1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:৫৭ অপরাহ্ন

#ছোট_গল্প #সহমর্মিতা ### #লেখা_সুরাইয়া_শারমিন

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০
  • ৪৩৯ বার
সায়মা বেগমের মনটা খুবই অস্হির হয়ে আছে, বারবার মনে হচ্ছে, এই যে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা গিয়ে আমারা মেয়ের বাসায় উঠবো? এটা কি ঠিক হলো? মনকে বার, বার, প্রশ্ন করে সে কখনোই, তার মন মতো উওর পাচ্ছে না।এর পেছনের ইতিহাস হলো
আজ সায়মা বেগমের মনের মধ্যে ঢাকা যেয়ে মেয়ের বাসায় উঠা নিয়ে যে ধন্ধ দেখা দিয়েছে। তার কারন দেখতে একটু পেছনে তাকাতে হবে। ঢাকা শহরে যে বাসায় যাওয়া বা উঠা নিয়ে এত সিদ্ধান্ত হীনতা, সেই বাসা এক সময় ছিলো তার একমাত্র মেয়ে শামিমার বাড়ি। কিন্তু আজ সেখানে শামীমা নামের কেউ আর থাকে না। তবে শামীমার বাসাটা তো আছে।
একসময় তারা ঢাকা আসতো মেয়ের বাসায় বেড়াতে। মেয়ে কত আদর যত্ন করতো। আর চলে আসার সময় কত মন খারাপ করতো আর বার বার বলতো
– আম্মা আর দুদিন থাকলে কি হতো!থাকো না আর দুইদিন। আমার এখানে কি তোমাদের কোন অযত্ন হয়?
তখন তিনি হেঁসে বলতেন,
– পাগল মেয়ে কি বলে? মারে মেয়ের জামাই এর বাসায় মানুষ কত দিন বেড়ায়!আর বড়ি ফেলে কয় দিন থাকা যায়।
তখন মেয়ের বাসায় বেড়ানো ছিলো আনন্দের।
সেই একই বাসায় যাওয়া নিয়ে আজ মনের ভেতরে কত দিধা- ধন্ধ। দুনিয়াটা এত হিসাব নিকাশের কেন? এক সময় যেটা মেয়ের বাসা ছিলো, আজ সেই বাসাকে মেয়ের বাসা বলা ঠিক হবে কিনা তাই বুঝতে পারছে না তিনি। এর কারণ হলো সায়মা বেগমের মেয়ে শামিমা মারা গিয়েছে দুই বছর আগে। শামিমার একটা মাত্র ছেলে। সেই ছেলেকে শামীমা’রা মালয়েশিয়া পড়তে পাঠিয়েছে, শামিমা মারা যাওয়ার আগেই।
শামীমার হাসবেন্ড আতিক আবার বিয়ে করেছে। তাও তো এক বছর হয়ে গেছে। শামীমা মারা যাওয়ার পরেও প্রায়, প্রায় কথা হতো আতিকের সাথে।
তার পর আতিক যখন বিয়ে করবে ঠিক করেছে।তখন থেকে আতিক আর তেমন কোন যোগাযোগ রাখে নাই শ্বশুর বাড়ির সাথে।আর সায়মা বেগমও যখন জানলো আতিক বিয়ে করছে।তখন থেকে আর মেয়ে জামাই এর সাথে কথা বলার ইচ্ছে হতো না। বার বার মনে হতো, আমার মেয়েটা সংসার-সংসার করে, বছরে একবার আমার কাছে বেড়াতে পর্যন্ত আসতো না, আর আসলেও দু’ দিন থেকে চলে যেতো জামাইয়ের কষ্ট হবে বলে,সারাক্ষণ বলতো
-মা আতিক কি ভাবে রান্না করে খাবে? ও হোটেলের খাবার খেতে পারে না ও। ওর গ্যাস্টিকের সমস্যা আছে।
আর সেই আতিক শামীমা মারা যাওয়ার এক বছরও যেতে পারলো না নতুন বউ ঘরে তুলল! এই টুকু মূল্য একজন মানুষের কাছে আরেকজন মানুষের!এক বছর থাকা যায় না পুরাতন স্মৃতি নিয়ে! বাইশ বছরে একটা মানুষের জন্য এইটুকু ভালোবসা তৈরী হয় না! একজনের তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার। সেই বিছানা। সেই সব কিছু একজনের পছন্দে সাজানো। আজ সেই মানুষটা নাই বলে তার এক সময়ের জীবন সঙ্গীর স্হানে তার সংসারে, অন্য একজন কে নিয়ে আসতে, কোন রকম অসোয়াস্তি হয় না!মানুষ এত মূল্যহীন!
