1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন

# ছোট_গল্পঃ # রঙিন ফানুস ### ©মাহবুবা আরিফ সুমি

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ, ২০২১
  • ৫২২ বার
মাকসুদ সাহেবের বিবাহিত জীবনের বয়স তেইশ বছর। ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন কলেজ পড়ুয়া বছর বাইশের এক তরুণীকে। তবে সংসারে এসে ছোট থেকে বড় কোন বিষয়েই তার স্ত্রী শিরিন আক্তার কোনোদিন স্বামীর সাথে পেরে উঠতে পারেননি। সব বিষয়ে বিজয়ীর আসনটা বরাবর মাকসুদ সাহেব একচেটিয়া নিজের দখলেই রেখেছেন । সংসারে তার একচ্ছত্র আধিপত্য।
মাকসুদ সাহেবের বর্তমান বয়স তিপ্পান্ন বছর। উনার স্ত্রীর বয়সও চল্লিশের উপরে। তবে শুরুর মতো এখনও সংসারটাকে দুজনের বলে ভাবতে পারেননি তিনি একদিনের জন্যও।
আর এই নিয়ে কখনো তার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনারও জন্ম হয়নি।
মাকসুদ সাহেবের বিশ্বাস, তিনি খুবই দায়িত্বশীল স্বামী। কেননা, স্ত্রীর করে দেয়া লিস্ট অনুযায়ীই সংসারে তিনবেলার মাছ,মাংস বাজার করেন তিনি । বছর পাঁচেক হলো মিরপুরে নিজের নামে ফ্ল্যাট কিনেছেন । সেখানেও শিরিনকে উঠিয়েছেন, .. কয়জনেরই বা এমন সৌভাগ্য হয় ! অথচ মহিলার মধ্যে কৃতজ্ঞতার লেশমাত্র নেই।
মাকসুদ সাহেবের ধারণা উনার স্ত্রী ভীষণ স্বার্থপর এবং উচ্চাকাঙ্খী । শুরু থেকেই তার কেবল স্বামীর টাকা পয়সা উড়ানোর ধান্দা । যদিও কখনো এতে সফল হয়নি সে । তিনি কায়দা করে স্ত্রীর যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছেন প্রতিবার ।
এই তো সেদিনের কথা। এক বিয়ে বাড়িতে পাশে বসা নিম্মি ভাবীর সোনার বালা দুটোর দিকে এই বয়সে এসেও কী আগ্রহ নিয়েই না তাকিয়ে ছিল লোভী মহিলাটা … । সে কী নতুন বউ নাকি যে গহনা দেখে এখনো হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে..! দামটাম জিজ্ঞেসের আগেই তিনি চট করে শিরিনের কানের কাছে মুখ এনে ওর বয়স তুলে অপমানসূচক দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন । দ্বিতীয়বার আর ঐ বালার দিকে তাকাতে সাহস করেনি সে।
বিয়ের পর থেকেই এভাবে বুদ্ধি করে শক্ত হাতে সব সামলেছেন তিনি।
মাকসুদ সাহেবের স্ত্রী সাধারণ ঘরের মেয়ে । শহরে কাছাকাছিই ছিল এক সময় তার শ্বশুরবাড়ি মানে শিরিনের বাবার বাসা । বিয়ের প্রথম প্রথম পাছে শিরিন কিছু পাচার করে দেয় বাপের বাড়িতে , এই ভয়ে তিনি অফিসে যাবার সময় স্টোর রুম পর্যন্ত তালা দিয়ে চাবিটা তার নিজের সাথে নিয়ে যেতেন । একবার শিরিনের জন্য দুপুরের খাবার চাল বের করে রেখে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি । চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা শিরিনের সেদিন না খেয়ে উপোস থাকতে হয়েছিল।
শিরিন অবশ্য প্রথম দিকে এসবের প্রতিবাদ করত বেশ কান্নাকাটি করে। তিনি দুই, একবার বের করে দেবার হুমকি ধামকি দিতেই, ভয়ে সেসব থেমেছিল।
তাড়িয়ে দিলে শিরিন যাবেই বা কোথায়..! ওর বাবা নেই আর অসুস্থ বৃদ্ধা মা থাকে বড় ভাইয়ের সাথে । তাছাড়া বিয়ের পর মাত্র বছরখানেক ঘুরতেই তাদের একমাত্র ছেলে আদির জন্ম হয়েছিল। সেটাই তার বড় দুর্বলতা। সংসার ছাড়লে ছেলের কথাও তো মাথায় রাখতে হবে।
নতুন নতুন সময় বেড়ানোর বড্ড শখ ছিল মেয়েটার। মাঝে মাঝেই তাকে এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য বায়না ধরত । ঘুরতে যাওয়া মানেই বিস্তর টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার স্যাপার। তাই স্ত্রীর এসব আবদার তিনি কখনো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। বেশি বিরক্ত করলে সাফ জানিয়ে দিতেন, ঘুরার ইচ্ছে হলে সে যেন বাপের বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে আসে । তার কষ্টের উপার্জন তো আর স্ত্রীর ফালতু শখ পূরনের জন্য নয়।
