1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৯:০৬ অপরাহ্ন

গল্প: # চাঁদমুখ ### মাহফুজা রহমান অমি

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১
  • ২৪৪ বার
আট বছর পর যখন বাবার বাড়ির দরজায় স্বামী আর সন্তান নিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের ভেতরে এতদিন ধরে পুষে রাখা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা তখন যেন খুব বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।
দরজায় কড়া নাড়ব কী না এই সংশয়ে ভেতরে দ্বন্দ্ব চলতেছে ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কড়া নেড়ে বসলো ছোট্ট আরাফ। আমি রাতুলের দিকে তাকালে রাতুল শান্ত থাকার ইশারা দিলো।
দরজার ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠস্বরের আওয়াজ, ‘কে?’
আমার গলাটা যেন মুহূর্তেই ভারী হয়ে গেলো। কথাই বের হচ্ছে না৷
এপাশ থেকে আরাফ হাসিমুখে জবাব দিলো, ‘আমি আরাফ।’
‘কোন আরাফ?’ প্রশ্নটা করতে করতে মা দরজা খুলে তাকিয়ে দেখেন আমি দাঁড়িয়ে আছি। সঙ্গে ছয় বছরের ছেলে ও স্বামী। আমার চোখে ভীড় জমে গেল জলেদের। মা হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
রাতুল এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। মা অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলেন।
আরাফ প্রশ্ন করলো মা’কে, ‘তুমি কী নানুমণি?’
মা কোনো কথাই বলতে পারছেন না বিষ্ময়ে। তবুও মাথা নেড়ে আরাফের প্রশ্নের উত্তর জানালেন।
ভেতর থেকে অল্প বয়সী একটা মেয়ে এদিকে আসতে আসতে প্রশ্ন করলো, ‘কে এসেছে মা?’
আমার গলা দিয়ে এখনো কোনো কথা বের হচ্ছে না৷ মেয়েটা আমাকে দেখেই মুখে একরাশ আনন্দ নিয়ে অবাক স্বরে বলে উঠলো, ‘আপু! আপনি! দাঁড়িয়ে আছেন কেন ভেতরে আসুন আপনারা।’
আমি মেয়েটাকে এখনো চিনতে পারছি না৷ কখনো দেখিনি। তবে যেটা অনুমান করছি সেটা ঠিক কী না বুঝে উঠতে পারছি না৷ আমার এমন অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে মেয়েটা হেসে বললো, ‘আমি আপনার ছোট ভাইয়ের বউ।’
অনুমান সঠিক হওয়ায় মুখে হাসি ফুটলো। মা এখনো কোনো কথা বলছেন না৷ আমিও কথা বলতে পারছি না। গলাটা ভারী হয়ে আছে এখনো। চোখেও জমে আছে অজস্র জল।
আট বছর আগে বাবা যখন জোর করে তার অফিস সহকর্মীর ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাইছিলেন তখন উপায়ন্তর না পেয়ে আমি রাতুলের সঙ্গে বাড়ি ছেড়েছিলাম৷ রাতুল তখন সদ্য একটা চাকুরি পেয়েছে। বাবা তবুও রাতুলকে জামাই বানাতে রাজি ছিলেন না।
চলে যাওয়ার পরে রাতুলের পরিবার যতটা সানন্দে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলো ততটাই রাগ নিয়ে আমার পরিবার আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো। পরবর্তীকালে যোগাযোগ করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়েছিলাম। বাবা কড়া স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জানি আমার কোনো মেয়ে নেই। আমার একটাই ছেলে। সুতরাং মেয়ে পরিচয় দিয়ে অযথা যোগাযোগের চেষ্টা করো না।’
বাবার একরোখা মনোভাবের কাছে আমি হেরে গিয়ে মনের মধ্যে অভিমান আর অভিযোগের পাহাড় জমিয়ে ফেলেছিলাম। জীবনে যা’ই হোক না কেন কখনো বাবার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবো না বলে মনে মনে পণও করেছিলাম। ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়তো, মায়ের মুখটা ভেসে উঠতো। সব আবেগ চাপা দিয়ে দিনের পর দিন পার করেছি। অভিমানের তোড়জোড় এত বেশি ছিলো যে আরাফের জন্ম হলো তাও ও বাড়ির কাউকে জানাইনি। রাতুল যোগাযোগের চেষ্টা করতে চাইলেও বারন করেছিলাম।
