1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৬:৫৯ অপরাহ্ন

দিনশেষে আজ আমার রবিবারের গল্প…. “অপরাহ্নে” ### ফাহমিদা রিআ

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০
  • ২৮৪ বার
ধূসর বিবর্ণ সাদাকালো ছবিটা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে দেখে আবারো পূর্ণতা। দুটি চোখের শান্ত দৃষ্টি, নির্বিকার ভাবলেশহীন চেহারা। দু’হাতে ক’গাছি চুড়ি আর গলায় মোটা চেইনে গাঁথা পান পাতার লকেট। পাশে হাস্যোজ্বল চেহারার এক যুবক।
—–আপা এসে গেছি।
ড্রাইভারের ডাকে এবং ক্যাঁচকরে ব্রেক করার ঝাঁকুনিতে চিন্তাচ্ছেদ ঘটে পূর্ণতার। হঠাৎ করে ঝির ঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে খেয়ালই করেনি পূর্ণতা। ক্রমাগত ওয়াইপারে গাড়ির কাঁচের পানি মুছে চলেছে। জানালার গ্লাসটা তুলে সামনে তাকায় পূর্ণতা। ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়। গাছগাছালির ঘন সবুজে ছেয়ে থাকা চারপাশ। মস্ত গেটটা পেরুলে বিশাল কালো সাইন বোর্ড আঁটা। তাতে সাদা অক্ষরে লেখা “অপরাহ্নে”।
বৃষ্টিটা একটু ধরে আসতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে পূর্ণতা। ইয়া মোটা ভুড়িওলা দারোয়ান অর্ধেকটা গেট জুড়ে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বসে আছে। পূর্ণতাকে দেখে বিরস বদনে হাত তুলে সালাম ঠুকে রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়। পূর্ণতা কব্জি উল্টে সময়টা দেখে নেয়। ইশ্ অনেক খানি দেরি করে ফেলেছে। অফিস রুমে নামটা সিগনেচার করে এগিয়ে যায় দুই নাম্বার ওয়ার্ডের দিকে, মহিলা ওয়ার্ড। ধবধবে সাদা নিজ নিজ বিছানার ওপর কেউ শুয়ে কেউ বা বসে। পূর্ণতা রুমে ঢুকতেই সবার মুখগুলি কেমন মায়াবতি হয়ে উঠলো। সেই ছেলে বেলায় মাকে হারিয়েছে পূর্ণতা। মা বেঁচে থাকলে এমন বয়সই হতো। ডাক্তারি পাশ করার পর ওল্ড হোমের এই অফারটা সে লুফে নিয়েছে। অন্তত কয়েক ঘন্টাতো সে মায়েদের সাহচার্য পাবে। এর আগের দুটো ওল্ড হোম সে ঘুরে এসেছে বিশেষ কারনে মাস খানেক আগে তৃতীয় বিচরণ। তৃতীয় হলে কিহবে পূর্ণতার কাছে সব গুলোই এক ক্ষেত্র, একই অনুভুতি। পৃথিবী যেমন একটাই, মায়ের জাতও একটাই। আর তাই পৃথিবীতে এক মায়ের আঁচলের ছায়ায় পূর্ণতার যথেচ্ছা বিচরণ। কার কত রকমের সুখ দুঃখের ঘনঘটা পূর্ণতার সাথে শেয়ার সবারই। অনেক সময় এমন হয় যে, ডিউটির বাইরেও কত সময় পেরিয়ে যায় এই মায়েদের মাঝেই আটকা পড়ে, উপভোগ করে মাতৃস্নেহের ওম।
শওকত আরার কথাই ধরা যাক। কোনো ছেলে নেই উনার। তিন তিনটি কন্যা সন্তান। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া সুন্দর দ্বিতল বাড়ি আর নিজের ব্যাংকের চাকুরি এই দিয়েই তিন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। এক সময় তিনি যখন অবসরে গেলেন মেয়েরা মাকে নিয়ে চিন্তায় বসলো। চাকুরিতো শেষ এখন আর একা একা এতো বড় বাড়ি আগল বসে থাকার কোনো মানে হয়না। তারচে বরং তিন বোনেরই আবাস যখন ঢাকায় তখন ওখানেই আড়াই তিন কাঠার প্লট কিনে ডেভলাপারকে দিলে তিন মেয়েই একাধিক এপার্টমেন্টের মালিকানা পাবে। মা থাকবেন সবার কাছেই পালা করে। শওকত আরা চাকুরিরত অবস্থায় একাকিত্বের যন্ত্রনা কি টের পাননি ঘরে বাইরের