সারাবিশ্ব তখন মহামারী করোনায় জর্জরিত। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে। টিভি অন করলেই শত শত লাশের দেখা মিলছে। চারিদিকে শুধু হাহাকার। মরনব্যাধি করোনার থেকে অসহায় মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় বেশি হাহাকার করছে। দরিদ্র রিকশাচালক রহমান মিয়ার পরিবারেও এই হাহাকার চলছে। অসহায় দরিদ্র এই মানুষগুলো দিন আনে দিন খায়। কাল থেকে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে অনাহারে রয়েছে।
চারিদিকে তখন প্রচন্ড লকডাউন চলছে। বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবুও সন্তানদের এমন অবস্থা সইতে না পেরে তিনি রিকশা নিয়ে বেরুতে যায়। তার স্ত্রী রাবেয়া তাকে ডেকে বলে,”কই যাইতেছেন? দেশে লকডাউন চলতাছে,অহন বাইরে যাওয়া নিষেধ।”
-রহমান মিয়া অশ্রুঝরা চোখে বলে,”পেট যে কোনো বাধা নিষেধ মানে না। পোলাপানগোর দিকে তাকাইবার পারতাছি না। আমি এমনি হতভাগা যে ঠিক কইরা তোমগোরে খাওয়াইতেও দিতে পারি না।”
-কিন্তু?
-আর বাধা দিও না ময়নার মা,আমারে যাইতে দেও। যদি কিছু পাই!
রহমান মিয়া রাবেয়ার কোনো কথা না শুনেই রিকশা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রাস্তাঘাট শুনশান। কোথাও জনমানবের চিহ্নও নেই। রাস্তার ধারের কুকুরগুলো না খেতে পেয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে। আগের মতো সেই চঞ্চলতাও নেই তাদের মাঝে। এই কুকুরগুলোকে ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়লো না।
কিছুক্ষণ পর রহমান মিয়া একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছের ছায়ায় রিকশাটা দাঁড় করিয়ে কপালে জমে থাকা ঘামগুলি মুছে নেয়। অতঃপর পাশের একটা টিউবওয়েল থেকে কিছু পানি খেয়ে খানিকটা খিদে মেটায়। এরই মধ্যে পুলিশ এসে লাঠি দিয়ে রিকশায় কয়েকটা বারি মারে। রহমান দৌড়ে যায় রিকশার কাছে। পুলিশ খুব রাগ্বান্বিত হয়ে বলে,”যানবাহন চলা নিষেধ জেনেও রিকশা নিয়ে বের হয়েছিস কেন? এই ওর রিকশা থানায় নিয়ে চল।”
রহমান হাতে পায়ে ধরে অনেক আকুতি মিনতি করে কিন্তু রিকশা ফেরত পাই না। এতক্ষণ খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারলেও রিকশা হারিয়ে এখন যেন তার পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার মতো বিন্দুমাত্র শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।
অবশেষে অনেক কষ্টে বাড়ি ফিরে আসেন। তাকে এমন অবস্থায় দেখে রাবেয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,”রিকশা কই? আপন্যারে এমন দেখাইতেছে কেন?”
-“আর রিকশা নাই গো ময়নার মা। রিকশা পুলিশ নিয়া গেছে। আমার আর কিছুই রইলো না। রিকশা ছাড়ানোর মতো টাকা নাই আমার।” বলেই হো হো করে কেঁদে ওঠে। তার কান্না দেখে রাবেয়াও কেঁদে ওঠে।
এভাবেই আরো কয়েকটা দিন কেটে যায়। খিদের জ্বালায় সন্তান সহ রহমানের অবস্থাও পাগলপ্রায়। চুলগুলো উস্কোখুস্কো,মেঝেতে গড়াগড়ি করায় জামা কাপড় লেপ্টে আছে কাদামাটিতে। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় যেন,নিজের শরীরটাকেই ছিড়ে খায়। বাচ্চাগুলোও সমানে কেঁদে যাচ্ছে। রাবেয়া আঁচলে মুখ চেপে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,”ঘুমাই পড়ো সোনারা,ঘুমাইলে আর খিদা লাগে না।” এমন যন্ত্রণাময় কথায় রহমানও কেঁদে ওঠে। একজন পিতার কাছে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কষ্টদায়ক কিছু হতেই পারে না।
রাত্রিবেলায় বাচ্চারা সবাই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। রহমান আর স্ত্রী বাচ্চাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে,”এই পানিটুকু খাইয়া নেও বাবারা।” বাচ্চারা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাজান, পানি খাইলে তাও খিদা লাগে।”
রহমান চোখের পানি মুছে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”এইডা পরা পানি,এইডা খাইলে আমগো আর খিদা লাগবো না। খাইয়া নেও। “
বাচ্চারা কিছু না ভেবেই খেয়ে নেয়,রহমান মিয়া আর রাবেয়া একে ওপরের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠে। অতঃপর তারাও সেই বিষ মেশানো পানি খেয়ে দেয়। তারপর পুরো পরিবারটা পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে। এখন আর কোনো কোলাহল থাকবে না,থাকবে না কোনো খিদের জ্বালা।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply