1. press.sumon@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ১০:২৭ অপরাহ্ন

গল্প – – মল্লিকা চলে গেছে – – – – সুনির্মল বসু

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১৪৬ বার
খালের উপর সাঁকো। ডান দিকে বাঁদিকে পথ চলে গিয়েছে। পাশে একটি প্রাচীন বটগাছ। পাশে দুর্গা মন্দির।
আজ সকালে মহারাষ্ট্রে নিজের কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফিরেছে বিবৃতি রায়।
বাড়ি হয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ছোটবেলার ভালোবাসার জায়গাটায় ফিরে এসেছে ও। তখন এই জায়গাটায় এত বাড়িঘর ছিল না। দুপুরবেলায় বরশি দিয়ে খালের জল থেকে পুঁটি মাছ ধরত ও।
বটগাছ তলায় আসতে, সিধু কাকা প্রশ্ন করলেন, কবে আইছস?
ঘন্টাখানেক আগে।
ভালো করছস। যেখানেই থাকোস, পূজার আগে
নিজের জন্ম ভিটায় না আইলে, কারো ভালো লাগে?
বৌমা আইছে?
হ্যাঁ কাকা।
বিকালে তোগো বাড়ি যামু।
হ্যাঁ আসবেন।
হঠাৎ মল্লিকা ছুটে এলো।
কবে এসেছো?
একটু আগে।
ভালো আছো তুমি? বৌদি ভালো আছে?
হু।
সন্ধেবেলায় বৌদিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসো।
আসবো।
খানিক বাদে ওর ছোটবেলার বন্ধু আয়ুষ আর নৈঋৎ এলো। বলল, কেমন আছো গুরু!
ঠিক আছি।
মাল্লু কামাবার জন্য বোম্বে ফুটে গেলি?
এখানে চাকরি কোথায়?
আমাদের জন্য কিছু এনেছো, বস?
এই নে ইতালির সিগারেট। আমার এক অফিস কলিগ গিয়েছিল। আমার জন্য এক প্যাকেট এনেছে।
তিনজন একসঙ্গে সিগারেট ধরিয়ে আকাশে গোল্লা পাকাচ্ছিল।
সন্ধ্যেবেলায় বিবৃতি মল্লিকাদের বাড়ি এলো। সঙ্গে ওর স্ত্রী মনীষা।
মল্লিকার মা পদ্মাদেবী খুব আপ্যায়ণ করলেন। তারপর মল্লিকাকে পাশের ঘরে যেতে বলে চুপি চুপি বিবৃতিকে বললেন, মেয়ে তো আমার বড় হয়ে উঠলো। তিন বছর আগে বাবাকে হারিয়েছে। এ পর্যন্ত আমি একার হাতে ওকে বড় করলাম। তোর তো অনেক জায়গায় জানাশোনা। ওর জন্য একটা ভালো পাত্র দেখে দে না!
দেখবো মাসিমা।
তারপর উঠে পড়তেই, মল্লিকা বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে এলো। বলল, মা নিশ্চয়ই তোমাকে আমার বিয়ের ব্যাপারে পাত্র দেখতে বলেছেন, তাই না?
বিবৃতি বললো, হ্যাঁ।
আমার বিয়ে হয়ে গেলে, মাকে কে দেখবে?
সেটা ঠিক কথা।
খবরদার ,তুমি আমার বিয়ের ব্যাপারে একটুও এগোবে না।
আচ্ছা।
বাবা তখন বেঁচে, তখন আমার বিয়ের কথা উঠেছিল, আমি তখন একজনকে ভালোবাসতাম,
তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, সে বিয়ে যখন হয়নি, বিয়ে নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই।
বিবৃতি আর মনীষা বাড়ি ফিরলো।
খাওয়া-দাওয়ার পর, রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না বিবৃতির। মল্লিকা তখন ভরা যুবতী। ধানক্ষেত পেরিয়ে আকাশী রঙয়ের শাড়ির আঁচল উড়িয়ে
মল্লিকা ওর কাছে এসে দাঁড়াতো। কোচড় থেকে
ডাসা পেয়ারা এনে বলতো, এগুলো খাও, আমাদের গাছের পেয়ারা। অনেক কষ্ট করে গাছে উঠে তোমার জন্য পেড়ে এনেছি।
পেয়ারা গাছের ডাল খুব নরম হয়। যদি পড়ে যেতে কি হতো?
আমি ভয়টয় পাই না।
তুমি যা দস্যুপনা করো, একদিন সিওর কিছু একটা ঘটাবে!
আমি তোমার মত ভীতু নই। স্কুটার চালাতে গিয়ে একবার পড়ে গিয়ে ভয়ে আর জীবনে গাড়িটা ছুঁয়ে দেখ নি।
বিবৃতি চুপ করে যায়।
মল্লিকা বলে, বিবৃতিদা, তুমি এত ভীতু কেন গো?
যার মাথায় বুদ্ধি আছে, বিবেচনা আছে, সেতো ভীতু হবেই। সবাই তো তোমার মত না। আগে পিছনে চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ো।
তাতে তোমার কি?