ব্যস্ততায়। অবসরে যাওয়ার পর থেকেই বুঝতে শুরু করলেন সবারই সময়ের অভাব, শুধু তারই অফুরন্ত সময়, কাটতেই চায়না। মেয়েদের জানালেন ঢাকায় প্লট খুঁজো। এবাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করছি। ব্যস্, তিন জামাই অফিস ব্যবসা স্থগিত রেখে সরাসরি হাজির শ্বশুর বাড়ি কদিন বাদেই। পার্টিও রেডি। কথা অনুযায়ী সুন্দর প্লটও রেজিষ্ট্রি হল যথা সময়ে। ডেভলাপাররা পাঁচ বছরের চুক্তিকে সাত বছর গড়িয়ে হস্তান্তরও করলো। কিন্তু ততদিনে শওকত আরা সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে আশা আকাংখা জলাঞ্জলি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মেয়েদের সঙ্গে আর নয়। আজ এমেয়ের বাড়ি তো কাল ওমেয়ের। নিজ ইচ্ছে মত তেলাওয়াত কিংবা টেলিফোনে পুরোনো কলিগদের সাথে আলাপনে মেতে উঠবেন তার কোনো উপায় নেই। ওদের বাচ্চার পড়ার টিচার, গানের টিচার অতিরিক্ত রুমটা দখল করে ফেলে। আর বাচ্চা ঘুমালে ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখা তো দুরে থাক হাঁটা চলা এমন কি পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখতে গেলেও হিসাব করে রাখতে হয়। জামাইরা শাশুড়ির এতদিনের চাকুরির পেনশানটা বিক্রি নাকি থাকবে এই নিয়ে তিন জনে তিন মত পোষন করে শাশুড়িকে স্বপক্ষের যুক্তি তুলে ধরে। অগত্যা নিজের স্বামীর ভিটার বিনিময়ে তৈরি করুনার আবাস স্থলে বাসিন্দা হবার আগেই নিজ সঞ্চেয়ের যেটুকু ছিল পুরোটা বন্টন এর খাতায় যাবার আগেই শওকত আরা “অপরাহ্নে”র বাসিন্দা হয়েছেন। কোনো মেয়ে বা জামাই একবারও এখানে উঁকি দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
পাশের বেডেই থাকেন জেবুন্নেছা। সাত সাতটি সন্তানের জননী তিনি। সন্তানেরা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সরলতা মাখা মুখশ্রী স্বল্প শিক্ষিতা । অল্প বয়সে সংসারি। স্বামী ছিলেন সরকারি বড় কর্মকর্তা। প্যারালাইজড হয়ে যাবার পর তিন বছর টানা শয্যাশায়ী। একে একে অঙ্গ প্রতঙ্গগুলি নিঃসাড় হয়ে যেতে লাগলো। বন্ধ হয়ে গেলো কথাও। সাত সস্তানকে বড় করার পরও নিজের অর্জিত অর্থ আর পৈত্রিক সম্পত্তির যোগফলে বিশাল বাড়ি জমি আর ব্যাংক ব্যালান্স ছিল মোটা অংকের। জেবুন্নেসা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অনুধাবন করলেন ছেলেরা কেউই অর্থ সম্পত্তি ব্যয় করতে চাইলোনা চিকিৎসায়, ভাগে কম হয়ে যাওয়ার আশংকায়। উনি যতটুকু পারলেন স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসা আর নিজের মনপ্রাণ ঢেলে দেয়া সেবায় আশার আলো দেখতেন, সুস্থ্য হয়ে উঠলে বাড়িটা আবার আগের মত হয়ে যাবে। না, বাড়িটা আর আগের মত হলোনা। ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কখন কাগজে কলমে। তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। স্বামী মারা যাবার পর জানা গেল ছেলেরা এক জোট হয়ে বন্টননামা তৈরি করে অসুস্থ বাবার টিপ সই নিয়ে কাগজপত্র কমপ্লিট করে রেখেছে সুচারু ভাবেই। ছেলেরা বাবার মৃত্যুর পর আপন আপন অংশ বিক্রি করে ফ্ল্যাট কিংবা প্লটের মালিক হয়েছে। মা নীরবে চোখ মুছেন আঁচলে। স্বজনেরা হায় হায় করেছে – নিজ হাতে সাজানো নিজ বাড়িটার কিছুই অবশিষ্ট নেই মায়ের জন্য ?