মেয়ে’র বিয়ের আগে ঢাকা শহরের খুব বেশি আসা হয় নাই সায়মা বেগমদের। মেয়ের বিয়ের পরে মেয়ের আবদারে তারা বেশ কয়েক বার বেড়াতে এসেছে ঢাকা শহরে। তার পরেও ঢাকা শহর তারা খুব একটা চিনে না।তাঁরা ঢাকা বেড়াতে আসতো মেয়ের বাসায় তারপর মেয়ে তাদের এদিক সেদিক নিয়ে যেতো তাদের তো শহর চেনার দরকার ছিলো না। সব জায়গায় মেয়ে নিয়ে যেতো তাঁর পর সোজা ফেরত যেতো নিজের বাড়িতে। আর জানাশোনা কাছের কোন আত্মীয়ও নাই এখননে যার বাসায় উঠা যায়।
শামীমা মারা যাওয়ার পরে ঢাকা আসার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিলো তাদের।কিন্তু তার পরেও এখন আসতে হচ্ছে নিদারুন বিপদে পড়ে। শামীমার বাবা কে ডাক্তার দেখানোর জন্য।আজ কাল আপন আত্মীয়ের বাসাতে না বলে একবেলা যাওয়া হয় না। আর সেখানে অনাত্মীয় কারো বাসায় তো উঠার তো প্রশ্নই আসে না।একবেলা ঢাকা শহরে আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াবে মানুষ। তবে থাকার জায়গা দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব না। আর হোটেলে থাকার কথা চিন্তাও করা যায় না।সব কিছু ভেবে সায়মা বেগম তার হাসবেন্ড কে বলে,
– ঢাকায় কি আমাদের থাকার জায়গার অভাব আছে? আমার নিজের মেয়ের বাসা আছে না, আমরা সেখানে উঠবো।
তখন সায়মার বাবা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,
-মেয়ে’ই নাই আর তার বাসা!মেয়ের জামাই তো কোন খোঁজখবরই রাখে না আমাদের।
– মেয়ে না থাকলে মেয়ের জামাইয়ের সাথে, কি আর সম্পর্ক থাকে বলো?আর সেই সম্পর্কের কি আর মূল্য আছে জামাইয়ের কাছে?
ঢাকা আসা কথা ঠিক হলে সায়মা বেগম আতিক কে কল দিয়ে কথা বলে।
– আতিক তোমার শ্বশুর অসুস্থ, উনাকে ডাক্তার দেখাতে ঢাকা আসবো আমরা।
মেয়ের জামাই তখন শ্বশুরের অসুখ নিয়ে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে। সেই সময় সায়মা বেগম কথার ফাঁকে বলে
– বাবা আমরা তোমার ওখানে উঠতে চাই, তোমাদের কোন সমস্যা হবে না তো?
তখন মেয়ের জামাই বলে,
-না মা আমাদের কোন সমস্যা নাই। আসলে আপনাদের একটু কষ্ট হবে।
– আমরা দু’জনেই চাকরি করিতো।আমরা সারাদিন অফিসে থাকবো।আপনাদের দেখাশোনা করতে পারবো না।
সায়মা বেগম তখন বলে
– আমরা তো বেড়াতে আসতেছি না বাবা,আমরা প্রয়োজনে আসবো। তখন জামাই বলে
-আম্মা টিকেট কেটে আমাকে একটু জানাবেন কবে আপনারা রওনা দিবেন।
এই পর্যন্ত কথা হয় মেয়ের জামাইয়ের সাথে। আর ঠিক হয় সায়মা বেগমরা ঢাকা যাওয়ার ডেট জানালে। আতিক ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাখবে।
তার পরে ঢাকা আসার আগে আর একবার আতিকের সাথে কথা হয়েছে সায়মা বেগমের। তা শুধু ট্রেনে উঠার আগে।ট্রেনে উঠলেই আগে সায়মা বেগম ঘুমিয়ে যেতো। ট্রেনের দুলনিতে কেমন একটা ঘোর লাগতো।আর আজ সেই ঘুম কোথায় পালিয়েছে! একটার পর একটা কথা মনে হচ্ছে। সব চাইতে বড় কথা, আজ ঢাকায় মেয়ের বাসায় যেয়ে।সে তার কলিজার টুকরা মেয়ে’কে দেখবে না! সন্তান হারানোর ব্যথা কেউ ভুলতে পারে না!তারপরেও সময় ও জীবনের বাস্তবতা হচ্ছে এমন যে, কিছু কষ্ট কে ভুলে থাকার জন্য। শতক কাজের বাহানায় মনকে সরিয়ে রাখতে হয়। আর আজ তিনি যাচ্ছেন এমন এক জায়গায় যেখানে তার পুরাতন ঘা কে ছুরি চালিয়ে সে নিজেই আরো বেশি টাটকা করে তুলবে।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের কাছে একটা ছোট দোকানে বসে পরটা ভাজি আর চা খেলো সায়মা বেগম আর তার স্বামী । তার পর একটা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে মেয়ের বাসা নিকেতনে রওনা হয় সায়মা বেগম’রা।