আজ এত বছর বাদে সব অভিমান অভিযোগ ভুলে হাজির হয়েছি এ বাড়িতে। কারণ কেবল আরাফ চেয়েছে বলে নয়, পরিবারের প্রতি প্রবল ভালোবাসাটা ভেতরে আবার নতুন করে জেগে উঠেছে বলে।
ঈদে সবাইকে নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতে দেখে আরাফও বায়না ধরতো নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার। আমি আর রাতুল তখন এটা ওটা বুঝিয়ে ওকে থামিয়ে রাখতাম৷ সঙ্গে থামিয়ে রাখতাম আমার ভেতরে জেগে ওঠা ইচ্ছাকেও। কিন্তু এবার আর থামিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি৷ আরাফ এবার রমজানে প্রথম রোজা রেখেছে। ওর রোজা রাখায় আমরা সকলে খুশি হলে আরাফ উপহার বায়না করেছে। উপহার হিসেবে এবার ঈদে নানাবাড়ি যেতে চেয়েছে। ছেলের আবদার আর আমার গোপন ইচ্ছে সব মিলিয়ে পুষে রাখা পুরানো সব রাগ, অভিমান, অভিযোগকে পিষে ফেলে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। রাতুলও মত দিলো।
আরাফের খুশিকে আরও একটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই আরাফকে সঙ্গে নিয়ে আমি আর রাতুল চাঁদ রাতেই ছুটে এলাম এ বাড়িতে।
বাড়ির ভেতরে এসে বসলাম আমরা। সেই আগের বাড়ি। তবে বদলেছে অনেক কিছু। কিন্তু বদলায়নি বাড়ির দেয়ালে করা আমার প্রিয় রং নীল। মায়ের চোখে টলমল করছে জল। আরাফকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বসে আছেন সে৷
আমি মায়ের মুখোমুখি হয়ে কান্না জড়ানো গলায় বললাম, ‘এখনো মাফ করোনি আমায়?’
মা এবার হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। আরাফের সঙ্গে আমাকেও জড়িয়ে ধরলেন বুকের মধ্যে। আমার চোখ ভিজে গড়িয়ে পড়ছে জলের স্রোত।
অভিযোগের স্বরে বললেন, ‘তোর বাবা রাগ করেছিলো বলে তুইও রাগ করলি! এতটা বছর পেরিয়ে গেলো একটা বার কেন এলি না রে? মায়ের কথা মনে পড়তো না তোর?’
আমি কান্না করেই চলছি। জবাব দেওয়ার বদলে মা’কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম।
কান্নাকাটি শেষ হলে ছোট ভাইটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। ছোট ভাইয়ের বউ বললো ছাঁদে আছে ও। প্রশ্ন করলাম, ‘আমাকে কীভাবে চিনলে তুমি?’
হাসিমুখে বললো, ‘চিনতে পারব না! আপনার ভাইয়ের ফোনের গ্যালারির অর্ধেক ছবিই তো আপনার।’
আমার চোখে আবার ভীড় জমালো জলেরা। ভেতরের আবেগ কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না৷ বাবাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারছি না সে কোথায়।
আরাফ মা’কে প্রশ্ন করলো, ‘নানুমণি, নানুভাই কোথায়?’
মা হেসে বললেন, ‘তোমার নানুভাইও ছাঁদে। মামার সঙ্গে ঈদের চাঁদ দেখছে।’
‘তুমি চাঁদ দেখতে যাবে না?’
মা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমার সামনেই তো চাঁদ চলে এসেছে। আমার আবার কেন চাঁদ দেখতে হবে।’
অবাক হয়ে আরাফ বললো, ‘কোথায় চাঁদ?’
মা আরাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এই তো তুমি। তুমিই তো আমাদের চাঁদ।’
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বাবার কাছে যাব নাকি এখানে অপেক্ষা করব?’
মা বললেন, ‘যেটা করতে মন চাইছে সেটাই করতে পারিস।’
আমি হেসে বললাম, ‘তাহলে চলো ছাঁদেই যাই।’
আরাফ খুশি হয়ে উঠলো। ছাঁদে পা রাখলাম। আলো জ্বলছে। বাবা আর ভাই চেয়ারে বসে বসে গল্প করছেন। আরাফ ওর বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। আমাকে দেখতেই বাবা অবাক হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভাইটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বললো, ‘আপু। কখন এলি তুই? আমাকে ডাকলি না কেন?’
