1. press.sumon@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৪:৫৪ অপরাহ্ন

একজন শিক্ষকের আত্মজীবনী – প্রথম খণ্ড, অধ্যায় দুই – আমার ছেলেবেলা – – – শাহাদৎ হোসেন

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ৮৩ বার
আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান, আমার জীবনের শুরুটা গ্রাম থেকে। গ্রামীণ মানুষের জীবন-যাপন খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। ছেলেবেলার যে দশটা বছর গ্রামে কেঁটেছে, যে আনন্দ আমি পেয়েছি; কিন্তু আজ মনে হয় -জীবনের এতোগুলো বছর পার করে কত আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, কত না বিচিত্র ধরনের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছি; কিন্তু পাড়া-গাঁয়ের ধূঁলো-বালি মাখানো সেই দশটা বছরের কথা কখনও ভুলতে পারবো বলে মনে হয় না। ছোট্ট একটা গ্রাম, মানুষ-জনও খুব বেশী নয়। আমাদের গ্রামটি দেখতে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো, সামনে দিয়ে চলাচলের রাস্তা, তারপর বয়ে চলা মধুমতি নদী। এই সেই ঐতিহাসিক নদী যে পথ দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ মহাকুমা শহরে কখনো হেঁটে, আবার কখনোবা ‘টাবুরে নৌকায়’ আশা-যাওয়া করতেন। আশপাশের অন্ততঃ ৫০টা গ্রামের মানুষের শহরে যাওয়ার এই একটাই ছিল পথ।
যদিও এটা মধুমতি নদীর শাখা, কিন্তু আমরা গ্রামের সবাই এটাকে ‘খাল’ বলতাম। ‘তখন খালটা অনেক প্রশস্ত ছিল। “সকালবেলা জোয়ারের পানিতে খালের কানায়-কানায় ভর্তি হয়ে যেতো, মৃদু-টলটলে স্রোতস্বিনীকে দেখে মনে হতো- যেন এক যৌবনা কিশোরী স্বচ্ছ পানি সাথে করে অতি-দূর অজানা পথে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এ-নিটোল পানিতে চোখ পড়তেই আমরা কেমন যেন পবিত্র হয়ে যেতাম! নদীকে তখন খুব আপন মনে হোত; মনে হোতো এ যেন একান্তই আমার। তখন পানিতে ভেসে থাকা কচুরিপানার বেগুনি ফুলকে মনে হতো পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যটুকুই বুঁঝি তার; মোচার মতো থোল ধরা ফুলগুলি ঠিক যেন ঝাঁড়বাতির মতো, কী যে এক অপরূপ শোভা নিয়ে প্রকৃতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলেছে। আমরা পানিতে মুখ ধুঁতে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম, সেই কচুরি পানার অদ্ভূত রঙের ফুলগুলি, নীরবে-নিভৃতে চুপচাপ আপন গতিতে জোয়ারের পানিতে ভেসে চলেছে। এ চলার যেন কোনো শেষ নেই! বুঝিনা কী-এমন দায়িত্ব পড়েছে এ নদী, তার স্রোত এবং কচুরি পানাগুলির গাঁট-বেঁধে ছুটে চলার! কোনো মজুরী নেই, তবু ছুঁটে চলেছে ফুলের শ্নিগ্ধতা ছড়িয়ে, কেন? এদের কী কোনো কাজ নেই? বুঝিনা, কেন মানুষের মতো স্বার্থপর হতে পারে না!”