মেয়ের বাসার নীচে গিয়ে মেয়ের জামাই কে কল দেয় সায়মা বেগম। তাদের দেখে দারোয়ান সালাম দিয়ে বলে,
– খালাম্মা – খালুজান আপনারা কেমন আছেন? কতদিন পরে দেখলাম।
দারোয়ানের এই কথাতেই কেমন চোখে পানি চলে আসতেছে সায়মা বেগমর। শুধু পুরাতন কথা, পুরাতন ছবি চোখের সামনে ভাসছে। বসার ভেতরে আর যেতে মন চাইছে না। যত বার মেয়ের বাসায় আসার জন্য রওনা হতো তাঁরা। মেয়ে সারা রাস্তায় একটু পর পর কল দিয়ে জানতো
-আম্মা তোমরা এখন কোথায়?
-আম্মা কতটুকু এসেছো বলো?
– আর কতক্ষন লাগবে? তোমাদের ট্রেনটা কি আজ আস্তে চলছে!
ট্রেনে বসে বারবার বাহিরের সাইনবোর্ড পড়তে হতো আর মেয়েকে বলতে হতো জায়গার নাম।ট্রেন থেকে নেমে মেয়েকে কল দিয়ে বলতেন,
– আমরা ঢাকা চলে এসেছি। এখন শুধু অটো নিয়ে তোমার বাসা।
এই কথা শোনার পর থেকে মেয়ে বারান্দায় এসে দাড়িয়ে থাকতো। সিএনজির শব্দ শুনে ব্যালকনি থেকে হাত নেড়ে এক দৌড়ে নীচে চলে আসতো, আর বলতো
– মা আমি রাতে একদম ঘুমাতে পারি নাই, একটু পর পর মনে হয়েছে নীচে সিএনজির শব্দ, আর তোমরা চলে এসেছো!
আর আজ এই বাসা থেকে কেউ বের হওয়ার নাই,কেউ তাদের অপেক্ষায় রাত জেগে থাকার মতো নাই। পা সরছে না কেন আসতে গেলাম এই বাসায়? ঝাপসা চোখে সায়মা বেগম দেখলো কে যেন তার সামনে এসে দাঁড়ালো এবং একটু ঝুঁকে তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।সায়মা বেগম একটু হতবিহ্বল হয়ে গেছে।সে বুঝতে পারছে না, কে তাকে সালাম করলো! এটা তো শামীমা!তার পরেই সে হাত ধরে মেয়েটিকে বুকের কাছে নিয়ে নেয়।আর বলতে থাকে শামীমা মা কেমন আছিস?এই কথা বলেই সায়মা বেগমের মাথা ঘুরে যায়। আর তিনি পরে যাওয়ার সময় তাকে শক্ত করে ধরে ফেলে মেয়েটি। আর সেই মেয়েটিই হলো মুনমুন আতিকের নতুন বউ।
সায়মা বেগমর সারারাতের জার্নি, টেনশন আর মৃত সন্তানের জন্য অসহনীয় কষ্ট। আার এ সবের সাথে স্বামীর অসুস্থ্যতা। আর মৃত মেয়ের বাসায় উঠার চাপ।উনও আর নিতে পারে নাই তাই তিনি সিক হয়ে যান।
সেদিন আর আতিকের নতুন বউ মুনমুন অফিসে যাওয়া হয় নাই। মুনমুন বাসায় একজন ডাক্তার ডেকে এনে সায়মা বেগম কে দেখায়। ডাক্তার সায়মা বেগম কে দেখে চলে যাওয়ার সময় বলে যায়,
– উনার প্রেশার অনেক লো তাই মাথা ঘুরে গেছে আর হয়তো বেশি টেনশন করছে, আপনার আংকেলের অসুস্থতা নিয়ে। উনি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করলে আর একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে, টেনশনে এমন হয়েছে ঘুমের ঔষধ দিয়েছি।
শামীমার বাবা শাহজাহান সাহেবের খুবই লজ্জা লাগছে। সে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। আতিকের নতুন বউকে তারা এসে প্রথম দিনেই কি ঝামেলায় ফেলে দিলো! মেয়েটা চাকরি করে। সে তাদের জন্য অফিস কামাই করলো। এদিকে তাঁর স্ত্রী সায়মা তাঁকে এত ভরসা দিয়ে নিয়ে আসলো ঢাকাতে চিকিৎসা করানো জন্য অথচ সে নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলো। তিনি ভাবছেন, কেন যে আসতে গেলাম ঢাকাতে!
