1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ১২:০৪ পূর্বাহ্ন

# গল্পটা_ভালোবাসার! ********************** ফারজানা ইসলাম

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৭ জুলাই, ২০২১
  • ৫০১ বার
আমার গায়ের রঙটা যদি বুঝিয়ে বলি তাহলে ডার্ক চকলেটের মত । অবশ্য এটা আমার পৈতৃক সুত্রে পাওয়া আর ছোটোবেলা থেকে দেখতে দেখতে আমিও এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি । ছোটোবেলায় এই রঙ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বলত আমার বন্ধুর মায়েরা । যাঁরা আমায় প্রথম দেখতেন, তাঁরা ছেলেকে শাসন করতেন এই বলে যে, আর কোনও মানুষ পেলি না দুনিয়ায়? সব ছেড়ে এই কালিয়া, কেলোটের সাথে বন্ধুত্ব করেছিস ! মন খারাপ হত ভীষণ তবে আমার বন্ধু ভাগ্য খুব ভাল । যারা আমার বন্ধু , আমার রঙ নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না কস্মিনকালেও । তবে তরু’র মাথাব্যথা ছিল । আমি তরু’র দিকে যখনই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম, তরু হাতটা অল্প একটু তুলে ইশারায় চড় দেখাত । এতোটুকু মেয়ের সাহস দেখে অবাক হতাম তবে আমার বেহায়া চোখ ঐসব হালকা পাতলা ইশারায় কখনও দমে যেত না । তরুকে যখনই দেখতাম, যতক্ষণ দেখা যায় আমি তাকিয়েই থাকতাম ।
জন্মসূত্রে তরু আমার প্রতিবেশি । একেবারে পাশের বাড়ির সেই মেয়েটি । তরু’রা দুই বোন । তমা আপার সাথে আমার দারুণ ভাব । ছোট্টোবেলা থেকে আমি তমা আপার ফরমায়েশ খাটতাম । ‘এই অমিত দোকানে যাচ্ছিস? আমার জন্য এক দিস্তা কাগজ আনবি কিন্তু । এই বাজারে গেলে পাকা কদবেল নিয়ে আসিস তো । অমিত আমি একদম আঁকতে পারি না । তুই আমার প্রাকটিক্যাল খাতায় ব্যাঙটা এঁকে দিস তো ।’
আমি সুন্দর করে সব কাজ করে দিতাম একটাই লোভে, যদি তরু আমাকে কোনও ফরমায়েশ দেয় ; কিন্তু তরু তো আমার দিকে ফিরেও তাকায় না । ভাবখানা এমন যে তাকালে পাছে আমার কালো রঙ যদি ওর গায়ে লেগে যায় ! আমি তবুও হাল ছাড়ি না । যদি একবার তরু কিছু বলে এই আশায় ওর আশেপাশে হ্যাংলার মতো ঘুরতে থাকি । তখনও ভালোবাসাবাসির বয়স হয়নি । নিস্পাপ ভালোলাগা থেকে আমি তরু’র কাছাকাছি আসতে চাইতাম কারণ তরু ছিল সমবয়সী মেয়েগুলোর থেকে একটু আলাদা, একটু নিজের মতো । ওর এই ভাবটা আমার খুব ভালো লাগত । দুধে আলতা গায়ের রঙ কেমন হয় আমি ঠিক জানি না, তবে তরুকে দেখলে আমার মনে হত ওর রঙটা ভাজার আগের চীনেবাদামের খোসার মত ।
তরু দুই বেণী ঝুলিয়ে একটু অহংকারী ভাব নিয়ে সব সময় পাশ কাটিয়ে স্কুলে চলে যেত । পাশে থাকা তমা আপা মাঝেমধ্যে বলত –
‘এই তরু জানিস, অমিত না কালকে ব্যাডমিন্টন খেলে মেডেল জিতেছে । তরু শোন আইয়ুব বাচ্চুর সেই তুমি গানটা অমিত এত সুন্দর করে গলায় তুলেছে যে কী বলব ! এই অমিত দু’লাইন গেয়ে শোনা তো ।’
তরু বলত , থাক আপা, আমার গান শুনে কাজ নেই । মাটি পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে তবুও এমন রঙ আসবে না । যেই না সুরৎ তাতে আবার “সেই তুমি” ! ওকে “ও সখিনা” গাইতে বল, ওটাই মানাবে চেহারার সাথে ।