আমাদের গ্রামের উত্তর পাশের শেষ মাথায় অনেক হিন্দু পরিবার বসবাস করতো। তাদের একমাত্র জীবিকা ছিল এ খালটায় মাছ ধরা। এক একটা নৌকায় তিন-চারজন জেলে একসাথে মাছ ধরতো। বড়-বড় বোয়াল, আইড়সহ অনেক ধরনের মাছ উঠতো জালে। আমরা পাল্লা দিয়ে কার কয়টা মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়লো, কে কার আগে কত বড় কচুরিধাপ দেখতে পেরেছে, এই যেমন – ‘না না তুই না, ঐ বড় ধাপটা আমি সবার আগে দেখেছি’- এ নিয়ে একটা যুদ্ধ চলতে থাকতো। এইখানে আমি একটু বলে রাখি- আমার চার-পাঁচজন খেলার সাথি ছিল; তার মধ্যে মনির, জামাত, আব্বাস, কামরুল, আলেয়া, উসমান অন্যতম। খেলার জন্য কাউকে বাড়িতে যেয়ে ডাকতে হোত না। তিনবেলা খাবার শেষে কিভাবে যেন আমরা এক হয়ে যেতাম। একথা বললে ভুল হবে না সারাদিন এ খালের পানিতেই কাঁটতো আমাদের জীবন।
চতুর্দিকে ঠাণ্ডা থাকলেও খালের পানি ছিল ঠিক ‘কুসুম গরম’, বেশ মজা লাগতো। দিনের অন্ততঃ পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কাঁটাতাম খালের মধ্যে ডুবাডুবি করে। ওর মধ্যেও একটা খেলা চলতো আমাদের। যার নাম ছিল ‘ঐলডুব’। ডুব দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম। পুরো দল ঐ একজনকে ছোঁয়ার জন্য পানির মধ্যে সে যে কী নিরন্তর চেষ্টা! অনেক সময় গলার মধ্যে পানি ঢুঁকে মরার মতো অবস্থা হতো। প্রত্যেকেই চোখ লাল না করে বাড়িতে ফিরতাম না। দীর্ঘক্ষণ পানির মধ্যে থাকায় শরীরে শ্যাওলা লেগে যেতো। ল্যাংটা শরীরে চেহারার এদশা নিয়ে বাড়ির ধারে-কাছেও যাওয়ার সাহস ছিল না আমার। নানা বাড়ী আমাদের বাড়ীর পাশাপাশি। আমার সমস্ত আদর-যত্নের একটা মাত্র জায়গা ছিল সেটা নানির কাছে; আমরা সব ভাইবোন নানিকে ডাকতাম নানা বলে।
নানাভাইকে আমি দেখিনি। নানার নাম ছিল মোকসুদুল হক মোল্লা, সবাই তাকে ‘ধলা ভাই’ বলে ডাকতেন। আমাদের পুরা ইউনিয়নের মধ্যে বিত্তশালী, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তাঁর গুনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমি বড় হওয়ার পর এসব মায়ের মুখে শুনেছি; আমার নানাভাই একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের ইউনিয়নে প্রথম একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় চল্লিশের দশকে। আমার নানাভাই ৫০১/- টাকা দান করেন। পরবর্তীতে আব্বার কাছে শুনেছি, ঐ সময়ের ৫০১/- টাকা দিয়ে নাকি পাঁচশত মন পাট ধরে এরূপ চারটে বড়নৌকায় ব্যবসা পরিচালনা করতে ঐ পাঁচশত টাকাই যথেষ্ট ছিল। এই ৫০১/- টাকাই ছিল ঐ সময়ের সর্বোচ্চ দান, যা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা!