মুনমুন শাহাজাহান সাহেবের কাছে এসে কোমল সুরে বলল।
-আংকেল আপনি ফ্রেস হয়ে একটু ঘুমিয়ে নেন। আন্টিকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। উনি এখন তো ঘুমাবে। আর একটু কিছু খেয়ে নেন অনেক বেলা হয়েছে।
শাজাহান সাহেবের মুনমুন কে খুবই পছন্দ হলো,মনে মনে ভাবছে আহারে মেয়েটা কত ভালো। আমরা আসায় একটুও বিরক্ত হয় নাই, উল্টো আমরা কত ঝামেলায় ফেললাম। শাহাজাহান সাহেবের গলা কান্নায় বন্ধ হয়ে আসতেছে, সেটা মুনমুনের নরম ব্যবহারে? নাকি তার মেয়ে শামীমার স্থানে অন্য কাউকে দেখার কষ্টে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। তিনি কোন রকমে মুনমুন কে বলল,
-মা আমরা এসেই তোমাকে কত ঝামেলায় ফেলে দিলাম,তুমি কিছু মনে করো না, তেমার খালাম্মা মেয়ের কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে আর পারে নাই সে বেসামাল হয়ে গেছে, মা তো , তাই!
মুনমুন আস্তে করে বলল
-আমি বুঝতে পারছি ওনার কষ্ট! আপনাদের কষ্ট!
মনে মনে মুনমুন বলল, – এই দুইজন দুঃখী মানুষ কে আমার কাছ থেকে আমি কোন রকম কষ্ট পেতে দিবো না। আমার বাসায় ওনাদের কোন অযত্ন হবে না। মুনমুন তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তার করনীয় বিষয়ে।
তারপর মুনমুন তার অফিসে কল দেয় এবং জানিয়ে দেয় সে আগামী তিনদিন অফিস থেকে জরুরী প্রয়োজনে ছুটি নিতে চায়। আর আগামীকাল অফিসে গিয়ে তার কাজ গুলো বুঝিয়ে দিয়ে আসবে।
এদিকে সায়মা বেগম দের এই বসায় উঠার কথা যখন আতিক মুনমুন কে জানিয়েছিলো তখন থেকে মুনমুনও এক ধরনের মানসিক চাপে ছিলো। তার বার বার মনে হচ্ছিল একজন মা- বাবার কেমন লাগবে তার মৃত মেয়ের বাড়িতে এসে তার মেয়ের স্হানে অন্য কাউকে দেখতে? আবার সে যদি তাঁরা আসার আগেই এই বাসা থেকে চলে যায় সেটা তো আরো খারাপ দেখায় মুনমুনও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। আর আজ সায়মা বেগম যখন মুনমুন কে শামীমা বলে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হারায় ।তখন-ই মুনমুনের মানসিক চাপ একদম চলে যায়। তার ভেতরে কেমন এক ফুরফুরে ভাব চলে আসে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই অসহায় সন্তান হারানো মানুষ দুইজন কে সে তার দিক থেকে যত্ন বা দায়িত্ব পালনের কোন কমতি সে রাখবে না।সে হয়তো তাদের শামীমার মতো করে তাদের ভালোবাসতে পারবে না কিন্তু সে তার মতো করে তাদের আপন করে নিবে।মানুষের সাথেই তো মানুষের সম্পর্ক হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..