ছেলেরা বিস্ময়ের সুর তুলে বলেছে – মা একা একা বাড়িতে থাকতে পারেন নাকি ? আমাদের সবার কাছেই থাকবেন পর্যায়ক্রমে। হ্যাঁ পর্যাক্রমে আসবাব তৈজসপত্র সবই হল ভাগাভাগি, কিছু হল পরিত্যক্ত। মার হাতের সম্বল ছোট্ট সুটকেসখানি নিয়ে আজ এবাড়ি তো কাল ওবাড়ি। আজ ওর ছেলের পরীক্ষা তো কাল ওর বাসায় মেহমান। কিংবা ছেলে বৌ দুজনেরই অফিসের তাড়া, কাজের ছেলেটাও অনুপস্থিত। বাচ্চাকে স্কুলে আনা নেয়ার জন্য দরকার মাকে। অথবা প্রেগনেন্ট বৌমা শরীরটা খুব খারাপ। রান্নার বুয়ার বেতন বাড়ানোর অভিযোগে লাপাত্তা। ছেলে আর নাতির খুব অসুবিধা। কটা মাস ওখানেই মায়ের অবস্থান জরুরী।
শেষতক আঘাতটা এসে পড়লো যত্নে রাখা তিনপদ গহনার ওপর। স্বামীর নিজ পছন্দে গড়ে দেয়া একজোড়া বালা আর পুরোনো কালের ‘সীতাহার’। নাড়াচাড়া করেন আবার কৌটোয় তুলে রাখেন। ছেলে বৌদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই কিজানি কখন কে হাতিয়ে নেয়। সেজ ছেলের পালা আসতেই নিজেই চেয়ে বসে ডিজাইনগুলো দেখিয়ে অর্ডার দিবে বলে। এরপর একদিন সেজ ছেলের কাছে আসতেই ছেলে আহলাদী কন্ঠে বলে – বুঝলে মা তোমার নাতনি সীতাহারটা রেখে দিয়েছে দাদীর স্মৃতি রাখবে বলে। আর বালা জোড়া তোমার বৌমার হাতে। হাত খালি করে তোমাকে দেই কি করে। এক জোড়া বানিয়ে তারপর তোমারটা ঠিক দিয়ে দেব। চোখ জ্বালা করে ওঠে জেবুন্নেসার। রক্তক্ষরণ হয় অন্তরে, আস্ত দাদীর বদলে দাদীর অলংকারের স্মৃতি, হায় ভালবাসা!
অন্যান্য বৌ আর নাতনিদের মাঝে বিষয়টা ছড়াতে সময় লাগলোনা। ওরাই যদি এতো ভালবাসার তবে পালা করে থাকার কি দরকার। সেজ ছেলের বাড়ি স্থায়ী করে নিলেই তো হয়। অস্থায়ী ছুটাছুটি আর নয়। ভেবে চিন্তে স্বামীর পেনশানের টাকা কটি নিজ সুটকেসে সন্তর্পনে জমিয়ে রাখা সঞ্চয় যোগে এক আত্মীয়ের সহায়তায় এই আশ্রয় “অপরাহ্নে।”
আরো কত মন উতলা করা কাহিনীতে মিশে যায় পূর্ণতা। মিনতি দাস, রহিমা আখতার কিংবা সুফিয়া আমিন দের কথকতাও একই। শুধু মঞ্চটা ভিন্ন। পুরুষ ওয়ার্ডেও তাই। এক কালের দন্ডমুন্ডের কর্তা, বাড়ি কাঁপানো হুকুম দাতা মানুষগুলোর কি করুণ উপাখ্যান। পূর্ণতা আজ নুরুন্নাহারের কাছে বসেছে। তার সবটুকু জানা হয়নি। একেতো স্বল্পভাষী তার ওপর চোখের কঠিন অসুখে ভুগছেন। পূর্ণতা উনার মাথায় হাত রেখে চোখে টর্চের আলো ফেলে বলে – চোখটা দেখবো মা। স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে পূর্ণতার হাতটা ধরে পাশে বসান।
—-অপনজন কে আছে মা আপনার ?
