখেছে” ফারহানা আপার আগমন,শুভেচ্ছা স্বাগতম। “… আমি তো রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম।আমাকে দেখে তারা উঠে দাঁড়ালো,” গুড মর্নিং বল্ল”… আমিও গুড মর্নিং বললাম।এরপরে তাদের কে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম” গুড মর্নিং মানে কি বলত?”… তারা সবাই একসাথে বল্ল ” শুভ সকাল”… আমি বললাম” খুব ভাল, তোমরা সবাই সঠিক বলেছ।আমাকে যে তোমরা গুড মর্নিং বললে,এখন কি সকাল না-কি দুপুর?”… একজন চঞ্চল মতো ছেলে দাঁড়িয়ে বল্ল” এখন তো সকাল আর নাই আপা,এখন দুপুর।কিন্তু আপা আপনিও তো আমাদের কে গুড মর্নিং বলেছেন।আপনি কেন ভুল করলেন?”… আমি বললাম,” অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি গুড মর্নিং বলেছি কারণ তোমরা আমাকে বলেছ।আমি যদি গুড আফটার নুন বলতাম,তাহলে তোমরা গুড মর্নিং শব্দ টা আর কখনোই বলতে না।মনে করতে এটা একটা ভুল শব্দ,ভুল বাক্য।আসলে ওটা তো ভুল শব্দ বা ভুল বাক্য নয়।আমাদের প্রয়োগ টা ভুল হয়েছে।তোমাদের সাথে আমিও ভুল প্রয়োগ করেছি।একসাথে ভুল করেছি।কি মজার ব্যাপার তাই-না? “..পুরো ক্লাস একসাথে হেসে উঠলাম।কি সহজ সরল গ্রামের শিশুগুলো।এদের সাথে সময় কাটাতে চাকরির প্রথমদিন আমার বেশ লাগছিল।এদের কেও বাংলা বই দেখে দেখে হাতের লেখা লিখতে বলে পঞ্চম শ্রেণিতে গেলাম।তারাও বোর্ডে বড় বড় করে লিখেছে” Whoel come Apa”..
লেখাটা দেখে চোখ নামিয়ে বললাম ” Thank You All”… এরপরে বললাম “বোর্ডে কি লিখেছ তোমরা?”
একজন চৌকস মেয়ে দাঁড়িয়ে বল্ল ” ওয়েলকাম আপা”… মেয়েটার নাম সম্পা।তার সাথে স্কুলে এসেই পরিচয় হয়েছিল।কারণ পঞ্চম শ্রেণি সকাল থেকেই স্কুলে ক্লাস করে।আমি জিজ্ঞেস করলাম” বানান টা কি ঠিকাছে?”… দীপু নামের একজন দাঁড়িয়ে বল্ল ” ম্যাডাম,ওইটা তো হোয়েলকাম হয়ে গেছে।”.. আমি দীপু কে বললাম “আমাকে ম্যাডাম বলবে না প্লিজ,আপা বলবে,আপা ডাকলে খুব আপন মানুষ মনে হয়,তাই না?”…
দীপু বলে ” জ্বি আপা”।
আমি তখন Welcome বানান টি ব্ল্যাকবোর্ডে সঠিক করে লিখে বললাম” বাংলা ভাষায় শুভেচ্ছা জানানো বেশি সহজ আর সুন্দর, কি বল তোমরা?”
সবাই একসাথে বলে উঠলো ” জ্বি আপা”।এরপর সম্পা নামের মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে একটা জবাফুল বের করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে” আপা,এটা আপনার জন্য, আপা আমাদের স্কুল ছেড়ে আপনি চলে যাবেন না তো? আমরা আপনার সব কথা শুনব,একটা আপাও স্কুলে থাকে না,আপনি থাকেন আপা”… বলতে বলতে সম্পা যেন কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা,আমি ওকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললাম”আমি যাব না,তোমাদের স্কুলেই থাকব,আর আমার কথামতো যে চলতেই হবে এমন কোনও কথা নেই,তোমরা শুধু আমাকে সাহায্য করিও,আমি যেন তোমাদের স্কুলে ভালমতো থাকতে পারি,আর বোকা মেয়ের মতো কান্না বন্ধ কর,কান্না করলে কিন্তু চলে যাব।”… সম্পা চোখ মুছে হাসিমুখে তার আসনে বসে।আমি জবা ফুল টা হাতে নিয়ে ভাবলাম এই জবার বৈজ্ঞানিক নাম যেন কি ছিল! ইন্টারমেডিয়েট এ পড়েছিলাম।মনে পড়েছে,জবার বৈজ্ঞানিক নাম হল” হিবিসকাস রোজা সিনেন্সিস”…।
পঞ্চম শ্রেণিতে তেমন ক্লাস নিতে পারলাম না।ঘড়িতে দেখি দুপুর একটা বাজে।প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিল আর ক্লান্ত লাগছিল।তাদের কে বললাম”আমি আগামীকাল থেকে তোমাদের ক্লাস নিব,আজ একটু রেস্ট নেই? তোমরা কেউ গন্ডগোল অথবা মারামারি করবে না কেমন?”