ওর চোখে চকচক করছে জল। কত বড় হয়ে গিয়েছে আমার ভাইটা৷ সংসারের দায়িত্ব নিতে শিখেছে। আমি আবার আবেগঘন হয়ে পড়লাম। ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে নিলাম৷
রাতুলের সঙ্গে আলাপ সেরে আরাফের দিকে ওর চোখ পড়তেই আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। আমি হেসে ইশারাতেই জবাব দিলাম ওর ধারণা ঠিক।
মুহূর্তেই ও আনন্দে আটখানা হয়ে আরাফকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলো। আমি সে দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাবা আর আমি মুখোমুখি আবার৷ আট বছর পর। বাবা মুখটা যতই রাগ রাগ করে রাখতে চাইছেন ততই যেন ব্যর্থ হচ্ছেন। মুখে সে চেষ্টা স্পষ্ট ফুটে উঠছে।
মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস করে বললাম, ‘আর কত বছর রেগে থাকবে বলোতো? আর কত কষ্ট দিতে চাইছো আমায়?’
বাবা চুপ করে রইলেন। রাতুল আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
গড়গড় করে চোখ বেয়ে পানি নামছে। নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কোনোদিনও কী মাফ করতে পারবে না আমায় বাবা?’
বাবার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বাবার চোখের দিকে তাকাতেই দেখি বাবা কান্না করছেন৷ মা এসে বাবার পাশে দাঁড়ালেন৷ আমি বাবাকে জাপটে ধরে কান্না শুরু করলাম।
বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি এই বুঝি তুই এলি বলে। কিন্তু কত বছর পার হয়ে গেলো তুই এলি না। ভেবেছিলাম আমি মরে গেলে তখন বুঝি আসবি।’
কথাটা শুনে আমার ভেতর ভেঙ্গে আরও জোরে কান্না নেমে এলো। বললাম, ‘তুমি তো একবার আমার খোঁজ নিতে পারতে বাবা!’
‘তোর এতটা অভিমান জমেছে বাবার উপর যে খোঁজ নিতে যেয়েও থেমে গিয়েছি। ভেবেছি, অভিমান কমে গেলেই তুই চলে আসবি৷ আজ নয়তো কাল। এমন অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটে গেলো কতগুলো বছর।’
বাবা রাহাতকে ডেকে কাছে টেনে নিলেন। আরাফ দৌড়ে এসে বললো, ‘তুমি সবাইকে জড়িয়ে ধরছো আমাকে তো ধরলে না নানুভাই?’
বাবার ভেজা চোখে মুহুর্তেই আনন্দ এসে ঘাঁটি জমালো। আরাফকে কোলে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তুমি এতদিন কেন এলে না নানুভাইকে দেখতে?’
আরাফ সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘আমি তো ছোট মানুষ। কিন্তু তুমি তো বড় মানুষ। তাহলে তুমি কেন এতদিন আমাকে দেখতে গেলে না?’
ওর কথা শুনে সবার সঙ্গে বাবাও হেসে উঠলেন। আরাফ বললো, ‘আর কত আকাশের চাঁদ দেখবে তুমি! তোমার বাসায় তো চাঁদ চলেই এসেছে।’
বাবা বললেন, ‘কোথায় চাঁদ এসেছে?’
আরাফ জোরালো গলায় বললো, ‘কেন নানুমণি তো বললো আমিই তোমাদের চাঁদ! তাহলে চাঁদ দেখতে হবে কেন?’
বাবা হেসে উঠে বললেন, ‘একদমই ঠিক। যেহেতু চাঁদ চলে এসেছে, তাহলে এখন তো আর চাঁদ দেখতে হবে না৷ চলো আমরা বাসায় যাই। বাসায় গিয়ে তাহলে আরামে বসে চাঁদ দেখি।’
আরাফ খুশি হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে নানুভাই৷’
ছোট ভাই পাশে এসে দাঁড়ালো।
‘আপু৷ খুব মিস করেছি তোকে।’
আমি রাগত্ব ভঙ্গিতে বললাম, ‘হ্যাঁ! একবার যোগাযোগও তো করিসনি!’
‘বাবার ভয়ে। আর তোর উপরেও রাগ ছিলো। আমার সঙ্গে তো যোগাযোগটা রাখতে পারতিস তুই না হয় ভাইয়া।’
আমি হেসে বললাম, ‘তা এখন সব রাগ কমেছে?’
‘বাসায় চাঁদমুখ নিয়ে এসেছিস। রাগ থাকে কী করে!’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘তোর বউটা কিন্তু খুব সুন্দর। কে পছন্দ করেছে মা নাকি বাবা?’
‘দু’জন মিলে।’
‘মেয়েটার চাঁদমুখটা দেখেই ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের বউ হবে।’
ছোট ভাইটা হেসে উঠলো। সঙ্গে আমিও হেসে উঠলাম।
আরাফ রাতুলকে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা বাবা, এখন থেকে কী তাহলে আমার নাম আরাফের পরিবর্তে চাঁদমুখ হবে?’
রাতুল হেসে উঠলো। সঙ্গে হেসে উঠলাম আমরা সকলে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..