আমার কিছু কিনা সেটা ভেবে দেখিনি। ভেবে বলবো।
বিবৃতিদা, তুমি আমায় ভালোবাসো?
এমন গুন্ডা মেয়েকে ভালোবাসতে যাবো কেন? আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে?
আমি গুন্ডা মেয়ে, বেশ তাহলে আজ থেকে তোমার সঙ্গে আড়ি আড়ি আড়ি!
রেগে শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে পিছন ঘুরে মাঠ পেরিয়ে চলে গিয়েছিল মল্লিকা।
পরদিন সকালে বিবৃতি নিজেই ওদের বাড়ির গিয়ে
ওর রাগ ভাঙ্গিয়ে দেয়।
বলে, পিয়ারী দাসের পুকুর পাড়ে কদম ফুলের গাছে অনেক ফুল হয়েছে। সন্ধ্যেবেলায় যাবো। তুমি যাবে তো মল্লিকা?
কদম ফুল আমি খুব ভালোবাসি। তুমি সাদা পাঞ্জাবী আর পাজামা পরে এসো। আমি সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো, তোমার জন্য।
আকাশ ভরা জ্যোৎসনা সেদিন। ঝুমকো লতার বন পেরিয়ে তরমুজের জমি ছাড়িয়ে ওরা কদম গাছের তলায় পৌঁচেছিল।
দূর আকাশে তারা, মাথার ওপরে শান্ত চাঁদ, বাঁশ বনে তিতির পাখির ডাক, চিরকালের পৃথিবীর সৌন্দর্য ওদের চোখে সেদিন ধরা পড়েছিল।
বিবৃতির মনে হয়েছিল, ভালোবাসার শব্দটা শুধু কথার কথা নয়, ভালোবাসা কি প্রবল ভাবে আঁকড়ে ধরা দরকার।
মল্লিকা, আমার চাকরি হলে, আমাদের বিয়ের ব্যাপারে ভাববো, তুমি কি বলো?
তুমি যা ভালো বুঝবে, তাই করো।
অনেক রাতে সেদিন ওরা বাড়ি ফিরে এসেছিল।
তারপর দ্রুত ঘটনাগুলি ঘটে চললো।
বোম্বাইতে চাকরি নিয়ে চলে গেল বিবৃতি। বস মনোহর রাঠোরের মেয়ে মনীষাকে বিয়ে করল ও।
জীবন থেকে হারিয়ে গেল মল্লিকা। কাজটা ঠিক করেনি সেদিন বিবৃতি। নিজের ক্যারিয়ার বানাতে গিয়ে এভাবে একটা নিষ্কলুষ ভালোবাসাকে খুন করা ওর উচিত হয়নি।
অপরাধ বোধটা আজ বুকে শেল হয়ে বিঁধছে।
মনীষা ব্যাপারটা হয়তো বুঝতে পারে নি। কিন্তু
বিবৃতি আজ নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না।
সত্যি সত্যি মল্লিকার সামনে দাঁড়াবার মুখ আজ আর ওর নেই।
বিবৃতি মনে মনে বলল, দুদিন পরে ছুটি শেষ হলে,
আমি কাজের জায়গায় ফিরে যাবো। তখন কাজের চাপে মল্লিকার কথা আমার মনেই পড়বে না। তারপরেই ভাবল, অপরাধ করে হয়তো পালিয়ে যাওয়া যায়, অন্যের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়,
নিজের কাছ থেকে পালাবার রাস্তা কোথায়?
তখন রাত্রি শেষ হয়ে গিয়েছে। গাছে গাছে প্রভাতী ফুল ফুটে উঠেছে। বনের পাখিরা ডাকছে। পাড়ার ভবা পাগল গান গাইছে, রাই জাগো রাই জাগো।
সিধু কাকা এসে খবর দিল। কাল রাতে মল্লিকা বাড়িওয়ালাকে টাকা মিটিয়ে ওর মাকে সঙ্গে করে চিরকালের জন্য এই গ্রাম ছেড়ে ওর মামার বাড়িতে চলে গিয়েছে।
বিবৃতি টেবিলে ড্রয়ার খুলল। অনেকদিন আগে লেখা মল্লিকার চিঠি হাতে পেল।
মল্লিকা লিখেছিল,
একদিন স্বপ্নে তোমাকে দেখেছিলাম, জেগে উঠে তোমাকে ছুঁয়ে দেখলাম, তুমি এসেছো, একটাই জীবন, একবারই ভালোবাসা। তোমাকে আষ্টে পৃষ্ঠে
ভালোবেসেছি আমি। সেই ভালোবাসা যদি সত্যি না হয়, সেদিন তোমার থেকে শত যোজন দূরে চলে যাবো আমি। আর কোনদিন তোমার কাছে আসবো না। কক্ষনো না।
সব জায়গায় বরাবর জিতে যাওয়া বিবৃতির চোখে তখন অঝোর ধারায় কান্না নেমেছে।
মনীষা ঘরে ঢুকে বলল, তোমার চোখে জল কেন?
আরে না না! চোখে মনে হয়, পোকা পড়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..