আমি অফিস রুমে এসে বসলাম।মনে হচ্ছিল একটু ফ্যানের বাতাস খাই,ফ্রিজের এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাই।চোখ দুটো বন্ধ করে কয়েক মিনিট ভাবছিলাম।কয়েকদিন আগেও চাকরি করতাম উপজেলার এক স্বনামধন্য কিন্ডারগার্টেনে।সেখানে ২৫ জন শিক্ষক/ শিক্ষিকা,৩ জন আয়া,তিন জন পিয়োন।পানি খেতে ইচ্ছে হলে শুধু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতাম,চোখের সামনে পরিষ্কার ঝকঝকে কাঁচের মগে পানি রেখে যেত আয়া।একটা ক্লাস নিয়ে একটা লিইজার ভোগ করতাম পরের ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য।আর আজকে আমি সরকারি চাকরি তে জয়েন করলাম।গ্রামের ভিতর,কাঁচা রাস্তা,বাসা থেকে বের হয়ে স্কুল পৌঁছতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘন্টা,স্কুলে মাত্র তিন জন শিক্ষক,কর্মরত দুইজন।কি সাংঘাতিক অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।কিছু ক্ষন পর কয়েকজন ছাত্র অফিস রুমে এসে বলে ” আপা,টিফিন দিবেন না?”…
আমি রুমের চারপাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও টিফিন নাই।আমি তাদের কে বললাম ” টিফিন তো এখনও আসে নি,যখন আসবে আমি দিয়ে দিব।”আমি ভাবলাম আশ্চর্য বিষয় তো,কিন্ডারগার্টেনে সাড়ে বারোটায় টিফিন চলে আসে,আর এখানে দেড়টা বাজতে চল্লো এখনো টিফিন এসে পৌঁছালো না।টিফিন টা এলে আমিও একটু খেয়ে পানি খেতাম,প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”…দশ পনের মিনিট পর আরো দুজন ছাত্রী এসে বলে টিফিন দিতে,তাদের না-কি খুব ক্ষুধা পেয়েছে।তখন কোনও উপায় না পেয়ে কাছেই একটা টঙ দোকান ছিল সেখান থেকে দুজন কে দুটো টোস্ট কিনে দিয়েছিলাম আর নিজেও একটা টোস্ট কিনে খেয়েছি।দুপুর আড়াই টা নাগাদ হেড স্যার শিক্ষা অফিস থেকে স্কুলে ফিরে আসেন।স্যার আসামাত্র সকল ছাত্রছাত্রীরা স্যারকে ঘিরে ধরে নালিশের সুরে বলতে থাকে ” স্যার,নতুন আপা আমাদের কে টিফিন দেয় নি”… স্যার আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন” তুমি এদের কে আজকে টিফিন দাও নি ফারহানা? “…
আমি অবাক হয়ে বললাম ” আমি আবার কোথায় টিফিন পাব স্যার? দুইজন কে বিস্কুট কিনে খাইয়াছি,সবাইকে যে খাওয়াতে হবে এটা তো জানতাম না স্যার,জানলে আমি আসার সময় মিষ্টি সিঙাড়া কিনে নিয়ে আসতাম,তাছাড়া টিফিন তো কেউ দিয়েও যায় নি আজকে।”…
আমার কথা শুনে হেড স্যার হা হা হা করে খানিকক্ষন হাসলেন।তারপর বললেন” তোমাকে টিফিন আনতে হবে না এদের জন্য,এদের কে কিছু কিনেও খাওয়াতে হবে না তোমার,আর বাইরে থেকে কেউ টিফিন দিয়েও যাবে না।”..
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম” তাহলে?”….