—– কেউ নেই।
সোজা জবাব নুরুন্নাহারের।
—— আপনার চোখের কন্ডিশনটা একটু অন্য রকম। অপারেশন লাগবে। নিয়ম অনুযায়ী আপনজনকে জানাতে হবে। তাই বলছিলাম–
পাশের বেড থেকে জেবুন্নেসা বলে উঠলেন
—– ওভাবে বলছেন কেন নুরুন্নাহার আপা ? আমরা নেই ওদের কাছে কিন্তু আমাদের মাঝে তো ওরা আছে। থাকুক সুখে শান্তিতে।
নুরুন্নাহার মাথা দোলালেন।
——আছে মা, আমার দুই ছেলে আছে। তুমি খবর পাবে কি করে ওদের। আমার স্বামী মারা যাবার সময় স্থাবর অস্থাবর সবকিছুই ছেলের নামে করে দিয়ে গেছেন মাকে দেখভাল করার শর্তে।
—— সেই দেখভালটাই বুঝি এই ‘অপরাহ্নে’ হচ্ছে।
—— না রেখে কী করবে ? নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য স্বপরিবারে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে যে।
—— এতো গেল এক জনের কথা। আর এক জন ?
—— তাকে পাবো কোথায় ? আমিই তো তাকে হারিয়ে ফেলেছি।
এটুকু বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে থাকেন নুরুন্নাহার। পরিবেশটা ভারি হয়ে ওঠে। অন্যান্য মায়েরাও আঁচলে চোখ মুছেন। পূর্ণতা ফিরে আসে অফিস রুমে। একটু পরেই লাঞ্চ আওয়ার।
চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয় সোফাটায় পূর্ণতা। কোথায় যেন একটা যোগসূত্র উঁকি দিচ্ছে মনের কোনে। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছেনা।
একমাসের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি একের পর এক সাজাতে থাকে।
আরিফ টগবগে এক যুবক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে জয়েন করতে না করতেই বাবা মায়ের শখ একেবারে উপচে উঠলো। ঘরের লক্ষি চাইই চাই। আপত্তিরও কিছু নেই। নির্দিষ্ট ভাল লাগা বা নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যও নেই। মোটামুটি সুন্দরি এক মেয়ে দেখে বাবা মায়ের পছন্দেই আরিফের বিয়ে ঠিক হল। তিন কবুলে বৌ ঘরেও নিয়ে এলো। বাবা মাতো মহা খুশি। খুশি আরিফও। কিন্তু বৌ আনত দৃষ্টিতে সারাক্ষণ বিষন্ন।
আরিফ অফিসের জন্য তৈরি হয় মা পূর্বের মত জামাটা ঘড়িটা এগিয়ে দেন। টিফিন বক্স সাজিয়ে দেন। মেরুন সূতোয় বোনা কারুকাজময় কমলা রঙা শাড়ির আঁচল রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখা যায় কুটনা কুটায় কিংবা বাটনা বাটায় ব্যস্ত। মা ভাবেন ভারি লজ্জাবতি মেয়ে কদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
দিন গড়ায় কিন্তু নতুন বৌ নতুনই থাকে। বৌয়ের লজ্জা ভাঙ্গেনা। আরিফ অফিস থেকে ফেরার পথে জানালার গ্রীলটায় প্রতিক্ষীত কোনো মুখ দেখতে পায়না। কাঙ্খিত চোখ জোড়ায় লাজ বিধুর কোনো হাসিও খেলা করেনা। নাহ – অত মন গড়া ভাবনা আরিফ আর ভাববেনা। বৌ যত খুশি চুপ করে থাকুক। আরিফও চুপ করে থাকবে। কিন্তু তা হলোনা। বৌ হঠাৎ শয্যা নিল। রান্না ঘরেও যায় না খায়ও না। শাশুড়ি মাথায় হাত রেখে বললেন
—-বৌ আমার দিকে তাকাও। শরীর গুলায় ? বমি বমি লাগে ?
