1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৮:১৫ অপরাহ্ন

# জীবন_যুদ্ধ ### সোনিয়া_শেখ

  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২১
  • ১৮৬ বার

বিশ্বাসঘাতকতা অপরিচিত মানুষ করে না। বিশ্বাসের ভীট’টা নষ্ট করে অতি-পরিচিত মুখগুলোই।
যেদিন প্রথম আমার স্বামীকে রাত ২টার সময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখেছিলাম। সেদিনই বিশ্বাসের খুঁটি’টা নড়েচড়ে উঠেছিলো। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো ভেতর থেকে কেউ একজন চুম্বকের মতো নিঃশ্বাসটা আঁটকে রেখেছে। আমার নয় মাস বয়সী ছেলেটার কান্নার উছিলায় আমি সেদিন জাগ্রত হই। আর এই দৃশ্যটা সেই রাতেই প্রথম স্বচক্ষে দেখতে পাই।
শুরু হয় সন্দেহের তীব্র যন্ত্রণা। কোন মানুষটার ভালো লাগে তার প্রিয় মানুষটাকে সন্দেহের নজরে দেখতে? মাঝে মাঝে নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে যেতাম। ভাবতাম কি প্রয়োজন এত সন্দেহ করার? ও থাকুক না ওর মতো। সৃষ্টিকর্তাতো দেখছেন’ই তিনিই সবকিছু ঠিক করে দেবেন।
কিন্তু না, কোনো কিছুই আর ঠিক হলো না। ছেলের বয়স এক বছর না ছুঁতেই ডিভোর্স পেপার পাঠানো হয়। বেড়াতে এসেছিলাম বাবার বাসায়, কিন্তু জানতাম না এটাই আমার শেষ আসা। কি দোষ ছিলো আমার? ওকে’তো কখনো এই ব্যপারে কোনো প্রশ্নও করিনি তাহলে কেন আমার জীবনটা নষ্ট করতে হলো? কেন একটা নিষ্পাপ শিশুকে শুরুতেই এভাবে ঠকানো হলো?
আমি মরেতো সেদিনই গেছি যেদিন নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে এক রিক্সাতে ঘুরতে দেখেছি। শেষবারের মতো মরেছিলাম ডিভোর্স পেপারটা দেখে।
সেদিন সারারাত কেঁদেছি বোবার মতো। মাঝরাতে জানালা খুলে আকাশ দেখছিলাম। কি সুন্দর জোছনায় ভরা আকাশটা। জোছনার সবটুকু আলো আমার ছেলের মুখটার উপরে ঢেলে পড়ছে। আমি পারিনি সাইনটা করতে। বার বার ছেলের মুখটা দেখে ভেতরটা কেঁপে উঠেছিলো। আমি চেয়েছিলাম হাজার বার চেয়েছিলাম সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখতে৷ কিন্তু একার চাওয়াতে কি আর সংসার হয়? মানিয়ে নিয়ে থাকা আর মন থেকে থাকার মধ্যে যে অনেক ফারাক।
পরদিন সকালে পারিবারিক বৈঠক বসে। আমি ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে লজ্জায় ঘৃনায় কারো দিকে আর মুখ তুলে তাকাতে পারিনি। একটা সাইনে ছয় বছরের তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পর্কের ইতি টানলাম। সেদিন প্রথম দেখেছিলাম পৃথিবীর বুকে এমন নিষ্ঠুরতম পিতাকে। যে কিনা এক বছরের শিশুর মুখের দিকে তাকিয়েও আমায় শেষ আশ্রয়টুকু দেয়নি।
একটা পরিবারে বাড়তি দুইজন মানুষের খাওয়া পড়ার খরচ অনেকটা কষ্টসাধ্য। আর ছোটো বাচ্চাদের খরচতো হিসাব নিকাশের বাইরে। ভাইয়ারা মুখ ফুঁটে কিছু না বললেও ভাবীদের আচরণে ঠিকই বুঝতে পারতাম আমরা তাদের বোঝা। আর আমরা মা ছেলে কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাইনি৷ তাই ঠিক করলাম একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াতে শুরু করবো। আর যাইহোক ছেলের সামান্য খরচটাতো চালাতে পারবো এই আর কম কি। প্রথম অবস্থায় আমার প্রাক্তন স্বামী ছেলের খরচ দিতে চাইলেও আমিই না করে দেই। পরবর্তীতে শুনতে পাই তার পরকীয়া প্রেমিকাকেই সে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করছে। আর সেই সংসারে আমার ছেলেটাকে মনে করার মতো সময় তার হয়ে ওঠেনি।
ছেলের বয়স তিন বছর হওয়ার পর থেকেই আমার বাবা মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আমি পারিনি নতুন সম্পর্কে জড়াতে। কি করে পারতাম আমার অবুঝ সন্তানটাকে ওর বাবার মতোই ঠকিয়ে অন্য কারো সাথে সুখে সংসার করতে? তাই আমি এক কথাতেই ছিলাম জীবনের শেষ অবদি যুদ্ধ করবো, তারপর বাকিসব চিন্তা।