… তাছাড়া অফিসের কলিগ রফিকের শ্বশুরের মতো শিরিনের বাপের তো কোটি টাকা নেই। মামুনের বউয়ের মতো অফিসে উচু পদে চাকরিও করে না সে । এত শখ তার আসে কোথা থেকে !… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেসব কথা কয়েকবার কানে ঢুকাতেই শিরিনের মুখ বন্ধ হয়েছিল চিরতরে।
তিনি চালাক মানুষ। বরাবরই কায়দা করে স্ত্রীকে হারিয়ে দিয়েছেন কোনো না কোনোভাবে ।
এমন কী সারাজীবনে শখ করে কখনো স্ত্রীর হাতে পাঁচশোটা টাকাও দেননি কোনোদিন । বিয়ের প্রথমদিকে ঈদ করতে মায়ের কাছে যেতে চাইলে টুকটাক উপহার কিনে দেয়ার কথা বলত শিরিন। তিনি বুদ্ধি করে মার্কেট থেকে সস্তায় কিছু আজেবাজে কাপড়চোপড় এনে দিতেন ওর হাতে । তাতে লাভ হয়েছিল দুটো । এরপর থেকে শিরিন লজ্জায় পড়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া একদম কমিয়ে দিয়েছিল আর ওর টুকটাক হাত খরচ আর শাড়ি কাপড়ও আসতে শুরু করেছিল ওর পরিবার থেকেই।
তিনি সংসারের ক্ষমতাশীল ব্যক্তি, শ্বশুর বাড়ির ভদ্রতা রক্ষার ধার তিনি ধারেন না।
… পদে পদে স্ত্রীকে ঠকিয়ে, অপমানিত, লাঞ্ছিত করে সংসারে জয়ীর আসনটা তিনি ধরে রেখেছেন তেইশটি বছর ধরে। এটা নিজের সাফল্য বলেই মনে করেন তিনি ।
শিরিনকে মেনে নিতে হয়, হারতেই হয় বারবার । পৃথিবীতে জেতার ভাগ্য নিয়ে তো আর সবাই জন্মায় না।
******
এক বৃহস্পতিবার।
মাকসুদ সাহেব প্রতিদিনের মতো বিকালে অফিস থেকে ফিরলেন। বেল টেপার বেশ খানিকটা সময় পর শিরিন গম্ভীর মুখে এসে দরজা খুলে দিল। বিয়ের প্রথম কয় বছর অবশ্য শিরিনের এই মুখটা হাসিখুশিই ছিল। কলিংবেলের শব্দ শোনামাত্র তখন দৌড়ে এসে দরজা খুলত সে। আনন্দে ঝলমল করত তার মুখ। ধীরে ধীরে তার আচরণ পাল্টেছে। তিনি যে লক্ষ্য করেননি সেটা.. তা নয়। তবে পাত্তা দেননি কখনো। মেয়েদের সব কিছু এত পাত্তা দেয়ার প্রয়োজনও নেই। দিলে সংসারটা আজ শিরিনের হাতে থাকত, তার হাতে নয়।
স্ত্রীকে চায়ের কথা বলে জামা কাপড় পাল্টে তিনি ফ্রেশ হয়ে নিলেন।
হাতে টিভির রিমোট নিয়ে আরাম করে সোফায় বসতেই শিরিনের উপর প্রচণ্ড বিরক্তিতে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে এলো। সামান্য এক কাপ চা বানাতেও এই মহারানীর দুনিয়ায় সময় লাগে ! অথচ সারাদিন অফিসে কতশত ভ্যাজাল আর রাজ্যের মূল্যবান কাজকর্ম তিনি প্রতিদিন সামলাচ্ছেন সুনিপুনভাবে।
তিনি মনে মনে অকর্মা স্ত্রীকে স্বভাব সুলভ কঠিন, নোংরা কিছু গালি দেবার জন্য প্রস্তুত হলেন। আর আচমকা তখনই বুকে তীব্র তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা অনুভব করলেন তিনি । ব্যথাটা ধীরে ধীরে বুক থেকে তার বাম হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মনে হলো কেউ যেন তার বুকে প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে। তিনি ঠিকঠাক শ্বাসও নিতে পারছেন না। মাকসুদ সাহেব ভয়ে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন।
শিরিন শান্ত ভঙ্গিতে চা হাতে রুমে ঢুকছে । সাথে একটা বাটিতে সেমাই জাতীয় কিছু। মাকসুদ সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল । তিনি করুন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। অতি কষ্টে ভাঙা গলায় দুইবার ডাকলেন,
— শিরিন, শিরিন!
