1. press.sumon@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১১:৩২ পূর্বাহ্ন

# গল্প # কাষ্টডি-১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ এবং ১০ ও শেষ পর্ব – – – ©তাসনুভা সোমা

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৩
  • ২৮৪ বার

 

-১

শাম্মির একেকটা রাত আর দিন যেন গড়িয়ে গড়িয়ে কাটছে। মনে হচ্ছে প্রতিটা দিনের গড়িয়ে চলা নতুন ক্ষত তৈরি করছে মনের গভীরে থাকা ক্ষতগুলোতে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওর ওজন কমে গেছে ১০/১২ কেজি। রাতে ভাল ঘুম হয়না, খাবার সময় মুখে রুচি থাকে না। ওজন কমাই তো স্বাভাবিক। সেই সাথে আছে প্রচন্ড মানসিক চাপ। মানসিক চাপটাই হয়তবা ওর ওজন কমে যাবার প্রধান কারণ। ওজন কমা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় নয় অবশ্য।

গত একটা বছর শাম্মি ভালই ছিল। মা আর মেয়ের সুখ আর আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার সংসার ছিল তাদের। স্বামীর সাথে সংসার নামক সুখ-অসুখের পর্বটা শেষ হয়ে গিয়েছিল বছর দেড়েক আগে। প্রথম ছয়মাস বেশ কিছুটা কষ্টই গেছে কিন্তু তবুও সকল কষ্টকে ছাপিয়ে যেত নিজেকে ‘মানুষ’ মনে হওয়ার অনুভূতি। নিজেকে মনে হোত পোষা প্রানী রুপ থেকে মুক্ত হয়ে রুপান্তরিত ‘মানুষ’। তার উপর সাথে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন; ওর একমাত্র মেয়ে খুশবু। ক্ষুদ্র এই জীবনে আর কি চাই! একটা চাকরি জোগাড় করে নেয়ার পর জীবনটা বেশ পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল।

গত একটা বছর শাম্মি হেসেছে, প্রান ভরে নি:শ্বাস নিতে পেরেছে, এই বয়সে সুখ বলতে যা বোঝায় তারও সন্ধান পেয়েছে। এই বয়সে সুখ বলতে সম্ভবত বোঝায় আত্মার স্বাধীনতা কিংবা সারাক্ষণ অন্য কাউকে খুশি করা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না থাকা, ভয়ে ভয়ে না বেঁচে সাহস নিয়ে বাঁচা, এই ভেবে সব সময় তটস্থ না হয়ে থাকা ‘এটা করলে কিংবা না করলে কেউ কি রাগ করবে?’ ‘আমি কাজটা ঠিক করছি নাকি ভুল?’ ‘ওকে/তাকে খুশি রাখতে হলে কি করা উচিত?’ ‘আমার ব্যক্তিগত পছন্দ/অপছন্দ প্রকাশ করা কি ঠিক হবে’ ‘নিজের পছন্দমত কিছু করলে আবার অনর্থ হবে নাতো?’

সেসব ভাবনা চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনটা বেশ মসৃনভাবেই চলেছে বলা যায়। মেয়ের স্কুলে যাবার সময়টাতে মায়েরও কাজে বের হয়ে যাওয়া, তারপর মা-মেয়ে একসাথে বাসায় ফেরা এবং তাদের সুখ-দুখের গল্প গাঁথা। কি মধুর একটা জীবন!

সেই মধুর জীবনে হঠাৎ যেন বাজ পড়ল! বাজ হয়ে এল একটা অফিশিয়াল কাগজ; উকিলের চিঠি। চিঠির বক্তব্য ভয়ানক! ‘মেয়ের বাবা মেয়ের পুরো অভিভাবকত্ব দাবী করে কোর্টে আবেদন জানিয়েছে’ চিঠি এসেছে কোর্ট থেকে। চিঠিটা শাম্মির জন্য ভয়াবহ এক টুকরো কাগজ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জীবনটাকে দূর্বিষহ করে তোলার জন্য সেই এক টুকরো কাগজ বা চিঠিই যথেষ্ট! জীবন দূর্বিষহ হয়েছে কি হয়নি তা বোধ করার আগে যে বোধটা কাজ করল সেটা হচ্ছে ‘বিস্ময়’!

ও প্রথমে অবাক হলো; ওর সাথে বিষয়টা আলোচনা করলে ও অবশ্যই বাবার কাছে মেয়েকে যেতে দিত, সময় কাটাতে দিত। মেয়েকে কবে, কোথায়, কিভাবে, কত সময়ের জন্য বাবার কাছে যেতে দিত সেটা নিজেরা আলোচনা করেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব ছিল। মেয়ের জন্যও এটা ভাল এবং সেকারণেই শাম্মি এতে রাজি হোত। মেয়েটা বাবা-মা দু’জনকে একসাথে না পেলেও অন্তত আলাদা করে তো পেত! এতদিন কোন যোগাযোগ নেই, কথাবার্তা নেই, মেয়ের সাথে দেখা নেই, আগ্রহ নেই কিন্তু হঠাৎ একেবারে পুরো কাষ্টডি চেয়ে উকিলের চিঠি!

খুশবুর বাবা যখন প্রাথমিকভাবে মেয়ের জন্য কোনরকম টাকা পয়সা দিতে রাজি হলো না তখন অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিল কোর্ট কাচারি করতে। কিন্তু শাম্মি কোর্টে যায়নি। কোর্টে যেয়ে দায়িত্বহীন বাবার কাছ থেকে মেয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা নেয়ার চেয়ে বরং ওর কাছে ভাল মনে হয়েছে নিজের অর্জিত অর্থে মেয়ের সব খরচ চালানো। কোর্টে যেয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ অন্যদিকে তেমন ব্যয়বহুল। তাছাড়া হাজিরা দেয়ার ঝামেলাও আছে। তাছাড়া শাম্মির তখন মনে হয়েছিল, ‘মেয়ের বাবা কোন দায়িত্ব নিতে চায়না সেটা হয়ত একদিক দিয়ে মন্দের ভাল; মেয়েকে মায়ের থেকে আলাদা করারও কোন চেষ্টা করবে না সে’ সেই ভাবনাটা ভুল প্রমাণ হলো এক বছর পর!

শাম্মি খুশি ছিল মেয়েকে নিয়ে নতুন জীবনে। ‘ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয় কথাটা সবার জীবনে একইভাবে সত্য হয় না। শাম্মির জীবনেও এই সত্যটা এসেছে মেয়ের সাথে। ‘টু ফর জয়’ মানে যে স্বামী বা এরকম সঙ্গী হতে হবে তাই বা কেন?

সেই অন্যরকম সুখের জীবনে বিষ ছড়ানোর জন্য মেয়ের বাবার হঠাৎ আব্দার ‘মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চাই’ কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে মেয়ের মায়ের আর্থিক সঙ্গতি। বাবার দাবী, ‘মেয়ের সঠিক দায়িত্ব নেয়ার মত আর্থিক সঙ্গতি মেয়ের মায়ের নেই। বাবার সেই সঙ্গতি আছে এবং বাবার কাছে থাকলে মেয়ের মানসিক বিকাশ তুলনামূলক ভাবে ভাল হবে।’ তাছাড়াও আছে দায়িত্বহীনতা, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি ইত্যাদি ইত্যাদি। শাম্মির মনে হলো নানারকম হাবিজাবি সব কথা বার্তা দিয়ে চিঠি ভর্তি! পুরো চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়ার আগেই ওর মাথা ঝিমঝিম করা শুরু হলো। সকাল থেকে এমনিতেই কেমন যেন খারাপ লাগছিল। চিঠি পেয়ে সেটা মাথা ঝিমঝিমে উন্নীত হলো!

চিঠি পাওয়ার পর পর শাম্মি খুব ঘাবড়ে গেল। চিঠিটা ওর বার বছরের মেয়ে খুশবুই এনে দিয়েছিল ওর হাতে। চিঠিটা খুলে ও একেবারে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল। খুশবুর চোখে পড়েছিল বিষয়টা,

-মা তুমি ঠিক আছ তো? ও মা?

-হ্যা মা ঠিক আছি।

-আমি যে কখন থেকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি সেটার তো কোন উত্তরই দিচ্ছ না মা!

-সরি মা! শুনতে পাইনি!

-এতবার বলার পরও শুনতে পাওনি! সকালে বলছিলে শরীর ভাল লাগছে না। এখন কি ভাল লাগছে?

-এখন ভাল লাগছে মামনি। আমাকে একটু পানি খাওয়াবি?

-এক্ষুনি আনছি মা।

পানি শেষ করে মেয়েকে কাছে টেনে নিল শাম্মি। ওর মেয়েটা বয়সের তুলনায় যেন একটু যেন বেশিই বোঝে। হয়তবা ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাদের কিছু বিষয় বেশিই বুঝতে হয়! সেজন্যই বেশি বোঝে। মায়ের দিকে খুব খেয়াল, বন্ধুত্বও কম না। কিন্তু বাবার কথা বলেনা কখনও। শাম্মি অনেকবার বোঝার চেষ্টা করেছে যে নিজের পছন্দ নয় সেজন্য বাবার কথা বলেনা নাকি মাকে বিব্রত করতে চায়না বলে বলেনা? বোঝা যায়না। সে প্রসঙ্গটা ভুল করেও মায়ের সামনে নিয়ে আসেনা খুশবু।

সে যাইহোক, খুশবুকে কোনভাবেই সেই মানুষটার হাতে তুলে দেয়া যাবে না। শরীর-মনের সমস্ত শক্তিকে এক করে লড়তে হবে। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই শাম্মি মেয়ের সেই কথাটা শুনল যেটা এতক্ষন শোনা হয়নি। মেয়েকে বুঝতেই দিল না মেয়ের কথা শুনতে শুনতে ওর মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া ঝড়টা কি প্রবল হয়ে উঠছে!

-মা তুমি কি জানতে যে বাবা আমার স্কুলে আসবে?

-নাতো মা!

-ওহ সরি। আমি ভেবেছি তুমি জানতে।

-তোর বাবা তোর স্কুলে এসেছিল!?

-হ্যা মা। থাক বাদ দাও।

-বাদ দেয়ার দরকার নেই মামনি। কবে এসেছিল?

-এইতো গতকাল।

-তারপর?

-অনেকগুলো গিফটও এনেছিল।

-সেগুলো কোথায়?

-স্কুলেই আছে। হেডটিচার এর রুমে। স্কুলটাইমে ওগুলো নেয়া এ্যালাউড না। হেডটিচার বলেছিল হোমটাইমে তার রুম থেকে নিয়ে আসতে। আমি যাইনি।

-কেন যাওনি?

-ইচ্ছা করেনি মা!

-তোমার হেডটিচার এর সাথে আমি কি দেখা করব?

-হ্যা মা। সেটাই ভাল হবে।

ঘটনা তাহলে স্কুলেও গেছে! প্রাইমারী স্কুলের ক্লাস টিচার নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল কেয়ারে রিপোর্ট করে দিয়েছিল। তারপর সেই সোশ্যাল ওয়ার্কার এর সাথে মাসের পর মাস মিটিং মিটিং….পরে মেয়েকেও ক্লাস থেকে ডেকে নিত নানা রকম কথা বার্তা বলার জন্য বা তাদের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করার জন্য। মূলত সোশ্যাল ওয়ার্কার এর কাজের ধরণ দেখে মেয়েকে হারানোর ভয় থেকেই লোক দেখানো স্বামী-সংসার ছেড়েছিল শাম্মি। সেসব দিন শেষ হয়েছে কিন্তু সেকেন্ডারি স্কুলে আবার না জানি কোন ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছে লোকটা! শাম্মিকে এক ফ্রেন্ড বলেছিল,

“যতই মনে করো যে সেপারেশন বা ডিভোর্স এর মাধ্যমে খারাপ লোকটার থেকে তোমার মুক্তি হবে; বাস্তবে তা হবে না। সে তোমাকে যন্ত্রণা দিতে চাইলে তোমাদের মাঝে যে ব্রিজটা আছে তার সূত্র ধরেই তোমাকে সারাজীবন ধরে যন্ত্রণা দিতে থাকবে। তোমাদের ব্রিজ তোমাদের মেয়ে এবং সেটাকেই সে একটা অজুহাত বানিয়ে নেবে”

সেই বন্ধুর কথাগুলো খুব সত্যি মনে হচ্ছে! সত্যিই মানুষটা আর কতদিন শাম্মিকে যন্ত্রণা দেবে?

মেয়েটা মাত্র সেকেন্ডারি স্কুলে গেছে। সেখানে তো কোন ঝামেলা হতে দেয়া যাবে না! শাম্মি ঠিক করল পরদিনই হেডটিচারের সাথে দেখা করবে। যদিও সেকেন্ডারি স্কুলের হেডটিচারের সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া এমপিদের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার সমতুল্য তবুও সৌভাগ্যক্রমে হেডটিচার এর সাথে দেখা করা সম্ভব হলো। শাম্মি হেডটিচারকে ওদের বর্তমান অবস্হাটাই বলল,

“মিস ফিউনা, আমি আর খুশবুর বাবা একসাথে থাকছি না। খুশবু আমার কাছে থাকে। গত বছর দেড়েক খুশবুর বাবা আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। সে হঠাৎ করে স্কুলে দেখা করতে আসবে সেটাও আমার অজানা ছিল। সে এভাবে আসায় আমি বিব্রত বোধ করছি। আশা করছি এরকম আর হবেনা এবং খুব শীঘ্রই মেয়ের কাষ্টডির বিষয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারব।”

কথাগুলো গুছিয়ে বলতে প্রায় হিমশিম খেয়ে গেল শাম্মি। চিঠি পাওয়া ও মেয়ের স্কুলে বাবার উপস্হিতি; দু’টো ঘটনায় ও আসলে হতচকিচ।

(ক্রমশ)

 

২১/১০/২০

 

 

 

-২

হঠাৎ করে লোকটা যেন বিরাট ভালবাসায় মাখা, দায়িত্বশীল, বর্তমান-ভবিষ্যত চিন্তাকারী বাবা হয়ে উঠেছে! মায়ের কাছে উকিলের চিঠি, উপহার সহ স্কুলে যেয়ে মেয়ের সাথে দেখা করা! তারপর আর কিছু বাকি আছে নাকি!? মেয়ের স্কুল থেকে বের হতে হতে মাথা ধরে গেল শাম্মির।

মনে কিছু প্রশ্নও খচখচ করতে লাগল, লোকটার হঠাৎ বাবা হয়ে ওঠার শখ জাগল কেন? কোন কারণ কি আছে? থাকতেও পারে। লোকটা বেশ মতলবি ধরণের! মতলব ছাড়া তো তার কিছু করার কথা না! মতলবটা কি কোথাও প্রমাণ করা যে সে একজন দায়িত্বশীল মানুষ? প্রাক্তন স্ত্রীকে নতুন করে মানসিক যন্ত্রণা দেয়া/ঝামেলায় রাখা? আরেকটি বিয়ে করার জন্য সমাজের কাছে অজুহাত হিসেবে মেয়েকে কাছে নিয়ে যাওয়া? নাকি অন্যকিছু? লোকটা কি শাম্মিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ঘুরিয়ে বাধ্য করতে চাইছে?

এই লোকটাই তো সেই লোক যে কিনা কোন এক সময় খুশবুকে নিজের মেয়ে নয় বলে ডিএনএ টেষ্ট করেছিল! টেষ্টের রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি! বাবা হিসেবে দায়িত্ববান বা আবেগপ্রবণ ছিল তাও তো নয়! কি সব কঠিন দিন ছিল সেসব। বছরের পর বছর কত অপমানের, দহনের, অশ্রু ঝরানোর সেসব দিনের পরেও কি তার আঁশ মেটেনি? আজ আবার কেন?

হেডটিচারের সাথে আরও কিছু কথা হলো ওর,

-মিস শাম্মি খুশবুর বাবা যদি আবার আসে তাহলে কি দেখা করতে দিব?

-দিও তবে খুব বেশি সময়ের জন্য দিও না এবং বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিও না।

-তুমি যদি চাও তাহলে খুশবুর বাবাকে আমরা একজন ইনট্রুডার হিসেবে কাউন্ট করতে পারি।

-নো থ্যাংকস মিস। আশা করছি মেয়ের সাথে শুধু দেখা করাতে ও কিছু সময় কাটাতে কোন সমস্যা হবে না।

-ঠিক আছে তুমি যেরকম মনে করো। তবে যদি তোমার মাইন্ড চেঞ্জ হয় তাহলে আমাকে জানাবে।

-হ্যা নিশ্চয়।

খুব হকচকিয়ে গেলেও শাম্মি বেশ দ্রুততার সাথে নিজেকে সামলে নিল। মনের মাঝে যেসব প্রশ্ন এসে হানা দিয়েছে সেসব প্রশ্নের উত্তরের চেয়েও অনেক বেশি জরুরী এখন অন্যকিছু। উকিল ঠিক করতে হবে। শাম্মি স্বামী নামক মালিকের থেকে মুক্তি পাবার সময়ও আইন বিষয়ক সবকিছু থেকে যতটা সম্ভব দুরে থাকারই চেষ্টা করেছে। থেকেছেও দুরে। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল লড়াই করার। কারো খেয়াল খুশির উপর ভিত্তি করে, বাবা নামক প্রায় অচেনা কারো কাছে ওর এই দামি রত্নটাকে সব সময়ের জন্য রাখার কথা ভাবাই যায় না! ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ শব্দ দু’টো একটি বাচ্চার কাষ্টডি পাওয়ার জন্য কোনমতেই যথেষ্ট নয়। স্বামী নামক তথাকথিত সামাজিক ও পারিবারিক সাইনবোর্ডটির মারাত্মক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সহ আরও বেশ কিছু বড় বড় কারণে সংসার নামক সামাজিক রক্ষাকবচ ছুঁড়ে ফেলে আসতে পেরেছে শাম্মি। আর আজ নিজের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নকে রক্ষা করতে পারবে না! হতেই পারে না! লড়াই করতেই হবে।

এরপর সপ্তাহখানেক ধরে ও শুধু একজন উকিল খুঁজেছে। উকিলকে বিদেশী হতে হবে আর সেজন্যই এত খোজাখুজি। মেয়ের বাবা বিলেতের বাংলাদেশী সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সমাজের সব ধরণের পেশার লোকজনের কাছে তার নাম-ডাক। এমনকি বাংলাদেশী উকিল সমাজেও তার বেশ জানাশোনা। শাম্মি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই দেখেছে আশপাশের মানুষের নগ্ন চেহারা। তারা ন্যায়-অন্যায়, ভুল-শুদ্ধ, নৈতিকতা-অনৈতিকতার চেয়েও প্রাধান্য দেয় সামাজিক স্বীকৃতি ও অবস্হান, টাকা-পয়সার সামর্থ্য ও সর্বোপরি ক্ষমতাকে। যার সবগুলোই খুশবুর বাবার আছে।

শেষ পর্যন্ত একজন বিদেশী উকিল ঠিক করতে পারল ও। বিদেশী হলেই যে খুশবুর বাবার সাথে তার পরিচয় থাকবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তারা একে অপরের অচেনা।

উকিলের সাথে বেশ কিছু বৈঠক হলো শুনানী শুরু হওয়ার আগে। প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে যেয়ে শাম্মির চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল অতীতের দুর্বিষহ সব দিনের কথা। সেসব দিনের স্মৃতি ওকে শুধু জ্বালায়-পোড়ায়। সেসব দিনের স্মৃতিকে একটা কালো বাক্সবন্দী করে রেখেছিল। উকিলের সাথে কথা বলতে যেয়ে সেগুলো আবার বেরিয়ে এল সেই কালো বাক্স থেকে। আবারও বারবার মনে হোল, “লোকটার থেকে কবে মিলবে পরিপূর্ণ মুক্তি!”

দেখতে দেখতে শুনানির দিন এগিয়ে আসতে লাগল আর শাম্মির উৎকন্ঠা বাড়তে লাগল। সব কিছু ঠিক থাকলে ওরই জেতার কথা। কিন্তু বাঙালি সমাজে ম্যানিপুলেশন করে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বাচ্চার অভিভাবকত্ব জিতে নেয়ার কাহিনী বিরল নয়। আশেপাশেই আছে। সেসব চিন্তা করলে মারাত্মক উৎকন্ঠা হওয়ারই কথা!

বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী সমাজের কিছু অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য আছে; যেসবের মধ্যে একটি হচ্ছে একজন নারীকে পদে পদে কথা দিয়ে ঠোকর খাওয়ানো। এই ঠোকর আবার সবাই মিলেই দেয়! নিজের পরিবার থেকে শুরু করে চেনা পরিচিত প্রায় সকল নারী- পুরুষই ঠোকর দেয়ার প্রজেক্টে পারদর্শী! এরকম ঠোকর শাম্মির মত নারীদের আবার বেশি পরিমাণে খেতে হয়। যারা কিনা সহ্য করতে করতে একসময় অসহ্য হয়ে নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজে নেয় তাদেরকে একটু বাঁচতে সহায়তা করার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে ঠোকর। সাথে বাচ্চা থাকলে ঠোকর দেয়া আরও বেশি সহজ। সব কিছু জানার ও বোঝার পরও কাছের কিংবা পরিচিত মানুষের যখন উচিত আর কিছু না পারলেও অন্তত একটু মানসিক সাপোর্ট দেয়া তখন তারা খুব ব্যস্ত হয়ে যায় ঠোকরাতে। বিপদের সময়, জীবনের কঠিন সময় বা বড় কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অবস্হায় ঠোকরগুলো অনুভূতিতে বড় বেশি করে লাগে। যেমন আগে ঠোকরগুলি ছিল অনেকটা এরকম,

-একা একা কিভাবে বাচ্চা বড় করবা? পারবা না, অনেক কঠিন!

-বাচ্চার সব কিছুতো আমিই দেখাশোনা করি। ওর বাবাতো একসাথে থাকলেও বাচ্চার কোন দেখাশোনা করে না।

-দেখাশোনা হাতে ধরে না করলেও বাবা তো বিরাট একটা শক্তি তো তাই না! বাবা কিছু না করলেও শক্তি।

-কিসের শক্তি?

-সবই বুঝবা কিন্তু তখন বেশি দেরি হয়ে হয়ে গেলে চোখের পানি আর নাকের পানি এক করা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। মেয়ে যখন বড় হবে তখন বিয়া দিতে গেলেও দেখবা সমস্যা হবে। তাছাড়া তুমি নিজেই বা একা থাকবা কিভাবে?

-আমি তো একাই থাকতাম। আমার তো কোন সঙ্গী ছিল না। বাইরে বাইরেই থাকত খুশবুর বাবা। দিনের পর দিন দেশের বাইরেও কাটাত

-মেয়ে মানুষের এত হিসাব করলে চলে না। মেয়ে মানুষের সব কিছু সহ্য করতে হয়। তারা মাটি খেয়ে মাটি হজম করে ফেলবে সেটাই নিয়ম।

-মাটি আর হজম করতে পারতেছি না।

-এইসব বাদ দিয়া স্বামীর সাথে সব ঝামেলা মিটায় ফেল….পুরুষ মানুষের একটু-আকটু দোষ থাকবে, স্ত্রী সেটা মেনে নিবে সেটাই সমাজের নিয়ম।

সেইসব নিয়মের বাইরে যেয়ে মেয়েকে নিয়ে বাঁচার আশায় শাম্মির সিদ্ধান্তে ঠোকর বেড়েছে কিন্তু সাপোর্ট বাড়েনি। তখনও না, এখনও না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ওর মনোবল ভাঙার অনেক চেষ্টা হয়েছে; ও মনোবল হারায়নি। বরং অনেক ধৈর্য্য আর নিষ্ঠায় মেয়েকে নিয়ে সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। যে সংসারে আছে ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতার আদান-প্রদান। নেই কোন শোষন ও অহেতুক শাসন। সুখের ছোয়া লাগতেই মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার এই আঘাত এবং নতুন ঠোকর শুরু,

-শাম্মি তুমি ভুল করছ

-কি ভুল?

-তুমি এই কেসে জিততে পারবে না। মাঝখান দিয়ে সব হারাবে।

-কেন জিততে পারব না?

-খুশবুর বাবার শক্তি অনেক বেশি। সব দিক থেকেই।

-তাহলে আমার কি করা উচিত বলে তুমি মনে করো?

-তুমি বরং খুশবুর বাবার কাছে ফিরে যাও। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান।

-হঠাৎ এ প্রসঙ্গ কেন?

-না এই আরকি; মনে হলো তাই বললাম। তোমার মেয়েটার দিকে তাকালে খুব খারাপ লাগে। তোমার জন্যও খুব মায়া হয়

-তুমি কি নিশ্চয়তা দিতে পার যে খুশবুর বাবার কাছে ফিরে গেলে আমাকে আর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করবে না?

-তোমাকে মানিয়ে চলতে হবে। মেয়েদের জীবনটা এরকমই। তুমি এখন কেস লড়তে চাইছ। পরে দেখা যাবে মেয়ের কাষ্টডি ওর বাবা পেয়ে গেল তখন কি হবে? একুল-ওকূল দুই ই যাবে তোমার!

কেস না লড়ার পরামর্শ অনেকই দিল। বিশেষ করে কাছের মানুষরাই। নানা রকম কথাবার্তায় ওর মনোবল ভাঙার চেষ্টাও করল। খুশবুর বাবার কাছে অনুরোধ করতে বলল ফিরে যাবার কিন্তু শাম্মি এসব ভাবতেই পারছিল না। নিজেকে এতটা ছোটো করা ওর পক্ষে আর সম্ভব নয়। মানুষটা যদি এই কৌশলে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় সেখানেও ঘৃণাবোধ করে ও। তাছাড়া লোকটার কোন প্রতিশ্রুতি, আশ্বাসে বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাসেরও কোন অবকাশ নেই। ১৩টা বছর লোকটা সম্পর্কে অনেক কিছুই শেখা আর বোঝা হয়ে গেছে। কেসের জন্য মানসিকভাবে, আর্থিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করার দিকেই মনোযোগ দিল শাম্মি। যারা কথার ঠোকরে সুপরামর্শ দেয় তাদের থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব বাচিয়েই রাখল। এমনিতেই ওর মনটা আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। সেখানে আরও লবণ আর সহ্য হচ্ছিল না।

এক সময় শুনানী শুরু হলো। চলতে লাগল মাসের পর মাস। শুনানীর দিন কোর্টে হাজিরা দেয়া এবং বসে বসে দেখা আর শোনা ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই। এখানে কোর্টে তেমন কোন জেরা করার নিয়ম নেই। উকিলের কাছেই সব মতামত, রাজি-অরাজি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশ করা থাকে। কোর্টে হাজিরা দিয়ে সামান্য টুকটাক কথা বলা পর্যন্তই শাম্মির কাজ। উকিলের কাজ প্রয়োজনীয় তথ্যসম্বলিত কাগজ-পত্র ও প্রমানাদি উপস্থাপন করা। প্রয়োজনে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডানো ও অপরপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমানাদিও নথিপত্রের মাধ্যমেই পেশ করা হয়। বাংলাদেশের কোর্টের মত উত্তেজনাপূর্ণ কোন জেরা পর্ব নেই বিলেতের পারিবারিক মামলায়! প্রথম দিকে শাম্মি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল এরকম শান্ত, চুপচাপ কোর্টের পরিবেশ দেখে। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এটাই ভাল! কারো ব্যক্তিগত বিষয় ব্যক্তিগতই থাকছে এই ব্যবস্হায়!