আমার অপমানে লাগা উচিত ছিল কিন্তু কেন যেন ওটা ঠিকমত মাথাচাড়া দিয়ে উঠত না! তরু’র কোনও কথায় আমার কখনও অপমানবোধ হত না । যা-ই হোক তরু’র অপমান সহ্য করতে করতে একসময় আমরা সবাই বড়ই হয়ে গেলাম । তমা আপা তখন বাংলায় মাস্টার্স করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি ইংলিশ নিয়ে অনার্সের শেষের দিকে । তরু জাহাঙ্গীরনগরে অংক নিয়ে পড়ছে ।
আমি এখনও তরুকে দেখি তবে ছোটোবেলার মত আর গোগ্রাসে গিলতে থাকি না, বড়বেলার চোরা চাহুনিতে দেখি । বলা তো যায় না, এখনও যদি ইশারায় চড় তোলে ! তরুকে দেখলে আমার বুকের ভেতর মেঘের গুড়গুড় শব্দ হয়, মাথা ঝিমঝিম করে । আমি বুঝি, এটার নামই ভালোবাসা । আমি জানি আমি কোনোদিন তরু’র নাগাল পাব না, তবুও মন যেন মানতেই চায় না । মন হল আজন্মের বেহায়া । শতো অপমান, তাচ্ছিল্য কোনও কিছু গায়ে মাখে না । আমি বুঝি তরু আমাকে আগের চেয়েও বেশি ঘেন্না করে, হুম ওটা ঘেন্নাই হবে হয়ত । নইলে একটা মানুষ এত বছরে একবারও আমার সাথে হেসে কথা কইল না তো । আমি জানি আমি বামন, তাতে কী? জানি পাব না কিন্তু চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর অধিকার তো কেউ কাড়তে পারবে না আমার কাছ থেকে ।
******
এরমধ্যে হুট করে তমা আপার বিয়ে হয়ে গেল । বিয়ের পুরো আয়োজনে আমি খুব খেটেছি । খালাম্মা তো বলেই ফেললেন –
যাক, আমার ছেলে না থাকার দুঃখ ঘুচল এতোদিনে । অমিত তুই না থাকলে এত কাজ কে করতো বল দেখি ?
তমা আপা বলল, ও তো করবেই, ও আমার ছোট ভাইই তো । এই শোন, ভাইয়ের যা যা দায়িত্ব থাকে, সব কিন্তু তোকে করতে হবে । আর এই নে এখানে দু’টো শার্ট আছে । আমার বিয়ের দিন যেটা মন চায় গায়ে দিস ।
বিয়ের পর তমা আপা চলে গেল নতুন ঠিকানায় । তমা আপা নেই তাই তরুদের বাসায় আগের মত আর যাওয়া হয় না । কার কাছে যাব? এরমধ্যে তরু’র জন্মদিন চলে এল । নিজেকে অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না । সুনীলের প্রেমের কবিতা আর ছোট্টো একটা কেক নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম সন্ধ্যায় । সেদিন তমা আপাও এসেছিল । গিফট নিয়ে ধন্যবাদ বলা ছাড়া তরু আর কোনও কথা বলল না আমার সাথে । অনেকদিন পর সবার সাথে চমৎকার আড্ডা আর খানাপিনা শেষে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন থেকেই বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম ঢোলের আওয়াজ চালু হয়ে গেছে । কী বলবে তরু? তরু কী বুঝতে পারবে এই কবিতার মানে ? তরু কী কোনোদিন বুঝতে পারবে ওকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি? এত ভালোবাসা কেউ ওকে বাসবে না কোনোদিনও । সেই রাতে অধিক উত্তেজনায় আমার ঘুম হল না । সকালে আমার চেহারা দেখে মা ঘাবড়ে গেল –
কী রে শরীর খারাপ করেছে? চোখ দু’টো এমন লাল কেন?