তখন দশ মাইলের মধ্যে হাতেগোনা দু’তিনটে হাই স্কুল ছিল। আমাদের গ্রাম গোপালগঞ্জ মহকুমা শহরের কাছে হওয়ায়, দূুর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী আমার নানাবাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করতেন। এভাবে বহুসংখ্যক ছেলেকে আমার নানাভাই নিজের সন্তানের মতো আদর করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমার মনে হয় অন্যদের নিজের ছেলের মতো ভালোবাসার একটা অন্যতম কারণ ছিল- ঠিক ঐসময়ে আমার নানাভাই-এর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না, এজন্যই সবাইকে ছেলের মতো আপন করে নিয়েছিলেন হয়তো। যদিও আল্লাহর বিশেষ রহমতে শেষ বয়সে নানা পুত্র সন্তানের জনক হন। অবশেষে ১৯৬০ সালে এই কিংবদন্তিতূল্য মানুষটি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থণা করি আমার নানাভাইকে যেনো বেহেস্ত নসিব করেন।
নানা বাড়িতে শীতের সময় একটা আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। আমার মা-খালারা সবাই মিলে যেদিন চিতই পিঠা বানাতেন, তার ঠিক দু’দিন আগে থেকেই একটা সাজ-সাজ রব পড়ে যেতো। এ বাড়িতে মাটির চুলা ছিল মোট পাঁচটা, একটা সিঙ্গেল আর দুটো ছিল জয়েন্ট করা। আমাদের এলাকায় এটাকে বাইন-চুলা বলে। এখানে একটু বলে রাখা দরকার, আমার নানিকে সব সময়ের জন্য প্রতি ওয়াক্তে খাবারের আয়োজন করতে হতো ৪০/৫০ জন লোকের। একথা শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিকই সত্য। নানাভাই’র পাটের ব্যবসা থাকায় বড়-বড় পালতোলা নৌকায় দৌলতপুর, লৌহজং, নারায়নগঞ্জ এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন মোকামে পাট বেচা-কেনা হতো। এসব লোকদের সারা বছরের খাবারের দায়িত্ব থাকতো মহাজনের উপর। যে-কয়জন নৌকায় থাকতো তারা নৌকায় বসেই রান্না করে খেতো। নৌকায় বসে নদীর তাজা মাছের ঝোল যারা না খেয়েছে তারা কোনোদিন এর স্বাদ অনুভব করতে পারবে না। আমি মাঝে-মধ্যে এ রান্না করা খাবার এবং নতুন-নতুন হাট-বাজার দেখার লোভে নৌকার ডোরা-খোলের মধ্যে পালিয়ে থাকতাম। ঘাট থেকে নৌকা মাইল দু’য়েক যাওয়ার পর ডোরা খোল থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেরিয়ে আসতাম। হায়, কত মধুর ছিল সেইসব দিনগুলো! বড় আফসোস! কোথায় যেন হারিয়ে গেল, সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলো!
এতো সব লোকের রান্না-বান্না আয়োজনের জন্য একটা পরিবারের ৭/৮ জন লোক স্থায়ীভাবে বসবাস করতো নানা বাড়িতে। তাদের থাকার জন্য আলাদা একটা টিনের ঘর নানাভাই নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। যে কথা বলছিলাম, একদিকে পিঠা তৈরি হতে থাকতো, আর অন্যদিকে আমার খেলার সাথীদের নিয়ে নানাদের বাড়ির সামনে যে আম বাগান তার নীচে আলো-অন্ধকারে দৌড়া-দৌড়ি, চোখ বেঁধে কপালে টিপ দিয়ে আবার নিজ দলে ফিরে আসা, গোল্লাছুট, আবার কখনোবা খড় দিয়ে বল বানিয়ে খেলাধূলা -এভাবে আনন্দ উল্লাসে রাত পার করে দিতাম। দলের মধ্যে দুষ্ট ছিলাম আমি আর আব্বাস। এ রকম আনন্দের রাতে ডালিম, ডাব, পেঁপে, এসব কোথায় কোন গাছে থাকতো সেটা আগেই জানা ছিল, ফলে সময় বেশী নষ্ট না করে ওগুলো থেকে কিছু-কিছু হালাল করে ফেলতাম আমরা।
এমনিতেই খুব ভোর করে ঘুম থেকে উঠতাম। গ্রাম এলাকা, শীতের তীব্রতা একটু বেশী। নানু বাড়ির উত্তর পাশটায় সকালের রোদ এসে পড়তো। ফলে রোদ ওঠার আগেই পুকুরপাড়ে অপেক্ষা করতাম কখন সূর্য উঠবে। আস্তে আস্তে পূর্বাকাশ ভেদ করে লাল একটা সূর্য উঠতো, সামনে থাকতো ছড়ারবই। আর থাকতো রঙ্গিন লাল ডুলায় মুড়ি। খেজুরের গুড় দিয়ে সেই মুড়ি খাওয়ার মুহূর্তটি মনে হয় এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে; মাবুদ, এতোসব স্মৃতি ভুলবো আমি কেমন করে?

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..