স্যার বললেন ” দুপুর একটা থেকে দেড়টা এদের টিফিন টাইম।এই সময়ে তুমি শুধু বলবে টি -ফি – ন,ব্যাস ওদের টিফিন শুরু হয়ে যাবে,এদের সবার বাসা কাছেই,ওরা বাসায় গিয়ে ভাত খেয়ে আসবে,দুইটা বাজলে বলবে টি- ফি-ন শেষ, ব্যাস ওরা ক্লাসে চলে যাবে।”
আমি অবাক হয়ে স্যারের কথা শুনলাম। বিশ বছর আগের কথা লিখছি।তখন ক্লাস নিতেও হত শিক্ষক কে,ঘড়ি দেখে ঘন্টা বাজাতেও হতো শিক্ষক কে,ওয়াশরুম পরিষ্কার ও করতে হতো শিক্ষক কে।এখন সরকারি সুযোগ সুবিধার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।এখন টিউবওয়েল হয়েছে নল,আর নল ঘুরালেই আসে জল,সুইচ টিপলেই জ্বলে আলো,দিন কেটে যায় ভালো।
ধারাপাত নামতা (পর্ব:তিন)
নিপা সেন,চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। সে তিন দিন ধরে স্কুলে যেতে পারে নি,তার খুব জ্বর। হেড স্যার গতকাল বাসায় এসে তাকে দেখে গেছেন।সে সহপাঠীদের কাছে শুনেছে স্কুলে নতুন আপা এসেছে,আপা নাকি প্রথম দিন এসেই সবাইকে নিয়ে মাঠে খেলেছেন,বিষয়টি শুনে নিপার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে।সে মনে মনে ভাবে এখন সে অসুস্থ আর এখনই নতুন আপা স্কুলে এলো,খেলা করল,সে সব কিছু মিস করল।সুস্থ হলেই স্কুলে যাবে সে,নতুন আপাকে দেখার জন্য তার মন টা ছটফট করতে থাকে।এদিকে তৃতীয় দিন স্কুলে পৌঁছতেই হেড স্যার বলেন” ফারহানা, তোমাকে আজকে সভাপতি সাহেবের বাসায় যেতে হবে,উনার বাড়ীর উঠানে পোলিও ক্যাম্পেইন চলছে,তোমার ডিউটি আজকে ওখানে।”… আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।অবাক হয়ে স্যারকে বললাম,”স্যার,আমি কি স্বাস্থ্য কর্মী না-কি? তাছাড়া আমি সেখানে গিয়ে কি করব? “… স্যার মিটিমিটি হাসলেন।বল্লেন’ আমরা সরকারের গোলাম বুঝেছ ফারহানা, আমাদের কে যা করতে আদেশ দিবেন তাই করতে হবে।’.. আমি আবারও বল্লাম” আমি তো নতুন জয়েন করলাম চাকরি তে,আবার আজকেই নতুন আদেশ আসলো?”… স্যার আবারও মুখে হাসি নিয়ে বললেন ” যাও বাপু,তোমার অভিজ্ঞতা হবে,সভাপতির বাসায় দাওয়াত খাবে,কত মজা হবে!”… অগত্যা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটা দিলাম।স্কুল থেকে কয়েক কদম এগিয়েই সভাপতির বাসা।কাছে আসতেই দেখি শিশু কোলে নিয়ে মায়েদের লম্বা লাইন।চেয়ারে একজন স্বাস্থ্যকর্মী ম্যাডাম বসে আছেন।আমাকে আসতে দেখে বললেন” এসো,তুমি বুঝি নতুন আপা,তোমার কোনও কাজ নেই,শুধু আমার পাশের চেয়ারটায় বসে দেখো আমি কি করছি।”… আমি সালাম দিয়ে পাশে বসলাম।উনি একজন একজন করে শিশুর মুখে পোলিও ক্যাপস্যুল খাওয়াচ্ছিলেন,আমি চুপচাপ দেখছি,আর মনে মনে ভাবছি স্যার একা একা স্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন, আমি অযথা এখানে বসে আছি।আমি যদি স্কুলে থাকতাম,তাহলে কত্ত আনন্দ নিয়ে ক্লাস নিতে পারতাম! এভাবে একজন শিক্ষক কে পোলিও ক্যাপস্যুল খাওয়ানো প্রোগ্রামে জড়িত রেখে সরকারের কি লাভ বুঝতে পারছিলাম না।কিছুক্ষণ পর নিপা সেন চতুর্থ শ্রেণির সেই ছাত্রী বাসা থেকে বের হয়ে এলো।কাছে এসে সালাম জানিয়ে বল্ল যে সে আমার স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে,তার শরীর অসুস্থ তাই স্কুলে যেতে পারে নি, সে খবর পেয়েছে যে তাদের বাড়ীর বাইরের উঠোনে আমি এসেছি তাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।তার কপাল স্পর্শ করে দেখলাম জ্বর তেমন নেই।তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম” তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন, বেশি করে ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম,দুধ,ফলের রস,শাক,সবজি,পানি খাওয়া প্রয়োজন। শুয়ে বসে হাতের লেখা লিখো,শুয়ে গল্পের বই পড়,তোমার ভালো লাগবে।আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হও,স্কুলে যেতে হবে,আমরা অনেক মজা করব,কেমন!”… আপার এত সুন্দর সুন্দর কথা শুনে নিপার মন ভরে গেল,মনে হচ্ছিল যেন সে পুরো সুস্থ হয়ে গেছে।সে মাথা নেড়ে বাসায় চলে গেল।পরে জানতে পারলাম নিপা হল সভাপতি কাকুর বড় ছেলের মেয়ে।মেয়েটি খুবই ভদ্র আর নম্র।ক্যাপস্যুল খাওয়ানো দেখতে দেখতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল।স্বাস্থ্যকর্মী তার কাগজপত্র গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চলে যাওয়ার, এমন সময় সভাপতি কাকু হাসিমুখে বাসার বাইরে এসে বললেন ” এসো মা,বাসার ভিতরে চারটে ডাল ভাত মুখে দিবে।”… আমি তার মুখের দিকে চেয়ে আছি,স্বাস্থ্যকর্মী আমাকে বললেন” চল,আমি যেদিনই এখানে ডিউটি তে আসি,উনারা দুপুরে খাওয়ান।”.. তার পিছুপিছু বাসায় ঢুকলাম।বাসার বউ ঝি সবাই ছুটে এসেছে নতুন আপা কে দেখতে।সবার সাথে পরিচিত হলাম।বাসার ভিতর টা এত শীতল! মাটির ঘর,বিশাল বিছানা পাতা,বড় বড় পাখা নিয়ে বাতাস করছে বাসার বউদি রা।আমি লজ্জিত হচ্ছিলাম।খেতে বসে আরো অবাক হলাম।প্রায় সতের রকম নিরামিষ তরকারি। সেদিন ছিল একাদশী,উনারা নিরামিষ খেয়ে থাকেন।আমরাও খেলাম।এত সুস্বাদু তরকারি আমি কখনো খাই নি।দুপুরের খাওয়ার পর আরো অনেক গল্প হল,বিকেল হয়ে এলো,বাড়ী ফেরার পালা।আমি সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বাসার বাইরে এসে দেখি সভাপতি কাকু আমার জন্য ভ্যানের ব্যাবস্থা করেছেন এবং ভ্যান ভর্তি প্রচুর সবজি দিয়েছেন যেমন: লাউ,লাউয়ের ডগা,বেগুন,মরিচ,টমেটো, আলু,রসুন,পেঁয়াজ,হাঁসের ডিম,ছোট মুরগী আরো কত্ত কী!! আমি কি বলব কিছুই বুঝছিলাম না।শুধু বললাম” এতকিছু এগুলো কার জন্যে? “… কাকু বললেন” সবই বাড়ীর আবাদের,এগুলো তোমার জন্য মা,তুমি এগুলো নিয়ে গেলে আমি খুব খুশি হব,তুমি তো আমার মেয়ের মতো, বাবার উপহার টুকু নাও মা”… চোখে জল চলে এলো।নিজের বাবাকে সেই ছোট্ট বেলায় হারিয়েছি।মনেমনে সেই জায়গাটা হয়তোবা এই মানুষ টা নিয়ে নিলেন।আমি চোখ মুছে হাসিমুখে বললাম” কিন্তু কাকু,এতকিছু বাসে কিভাবে নিব?”… উনি জবাব দিলেন এই ভ্যান তোমাকে একদম বাসায় পৌঁছে দিবে মা,তোমাকে বাসস্ট্যান্ডে নেমে বাসে উঠতে হবে না,এটা আমাদের নিজস্ব ভ্যান।”… আর কি বলব,ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।উঠে পড়লাম ভ্যানে,হয়তো আজ একটু দেরি হতে পারে বাসায় পৌঁছতে।যেতে যেতে সারা রাস্তা শুধু এটাই ভেবেছি ” কিসের জন্য এত ভালবাসা? নিঃস্বার্থ স্নেহ কেন বিলোচ্ছেন তিনি? আমি এতদিন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত বলে সৃষ্টিকর্তা কি এভাবেই আমার ভাগ্যে পিতা সমতুল্য কারো স্নেহ লিখে রেখেছেন? হবে হয়তো। তাঁর রহস্য ভেদ করা জটিল।তবে জীবন খুবই সুখের মনে হতে লাগলো।সাথে সাথে সেই এলাকার বিদ্যালয় এবং সেখানকার ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়িত্ব ও অনেকটা বেড়ে গেল।বুঝতে পারলাম আমি হয়তো কোনও দায় ভারে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছি।(চলবে)।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..