কিছু না মা, এমনি । মা’র কাছে যদি ধরা পড়ে যাই এই ভয়ে খুব দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম । পর পর দু’টো দিন আমার ঘোরের মধ্যে কাটল । তরু কী কিছুই বুঝতে পারল না ! উহ,, অপেক্ষা আর অপেক্ষা ! অপেক্ষার বুঝি এমনই মরণ জ্বালা হয়? অপেক্ষার অবসান হলো একসময় । বাসায় ফিরতেই মা একটা বাঁশ কাগজের মোটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, তরু এসেছিল, এটা দিয়ে গেছে । আমার কান যেন এমন মধুর কথা এর আগে কোনোদিন শোনেনি । রুমে ঢুকে দরজা আটকে খামটা বুকে চেপে রাখলাম অনেকক্ষণ । তবে কী তরুও……
নেশা কাটলে খামটা খুলে ভেতরের জিনিসগুলো বের করলাম । আজ পর্যন্ত তরু আমাকে অজস্র অপমান করেছে ; কিন্তু আমার গন্ডারের চামড়া সব সয়ে নিয়েছে। এত বছরের সব অপমান এক পাল্লায় আর আজকেরটা আরেক পাল্লায় । আমার সামনে পড়ে আছে একটা ফেয়ার এন্ড লাভলী আর একটা চটি সাইজ বই – “রঙ ফর্সা করার হরেক উপায়” । আমি মরমে মরে গেলাম । এতটা অপমান! একটা মানুষ কী করে এতটা ঘৃণা করতে পারে অন্য মানুষকে ! শুধু কী গায়ের রঙের কারণে? আজ প্রথম আমার ভেতরের আমি জেগে উঠল । মনে হল যদি কখনও সুযোগ আসে, প্রতিশোধ নেব ।
এরপর আমি তরুকে মুছে দিলাম আমার জীবন থেকে । ভুলে গেলাম তরু নামের কেউ একজন ছিল, যার জন্য আমি হেন কোনও কাজ নেই যা করতে পারি না । তরু আমার জীবন থেকে বিদায় নিল । আমি লেখাপড়ায় মন দিলাম ।
সেই বছরই তরু’র বিয়ে হয়ে গেল । বর ওর আপন খালাতো ভাই । সদ্যই ডাক্তারি পাশ করেছে । তরু রাজি ছিল কি না জানি না, কারণ তরু তো আমার কাছে ছিল মলাট বন্দী একখানা বই । যার নামটা ছাড়া আর কিছুই আমার পড়া হয়নি । তবে মা’র কাছে শুনেছিলাম বিয়ে নিয়ে নাকি ওদের বাড়িতে বেশ অশান্তি হয়েছিল ।
তরুর বিয়ের আগে আগে তমা আপা চলে এল । একদিন বাসায় এসে বলল, দেখ অমিত অনেকদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি তোর ওপর । তরু’র বিয়ের এত কাজ কী করে সামাল দেই ভাই ? তুই ছাড়া এত গোছানো কাজ কে করবে বল তো?
বাজার-সদাই, ডেকোরেটর, গায়ে হলুদের স্টেজ সবকিছু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করিয়ে দিলাম । যদিও তরুকে মন থেকে মুছে ফেলেছিলাম কিন্তু আমার সামনে দিয়ে তরু অন্য কারও হাত ধরে চলে যাচ্ছে , এটা সহ্য করার মত মন আমার ছিল না । তরুর বিয়ের দিন ভোরের ট্রেনে তাই ময়মনসিংহ চলে গেলাম ।
********
একটা কলেজে পড়াই আমি । মেয়েরা আমাকে কোনোদিন পছন্দ না করলেও আমার ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু আমাকে খুব পছন্দ করে । হয়ত আমার পড়ানোর ধরণটা ওদের টানে । গল্পে গল্পে পড়াই ওদের । বিকেলে একটা কোচিং সেন্টারে ইংরেজি ক্লাস নেই । বাকিটা সময় বাসায় কাটে । বন্ধুরা সব ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে পেটের দায়ে । ঢাকায় শুধু নাদিম আর সাম্য আছে কিন্তু ওরাও চাকরি নিয়ে ব্যস্ত তাই কারোরই আর সময় হয় না । এই ব্যস্ততার মাঝেও মা হঠাৎ হঠাৎ অস্থির করে তোলে –
এবার বিয়ে কর, এভাবেই কী তোর দিন কাটবে? আমি মরলে রেঁধে খাওয়াবে কে?
আমি এক কান দিয়ে শুনি তারপর নিজের কাজে চলে যাই ।
অনেক দিন পর তমা আপার সাথে দেখা নীলক্ষেতে । প্রায় দুই বছর তো হবেই ! অনেক কথার শেষে বিদায় বেলায় তমা আপা বলল –
তরু কিন্তু এখন এখানেই থাকে ।
তাই নাকি !