বৌ নিঃশ্চুপ। আরিফ জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তারের সহাস্য জবাব – এই টেষ্টগুলো করে নিয়ে আসেন। টেষ্টের পর আবারো সহাস্য জবাব –
—– অভিনন্দন, বাবা হচ্ছেন।
আরিফতো খুশিতে আত্মহারা, পারেতো তখনই ছোটে দোলনা আর খেলনা কিনতে। কিন্তু বৌয়ের শুকনো মুখ আর নিরুৎসাহী মনোভাবে বাসায় ফিরতে বাধ্য হল। বংশধরের আগমন বলে কথা। বেয়াই বাড়িতে খবর পাঠান আরিফের বাবা। সে অঞ্চলের রীতি অনুযায়ী প্রথম সন্তান মাতুলালয়েই আগমনের নিয়ম। তাতেও বৌয়ের উচ্ছাসের কোনো চিহ্ন নেই। যেন হুকুমের বলি। যখন যেখানে যেমন।
যথা সময়ে ঘর আলো করে ফুটফুটে ছেলে এলো। সাত দিনের দিন দাদা জোড়া খাসি দিয়ে আকিকা দিলেন ‘আহনাফ আরিফ’ নামকরন করলেন। আরিফ তার ঘরটা শুধু যেন আহনাফের বাস যোগ্য করে সাজালো। দোলনা পান্ডা পুতুল ভেপু বাঁশি কিছুই বাদ গেলনা। রঙিন সুতায় ফুল পাখি নক্সা তোলা দাদীর হাতের তৈরি কাঁথা আর ছোট ছোট ফতুয়া জামায় ভরে গেল কাপড়ের আলমারি। এবার পিতৃগৃহে আহনাফের ফেরার সময় হল। আরিফ আনতে গেল এবং ফিরে এলো শুধু মাত্র শিশু আহনাফকে নিয়ে। আরিফের মা আঁতকে উঠলেন বৌ কোথায় ! আরিফ শুধু বললো – নেই।
আরিফ কাউকে কিছুই না বললেও ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বৌ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না গেলেও, সন্তান স্বামী এবং বাবা মায়ের মান সম্মানকে ধূলায় লুটিয়ে দিয়ে পূর্ব প্রেমিকের হাত ধরে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এক সময় প্রেমিক পুরুষটির প্রস্তাবকে তাচ্ছিল্যভরে তার বাবা মা প্রত্যাখান করে। মেয়ের প্রচন্ড অমত সত্ত্বেও আরিফের সাথে বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন কিছুদিন শ্বশুর বাড়িতে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেরাও মেয়ের কাছ থেকে দুরে দুরে থেকেছেন প্রথম প্রথম। বেশ কমাস পর মেয়ের সন্তান আগমনের খবরে মেয়ের ওপর স্নেহের টানটা অনুভব করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই মাতৃকালিন সময়টাকে কাজে লাগিয়েছে মেয়ে সবার বিশ্বাসের দুর্বলতা নিয়ে।
কিছুদিন পর স্বাভাবিক ভাবেই আরিফের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়েছেন মা। আরিফ অটল অনড় কন্ঠে বলেছে – আমাকে এমন কথা আর কখনোই বলবেনা। আহনাফের মা নেই। আমিও যদি পর হয়ে যাই ওর কী হবে ?
তারপর একে একে আরিফের বাবা মাও মারা যায়। আরিফ বাবা মা উভয়েরই ভুমিকায় সুনিপুন যত্নে আদরে শাসনে হাঁটি হাঁটি পা পা ছেড়ে নিজ পায়ে আহনাফকে দাঁড় করিয়ে দেয়, স্কুল কলেজ এবং মেডিকেলের গন্ডি পাড়ি দিয়ে। ঢাকার অদুরে এক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জয়েন করে আহনাফ। আরিফের চাকরি প্রায় শেষের দিকে। জীবনের এতোটা সময় একা একা ক্লান্তিহীন ছুটাছুটি করে আজকাল কেমন যেন একটুতেই অবসন্নতা ঘিরে ধরে।
আহনাফের পছন্দের ক্লাশ ফ্রেন্ড পূর্ণতাকে বৌ এর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তোলেন। অল্প কিছুদিনেই পূর্ণতা শ্বশুরের সার্বক্ষণিক কেয়ারটেকার হয়ে ওঠে।
আরিফের শরীরটা কিছুদিন থেকে ভাল যাচ্ছিলনা। পূর্ণতাকে একা পাশে বসিয়ে একদিন বললেন
—– আমি একটা দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে চাই। তুমি কী আমাকে সাহায্য করবে বৌমা ?