শুনানীর প্রথম দিন থেকেই অপরপক্ষ থেকে একের পর এক দাবি-দাওয়া ও আক্রমণ আসতে লাগল। দাবি-দাওয়া গুলো কেস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্য অর্থাৎ যতদিন মায়ের কাছে মেয়ে আছে! বিষয়টা অনেকটা এরকম যে ধরেই নেয়া হয়েছে, খুশবুর অভিভাবকত্ব ওর বাবাই পাচ্ছে। শাম্মি কিছুটা নার্ভাস হলেও সাহস হারাল না।

মেয়ের বাবা একের পর এক শর্ত ও দাবি রাখতে লাগল যেগুলো বারংবার ‘না’ বোধক উত্তরে পরিণত হতে থাকল শাম্মির দিক থেকে। যেমন: শাম্মি কার সাথে কথা বলবে/কার সাথে কথা বলবে না, কোথায় যাবে/কোথায় যাবেনা, ওর বাসায় কে বা কারা আসতে নিষিদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়ের বাবার মতে বিশেষ কিছু মানুষ আছে যাদের সংস্পর্শে আসলে তার মেয়ের ক্ষতি হবে। শাম্মির মতে সেই মানুষগুলো পরীক্ষিত বিশ্বস্ত মানুষ এবং তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা সম্ভব নয়।

শাম্মি কোথায় কাজ করবে, কোথায় কাজ করবে না সে জাতীয় দাবিও আসতে লাগল। মায়ের কাজের ষ্ট্যাটাস নাকি মেয়ের জীবনে প্রভাব ফেলবে এবং সেজন্যই এরকম দাবি!

মেয়ের বাবা শাম্মির দায়িত্ব হীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠাল। কিন্তু বাস্তবে অনেক যাচাই বাছাই করে দেখা গেল জিপি, স্কুল, ডেন্টিষ্ট, অপটিশিয়ান, সোশ্যাল ওয়ার্কার কিংবা হাসপাতাল এ্যাপয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি সব জায়গায় সবার মতে ও সকল কাগজপত্রে মেয়ের সাথে সকল সময় শুধু মাকেই পাওয়া গেছে। বাবার কথা কেউ কখনও স্মরণ করতে পারেনি! কোথাও কখনও বাবার সাথে মেয়ের উপস্হিতি দেখা যায়নি। কিংবা দায়িত্বহীনতার কারণে মেয়ের কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস হয়েছে, কোন শারীরিক-মানসিক ক্ষতি হয়েছে সেরকম কোন তথ্য প্রমাণাদিও নেই।

 

(ক্রমশ)

 

২২/১০/২০

 

 

 

 

 

 

-৩’

শাম্মির দায়িত্বহীনতার অভিযোগ বা প্রশ্নে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। কারণ খুশবুর কাষ্টডির প্রসঙ্গে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়।বছর দুয়েক আগে খুশবুর স্কুলের শিক্ষিকার রিপোর্টে ওদের জীবনে যখন সোশ্যাল ওয়ার্কার যুক্ত হয়েছিল তখনকার সকল রেকর্ড দেখা হলো। সেসব রিপোর্টের মধ্যে ছিল শিক্ষিকার বাবা-মায়ের সাথে একাধিকবার মিটিং এর রিপোর্ট এবং সোশ্যাল ওয়ার্কারের সাথে হওয়া মিটিং গুলোর রিপোর্ট। সেসব রেকর্ড অনুযায়ীও দেখা গেল সেসময়ও মেয়ের সমস্ত দেখা শোনা করত মা। ঘটনাটা আরও বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ হলো শাম্মির জবানীতে।

“সেসময়টাতে খুশবুর বাবা তার পুরনো অভ্যাসমতো, স্ত্রীকে হেনস্তা/নিয়ন্ত্রণ করার বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে, খুব ছোটো কোন কথা কাটাকাটি বা ঘটনার জের ধরে শাম্মির হাতে কোন টাকা পয়সা দেয়া/দৈনন্দিন বাজার করা ইত্যাদি বন্ধ করে দিয়েছিল। শাম্মিকে এরকম সংকটে ফেলা সেবারই প্রথম নয়। আগেরই মত উপায়ান্তর না দেখে শাম্মিও তখন আবার একটা কাজ খুঁজে নেয়। মা কাজ শুরু করার পর বাবার দায়িত্ব ছিল সপ্তাহের দুই/তিন দিন মেয়েকে স্কুলে পৌছে দেয়া কিংবা ছুটি হলে মেয়েকে স্কুল থেকে নেয়া। শাম্মি সকালবেলা স্কুলের জন্য মেয়েকে তৈরি করে দিয়ে, স্কুলের জন্য খাবার গুছিয়ে দিয়ে কাজে চলে যেত। মেয়ে তৈরি হয়ে বসে থাকত বাবার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়। বাবার দায়িত্বের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই স্কুলে যেতে দেরি হোত খুশবুর। যেদিন বাবার দায়িত্ব থাকত ছুটির পর মেয়েকে স্কুল থেকে নেয়ার সেদিনও খুশবুকে ঘন্টাখানেক বা তারও বেশি সময় ধরে বসে থাকতে হোত বাবার অপেক্ষায়। এভাবে কয়েকমাস ধরে চলতে চলতে স্কুলের শিক্ষিকা এক সময় বিষয়টা সোশ্যাল কেয়ারে রিপোর্ট করে দেয়”

এই একই জবানবন্দী শিক্ষিকা ও সোশ্যাল ওয়ার্কার দু’জনের কাছেই ছিল। পুরনো সেসব রেকর্ড থেকে খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে গেল যে দায়িত্বহীনতা যদি কিছু থেকে থাকে তা বাবার; মায়ের নয়।

খুশবুর বাবার পরবর্তী দাবি নানারকম কারণে ও নানা সময়ে শাম্মির দায়িত্বহীনতার সাথে সাথে ওর আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা গেছে। যে কারণে বাবা খুব চিন্তিত! মেয়েকে এরকম কারো কাছে রেখে দেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ন!

এই দাবিটা সহজেই খারিজ হয়ে গেল কারণ শাম্মির আত্মহত্যার চেষ্টা এবং পরবর্তীতে তাকে চিকিৎসার জন্য কোন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এরকম কোন রিপোর্ট পাওয়া গেল না।

কোন রিপোর্ট পেশ করতে না পারায় সেই বিষয়টা নিয়ে উকিলের সাথেও শাম্মির কোন কথা বলতে হলো না। তবে, ওর মনে বিষয়টা একটা বিরাট আঘাত হয়ে এল পুরনো ক্ষতের উপর। কষ্টে ওর দু’চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছিল কোর্টে বসা অবস্হায়ই। মনে পড়ে গিয়েছিল বহুবছর আগের সেই ঘটনা। সত্যিই তো আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল শাম্মি! দু:সহ জীবন থেকে মুক্তির জন্য। তারপর মরতে মরতে কিভাবে যেন বেঁচেও গিয়েছিল! কই সেদিন তো মনে হয়নি লোকটা বুঝতে পেরেছিল বা বোঝার চেষ্টা করেছিল যে স্ত্রীর কি হয়েছিল! এমনকি ওকে হাসপাতালেও নিয়ে যায়নি! আর আজ সেই ঘটনাকে ব্যবহার করছে নিজের সুবিধার জন্য! শাম্মি ভুলেই গিয়েছিল সেকথা! এখন থেকে প্রায় চৌদ্দ বছর আগের কথা! খুশবু পেটে আসার পর থেকে ওর আর মরে যেতে ইচ্ছা করত না। বরং বাঁচতেই ইচ্ছা করত সব সময়। আর সেই বাঁচার জন্যই তো চলছে চেষ্টা! গত কয়েকটি বছর যাবত! কিন্তু লোকটা সেই চেষ্টাতেও হানা দিতে ছাড়ছে না!

পরবর্তীতে শাম্মির সম্পর্কে বলা হলো যে ওর মানসিক স্হিতিশীলতার অভাব রয়েছে। সে কোথাও স্হিতিশীল নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে বারবার চাকরি শুরু করা ও ছেড়ে দেয়ার বিষয় বা বদলানোর বিষয়! মায়ের এই অস্হিতিশীল আচরণের নেগেটিভ প্রভাবও পড়বে মেয়ের জীবনে!

শাম্মি একেবারে হা হয়ে গেল এই অভিযোগে! মনে পড়ে গেল সেইসব ভুলে যাওয়া দিনগুলোর কথা। সামান্য এদিক সেদিক হলেই স্বামী নামক মানুষটি যখন দিনের পর দিন বাসায় বাজার বন্ধ করে দিত, নিজে বাইরে খেয়ে যখন ইচ্ছা তখন বাড়ি ফিরত, শাম্মির হাতে কোন বাজার খরচও দিত না তখন ধার দেনা করতে করতে বাধ্য হয়েই একসময় কোন একটা ছোটোখাটো চাকরি শুরু করতে হোত শাম্মিকে। কিছুদিন পর আবার সেই স্বামীর নির্দেশেই সংসারের শান্তি বজায় রাখতে, স্বামীকে খুশি করতে চাকরিটা ছাড়তে হোত। কারণ স্বামী চায়না যে শাম্মি টাকার জন্য বাইরে যেয়ে কাজ করবে। তাছাড়া স্বামীর পরিপূর্ণ সামর্থ্য থাকতে কেনই বা চাকরি করতে হবে! তারপর আবার কিছুদিন পর সেই টাকা দেয়া বন্ধ, বাজারঘাট বন্ধ এবং শাম্মির চাকরি খুঁজে নেয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি! এরকম করে নিজের জীবন চালাতে বারবার বেশ কয়েকটা চাকরি নিতে হয়েছিল ওকে এবং কয়েকমাসের মধ্যে এক প্রকার বাধ্য হয়ে সেসব চাকরি ছাড়তেও হয়েছিল। স্বামীর কথা শুনে, স্বামীর মন রক্ষার্থে, নিজের অনিচ্ছায় যা করতে হয়েছে আজ সেটাও ওরই দোষ!

এ বিষয়টাও অবশ্য বেশি গুরুত্ব পেল না। শাম্মি এখন যেখানে কাজ করছে সেখানে ওর রিপোর্ট বেশ ভাল। কাজে উপস্হিতি, সময়মত পৌছানো সহ নানারকম তথ্যের কাছে ওর মানসিক অস্হিতিশীলতার অভিযোগ কেটে গেল ঠিকই তবে বিষয়টা ওর মনে কিছুটা হলেও এক ধরণের চাপ তৈরি করতে লাগল। শুধু এ বিষয়টাই নয়; একের পর এক অভিযোগ ওকে ব্যাথাতুর করে তুলতে লাগল দিনের পর দিন!

ভুলে যাওয়া কালো কালো দিনগুলো গুটি গুটি পায়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, কঠিন কঠিন সব ঢাকা পড়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে একের পর এক। শাম্মির মন খারাপের সাথে সাথে শরীরও খারাপ হতে লাগল একটু একটু করে।

এরপর উঠে এল শাম্মির আর্থিক সঙ্গতির প্রসঙ্গ। বাবার ক্ষমতা আছে মেয়েকে প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর, প্রাইভেট গাড়িতে করে স্কুলে পাঠানোর, যখন তখন দামি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে ডিনার করানোর কিংবা অর্গানিক খাবার খাওয়ানোর, ব্র্যান্ডের কাপড় পরানোর এবং চাহিবা মাত্র যেকোন প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় দাবি পূরণে সামর্থ্য দেখানোর। কিন্তু মায়ের সাথে থাকলে মেয়ে বাসে-ট্রেনে করে স্কুলে যাবে, ষ্টেট স্কুলে পড়বে, সাধারণ খাবার খাবে কিংবা সাধারন পোশাক পরবে এবং যেকোন দাবি পূরণ হওয়ার তো প্রশ্নই আসেনা। বাবার দাবি,

“মেয়ে যদি দারিদ্রতার মধ্যে বড় হয় তাহলে স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটবে না, মেয়ে হীনমন্যতায় ভুগবে এবং ভবিষ্যত নিয়ে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করার মত যথেষ্ট পরিমাণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারবে না। পরিণামে ভুল সিদ্ধান্ত মেয়ের ভবিষ্যতকে করবে অনিশ্চিত”

শেষের বিষয়টা নিয়ে শাম্মির মনে ভয় শুরু হলো। আসলেই তো! মেয়ের বিলাসী পশ জীবন কেবল সম্ভব বাবার পক্ষে। মায়ের পক্ষে সেটা একেবারেই সম্ভব না! এ বিষয়ে উকিলও তেমন কোন স্বস্তির কথা না শোনালো না ওকে। তবে আরও কিছুদিন পর নতুন উকিল বেশ স্বস্তির কথা বলেছিল। বলেছিল “এদেশে এটা তেমন কোন বড় বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় বাচ্চার নিরাপত্তা” এরকম আশ্বাসের কথা শুনেও নিজের আর্থিক অবস্হার বিষয়টা শাম্মির মনে কেমন যেন কাঁটার মত বিঁধে থাকত প্রায়ই। প্রায়ই মনে হোত “মেয়েটা সবদিক থেকেই আরও ভাল কিছু ডিজার্ভ করে”

চারপাশে ঠোকর দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করার মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও দু’একজন মানুষ আছে যারা ঠোকর না দিয়ে সত্যিকার অর্থে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তেমন দু’একজনের সহযোগীতায় কিছুটা বিধ্বস্ত ও ঘাবড়ে যাওয়া শাম্মি এগিয়ে যেতে লাগল। যারা শাম্মির এই জটিল ও কঠিন সময়টাতে ওর পাশে ছিল তাদের মধ্যে একজন হলেন ডক্টর জায়েন; শাম্মির জিপি। কেস শুরু হওয়ার পর থেকে ওর শরীরটাও কেমন যেন খারাপ হচ্ছিল। প্রায়ই ডাক্তারের কাছেও যেতে হয়েছে। এরকমই একদিন,

-শাম্মি তোমার প্রেসারটা কিছুটা বেশি। গত কিছুদিন যাবত বারবার বেশিই পাচ্ছি। তোমার কি কোন মানসিক চাপ যাচ্ছে?

-হ্যা তা কিছুটা যাচ্ছে।

-তুমি চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।

-আমার মেয়ের কাষ্টডির কেস চলছে। সেটা নিয়েই মানসিক চাপ।

-তুমি কি ভয় পাচ্ছ নাকি অন্য কোন সমস্যা?

-আমার উপর এমন সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে যেগুলোর জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত নই। তাছাড়া বুঝতেও পারছি না শেষ পর্যন্ত কি হয়

-মনে সাহস রাখ। দেখবে তুমিই জিতবে। তোমাকে বহু বছর ধরে দেখছি। মেয়ের বিষয়ে তোমার মধ্যে একধরণের বিশেষ দায়িত্ববোধ সব সময় চোখে পড়েছে। মেয়েকে তুমি যেভাবে আগলে রেখেছ তার কোন তুলনাই হয়না।

-থ্যাংকস এ লট ডাক্তার।

-আমার কোন সহযোগীতা লাগলে বলবে।

-যদি লাগে তাহলে অবশ্যই বলব।

-আপাতত তোমার প্রেসারের ঔষধ বাড়ালাম না। আরও কিছুদিন অবজারভেশনে রাখব তোমাকে। যাওয়ার আগে আরেকটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যেও।

বিলেতে আসার পর থেকেই বলা যায় শাম্মি এই জিপির পেশেন্ট। বহুদিনের পরিচয়। ডাক্তার জায়েন একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ডাক্তার। আচার ব্যবহারে সব সময়ই বেশ আন্তরিক। চিকিৎসা নেয়া, টুকটাক গল্প করা ছাড়া এর আগে কোন সাহায্য নেয়া হয়নি তার কাছ থেকে। এমনকি ডাক্তারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কখনও তেমন কিছু জানা হয়নি। ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে বলা যাবে না। তবে বেশ আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক। ডাক্তার শাম্মির থেকে বয়সে বেশ কিছুটা সিনিয়র। তবে খুশবুর বিষয়ে ডাক্তার জায়েনের সচেতনতা সব সময়ই কিছুটা বেশি। জন্ম থেকেই মেয়েটাকে দেখছে সেজন্য অন্যরকম একটা বন্ডিং বলা যায়। খুশবুর জিপিও ডাক্তার জায়েন। ডাক্তারের কথা শুনে মনে একটু যেন জোর পেল শাম্মি।

 

(ক্রমশ)

 

২৩/১০/২০

 

 

 

 

 

-৪

ডাক্তার জায়েন এর সাথে খুশবুর কাষ্টডি নিয়ে কথা বলে যে ভাল হয়েছিল সেটা বেশ পরিষ্কার ভাবে বোঝা গেল কয়েকদিনের মধ্যেই! প্রয়োজনে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাবার পর পরই প্রায় কাকতালীয়ভাবে ডাক্তারের কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার মত একটা পরিস্হিতি তৈরি হলো উকিলকে নিয়ে!

বেশ কয়েকদিনের ধরেই উকিলকে নিয়ে শাম্মির মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধছিল। কেমন যেন একটা গড়িমসি ভাব চলছিল উকিলের মধ্যে! তাকে ফোন করলে পাওয়া যায় না! সে নিজেও ফোন করে না! অথচ ক্লায়েন্টের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা তার কাজেরই অংশ। এদিকে শাম্মি তাকে ফোন করেই যাচ্ছে। ‘উকিল সাহেব অসুস্হ হতে পারেন বা অন্য কোন সমস্যা; সেক্ষেত্রে সে ফোন রিসিভ করতে পারবে না’ কয়েকদিন সেরকম মনে করেই অপেক্ষা করল ও। পরবর্তী শুনানীর দিন এগিয়ে আসছিল, ওর চিন্তাও বাড়ছিল। ফোনে না পেয়ে শেষে একদিন উকিলের অফিসেই চলে গেল শাম্মি। সেখানে যেয়ে দেখল উকিল সাহেব দিব্যি অফিস করছেন। সরাসরি তার রুমে ঢোকা গেল না তবে এ্যাসিসটেন্ট জানাল যে তিনি অফিসে আছেন। অবাক কান্ড! শাম্মি অফিসে আসার আগেও ফোন করেছে ভদ্রলোককে! কোন উত্তর পাওয়া যায় নি! আরও অবাক হওয়ার পালা শুরু হলো যখন উকিল সাহেবের রুম থেকে অন্য কারো সাথে ফোনে কথা বলার শোনা যাচ্ছিল।

এর বেশ কিছুক্ষণ পর উকিল সাহেবর সাথে দেখা হলো ঠিকই তবে তিনি

ক্লায়েন্টকে দেখে খুব ব্যস্ততার অজুহাতে তেমন কোন কথাও বলতে চাইলেন না। বরং দেখেই বললেন,

-মিস শাম্মি আমি খুব সরি। খুব ব্যস্ত আছি। তোমাকে আজকে সময় দিতে পারব না।

-আমি তেমাকে কল করছিলাম গত কয়েকদিন ধরে। আজ সকালেও কল করেছি

-হ্যা আমি বেশ ব্যস্ত ছিলাম। মানে এখনও আছি। কিছুটা ফ্রি হয়েই তোমাকে কল ব্যাক করতাম।

-আমার কিছু আলাপ ছিল তোমার সাথে

-আজ নয় মিস শাম্মি।

এরপর শাম্মিকে আর কোন কথা বলারই সুযোগ দিলেন না তিনি! আশ্চর্য! অথচ পরবর্তী শুনানীর জন্য উকিলের সাথে আলোচনার প্রয়োজন। সেটাতো উকিল সাহেবও জানেন! আলোচনা ছাড়া কিভাবে পরবর্তী শুনানীর প্রস্তুতি সম্ভব!

ব্যক্তিগতভাবে শাম্মি আগের চেয়েও বেশি প্রয়োজন বোধ করছিল উকিলের সাথে কথা বলার। কেননা তখন এমন এক বিষয়ে শুনানী চলছিল যা কিনা ওর জন্য প্রচন্ড চিন্তার কারণ! তখন শুনানী চলছিল ‘খুশবুর বাবা ও মায়ের মধ্যে কার আর্থিক সঙ্গতি প্রসঙ্গে। কার পক্ষে অধিক নিশ্চিতভাবে মেয়ের সুস্হ-স্বাভাবিক জীবনের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব সে বিষয়ে’ শাম্মি একদিকে ভয়ে অস্হির হয়ে যাচ্ছিল অন্যদিকে উকিলের সাথে যোগাযোগ নেই। ওর আর্থিক সঙ্গতি খুশবুর বাবার থেকে অনেক কম সে ব্যাপারে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহের অবকাশও নেই। কাজেই এই অভিযোগ/দাবি খারিজ হয়ে যাবারও কোন সম্ভাবনা নেই আর সেজন্যই শাম্মির মনে মারাত্মক ভয় ঢুকে গিয়েছিল মেয়ে হারানোর!

এই রকম একটা ভয়াবহ সময়ে উকিল সাহেবের অসহযোগীতার মনোভাব প্রথমে অসহায়ত্ব ও পরে নতুন ভাবে ভাবতে সাহায্য করল শাম্মিকে:

ওর এক সময় সন্দেহ হতে লাগল যে মেয়ের বাবা পয়সা খরচ করে উকিলকে হাত করে নিয়েছে! এ ধরনের কাজ লোকটার পক্ষে করা খুবই সম্ভব! পয়সার কাছে নৈতিকতাকে বিকিয়ে দেয়া সেটাও তো খুবই সম্ভব যে কোন পেশার মানুষের কাছে। কোন ভয়-ভীতি বা অন্য কিছু কি হতে পারে? সেরকম কিছু হলে উকিল সেটা জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে তাও স্বাভাবিক। আবার এমনও হতে পারে শাম্মির কেস ধরে রেখে কেস হেরে যাওয়া নিশ্চিত করাটাই এখন তার কাজ! কারণ অন্য কোথাও অন্য কোন বিশেষ সুবিধা অপেক্ষা করছে!

কেস বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে এবং এই কেস অন্য কারো কাছে দেয়া বিরাট ঝামেলার বিষয় বা খুব কঠিন। সেটাও তো একটা অস্ত্র হতে পারে খুশবুর বাবার জন্য! বেশ মোক্ষম অস্ত্রই বলা যায়! শাম্মিকে বিষয়টা মারাত্মক ভাবিয়ে তুলল!

অবশ্য টাকা পয়সার বিষয়টাও অন্যভাবে উকিলের আগ্রহ নষ্ট করতে পারে শাম্মির কেস লড়ার ক্ষেত্রে! যদিও বিলেতের জীবনে সাধারণত এ সব বিষয়ে শাম্মির মত মায়েরা সরকারিভাবে আর্থিক বা আইনি সহায়তা পেয়ে থাকে তবে তা নি:শর্ত নয়। শাম্মি সেই সহায়তা পাওয়ার জন্য উপযোগী কিনা সেটাও নির্ভর করে অনেক বিষয়ের উপর। ওর জন্য বিষয়গুলো অজানা। এরকম কেসে আর্থিক বিষয়ের সমস্ত কাগজপত্র উকিলই তৈরি করে এবং সরকারি ফান্ড থেকে সরাসরি উকিলের কাছে পয়সা যায়। লিগ্যাল এইড পাওয়া ক্লায়েন্টের হাতে এরকম কোন বিষয় নেই যে সরকারি টাকা পয়সা হাতে নিয়ে উকিলের সাথে লেনদেন করবে। সেই ব্যবস্হা মতই শাম্মির উকিল প্রথমে বলেছিল তিনিই বিষয়টা দেখবেন এবং পরে বলেছিলেন,

-মিস শাম্মি তুমি লিগ্যাল এইড পাবে।

-তুমি কি কনফার্ম হয়েছ?

-হ্যা সব কিছু চেক করেছি। মনে হচ্ছে কোন সমস্যা হবে না।

-তার মানে তোমার সাথে আমার কোন টাকা পয়সা লেনদেন করতে হবে না, তাই তো?

-হ্যা ঠিক তাই।

উকিল সাহেব সরকারিভাবে আইনি সহায়তা পাবে সেটাই সিদ্ধান্ত ছিল। এমনও কি হতে পারে যে সেই বিষয়টা নিয়েই কোন ঝামেলা হচ্ছে? হতেও পারে। কিন্তু তা হলে তো উকিলের উচিত নিয়মিত যোগাযোগ রাখা বা বর্তমান অবস্হা জানানো। তাছাড়া অর্থগত কোন জটিলতা হলে তো শুরুর দিকেই হওয়ার কথা! এখন শেষের দিকে কেন হবে! কিংবা এমনও হতে পারে, খুশবুর বাবা উকিলকে এমন কোন মিথ্যা তথ্য দিয়ে কনফিউজ করেছে যে উকিল এসব ঝামেলা থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছে? অনেক কিছুই হতে পারে। কিছুই পরিষ্কার নয়!

শাম্মির সকাল-দুপুর-রাত এমনিতেই এক হয়ে গেছে গত কিছুদিন যাবত। মাথার উপর, মনের উপর এক বিরাট চাপ ভারি বোঝার মত হয়ে বসে আছে। ইদানিং সুগার লেভেলও বেড়ে গেছে। আগে একটা ট্যাবলেট খেতে হোত। এখন দু’টো করে খেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রেসারও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। নতুন করে আবার উকিলের ঝামেলা! অবস্হা অনেকটা এরকম যে অফিশিয়ালি ওর উকিল আছে কিন্তু আনঅফিশিয়ালি নেই! বেশ ভালভাবে নড়েচড়ে বসতে হলো শাম্মিকে!

শাম্মি মেয়ের জন্য জীবনও বাজি লাগাতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নিল উকিল বদলে ফেলার। চেষ্টাও শুরু করে দিল। কিন্তু বিষয়টা সহজ হলো না। এবারও বিদেশী উকিল নিয়োগের চেষ্টা করল তবে আরও প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বাসযাগ্য ও পেশাদারিত্বে আপোষহীন উকিলের খোঁজ করতে লাগল শাম্মি। সাথে আর্থিক বিষয়টা নিয়েও আরও ভাবল,

প্রথম থেকেই ভাবনাটা ছিল এরকম যে, ‘যদি সরকারিআইনি সহায়তা না পাওয়া যায় তাহলেও শাম্মি হাল ছাড়বে না বলেই মনস্হ করেছিল। প্রথমদিকে ভেবেছিল সরকারি আইনি সহায়তা না পেলে নিজেই কেস লড়বে। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি সেরকম অনেক কিছুই করতে হয়েছে গত কয়েকটি বছরে। তাহলে মেয়ের জন্য কেন নয়!’

তবে শেষ পর্যন্ত নিজের উপর অতটা বিশ্বাস রাখা বা সাহস জোগানো সম্ভব হলো না ওর পক্ষে। এত সিরিয়াস একটা কেস ও নিজে হ্যান্ডেল করতে পারবে না বা করা উচিত না। কেসে জিততে হবে সেটাকে লক্ষ্য হিসেবে রেখেই বাকি সব কিছু ভাবতে হবে এবং করতে হবে।

আগে থেকেই কিছু আর্থিক প্রস্তুতি ছিল শাম্মির। এবার উকিল পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে সেই প্রস্তুতিকে প্রয়োজনে আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিল ও। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল উকিল দিয়েই কেস চালানোর এবং প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়ে। উকিল খুঁজতে যেয়ে দেখা গেল

কিছু উকিলকে ওর নিজেরই ভাল লাগল না। আবার এরকমও হলো কোন উকিলকে ওর কাছে পেশাদার, নির্ভরযোগ্য ও সৎ মনে হলো কিন্তু কেসের জন্য রাজি করানো গেল না। তাদের রাজি না হওয়ার কারণ ছিল কেস অনেকদূর এগিয়ে গেছে। প্রায় হতাশ ও আশাহত অবস্হায় শাম্মির মনে পড়ল ডক্টর জায়েন এর কথা। আজ আবার ডাক্তারের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্টও আছে। আজই সুযোগ জিপির সাথে উকিলের বিষয়ে কথা বলার।

জিপির কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে চেক আপ এর সময় হলো ১০মিনিট। তবে ডাবল এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলে ২০মিনিট সময় পাওয়া যায়। এই এ্যাপয়েন্টমেন্টটা ডাবল ছিল। শাম্মি ২০মিনিট সময় পেল চেক আপ ও উকিল বিষয়ক আলোচনার জন্য।

 

(ক্রমশ)

 

২৪/১০/২০

 

 

 

 

 

-৫

চেক আপের শেষে ডাক্তারের মুখ দেখে মনে হলো না চেক আপের ফল ভাল হয়েছে। শাম্মি সে বিষয়টার দিকে মনোযোগ না দিয়েও বুঝতে পারল। ওর মূল ফোকাস যেহেতু ডক্টর জায়েন এর সাথে উকিলের বিষয়ে কথা বলা সেহেতু চেক আপের রেজাল্ট না জেনে বরং উকিল বিষয়ক কথাই শুরু করল,

-ডক্টর আমার মনে হচ্ছে সেই কেসটার বিষয়ে তোমার কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে

-হ্যা মনে আছে। যদি সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই হেল্প করব তোমাকে।

-হোপফুলি তুমি আমাকে হেল্প করতে পারবে। আমি লইয়ার চেঞ্জ করতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না।

-চেঞ্জ করতে চাও কেন?

-তার উপর ভরসা রাখতে পারছি না। বিহেভিয়ার কেমন যেন ফিশি লাগছে!

-চেঞ্জ করতে পারছ না কেন?

-কেস বেশ এগিয়ে গেছে বলে প্রতিষ্ঠিত কোন লইয়ার কেস নিতে চাচ্ছে না।

-আমি হয়ত তোমাকে হেল্প করতে পারব। কথা দিচ্ছি না তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে জানাব।

-ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করব

-তবে শাম্মি তোমাকে প্রেসারের জন্য ঔষধ দিতেই হচ্ছে। তোমার প্রেসার কমছেই না। আর ডায়াবেটিসের জন্য দু’টো ট্যাবলেট খাচ্ছতো?

-হ্যা দু’টোই খাচ্ছি। প্রেসারের ব্যাপারে তুমি যা ভাল মনে করো তাই করো

সেদিন ডাক্তার জায়েন এর সাথে কথা বলার পর শুরু হলো অপেক্ষা। অপেক্ষার সাথে আছে নানা রকম চিন্তা, দুশ্চিন্তা। অপেক্ষার সময়টার মধ্যে একদিন রাতে একটা দু:স্বপ্নও এসে হানা দিল শাম্মির ঘুমের মাঝে!

‘কেসে খুশবুর বাবা জিতে গেছে। শাম্মি এখন খুশবুর বাবার দয়ার পাত্রী। দয়া হলে মেয়ের সাথে কথা বলতে দেয় আর দয়া না হলে দেয় না। খুশবুর জন্য লোক দেখানো মত করে একজন গভর্নেস খুঁজছে ওর বাবা। যেহেতু লোক দেখানো সেহেতু গভর্নেস পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মেয়েকে একা বাড়িতে রেখেই লোকটা বাইরে চলে যায়। অনেক সময় খুব রাত করে বাড়ি ফেরে। খুশবু কখনও কখনও একা বাড়িতে ভয়ও পাচ্ছে, কখনও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু আগের মত মনোযোগ নেই। হোমওয়ার্ক না করা, ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়া বা দেরিতে স্কুলে পৌঁছানোর জন্য প্রচুর ডিটেনশন পাচ্ছে। ওর বাবাকেও স্কুল থেকে ডেকেছিল। ফলাফল হিসেবে খুশবু বাসায় এসে বকাও খেয়েছে। সেকেন্ডারি স্কুলে প্রাইমারি স্কুলের মত ওয়ান টু ওয়ান মনিটরিং কমে যাওয়ার কারণে টিচাররা বুঝতে পারছে না খুশবুর অবস্হা। এরকম চলতে চলতে মেয়ে ওর বাবাকে এক সময় বলেছে একা বাসায় রাতের বেলা ওর ভয় লাগে। এরপর থেকে শুরু হয়েছে আরেক আপত্তিকর ঘটনা। কখনও কখনও মেয়েকে বন্ধুদের আড্ডায়ও নিয়ে যাচ্ছে ওর বাবা। যেখানে নানা ধরণের লোকজনের উঠাবসা। মদখোর, জুয়াচারী সহ আজে বাজে, নানা বয়সের, নানা বয়সের সব লোকদের আসা যাওয়া সেই আড্ডায়। উঠতি বয়সের একটা মেয়ের জন্য সেই জায়গা কিংবা আড্ডা একেবারেই ঠিক জায়গা নয়। শাম্মি এসব যেন দূর থেকে নিরব দর্শকের মত করে দেখছে কিন্তু মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারছে না। ভীষণ কাঁদছে কিন্তু মেয়েকে বের করতে পারছে না সেই বাড়ি বা বাবার অভিভাবকত্ব থেকে’

শাম্মি ঘুম ভেঙে বুঝতে পারল যে সেটা একটা দু:স্বপ্ন হলেও সত্যি হওয়া খুবই সম্ভব। খুশবুর বাবার এরকম দায়িত্বহীনতা কিংবা আপত্তিজনক কাজের নমুনা শাম্মির অভিজ্ঞতায় আছে। এসবের কোনটাই ওর কল্পনা নয়। বরং অবচেতন মনে থেকে যাওয়া অভিজ্ঞতা।

খুশবুর বাবার জন্য প্রকৃতপক্ষে একটি বাচ্চার দায়িত্ব পালন করা কখনই সম্ভব নয়। এক কথায়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে একজন বাচ্চার সার্বিক দেখাশোনা লোকটার পক্ষে অসম্ভব। সে যদি মেয়ের দায়িত্ব পায় তাহলে খুশবুর জীবন খুবই ইনসিকিওর হয়ে যাবে। সর্বোচ্চ কোন গভর্নেসের হাতে যেতে পারে খুশবুর দেখা শোনার ভার। কিংবা সৎমায়ের হাতে। দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম জেনেও কেস ফাইল করা ও আইনি লড়াই করা একটা হুজুগ, কোন উদ্দেশ্য সাধন বা প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছুই না। লোকটার দায়িত্ববান বাবা হয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র কোন সম্ভাবনা নেই!

আসলে নানা রকম খারাপ অভিজ্ঞতা, দুশ্চিন্তা, নানান চিন্তা ভাবনা থেকেই এ ধরণের দু:স্বপ্নের আগমন! স্বপ্নে শাম্মি ভীষণ কাঁদছিল; ঘুম ভাঙার পর চোখের কোণে জমে থাকা কিছুটা পানি ওকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলল মেয়ের কাষ্টডির বিষয়ে!

সেরাতে আর ঘুম হলো না। বাকি রাতটা কেটে গেল ঘুমন্ত খুশবুর পাশে নামাজ আর নানা দোয়া দুরুদ পড়ে। অবশ্যই আল্লাহই সবচেয়ে বড় ভরসা। সেই ভরসাও শক্তি যোগাল শাম্মির মনে।

পুরনো উকিলের অসহযোগীতায় নতুন সিদ্ধান্ত ও নতুন উকিলের সন্ধান পাওয়া এই দুই বিষয়কে একটা ভারসাম্য মূলক অবস্হায় আনতে সময় লাগছিল। শেষে আল্লাহর দয়ায় ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন হলো শাম্মির জন্য।

পরবর্তী শুনানীর তারিখ পোষ্টপন্ড হয়ে গেল। ও কিছুটা স্বস্তি ও সময় পেল নতুন উকিল নিয়ে ভাবার ও বাছাই করার। কয়েকদিন পর ডাক্তার জায়েনও একজন উকিলের কথা জানাল। কঠিন হলেও শেষ পর্যন্ত জিপির সহযোগীতায় পাওয়া গেল একজন উকিল! ফোনে কথা হচ্ছিল ডা: জায়েন এর সাথে

-শাম্মি আমি একজন উকিলের নম্বর দিচ্ছি তোমাকে। তুমি তার সাথে কথা বলে নাও। তাকে তোমার বিষয়টা সংক্ষেপে বলেছি

-তার মানে সে জানে যে কেস অনেকদূর এগিয়ে গেছে।

-হ্যা সেটা বলেছি।

-উনি পুরনো উকিল পরিবর্তনের কারণ জানতে চেয়েছিল?

-হ্যা সেটাও বলেছি। একটু ঝামেলা হতে পারে তবে লিগ্যালি তোমার পুরনো উকিল সব কাগজপত্র ট্রান্সফার করতে বাধ্য হবে। তুমি উকিলের নম্বরটা নাও। আজই কথা বলে ডিটেইলস আলাপ করে নিও।

তবে শাম্মি চুন খেয়ে মুখ পোড়া মানুষ। মিষ্টি সাদা দই দেখলেও ভয় হয়। ও সন্দেহমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল আরও কথা বলে বলে,

-ডাক্তার জায়েন আমি কি এই উকিলের সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি?

-অবশ্যই জানতে পার! তোমাকে তার নাম পাঠাচ্ছি তুমি অনলাইনেই চেক করে দেখতে পার।

-আমি আসলে জানতে চাইছিলাম যে তার উপর কতটা ভরসা করতে পারি

-এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাক। এই লইয়ারের উপর পুরো বিশ্বাস রাখতে পারবে। খুবই পেশাদার ও ক্লায়েন্টের বিষয়ে শতভাগ সৎ ও বিশ্বস্ত।

-তোমার সাথে এই উকিলের কি রকম জানাশোনা?

-শাম্মি তুমি কোন চিন্তা কোরো না। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং খুব ভালভাবে চিনি।

শাম্মি আর্থিক বিষয়টাও বলতে চাইছিল। কিন্তু ডাক্তার জায়েন এর চোখ-মুখের ভাষা দেখে আর বলতে ইচ্ছা করল না। মনে হলো পরিবেশটা বিব্রতকর হয়ে উঠবে আর কিছু বললে। উকিল সম্পর্কে আরও জানার ইচ্ছা ও প্রয়োজনও হয়ত ছিল কিন্তু আর কোন উপায়ও ছিল না। ডাক্তারের উকিলের সাথে যোগাযোগ করাই ভাল মনে হলো ওর কাছে। তবে আরও একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়ার দরকার ছিল শাম্মির,

-ড. জায়েন তুমি আমার জিপি হয়ে আমাকে উকিলের রেফারেন্স দিচ্ছ সেটা কি এদেশের নিয়ম কানুনে ঠিক আছে?

-আমি শিওর না তবে এত ভয় পেলে কি চলে?

-আসলে খুশবুর বাবা যদি কোনরকম ফাঁক ফোকর খুঁজে পায় তাহলে আমাকে হেনস্তা করতে ছাড়বে না। তাছাড়া সেরকম হলে তোমার জন্যও তো খারাপ হবে।

-এত চিন্তা কোরো না। কাউকে বলার দরকার বা কি যে কার রেফারেন্সে তুমি এই উকিলকে পেয়েছ। প্রয়োজনে বলবে অনলাইন থেকে পেয়েছ। এই একই কথা আমি রিশিকেও বলে দিচ্ছি। মনে সাহস রাখো।

বিষয়টা নিয়ে আর খুব বেশি চিন্তা ভাবনা না করে শাম্মি উকিল বদলে ফেলল। বদলে ফেলা আসলেই খুব সহজ হলো না অবশ্য। পুরনো উকিল নানান প্রশ্ন করতে লাগল এবং নতুন উকিলকে বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরিয়ে তারপর কাগজপত্র গুলো পাঠাল। পুরনো উকিল যতই সময়ক্ষেপন করুক তাতে খুব একটা ক্ষতি হলো না কারণ পরবর্তী শুনানীর তারিখ বেশ কিছুটা দেরিতে।

আরেকটা শুনানীর আগেই জিপির রেফারেন্সে পাওয়া উকিলের কাছে কেস হস্তান্তর করে দেয়া সম্ভব হলো। সেই নতুন উকিলের ফি বেশি অর্থাৎ আরও পয়সার প্রয়োজন হতে পারে। নতুন উকিলও প্রথমদিকে নানা রকম প্রশ্ন-উত্তর এর ভিত্তিতে জানার ও বোঝার চেষ্টা করল যে শাম্মি কি সরকারী ভাবে আইনি সহায়তা পাবার যোগ্য কিনা। নতুন উকিল খুব অবাক করে দিয়ে শাম্মিকে এ ব্যাপারে আশ্বস্তও করল,

-মিস শাম্মি, তোমার বিষয়ে আমার কিছু বিষয় জানা দরকার।

-কেসের বিষয়ে?

-হ্যা। প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে যে খুব ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাচ্ছি কিন্তু আসলে এটা কাজের অংশ হিসেবেই করতে হবে।

-ঠিক আছে মি: রিশি। তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারো

-তোমার আর্থিক অবস্হার উপরে নির্ভর করছে তোমার কেসের আর্থিক দায়িত্ব কে নেবে।

-হ্যা সেটা আমি জানি। আগের উকিলের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছে।

-ওকে। ব্রিলিয়ান্ট। সবচেয়ে প্রথম যেটা জানা দরকার সেটা হচ্ছে তুমি কোন আইনি সহায়তা চাও কিনা?

-হ্যা যদি সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই লিগ্যাল এইড নিব।

-ওকে সেক্ষেত্রে আমাকে একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তোমাকে

-হ্যা আমি তৈরি। তুমি শুরু করতে পারো।

প্রথম উকিলের মতই দ্বিতীয় উকিলের সাথে বিশাল সাইজের একটা ফর্ম ভর্তি করতে হলো। ফর্মটা ভর্তি করল উকিলই। শাম্মিকে শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো। সবই ওর আর্থিক অবস্হার উপর নির্ভর করা প্রশ্ন। ফর্ম ভর্তি করার পর মি: রিশি যেসব কথা বলল সেটাই ছিল অবাক হওয়ার মত!

 

(ক্রমশ)

 

২৫/১০/২০

 

 

 

 

 

 

-৬

অবাক হওয়ার মত করেই মি: রিশি বলল,

“তুমি যদি লিগ্যাল এইড পাওয়ার উপযোগী না হও এবং যদি তোমার কোন আর্থিক ইস্যু থাকে তাহলেও আমি তোমাকে লেট ডাউন করব না। আমি তোমার কেসটা শেষ পর্যন্ত দেখব। সেক্ষেত্রে তুমি সময় নিয়ে ইনষ্টলমেন্টে আমার ফি দিতে পারবে। কাজেই টাকা পয়সা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। ইউ ক্যান রিল্যাক্স ফ্রম নাও”

এবং তার পর পরই মি: রিশি শাম্মিকে নিশ্চিন্ত করল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়া বিষয়টি নিয়েও। খুব ভাল করে বুঝিয়ে বলল,

“ব্রিটেনে এধরণের কেসে যাচাই বাছাই করা হয় দায়িত্বহীনতা, আসক্তি, আগের রেকর্ড ইত্যাদি বিষয়ে। বাচ্চার জন্য প্রচুর টাকা-পয়সার চেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরাপত্তা। তুমি যদি বাচ্চার প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পূরণ করতে সক্ষম হও, তোমার যদি বাচ্চার শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তা দেয়ার যোগ্যতা থাকে তাহলে তোমার কাছেই বাচ্চা থাকবে”

দ্বিতীয় উকিলের কথাগুলো শুনে খুব ভাল লাগল শাম্মির। চোখে প্রায় পানি এসে যাওয়ার মত অবস্হা! কোনমতে চোখের পানি লুকিয়ে বিব্রতকর অবস্হা থেকে রক্ষা পাওয়া গেল! মি: রিশি যেভাবে ওকে নিশ্চিন্ত করল সেটা সব ক্লায়েন্টকেই করে কিনা সেটা শাম্মির জানার কথা নয় কিন্তু ওকে যা বলল তা ওর নিজের কানেই শোনা। আর্থিক ও মানসিক দু’টো বিষয়েই জোরদার ধরণের সাপোর্ট দেয়ার ইচ্ছা পোষণ! দু’টোই খুব ভাল লাগল শাম্মির।

তাছাড়া ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে এই উকিলের সম্পর্কে জেনেও নিয়েছে ও। পেশাদারিত্বে তার রিভিউ খুব একটা ভাল/খারাপ না। রিভিউ অনুযায়ী একেবারে টপ ক্লাস উকিল না হলেও শাম্মির জন্য ঠিক আছে। আর সামনাসামনি তো যথেষ্ট মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ বলেই মনে হলো। এই মানবিক বোধটাই হয়ত শাম্মির জন্য খুব উপকারে আসবে। নতুন উকিলের উপর ভরসা করতে শুরু করল শাম্মি।

মি: রিশি যদিও শাম্মিকে রিলাক্স থাকতে বলেছিল তবুও মায়ের মন বলে কথা! নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায় না।

কিছু গহনা ছিল সেগুলো বিক্রি করে দেবে সিদ্ধান্ত নিল শাম্মি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একটা ছোটো জমি ছিল দেশে; সেটাকে বিক্রি করার প্রস্তুতি নিতে বলল ছোটোভাইকে, ব্যাংকের থেকে একটা পার্সোনাল লোন নেয়ার চেষ্টাও করতে লাগল, ভেবে রাখল প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ডও ভেঙে ফেলবে। অনেক চড়া সূদে নগদ পয়সা বের করে পয়সার জোগাড় করবে। গয়না, জমি, ঋণের বোঝা এসবের চেয়ে মেয়ে শাম্মির কাছে অনেক দামি। লিগ্যাল এইড না পাওয়া গেলেও পয়সার ব্যবস্হা হয়েই যাবে নিশ্চয়। আল্লাহ ভরসা।

কিন্তু তারপরও ছোটো একটা সমস্যা রয়েই গেল; একেবারে শেষের দিকে নতুন এই উকিলের কাছে কেস গিয়েছে! নতুন এই উকিল তার মানবতা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব বা সততা দেখানোর সুযোগ কতটুকু পাবে সেটাই এখন আরেক চিন্তার বিষয়!

একদিকে যদিও কেস শেষ হয়ে যাচ্ছে তবুও শাম্মির উপর আরও নতুন অভিযোগ আরোপ বন্ধ হচ্ছে না। আরও একটি নতুন অভিযোগ করা হয়েছে,

‘শাম্মির এক/একাধিক বয়ফ্রেন্ড আছে। বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে মেয়ের বিষয়ে সে উদাসীন। এমনকি ঘনিষ্ঠ একজন বয়ফ্রেন্ড আছে বাংলাদেশে। যদি সেই বয়ফ্রেন্ডকে শাম্মি বিয়ে করে তাহলে সমূহ সম্ভাবনা আছে মেয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে চলে যাওয়ার। সেক্ষেত্রে বাবার সাথে মেয়ের দেখা সাক্ষাত খুবই কঠিন হয়ে যাবে। পরিণামে বাবা বঞ্চিত হবে মেয়ের সান্নিধ্য থেকে’

এই অভিযোগটা ওর কাছে লেগেছে বাঙালি সমাজের অতি সাধারণ সেই অব্যর্থ অস্ত্র ছুঁড়ে মারার মত,

‘মেয়েটির/মহিলাটির চরিত্র খারাপ।’

কোন নারীর বিরুদ্ধে এই একটা মাত্র বাক্য প্রচার করে দিতে পারলেই যথেষ্ট। কাজে লাগা শুধু সময়ের ব্যাপার। যারা কোনদিন সেই নারীকে নিয়ে এরকম চিন্তাও করেনি তারাও; এই অদ্ভূত সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে দেবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা, মন্তব্য, ছোক ছোক করা এবং শেষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটি/মহিলাটির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তে আসা। এটাই চলে আসছে শত শত বছর ধরে!

অভিযোগ শুনে শাম্মি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। পরে উকিলকে বলেছিল খুশবুর বাবার সাথে সম্পর্কের টানা পোড়েনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তারপরে ওর পক্ষে কোন পুরুষকে বিশ্বাস করা হয়ত আর কোনদিনই সম্ভব নয়। এই রকম মন-মানসিকতা নিয়ে বয় ফ্রেন্ড রাখার প্রশ্নই ওঠে না!

তবে, এই বিষয়টিও আইনগতভাবে ধোপে টিকল না। একেতো পশ্চিমা সমাজে বয়ফ্রেন্ড থাকা কোন দোষের বিষয় নয় তার উপর আবার মেয়ের বিষয়ে কখনই দায়িত্বহীনতার, উদাসীনতার বা মেয়ে নিয়ে বিলেত ছেড়ে যাওয়ার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি শাম্মির বিরুদ্ধে।

কেস একেবারেই শেষের দিকে এখন। প্রায় বছরখানেক ধরে কেস চলছে। গত একটা বছর চাকরিতে বেশ কয়েকদিন অনুপস্হিত থাকতে হয়েছে শাম্মিকে। শারীরিক অসুস্হতা কিংবা কোর্টে হাজিরা দেয়ার কারণে হয়েছে অনুপস্হিতিগুলো। প্রতিটা কারণই একেবারে জেনুইন ছিল। ওর ম্যানেজার মহিলাটা বেশ সেন্সিবল। শাম্মির সাথে অনুপস্হিতির বিষয়ে ইনভেষ্টিগেশনে বসেছে তবে কোন হার্ড টাইম দেয়ার চেষ্টা করেনি। একদিন তো ফর্মাল কথাবার্তার বাইরেও কথা বলল,

-শাম্মি তোমার এ্যাবসেন্ট খুব বেশি হওয়াতে ইনভেষ্টিগেশনে বসতে হচ্ছে তবে এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই

-ওকে এ্যালিসন ইনভেষ্টিগেশনে অসুবিধা নেই।

-তুমি তোমার জিপি লেটার এবং কোর্টের হিয়ারিং ডেট এর একটা লিষ্ট তোমার উকিলকে দিয়ে সাইন করিয়ে আমাকে দিও। বাকিটা আমি বুঝে নিব।

-ঠিক আছে দিয়ে দিব। আমাকে কিছু সময় দিতে হবে।

-তুমি সময় নাও। তাতে কোন সমস্যা নেই। তোমার লিটল এনজেল কেমন আছে?

-ভাল আছে তবে মনে হচ্ছে সেকেন্ডারি স্কুলে সেটেল হতে আরও সময় লাগবে।

-ব্লেস হার। শি উইল বি এ্যাবসলিউটলি ফাইন। হোপ ইউ উইন হার ফর এভার এ্যান্ড ইউ টেক কেয়ার অফ ইওর সেল্ফ।

চাকরিটা শাম্মির জীবনে বিশাল এক পাওয়া। সেটাকে ধরে রাখা সব দিক থেকেই প্রয়োজন। গত বছরটা ও একটা মেশিনের মত কাজ করে গেছে। মুখে কোন হাসি নেই, কলিগদের সাথে কোন হাই হ্যালো নেই, কোম্পানির কোন সেলিব্রেশনে জয়েন করা নেই। শুধু কাজে যাওয়া, কাজ করা এবং কাজ শেষে ফিরে আসা। এদেশে মুখে হাসি ঝুলিয়ে কাজ করার নিয়ম। গম্ভীর মুখে কাজ করার পরও চাকরিটা যে টিকে আছে সেটাও এক বিশাল প্রাপ্তি।

কেস চলাকালীন সময়টাতে খুশবু যেন আরও কিছুটা ম্যাচিউর হয়ে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মাকে যেন স্পেস দিচ্ছে কোর্ট কাচারির বিষয়গুলোকে আরও ভালভাবে ডিল করার। মাঝে মাঝে এটা সেটা রান্না করছে মাকে রিলিফ দেয়ার জন্য, সকালে ঘুম থেকে একাই উঠে যাচ্ছে স্কুলের জন্য, ভিডিও গেম খেলা কমিয়ে দিয়েছে এবং নিজে থেকেই হোম ওয়ার্ক করতে বসছে।

বিষয়গুলো শাম্মির যে একেবারে চোখে পড়েনি তা নয় তবে কো ইনসিডেন্সই হবে। কারণ মেয়েকে তো কেসের কথা বলা হয়নি। খুশবুর এখন প্রি টিন। এজ চলছে। এ বয়সে এরকম পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। কখনও রান্না করতে ইচ্ছা করা, হঠাৎ নিজের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠা, নিজেকে বড় বড় মনে করা, নিজের জন্য আলাদা কোন জগত তৈরি করে নেয়া ইত্যাদি।

মায়ের সাথে মেয়ের এখন আর আগের মত সময় কাটানো হয়ে উঠছে না। মা তার কেস, শরীর-মন, চাকরি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত আর মেয়ে তার সেকেন্ডারি স্কুলে সেটেল হওয়া, পড়ার চাপ, বয়সের প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত।

আসলে ওদের জীবনে যেন এক কালো, নিরব, ঘাতক ঝড় বয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কেউ কারো কাছে কিছু প্রকাশ করছে না, অন্যকে বাঁচাতে চাইছে এই খারাপ ঝড়ের কবল থেকে। সেজন্যই শাম্মি মেয়েকে বলছে না কেসের কথা আর খুশবুও মাকে বলছে না বাবার কথা, বাবা যে মাঝে মাঝেই স্কুলে আসছে সেকথা বলছে না কখনই!