হুম, ওর সংসারটা টিকলো না রে । কার যে দোষ ছিল, আমরা বুঝতেই পারলাম না । পাঁচ বছর ধরে একসাথে থাকলো অথচ দেখ, না হলো কোনও ভাব-ভালোবাসা, না হল বাচ্চাকাচ্চা ।
প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইছিলাম, তাড়াতাড়ি বিদায় নিলাম আপার কাছে ।
একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি তরু আর খালাম্মা গল্প করছে মা’র সাথে । একটু থতমত খেয়েও সামলে নিলাম । সালাম দিয়ে ভেতরে চলে গেলাম । তরু’র চাহুনিতে বুঝলাম, আমার এই নির্লিপ্ততা ওকে হতবাক করেছে ।
খানিক পরে দরজায় নক, তরু ! এ কী যন্ত্রণা! এই অবেলায় বুকের ভেতর আবার কিসের ডামাডোল ! আমি ভেবেছিলাম আমার মনটা শুধরে গেছে কিন্তু এ তো দেখি এখনও তরুর নাম জপ করে ! যতটা পারা যায় স্বাভাবিক থেকে তরুকে বসতে বললাম । তরু জানালো, ও অনার্সটা শেষ করতে পারেনি কিছু ঝামেলার কারণে । এখন আবার পড়া শুরু করতে চাচ্ছে । কাগজপত্রে সই দরকার । আমার চেনা কোনও গেজেটেড অফিসার থাকলে…
বললাম, রেখে যাও । আমি কাল ফেরার সময় করিয়ে নিয়ে আসব ।
পরদিন আমি কাগজগুলো নিয়ে তরুদের বাড়িতে গেলাম । আমি নিজে না গেলেও পারতাম । যে কারও হাতে পৌঁছে দিতে পারতাম । বুঝলাম বেহায়া, নচ্ছার মনটা এখনও ধুঁকছে । কাগজপত্র রেখে চলে আসার সময় জীবনে প্রথম তরু আমাকে চা সাধলো ! আমি না করতে পারলাম না ।
এরপর থেকে তরুর সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয় যাওয়া-আসার পথে । হাসি বিনিময় পর্যন্তই সম্পর্ক আমাদের । এরচেয়ে বেশি বাড়তে দেই না আমি । ছাত্র পড়াতে যেয়ে কিছুটা আত্মসম্মানবোধ আমারও তৈরি হয়েছে । তবে ইদানিং তরু ওর মা’কে নিয়ে প্রায়ই বাসায় আসে । রাতে খেতে বসলে মা’র মুখে তরু’র অনেক প্রশংসা শুনি । আমি কখনও আগ্রহ দেখাই না কারণ আমি মা’র কাছে ধরা পড়তে চাই না । আমার হৃদয়টা পুড়ে কয়লা হয়েছে । নতুন করে আর কোনও ক্ষত সইতে পারব না ।
তরু ইদানিং রাতের দিকে বেশি আসে । আমার বুক শেলফ ভরা বই থেকে কোনও একটা বই নিয়ে আলোচনা করে, পড়ার জন্য বাসায় নিয়ে যায় । যদিও অংকের ছাত্রী কিন্তু ইতিহাস ওকে বেশি টানে । একদিন বই ফেরত দিতে এসে জিজ্ঞেস করল –
আচ্ছা অমিত তোমার বেশিরভাগ বইয়ে টি লিখে একটা করে সংখ্যা দেয়া কেন ?
তরুর কথায় আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল । মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলো , যখন আমি একতরফাভাবে পাগলের মত ভালোবাসতাম তরুকে । কোনও দিবস উপলক্ষ্যে তরু’র নামে বই কিনে নাম্বার দিয়ে রাখতাম ।
আমি হেসে বললাম – ওটা একটা কোড, তুমি বুঝবে না ।
একদিন খেতে বসে বিষম খেলাম মা’র কথা শুনে –
হ্যাঁ রে তরুকে তোর কেমন লাগে বল তো?
তরুকে আবার কেমন লাগবে! সবসময় যেমন লাগে তেমনই ।
আরে বাবা বলছি যে বউ হিসেবে কেমন হয়?
কার বউ মা? ওর কী আবার বিয়ে হচ্ছে নাকি!
