1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৩:৩৩ অপরাহ্ন

৭ মার্চের ভাষণ ও জয় বাংলা : বাঙালির মুক্তি ও অগ্রযাত্রার সনদ – – – আহমেদ আমিনুল ইসলাম – – অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২
  • ১২০ বার
আবারো ‘জয় বাংলা’ বাঙালির জাতীয় স্লোগান হিসেবে নবরূপে মর্যাদায় অভিষিক্ত হলো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগানে রূপ দিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি, বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার কাছে আমাদের শ্রদ্ধার শেষ নেই। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক মুহূর্তের পূর্বে এবার এমন একটি খবরে আমরা উচ্ছ¡সিত, আনন্দিত। অনেকে জয় বাংলাকে কেবল আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান মনে করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই স্বাধীনতার সপক্ষ সাধারণের কাছে এটা ছিল সর্বজনীন উচ্চারণ। আবার আরেক শ্রেণির মানুষ সাম্প্রদায়িক কিংবা ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব থেকে দেশবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করে থাকে যে, জয় বাংলা হিন্দু আদর্শ থেকে আগত এমনকি এটি ভারতের দালালদের স্লোগান মাত্র! কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম বাঙালির সহস্রবর্ষের ইতিহাস ও প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধিপূর্বক জয় বাংলা স্লোগানকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে ওঠা ও বিজয়ীর স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করবেন।
আগামীকাল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এ দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে দিকনির্দেশনামূলক এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকদের নানা রকমের অজুহাত ও টালবাহানার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছিল ৭ মার্চ। ফাগুনের আগুন ঝরানো সময়! উত্তাল মানুষ, উত্তাল দেশ! সেই উত্তাল ও উদ্বেলিত সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একটি মাত্র ভাষণে বাঙালির সামগ্রিক জীবনের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে গ্রহণ করেছিলেন এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত- বাঙালির জীবনের এক শাশ্বত সিদ্ধান্ত। এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ তার ওপর নির্ভার সমর্পণ করেছিল বলেই বঙ্গবন্ধুও স্বচ্ছন্দভাবেই এরূপ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন। সক্ষম হয়েছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে আপামর বাঙালির জীবনকে মুক্তির আহ্বানে উজ্জীবিত করার। তার আহ্বানে বাঙালি উজ্জীবিত হয়েছিল। আর সেজন্যই লাখ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে নিঃশর্ত ও অসংকোচে সশস্ত্র ও শক্তিধর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিলেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণের পর এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ হিসেবে বাঙালির প্রস্তুতি গ্রহণের ইতিহাস কম দীর্ঘ ছিল না। প্রায় চব্বিশ বছরের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, নির্যাতন ও নিপীড়নের জমাট ক্ষোভ ও সংক্ষোভ বাঙালিকে একদিকে যেমন তিল তিল করে প্রতিবাদী হিসেবে তৈরি করেছিল তেমনি নির্বাচনোত্তর ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘসূত্রতাও তাদের চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে। ৭ মার্চ তাই ঐতিহাসিকভাবেই হয়ে ওঠে বাঙালির সব ধরনের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির আহ্বান। ৭ মার্চ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমুন্নত রাখার উদ্দীপনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান- হয়ে ওঠে সোনার বাংলা গড়ার আহ্বান। পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক ভাষণগুলোর মধ্যে ৭ মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মানব মুক্তির এক বিশ্ব সেরা সনদ। ইউনেস্কো ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণটিকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে।
৭ মার্চের ভাষণের প্রেরণা থেকে, বঙ্গবন্ধুর অমিত সাহসী সেই উদ্দীপনা থেকে বাঙালি জাতির সম্মুখে একদিকে ভৌগোলিক স্বাধীনতার স্বপ্ন যেমন বাস্তবে রূপান্তর ঘটে অপরদিকে তেমনি অর্থনৈতিক মুক্তির পথও নির্দেশ করে। এক কথায় সমকালীন বাঙালি মানসে স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে যে চিত্তচাঞ্চল্য লক্ষ করা গিয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে তার এক সুনির্দিষ্ট পরিণতি পায়। সেদিনকার সেই ভাষণ বাঙালির সামগ্রিক মানস থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা না থাকার বিষয়েও সব দ্বিধার অবসান ঘটে যায়। সবার সম্মুখে তখন একটি মাত্র লক্ষ্য স্থির হয়ে যায়। সে লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সুতরাং ৭ মার্চের প্রণোদিত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে প্রাণোৎসর্গও দেশবাসীর জন্য সহজ হয় উঠেছিল। তাই দেশের আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, কুলি, কেরানি সবাই জাতির মুক্তির লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে বুকভরা নিশ্বাসে। পাকিস্তানি হায়েনা আর এ দেশীয় দালালদের কাছে ৩০ লাখ মানুষের