শিরিন থমকে দাঁড়িয়ে স্থির তাকিয়ে থাকল । তাকে কিছুটা হতবিহ্বল দেখাচ্ছে। মনে হলো মাকসুদ সাহেবের অহংকারী , একগুঁয়ে চেনা চেহারাটা হঠাৎ এমন বদলে যাবার কারণটা সে ধরতে পারছে না।
তিনি বড় করে শ্বাস নিতে নিতে অস্ফুটে বললেন,
— শিরিন বুকে ব্যথা।
শিরিনের অভিব্যক্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। যেন সে শুনতে পায়নি।
দীর্ঘদিন হলো মাকসুদ সাহেব স্ত্রীর চোখের দিকে ভালো করে তাকাননি। গত তেইশ বছরে কখনো তার মন বোঝার চেষ্টা বা প্রয়োজনও বোধ করেননি। তবে আজ শিরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনে হলো শিরিনের চোখে আর যাই থাকুক তার প্রতি মায়া, ভালোবাসা নেই। মূল্যহীন, তুচ্ছ ভেবে তিনি নিজেই অবশ্য সে ভালোবাসা অর্জনের চেষ্টাও করেননি কখনো ।
দ্রুত ব্যথার তীব্রতা বাড়ছে। মাকসুদ সাহেবের মনে হলো তিনি আর বাঁচবেন না।
এই মুহুর্তে তার ব্যাংকে আছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকারও বেশি । স্ত্রীকে পদে পদে পরাজিত করে.. তার ইচ্ছে,স্বপ্নগুলোকে তিলে তিলে নির্দয়ভাবে হত্যা করে যে অর্থ তিনি সঞ্চয় করেছিলেন জেতার নেশায়।.. সেসব ভোগ না করেই কি তবে আজ তাকে চলে যেতে হবে পৃথিবী ছেড়ে ?
তিনি বাঁচতে মরিয়া হলেন।
সৃষ্টিকর্তা কখন কাকে কার মুখাপেক্ষী করেন তা বোঝা মুশকিল। নিজের এই ঘোর বিপদে তিনি আজ সেই স্ত্রীরই মুখাপেক্ষী হলেন, যার দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকায় গুণগুলো কখনো চোখে পড়েনি তার। সাহায্যের আশায় হাত বাড়িয়ে কাতর কন্ঠে বললেন,
— শিরিন বাঁচাও।
শিরিন ছুটে এলো না। সে কাপ হাতে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই রইল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তিনি আজ স্ত্রীর উপর রাগ করতে পারলেন না।
তিনি জানেন, শিরিনের অনুভূতিগুলোকে তিনিই হত্যা করেছেন,…. ধীরে ধীরে গত তেইশটি বছর ধরে ।
… অথচ মৃত্যু নিকটে অনুভব করে আজ এ মুহূর্তে কী ভীষণ হাহাকারই না জাগছে কোনো জলে ভেঁজা চোখ, শোকাতুর মমতাময় শীতল হাতের স্পর্শ পেতে তার !
তিনি খুব আশা নিয়ে আবারও স্ত্রীর দিকে তাকালেন। প্রচন্ড হতাশায় তার মন ছেয়ে গেল।
শিরিনের মৃত অনুভূতিগুলো কি শেষ মুহুর্তেও প্রাণ ফিরে পাবে না..!?
সংসার জীবনের ২৩ টি বছর মাকসুদ সাহেব কেবল একতরফা জিতেই গেছেন। আজ সেসব অর্জন তাকে আনন্দ দিতে পারল না বিন্দুমাত্র।
ঝাপসা হয়ে আসা চোখে স্ত্রীর শীতল, ভাবলেশহীন পাথরের মতো মুখটা দেখতে দেখতে জীবনের প্রথম মাকসুদ সাহেবের নিজেকে বড্ড ব্যর্থ, পরাজিত মনে হতে লাগল ।
***গল্পটি কপি করা নিষেধ।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..