বিয়ে তো দিতেই হবে, আজ অথবা কাল । সারাজীবন কী ওর মা বেঁচে থাকবে নাকি ? আর বিয়ে ভেঙেছে বলে কী আর বিয়ে হতে পারে না?
আমি সেটা বলিনি মা ।
তুই কী বিয়ের কথা ভাববি না কোনোদিন?
এরমধ্যে আবার আমার বিয়ের কথা আসছে কেন?
তরুকে যদি আমাদের বাসায় নিয়ে আসি কেমন হয় বল তো?
তখনও আমি ধরতে পারছি না বিষয়টা । বললাম –
আনতে হবে কেন? ও তো প্রতিদিনই আসছে ।
আমরা সবাই মিলে কথা বলেছি অমিত । এখন তুই যদি রাজি থাকিস তো বিয়ের….
মা! আঁৎকে উঠলাম আমি । তরু’র সাথে আমার বিয়ে! কী করে চিন্তা করো, বলো তো? তরু জানলে কী ভাববে!
তরু জানে । তমা জেনেছে ওর মতামত । এখন তুই যদি অমত না করিস তো….
******
তরু’র সাথে আমার বিয়ে হয়েছে দেড় বছর হল । আমি এখনও ঘোরের মধ্যে থাকি । আমার এখনও মনে হয়, একদিন ঘুম ভেঙে দেখব তরু চলে গেছে । এতটা ঘৃণা করা একটা মানুষকে কেউ ভালোবাসতে পারে ! তরু আমাকে বোকা বানানোর জন্য একটা খেলা খেলছে হয়ত । সারাজীবনের সব অপমানের প্রতিশোধের চিন্তাটা মাথায় আসে তবে তরু’র চোখে চোখ পড়লে আমি অন্য মানুষ হয়ে যাই ।
তরু এখন আর আগের তরু নেই । সেই অহংকারী, দাম্ভিক তরু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । সে আমার সাথে খুব স্বাভাবিক আচরণ করে ; কিন্তু সারাজীবনের জড়তা, না পাওয়ার কষ্ট আমাকে এখনও আষ্টেপৃষ্টে রেখেছে । একটা ভয় আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে । তরু যদি প্রেমে ভাসিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় তখন আমি আর কূলে ফিরতে পারব না । নির্ঘাত ডুবে মরব । একটা মানুষ এক জীবনে কতবার মরতে পারে ?
তরু আমার ধারণা ভুল প্রমান করতে নিজেকে নতুন করে মেলে ধরে আমার কাছে । প্রতিদিন আমি তরুকে নতুন করে আবিষ্কার করি । তরু যখন দুই কাপ চা এনে আমার হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে কাপ ধরিয়ে দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দেয়, আমার বুকে চাপ লাগে । নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে । মনেহয় পৃথিবীটা সত্যি অনেক সুন্দর ।
দেখতে দেখতে বিবাহিত জীবনের দুই বছর পার করে দিলাম আমরা । আমার জীবনের জমে থাকা সব কষ্টের মেঘ তরু ওর ঝলমলে ভালোবাসা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে । তরু হয়ত জীবনে অনেক বড় ধাক্কা খেয়ে তারপর আমার দুয়ারে এসেছিল । তখন হয়ত তার মনে হয়েছিল, নিরাপদ একটা আশ্রয় দরকার । অথবা….. আমি আসলে জানি না তরুর কী মনে হয়েছিল । তবে আমি আগের কোনও কথা মনে রাখিনি, কোনও দুঃখ পুষে রাখিনি মনের ভেতর । মনের ভেতর ‘কিন্তু’ থাকলে আমরা ভাল থাকতে পারতাম না ।
আমি হাসপাতালের কেবিনে বসে আছি । সামনের বেডে তরু হেলান দিয়ে বসে আছে । নরম তোয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটা মা’র বুকে উপুড় হয়ে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে । কী তীব্র ভালোবাসামাখা একটা দৃশ্য ! তরু’র বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে আছি আমি । আমার আরেকটা হাত আমাদের সন্তানের শরীরে । তরু’র মুখটা ভালোলাগায় ভরে আছে । যেন দুনিয়ার সব সুখ ওর বুকে । তরু আস্তে আস্তে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । আমার ছেলের গায়ের রঙ ডার্ক চকলেটের মত, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..