—- কী সাহায্য বাবা ?
—— একটা মেসেজ তোমার কাছে রাখছি। তুমি যেভাবে পারো আহনাফকে বলবে।
—– বলুন বাবা।
—— আহনাফের মা মারা যায়নি, আজও বেঁচে আছে।
—— তড়িতাহত হয় পূর্ণতা, বেঁচে আছে ! কোথায় আছে ?
—— শুনেছি তার স্বামী মারা যাবার আগে তাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করে কপর্দক শুন্য অবস্থায় নিজ সন্তানকে সবটুকু দিয়ে গেছে। সন্তানও মাকে তার আশ্রয়ে না রেখে কোনো এক বৃদ্ধশ্রমে রেখে গেছে।
ঠিক এসময়ে আহনাফের আগমনে আরিফ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলেন
—-+- তোমাদের দুজনকেই বলি, আমি কাল দেশের বাড়ি যাবো ভাবছি।
আহনাফ এবং পূর্ণতা দুজনেই বাবার শরীরের এ অবস্থায় রাজি হয়না। আর কি অশ্চর্য ব্যপার এর কদিন পরেই আরিফ হঠাৎ করে স্ট্রোক করলেন, আর উঠলেন না।
পূর্ণতা আহনাফকে খবরটা এ অস্বভাবিকতার মধ্যে কিভাবে বলবে ভাবতে থাকে আর বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় খুঁজতে থাকে তার শাশুড়িকে। কিন্তু নামহীন ব্যক্তিকে খুঁজবে কিভাবে। কমাসের অদমনীয় প্রচেষ্টায় এক স্থান থেকে আর এক স্থানে এভাবেই চষে বেড়ায় পূর্ণতা। বিশেষ প্রয়োজনে শ্বশুরের ফাইল খুঁজতে গিয়ে অনেক পুরোনো একটা ফাইলে বিবর্ন একটি ছবি আবিষ্কার করে কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনা। শশ্রুমন্ডিত যে শ্বশুরকে সে দেখেছে তার দৃষ্টির সঙ্গে ছবির যুবকের দৃষ্টির কিছু মিল খুঁজে পায়। তবে কী – – ভেবে, ছবিটি রেখে দেয় হাত ব্যাগে।
ঝিমুনি কাটিয়ে সোজা হয়ে বসে পূর্ণতা। ছবির মহিলাটিকে পর্যবেক্ষণ করে এবার। এক মুহুর্ত। এক ছুটে নুরুন্নাহারের কাছে। দুবাহু তুলে নুরুন্নাহারকে সোজা করে বসিয়ে ছবিটা মেলে ধরে।
—– মা এদের চিনতে পারেন ?
নুরুন্নাহারের কোটোরাগত বসে যাওয়া চোখদুটি উজ্জ্বল হয়
—– এ ছবি তুমি কোথায় পেলে ?
পূর্ণতা কোনো জবাব না দিয়ে ছবির মেয়েটির ভাসা ভাসা দৃষ্টির সাথে নুরুন্নাহারের দৃষ্টির সাথে কোনো মিল খুঁজে পায়না। কিন্তু কপালের বাঁ পাশের কালো তিলটা আর ডান ভ্রুতে কাটা দাগটি হুবুহু এক। আর বলে দিতে হয়না কিছু। নুরুন্নাহারের শীর্ণ হাত পূর্ণতাকে চেপে ধরে
—– আরিফের ছবি তুমি কোথায় পেলে ?
—– উনার কাছেই।
—– তবে তুমি কে মা ?
জবাবটা না দিয়েই বেরিয়ে যায় পূর্ণতা। আর দেরি নয়। আহনাফকে জানাতে হবে এখনি, মা চলে গেলেও হারিয়ে যান নি। বেঁচে আছেন।
****************
Image may contain: drawing

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..