তাজা প্রাণের আত্মাহুতি আর আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বহুল আকাক্সক্ষার ও স্বপ্নের স্বাধীনতা, পেয়েছি মুক্তির আস্বাদ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে এবং ধর্মের ভ্রান্ত ব্যাখ্যায় এক শ্রেণির মানুষকে বুঁদ বানিয়ে এবং ‘বহু দলীয় গণতন্ত্র’ প্রবর্তনের আড়ালে মূলত স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের সমর্থনে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে। এই অপশক্তির মদদপুষ্ট শাসকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম-নিশানাসহ আওয়ামী লীগকেও নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনীতিচর্চার পথকেও কণ্টকিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষকে উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত করার অমিত সেøাগান জয় বাংলাকেও তারা নিষিদ্ধ করে! সর্বস্তরে উচ্চারিত জয় বাংলা সেøাগানকে শাসকরা সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেই নিষিদ্ধ করে। জয় বাংলা উচ্চারণের পরিবর্তে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর অনুকরণে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ সেøাগান চালু করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর অতিক্রম করে পুনরায় বাঙালি তার সেই প্রাণাদিত আবেগের সেøাগানটি আবার ফেরত পেতে যাচ্ছে! ইতোমধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়ে গেছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখের একটি খবর। ৭ মার্চের ভাষণের স্মরণীয় দিবসটির আগে মহামান্য উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে এবার রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ায় জয় বাংলা সেøাগানটি পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় আমাদের আনন্দও সীমাহীন। পূর্বেই যেমন ব্যক্ত হয়েছে, ৭ মার্চ ভাষণের মধ্য দিয়েই প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পথচলার স্পর্ধিত ঘোষণায় দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। সেই প্রেরণার স্রোতধারায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যও অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা চূড়ান্ত মুক্তিও অর্জন করি। কিন্তু পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রের কাছে আমরা হেরেও যাই- স্বাধীন দেশে তাদের কাছেই সপরিবারে খুন হতে হয় বাঙালির জাতির পিতাকেও! যে স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা নিয়ে একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র ও সোনার বাংলা গঠনে বঙ্গবন্ধুর অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল সদ্য স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই তা ভূলুণ্ঠিত হয়!
জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির কবল থেকে দীর্ঘ একুশ বছর পর দেশ আবার মূল স্রোতধারায় ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে সূ² কারচুপির মাধ্যমে আবারো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত-শিবিরের সমর্থন নিয়ে বিএনপি। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষেও ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখায় তাদের ষড়যন্ত্রের যেন কোনো শেষই ছিল না! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে নানা রকমের ছলচাতুরির কারণে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হয় ১/১১। তারপরে সেখানেও গণতন্ত্রকে সুকৌশলে হত্যার অনবরত ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। চলতে থাকে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নেরও! কিন্তু এ দেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত সে ফাঁদে পা বাড়ায়নি। দীর্ঘ সময় পরে হলেও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০২০ রূপকল্প এ দেশের সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে উৎসাহী করে। সে উৎসাহের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার ব্যবস্থাপনায় সে সাফল্য কেবল একবারই আসেনি- বরং বারবারই বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশকে দেখা যায় দুর্দান্ত এক অভিযাত্রায় সওয়ার রূপে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ‘এশিয়ার টাইগার’ হিসেবে আন্তর্জাতিক উপাধি লাভ করতেও সক্ষম হয়। একদা পরিচিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ’ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ বিগত একাধিক বছর ধরে পর পর কয়েকবার ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে তার অগ্রগতির অভিযাত্রাকে সক্রিয় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের এই অভিযাত্রা প্রমাণ করে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তা শতভাগ সঠিক এবং বাস্তবসম্মত ছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুচিন্তিত নেতৃত্বে দেশের এই অগ্রগতির অভিযাত্রাকে ধরে রাখার জন্য তার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। সব ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়িয়ে ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের অভিমুখেই পথ চলতে হবে। জয় বাংলা।
আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
aislam.ju@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..