আজকের সকালটা দেখতে অন্যান্য সকালের মতই। অন্তত খুশবুর সেরকমই মনে হলো। কিন্তু মাকে দেখে ওর কেমন যেন লাগল! মা কেমন অসুস্হ অসুস্হ ভাব নিয়ে কিচেনে বসে আছে! খুশবুকে শাম্মি এতদিন ওকে নিয়ে চলা কোর্টের কেস বা এসম্পর্কিত কিছুই বলেনি। কিন্তু সেই সকালে শাম্মি খুব দ্বিধান্বিত হয়ে বসে ছিল। সেজন্যই ওকে দেখে অসুস্হ অসুস্হ লাগছিল। তাছাড়া কেসের রায় নিয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপ তো আছেই।

ব্রিটিশ আইনে বার বছরের শিশুর অভিভাবকত্ব নিয়ে সিদ্ধান্তে শুধুমাত্র বড়দের মতামতই গ্রহণযোগ্য। ১৬বছররে আগে শিশুটি সে বিষয়ে কোন মতামত প্রকাশ করতে পারবে না। তাহলে খুশবুকে বলা কি ঠিক হবে?

সেদিন খুশবুকে বলতে বলতেও থেমে গেল শাম্মি। নিজে যে মানসিক অস্হিরতা আর উৎকন্ঠার মধ্যে আছে সেটা আর মেয়েটার মধ্যে দিতে ইচ্ছা করল না। বরং বলল,

-মামনি আজকের দিনটা আমার জন্য খুব স্ট্রেসফুল, আজকের সকালটা মা তোমাকে কেন হেল্প করতে পারছি না।

মেয়ে কি বুঝল কে জানে! মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-ডোন্ট ওয়ারি মা আমিতো বড় হয়ে গেছি। কোন হেল্প লাগবে না। মনে মনে বলল,

(আমাকে তোমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না মা। তুমি দেখে নিও মা জাজ এরকম কোন কথা বলবেই না।)

শাম্মি জানেনা যে ওর বার বছরের মেয়েটাকে মানসিক ভাবে ও যতই স্বস্তিতে রাখতে চাক সেটা শুধু ওর দিক থেকে। মেয়েও যেটা তার মাকে বলল না সেটা হচ্ছে, কেসের কথা সে আগে থেকেই জানে। স্কুলে ওর সাথে ওর বাবা বেশ কয়েকবার দেখা করতে এসেছিল। হেডটিচার প্রতিবার ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ক্লাস থেকে। বাবা ওর সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গেছে। ও যখন বাবার সাথে কথা বলেছে তখন হেডটিচার রুমের বাইরে থাকে।

খুশবু ওর বাবার সাথে কথা বলেছে খুব কম তবে শুনেছে খুব মন দিয়ে। কথা শুনতে শুনতে মনে হয়েছে যে বাবা নামক মানুষটা বেশ ডমিনেটিং ধরণের, নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে খুব পছন্দ করে কিন্তু অপরপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। বিষয়টা খুশবুর ভাল লাগেনি। শেষের বার যাবার আগে বাবা ওকে জড়িয়েও ধরেছিল কিন্তু মায়ের গা থেকে যেরকম আপন আপন গন্ধ বের হয় সেরকম গন্ধ ছিল না তার শরীরে। মা জড়িয়ে ধরলে এক ধরণের স্বস্তি হয় কিন্তু বাবা জড়িয়ে ধরাতে অস্বস্তি হচ্ছিল!

খুশবুর পৃথিবী তার মা। বাবাকে তার পছন্দ নয়। বাবার কাছে যাবার জন্য কখনও আব্দারও করে না। মাকে কেন্দ্র করেই তার সব চাওয়া-পাওয়া। অন্যান্য দিনের মত মা আজকে হাসিমুখে বিদায় দিল না বলে খুশবু একটু মন খারাপ করেই স্কুলে গেল। তবে, মন খারাপের সাথে একটু মানসিক চাপও ছিল বোধহয়! বাবা সেদিন স্কুলে বলে এসেছিল,

“ভার্ডিক্ট হলেই তুমি আমার কাছে চলে আসবে। এইতো আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে। এ মাসের শেষের দিকে ভার্ডিক্ট হবে”

 

(ক্রমশ)

 

২৬/১০/২০

 

 

 

 

 

-৭

‘আজ কি তাহলে সেই দিন! মা তো বলল আজকের দিনটা খুব ষ্ট্রেসফুল!’

স্কুলে যাওয়ার পথে এটা মনে হওয়ার পর খুশবুর মন খারাপ ভাবটা আরও যেন বেড়ে গেল। মনটা পড়ে রইল মায়ের কাছেই, আচ্ছন্ন হয়ে গেল মায়ের চিন্তায়। মন বলছিল, ‘মায়ের কাছেই থাকতে চাই আমি। সব সময়ের জন্য, সারা দিন-রাত, সারা জীবনের জন্য!’

মনের মধ্যে নানা রকম সব চিন্তার ভীড় আর পিঠে স্কুলের ভারি ব্যাগ নিয়ে অনেকটা এলোমেলো ভাবে হাঁটতে লাগল মেয়েটা। এমনকি অনেকটা ইচ্ছা করেই ঘুরপথ বেছে নিল স্কুলে যাওয়ার জন্য। রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে ঘুরপথ! খুশবু কখনও চিন্তাও করতে পারত না কোনদিন। কিন্তু আজ মন এতটাই খারাপ যে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিজতেই ভাল লাগছিল। স্কুলে যেতে ইচ্ছাই করছিল না ওর। একবার ইচ্ছা করছিল মায়ের সাথে কোর্টে যেতে, আবার ইচ্ছা করছিল কোন পার্কে যেয়ে বসে থাকতে কিংবা হারিয়ে যেতে!

কোনটাই সম্ভব হলো না।কোনমতে স্কুল শুরু হবার শেষ এ্যালার্ম বাজার মিনিটখানেক আগে স্কুলে যেয়ে পৌছাল খুশবু। ওর মন খুবই বিক্ষিপ্ত! আজ স্কুলে কি হবে, কি হবেনা এসব কিছুই আর ভাল লাগছিল না বাচ্চা মেয়েটার। ইদানিং প্রায়ই আরেকটা চিন্তা এসে ভূতের মত সওয়ার হয়। সেই চিন্তাও এল; ‘আজ আবার বাবা আসবে নাতো!’ চিন্তাটা মনে আসলে মুখ থেকে এমনিতেই বের হয়ে আসে ‘উফ! নট এগেইন!’

স্কুলে বাবা আসবে চিন্তা করলে খুশবুর আর স্কুলেই যেতে ইচ্ছা করে না। তাছাড়া কয়েকবার এরকম হয়েছে! ক্লাসের মাঝে হঠাৎ যখন ওর ডাক পড়ে তখন অবস্হাটা খুব বিব্রতকর! টিচার লেসন দেয়া বন্ধ করে ওর দিকে তাকায়, ও ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং বাকি ২৯জন ক্লাসমেট ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরো ক্লাস চুপচাপ ওকে দেখতে থাকে! নিজেকে একটা এলিয়েন মনে হয় খুশবুর! কয়েকবার বন্ধুরাও জানতে চেয়েছে কে এসেছিল, কেন এসেছিল ইত্যাদি।

বাবাকে তো ওর একেবারেই পছন্দ নয়! কখনও সখনও মায়ের উপরও রাগ-অভিমান হয় খুশবুর। যদিও বুঝে উঠতে পারে না যে মায়ের দোষ কি! তবে মাঝে মাঝে এটাও মনে হয়,

‘বাবার মত এরকম একটা উইয়ার্ড মানুষকে বিয়ে করল কেন মা? বিয়ের আগেই তো বোঝা উচিত ছিল যে তার সাথে বাবার ফ্রেন্ডশিপ থাকবে না। তারা দু’জনে অপোজিট টাইপ মানুষ। ফ্রেন্ডশিপ তো হয় একই রকম মানুষের মধ্যে। তাদের দু’জনের নিশ্চয় একসময় ফ্রেন্ডশিপ ছিল! কিন্তু কিভাবে? মা এত বোকা কেন? কেমন করে বাবার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করল! ফ্রেন্ডশিপ ভুল করে অবশ্য হতে পারে কিন্তু ম্যারি কি ভুল করে হয় নাকি? হতেও পারে। মায়ের তো হয়েছে। আমি বিয়েই করব না। বিয়ে করলে পরে যদি আমারও মায়ের মত অবস্হা হয়!’

এসব অবশ্য খুশবুর একান্ত ও ব্যক্তিগত চিন্তা। মাকে বলা হয়নি। বললে মা মন খারাপ করতে পারে। মায়ের মন খারাপ সহ্য করা খুশবুর জন্য ভীষণ কঠিন।

আজকেই যদি ভার্ডিক্ট হয়ে যায়; মায়ের সাথেই যেন ওর থাকার সিদ্ধান্ত হয় সেই আকুতিতে খুশবুর মন কিছুটা সময় ছেয়ে থাকল। মা তো অনেক খুশি থাকবে। খুশবুও।

কেস শেষ হয়ে গেলে মাকে বলতে হবে ওজন মাপার একটা মেশিন কিনতে। সবার বাসাতেই আছে শুধু ওদের বাসায় নেই। মা যে বারবার বলে খুশবুর ওজন কমে গেছে সেটার ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে বাসায় একটা ওজন মাপার মেশিন থাকলে। খুশবু যে বেশ খানিকটা লম্বা হয়েছে সেটা মা একেবারেই বুঝতে পারছে না। এমনকি ওর স্কুলের ট্রাউজারটা ইদানিং লম্বায় ছোট হচ্ছে, টি শার্ট বা ব্লেজারটাও কেমন টাইট লাগছে। মাকে বলতে হবে নতুন ইউনিফর্ম কেনার কথাও।

তাছাড়া ওদের কিচেনে দু’টো গ্লাস ভেঙেছে, টেবিল ম্যাটগুলো খুব পুরনো হয়ে প্রায় ছিড়ে গেছে। কয়েকটা গ্লাস আর টেবিল ম্যাটও কিনতে হবে। খুশবুর রুমের কার্টেন এর একটা সাইড আলগা হয়ে গেছে সেটাও ফিক্সড করতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় নতুন কার্টেন কিনতে পারলে। কার্টেনটা কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিবার ওর কোন ফ্রেন্ড যখন ওর রুমে আসে তখন বেশ লজ্জা লাগে!

মা খুব ভাল কেক বেক করে। আজকে কেস জিতে গেলে খুশবু মাকে বলবে ওর জন্য একটা কেক বেক করে দিতে। তাছাড়া গত ইদে মা ওকে নতুন কাপড়ও কিনে দেয়নি। মাই তো শিখিয়েছিল ইদে নতুন কাপড় পরা সুন্নত! তবে সেদিন অবশ্য খুশবুকে স্কুলে যেতে হয়েছে। মা বলেছিল জরুরী কাজে বাইরে যেতেই হবে। খুশবুও সেজন্য স্কুলেই গিয়েছিল। সময়টা খারাপ কাটেনি।

গত বার্থডের দিনও তো মাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। খুশবু স্কুল থেকে ফিরে পাশের বাসার পলিনদের বাসায় মার জন্য অপেক্ষা করেছে। মা সেদিন বাইরে থেকে খাবার কিনে এনেছিল। যদিও খুশবুর পছন্দ মায়ের হাতের রান্না করা বিরিয়ানি আর বেক করা কেক; মাকে সেদিন এত ক্লান্ত লাগছিল যে কিছু বলতে ইচ্ছাই করছিল না। মা জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়েছিল যেটাতে খুশবুর মনটা এমনিতেই ভাল হয়ে যায়; সেদিনও হয়েছিল।

উফ! মায়ের সাথে বলার মত কত কথা যে জমে আছে!

