দেশব্যাপী বিনম্র শ্রদ্ধায় আজ পালিত হলো শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। সূর্যোদয়ের পর থেকে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বাঙালি জাতি। ঠিক সে সময় জীবিকার সন্ধানে ফুটপাতে দোকানে চা বিক্রি করছেন রাজশাহীর শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদের দ্বিতীয় ছেলে এসএম আলমগীর বাবলু।
এসএম আলমগীর বাবলুকে নিয়ে গতবছর গণমাধ্যমে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘ফুটপাতে চা বিক্রি করেন শহিদ বুদ্ধিজীবীর ছেলে’। সংবাদটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। তারপর একজন প্রতিমন্ত্রী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তাকে সহায়তার কথা জানিয়েছিলেন। রাজশাহীর একজন জনপ্রতিনিধিও তার পরিবারকে একটি চাকরির আশ্বাস দেন। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও সেসব সহায়তার কিছুই পাননি এসএম আলমগীর বাবলু। পেয়েছেন শুধু আশ্বাস।
এসএম আলমগীর বাবলু জানান, গতবছর অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। সরকারিভাবে জমি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই জমি এখনও পাওয়া হয়নি তার। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী আবার রাজশাহীর একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে বলেছেন আমার ছেলের জন্য একটা চাকরির কথা। সে সময় আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু তার চাকরি এখনও হয়নি।’
রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল ফুটপাতে তার ছোট্ট অস্থায়ী দোকান। সেখানে দিনভর চা বিক্রি করেন বাবলু। সেখানে দেখা মেলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পরিবহন শ্রমিকদের। কেউ একজন হাঁক ছাড়ছেন- ‘এই বাবলু, পাঁচটা চা ধর তো!’ চা দিতে দেরি হলে অনেকের তোড়জোড়! আওয়াজ কড়া হয়, চলে ধমকা-ধমকি। অথচ শহিদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান বাবলুকে দিনভর চা বেঁচে গভীর রাতে ফেরেন বাড়িতে, যা আয় হবে তা দিয়ে চলে ১০ জনের সংসার। অথচ কেউ জানেন না তিনি একাত্তরের শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদের সন্তান।
আলমগীর বাবলু জানালেন, আগে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। বয়স বেড়েছে, কমেছে শারীরিক শক্তি। ফলে রিকশা ছেড়ে কয়েক বছর যাবত ফুটপাতে চায়ের দোকান দিয়েছেন। চা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনো মতে সংসার চলে। শারীরিক অসুস্থতা বা কোনো কারণে দোকান বন্ধ থাকলে বন্ধ হয়ে যায় বাড়ির চুলাও। বাবার বদৌলতে রাষ্ট্রীয় যে ভাতা পান, তাও ভাগ হয়ে যায় ১৩ ভাইবোনের মধ্যে। ফলে পরিবার নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন বাবলু।
জানা গেছে, রাজশাহীর শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক এমএ সাঈদের ১৩ সন্তান। এদের মধ্যে দ্বিতীয় এসএম আলমগীর বাবলু। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এমএ সাঈদ ছিলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। রাজশাহীতে আর্ট কাউন্সিল বর্তমান ‘পদ্মামঞ্চ’ ও ‘রাজশাহী প্রেসক্লাব’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি। বেতারের রাজশাহী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠালগ্নে বাংলা খবর পাঠক ও অভিনেতা ছিলেন। তিনি শহিদ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং একটি সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। পরে সেই সার্টিফিকেটটি হারিয়ে ফেলে পরিবার।
বাবাকে নিয়েও স্মৃতিচারণ করলেন বাবলু। বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জুন মাসের মাঝামাঝিতে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তখন ষষ্ঠীতলা এলাকার একটি বাড়িতে থাকতাম আমরা। খান সেনাদের একটি বড় গাড়ি এলো একদিন। তারা উর্দুতে বলল, ‘এই লাড়কা, সাঈদ রিপোর্টার ক্যা মাকান কিধার হ্যায়?’ আমাদের বাসা না দেখিয়ে তখন আমি ইউনিক টেইলারের মালিকের বাসা দেখিয়ে দিলাম। গাড়ি ওই দিকে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক পিস কমিটির সদস্য পড়ল সামনে। তাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, সাঈদ রিপোর্টার ক্যা মাকান কিধার হ্যায়?’
বাবলু বলতে থাকেন, ‘ভয়ে আমি মসজিদের পাশে লুকিয়ে গেলাম। দেখছি সবকিছু। আটজন খান সেনা বাড়ির ভেতর ঢুকে। আমার চোখের সামনেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় বাবাকে। বাড়িতে এসে দেখলাম মা কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, খান সেনারা ভুবনমোহন পার্কের মিছিলের ছবি দেখিয়ে বাবাকে বলল, এটা কার ছবি? আব্বা উত্তর দিলো- ‘এটা আমার ছবি।’ খান সেনারা বলল, আমাদের বিরুদ্ধে আপনারা কেন এসব করছেন? মেজর পারভেজ আপনাকে ডেকেছেন, সার্কিট হাউসে যেতে হবে- বলে নিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারপর বাবার সহযোগী স্টার স্টুডিওর মালিক মোতাহার হোসেন, ঘড়িঘরের মালিক নাসির আহমেদ বাবাকে খুঁজতে বের হলেন। বিভিন্ন জায়গায় খুঁজলেন, পেলেন না কোথাও। কিছুদিন পর শাহ মখদুম ইনস্টিটিউটের পিয়ন কাদের মিয়া এসে আমাদের জানালেন, সাঈদ ভাইকে আর খুঁজবেন না। ওনাকেসহ ১৩ জনকে জোহা হলে খান সেনারা গুলি করেছে। সেখানে আমিও ছিলাম। গুলি লাগার আগেই আমি মাটিতে পড়ে যাই। মরার ভান করেছিলাম। খান সেনারা ভেবেছে আমিও মরে গেছি। তারপর সবাইকে গর্তে ফেলে দেয়। খান সেনারা চলে গেলে আমি লাশভর্তি গর্ত থেকে পালিয়ে আসি।’ তখন থেকে বাবলুরা জেনেছেন, তাদের বাবার মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের বধ্যভূমিতে আছে। সেখানকার শহিদদের নামের তালিকায় নাম রয়েছে তার বাবার।
বড় অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছেন জানিয়ে বাবলু বলেন, ‘আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। দারিদ্র্যের কারণে তিন ছেলেকে ঠিকমত পড়াশোনা করাতে পারিনি। দুই ছেলে চা বিক্রিতে সহায়তা করেন। আর ছোট ছেলে একটি ফার্নিচার শো-রুমের সেলসম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন।
তিনি বলেন, যে ফুটপাতে চায়ের দোকানটা চালাই, সিটি করপোরেশন থেকে মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে ভেঙে দেয়। আবার কিছুদিন পর দোকান বসাই। কি করব বলেন? এছাড়া যে উপায় নেই!’ ‘শহিদ সাংবাদিকের ছেলে হলেও আমার কোনো নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই। মথুর ডাঙ্গাতে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করি। প্রতিমাসে ভাড়া লাগে ৫ হাজার টাকা। স্টল চালিয়ে সংসারের খরচ জোগাড় হয় না। তারাও এখন আমার সঙ্গে ফুটপাতে চা বিক্রি করে। তাদের চাকরি দরকার। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে শুধুই মিলেছে আশ্বাস।
Leave a Reply