সারাদিন স্কুল কোচিং, বিকেলে টিউশন শেষে রাতে যখন ছেলেটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়তাম। চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু পড়ে বালিশটা ভিজে একাকার হতো। মনের মধ্যে কতশত প্রশ্ন ভর করতো। কেন এমন হলো আমাদের জীবনটা? এমনটাতো হওয়ার কথা ছিলো না। কত বিশ্বাস ভালোবাসা ছিলো আমাদের মধ্যে। স্বামী সন্তান নিয়ে কত আশা স্বপ্ন ছিলো। তাহলে কোথায় থেকে এমন ঝর এসে সবকিছু শেষ করে দিলো? আমার অবুঝ ছেলেটার পুরো জীবন এক নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। আমরা কি দোষ করেছিলাম? কেন ভাগ্য আমাদের এভাবে ঠকালো? সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের ব্যথাটাও শুরু হয়ে যেতো। যখন ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতাম সমস্ত কষ্ট যেন এক নিমিষেই ভুলে যেতাম। ওর জন্যইতো আমার বাঁচতে হবে৷
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সৃষ্টিকর্তাতো যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এই চিরন্তন সত্য কথাটা আমি ছোটো থেকেই বিশ্বাস করতাম।
পড়াশোনার প্রতি ঝোঁকটা আমার ছোটোবেলা থেকেই ছিলো। বিয়ের পরেও পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতাম৷ সাড়ে আট মাসের প্রেগন্যান্সিতেও আমি ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। পড়াশোনাটা ছাড়িনি বলেই হয়তো আজ আল্লাহ তায়ালার করুনায় আর নিজের যোগ্যতায় এতদূর আসতে পেরেছি।
কোনো এক সকালে আমাদের জন্য সুখের বার্তা পাঠান সৃষ্টিকর্তা। আর সেই বার্তাতেই আমার জীবন নামক বেঁচে থাকার যুদ্ধটা সফল হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদের ভাইবাতে উত্তীর্ণ হই আমি।
খবরটা বাতাসের আগেই চারদিকে ছড়িয়ে যায়। যে আত্মীয়রা কখনো আমার অবুঝ ছেলেটার মাথায় হাত রেখেও দেখতো না, আজ তারাই আসে সকাল বিকাল আমাদের ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিতে।
.
আজকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ছেলের জন্য আইসক্রিম কিনছিলাম। দোকানদারকে টাকাটা দিয়ে পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার প্রাক্তন স্বামী তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখেও না দেখার ভঙ্গিতে পাশ কেটে চলে আসি।
আজ আর পা চলছে না আমার। পঁচিশ মিনিটের রাস্তা হওয়া স্বত্বেও আমি পায়ে হেঁটেই যাওয়া আসা করি। খুব দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। দেরি হয়ে গেলে ছেলেটা আবার চিন্তা করে খুব।
আজ আকাশটাও ভীষণ মেঘলা৷ মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। ভিজে গেলেও ক্ষতি নেই। কত রাত’ই-তো চোখের বৃষ্টিতে হৃদয় ভিজিয়েছি, আজ না হয় আকাশের বৃষ্টিতে বাহিরটা ভিজলো।
বাসায় ঢুকতেই ছেলেটা দৌঁড়ে এলো টাওয়াল হাতে। মাথাটা মুছে দিয়েই কিছু না বলে সোজা জড়িয়ে ধরলো। আমি খানিক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বলার আগেই কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
-এত দেরি কেন করছিলা আম্মু? আমার ভয় লাগে তুমি জানো না?
আমি কি বলবো জানা নেই। শুধু ভাবছি আমার পুরো পৃথিবীতে এই একটা মানুষই আছে যে আমার জন্য এত চিন্তা করে।
ছেলেটা এবার আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কান্নামাখা কন্ঠে বলে উঠলো,
-আই লাভ ইউ আম্মু!
আমার দু’চোখ আজ সুখের অশ্রুতে চকচক করছে। বাবা মা আমাদের মা-ছেলের ভালোবাসা দেখে চোখ মুছতে লাগলো। আমার ছেলেটা ওর নানা-নানীজান কে কাঁদতে দেখেই দৌঁড়ে তাদের কাছে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা রুমে খিলখিল হাসির শব্দে ফেটে পড়লো।
কত স্নিগ্ধ, সুন্দর আমার ছেলের হাসিটা। এই হাসিটার জন্য আমি সমস্ত কষ্ট ভুলে আরো এক যুগ যুদ্ধ করে পাড়ি দিতে পারবো।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..