ওর ক্লাসমেট লাবিলা শেষ পর্যন্ত আবার ওর ক্লাসে এসেছে। একটু খারাপ রেজাল্টের জন্য ওকে নিচের একটা ফর্মে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেদিন লাবিলা আর খুশবু দু’জনেই কেঁদেছিল। পরের টার্মে পরীক্ষায় ভাল করে লাবিলা আবার ফিরে এসেছে টপ ফর্মে। খুশবুর সাথে।

রিগানের একটা বেবি ব্রাদার হয়েছে দেখতে একেবারে রিগানের মতই, ভুরু কুচকে থাকে। দেখতে কেমন ইন্টারেষ্টিং লাগে! রিগানের মা এখনও হোম টাইমে রিগানকে নিতে আসে। সাথে কার সিটে করে বেবি ব্রাদারটিকেও নিয়ে আসে। সেজন্যই খুশবু দেখতে পেরেছে।

সকালে স্কুলের সামনে যে রেড কোর্ট টিম থাকে দুষ্টু বাচ্চাদের অবজার্ভ করা, ধরে ফেলা এবং শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে তার কিন্তু আসলে খুব ভয়ঙ্কর না! তারা প্রত্যেকেই দেখতে একটু বিশাল সাইজের এবং একই রকম লাল ড্রেস পরে থাকে বলে দেখতে ভয়ঙ্কর লাগে। ওরা আসলে অত খারাপ না। ভিকি একদিন কোকের বোতল থেকে কোক ছিটাচ্ছিল বলে ওকে শাস্তি দিয়েছে। ঠিকই তো আছে! ভিকিটা এখনও মহা দুষ্ট!

মিস নাওমির বিয়ে হয়েছে। স্কুলেরই আরেক টিচারের সাথে। তারা অনেক আগে থেকেই গুড ফ্রেন্ড ছিল। মিস টিমি স্কুলের জব ছেড়ে আয়ারল্যান্ডে ফিরে গেছে আর মি: কলিও এখনও হাসির হাসির কথা বলে হিস্ট্রি ক্লাসে সবাইকে খুব হাসায়!

কত শত জমে থাকা কথা ভাবতে ভাবতে মায়ের মত সেও প্রার্থনা করতে লাগল আল্লাহর কাছে। মায়ের মত সেও মনে মনে বলতে লাগল আল্লাহ ভরসা। আর যদি বাবা জিতে যায় তাহলে ও কি করবে? খুশবু ঠিক করল বাবা যদি ওর কাষ্টডি পায় তাহলে ও কোথাও পালিয়ে যাবে। কোথায়, কিভাবে, কতদিনের জন্য পালাবে সেটা ঠিক করতে পারল না অসহায় মেয়েটা!

সারাটা দিন মনটা যে কি ভীষণ খারাপ ভাবে কাটল খুশবুর! শুধু ক্লোজ বন্ধুরাই যে বুঝল তা নয়। ক্লাসের সবাই বুঝল। খুশবু ক্লাসের মধ্যেই কোন একটা সময় ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাও শুরু করে দিল। পাশের বন্ধু বারবার জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে কিন্তু খুশবুর বলতে ইচ্ছা করেনি। পরে টিচার ও দেখে ফেলেছে। লেসন বন্ধ করে খুশবুকে নিয়ে বাইরে যেয়ে কথা বলেছে। টিচাররে কাছে অনিচ্ছা সত্বেও ওকে বলতে হয়েছে কারণটা। টিচার ওকে বুঝিয়ে বলল,

“Keep faith on God. God will not do anything bad for you or mum. He is the best judge”

কান্না থামিয়ে, টয়লেটে যেয়ে চোখ-মুখে পানি দিয়ে ফিরে এলেও মনটা খারাপ হয়েই রইল বাচ্চা মেয়েটার!

খুশবুকে ওর মা যদিও বলেনি কেস, কাষ্টডি বা ভার্ডিক্টের কথা; ওর বাবা ওকে নিশ্চিত করেই বলেছিল দিনটার কথা। সেজন্যই মেয়েটা বুঝে গিয়েছিল যে আজকেই ভার্ডিক্টের দিন। খুশবুর বাবা না বুঝে মেয়েটার মনে যে চাপ তৈরি করে দিয়েছে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না ওর মায়ের। ওর মা বরং ভাবছিল ‘মেয়েকে এসব বিষয়ে না বলাটাই ভাল হয়েছে। মেয়েটা অন্তত নিশ্চিন্তে স্কুল করছে’

মেয়ের মানসিক অবস্হা নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকলেও বাকি সব বিষয়ে অপরদিকে খুশবুর মায়ের অবস্হাও তথৈবচ! ওর মায়েরও সেই একই চাওয়া, একই অস্হিরতা, চাপা কান্না, এলোমেলো ভাবনা নিয়ে চলেছে দিনটা!

আজ প্রায় তেরটি মাস কিভাবে যে কেটেছে ওর। ও জানে আর জানে ওর মালিক!

কিন্তু আজ একেবারে যেন আত্মা খাচাঁ-ছাড়া! আজ কেসের রায় হবে! শরীরটাও যেন বিদ্রোহ করতে চাইছে। মনে হচ্ছিল বিছানা থেকে উঠতেই চাইছিল না। একবার ওর মনে হচ্ছিল আজ কোর্টে যাবেই না। বাইরে বৃষ্টি, মনের ভিতরেও জমে থাকা মেঘ আর বৃষ্টি। মি: রিশির কাছ থেকে বরং সব জেনে নেবে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার মনে হতে লাগল সেটা সম্ভব নয়। কোর্টে যেতেই হবে।

দ্বিতীয় উকিলের উপর শাম্মির ভরসা আছে কিন্তু তারপরও রায় হওয়ার আগে যেন জীবন-মরণ অবস্হা! ঘরে শান্তি নাই, বাইরে শান্তি নাই। শুধু অশান্তির অনুভূতি চারপাশে!

 

(ক্রমশ)

 

২৭/১০/২০

 

 

 

 

 

 

-৮

শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত রায়ে কি হবে সেই টেনশনে শাম্মির গতকয়েক রাত ধরে কোন ঘুমই হচ্ছিল না। গতরাতে কখন যেন চোখদু’টো লেগে গিয়েছিল; তখন কোত্থেকে একটা সুখের স্বপ্ন এসে ভর করেছিল ঘুমের মাঝে,

‘ওদের দু’জনের সংসারে নিজেদেরকে নিয়ে ওরা আবার আগের মত সুখি। মেয়ে বড় হচ্ছে আর মায়ের শক্তিতে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন। আসলেই, সন্তানই তো মায়েদের শক্তি। সন্তানকে কেন্দ্র করে কোন কোন মাকে নানা রকম মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়; পরবর্তীতে সন্তানের কারণেই সেসব প্রায় মুছে যায় একসময়। ঠিক এরকমই হয়েছে শাম্মির জীবনে। খুশবু যেন ওর এক বিরাট শক্তি, সুখের আধার। মা-মেয়ের সুখের সংসারে অন্য কারো ছায়া আর পড়ে না। খুশবুর বাবা মেয়ের পুরো কাষ্টডি না পেয়ে মেয়ের বিষয়ে আবার আগ্রহ হারিয়েছে। কোর্টের নির্দেশ মত শর্তসাপেক্ষ নাম কাওয়াস্তে কাষ্টডি পেয়ে তিনি মেয়ের বিষয়ে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। তার সেই অনাগ্রহ যেন মা-মেয়েকে করেছে আরও ঘনিষ্ঠ ও একে অপরের পরিপূরক। তারা তাদের ছোট্ট ঘরে, স্বল্প সামর্থ্যে, ভালবাসা পূর্ণ সুখের সংসার পেতেছে অনেকটা নিশ্চিন্তে।’

স্বপ্নের মধ্যে কে যেন বলছিল, “মা-মেয়ের সুখের সংসারে কারো যেন নজর না লাগে!” ঘুম ভেঙে মনে হয়েছিল আহা! স্বপ্নটাই যদি সত্যি হোত!

রায় হবার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শাম্মির খুব ইচ্ছা করছিল মায়ের সাথে কথা বলতে। যে লোকটার হাত ধরে মা-মাতৃভূমি ছেড়ে পরদেশ এসেছিল সেই লোকটা পরদেশ জীবনের প্রথমদিকেই ওর হাত ছেড়ে দিয়েছিল। সেই একাকী জীবনে মায়ের সাথে আর কোনদিন দেখা হয়নি। প্রথমবার দেশে বেড়াতে যাওয়ার আগেই মা মারা যান। জীবিত অবস্হায় মার সাথে ফোনে কথা হতো মাঝে মধ্যে। বহুদিন আগেই মা চলে গেছেন সবাইকে ছেড়ে। মা যদি আজ বেঁচে থাকতেন হয়ত এই ভয়াবহ কঠিন সময়টাতে মেয়েকে মানসিক শক্তি যোগাতে পারতেন।

শাম্মির আসলে খুব অসহায় লাগছিল। কাউকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। একবার মনে হচ্ছিল ওর জীবনের একমাত্র সত্য পাওয়া, ওর বেঁচে থাকার প্রান শক্তি, ওর মেয়েটা ওর কাছেই থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নি:সন্দেহে মহান ও ন্যায় বিচারক। পরমুহূর্তে কেমন যেন ভয় এসে চেপে ধরছিল।

মা বেঁচে নেই। হয়ত ভালই হয়েছে। মা হয়ত নিজের মেয়ের জীবনের এত টানা পোড়েন সহ্যই করতে পারতেন না। কোর্টের উদ্দশ্যে বের হওয়ার আগে কেমন যেন একটা এক চাপা ভয়, কান্না, ব্যথার বোধ নিয়ে বের হতে হলো শান্মিকে।

সেই সকালটা এমনই ছিল যে বাসা থেকে বের হবার আগে শাম্মি এবং খুশবু দু’জনই কিছু না খেয়ে বের হলো। দু’জনেরই মনে নানা রকম আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, গত কয়েকটা মাসের কঠিন সব স্মৃতি! দু’জনই ভাবতেই পারছে না খুশবু ওর বাবার কাছে চলে যাবে। আবার চিন্তাটা ছাড়তেও পারছে না!

শাম্মির যেমন স্বাস্হ্য খারাপ হয়ে গেছে তেমনি খুশবুরও হয়েছে। মা এখন আর খুশবুর খাওয়া নিয়ে তেমন জোরাজুরি করেনা। নিজেও তেমন একটা খায় না। ঘরে থাকলে নামাজ, কোরান পড়া কিংবা শুয়ে থাকা এসব নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে। হয়ত একবার-দু’বার মেয়েকে বলে খাওয়ার কথা তারপর ভুলেও যায়! খুশবুর যে ওজন কমেছে তা শাম্মির চোখে পড়েছে কিন্তু মেয়ে সেটা মানতে রাজি না। ওর কথা হলো ইদানিং ওর উচ্চতা বেড়েছে সেজন্য ওকে দেখতে স্লিম লাগছে।

কোর্টে যাওয়ার পথে বাসের এক কর্ণারে বসে মনে পড়ছিল মেয়ের কথা, নানা বিষয়ের কথা। বাসটাও যেন অন্যদিনের চেয়ে ধীর গতিতে চলছিল। যেসব ষ্টপে থামার জন্য অন্য দিন কোন রিকোয়েষ্ট থাকে না সেসব ষ্টপেও রিকোয়েষ্ট আসছিল সেদিন। অতি ধীরগতির সেই জার্নিতে শাম্মির মন যেন হিসেব করছিল নানা ঘটনার! পজিটিভ ছিল অপ্রত্যাশিত সব জায়গা থেকে সহায়তা পাওয়া। আবার সেটাও বা কম কি? যেদিন মি: রিশি জানিয়েছিল,

“মিস শাম্মি আমি কনফার্ম যে তুমি লিগ্যাল এইড পাচ্ছ। কাজেই সে ব্যাপারে তোমার আর কোন চিন্তা নেই। তোমার আগের উকিলের থেকে লিগ্যাল এইড সংক্রাম্ত পেপারস গুলো নিয়েছি এবং পুরো বিষয়টাও মিমাংসা করে ফেলেছি”

শাম্মিকে শেষ পর্যন্ত গহনা, জমি এসব কিছুই বিক্রি করতে হয়নি। ক্রেডিট কার্ড থেকেও চড়া সূদে ক্যাশ বের করতে হয়নি। লোনের এ্যাপ্লিকেশন অবশ্য এমনিতেই বাতিল হয়ে গিয়েছিল।

পুরো কেস চলাকালীন সময়টার মধ্যে

যেটা সবচেয়ে কঠিন লেগেছে সেটা ছিল অনুসন্ধান। অনেকটা শুরুর দিকেই বিশেষ এক প্রতিষ্ঠান থেকে ফোন করে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল। প্রশ্ন গুলো করা সেই প্রতিষ্ঠানের কাজের অন্তর্ভূক্ত। মূলত বাচ্চা কার কাছে বা কোথায় নিরাপদ সেটা বের করাই তাদের কাজ। তাদের সাথে সোশ্যাল কেয়ারও কাজ করছিল। শাম্মির কাছে প্রশ্নের উত্তর দিতে কঠিন লাগেনি। কঠিন লেগেছে এই ভেবে যে ঠিক একই ভাবে খুশবুর বাবার কাছেও তারা প্রশ্ন করবে। এমনকি খুশবুর কাছেও যেতে পারে তারা। মেয়েটাকে হয়ত সরাসরি বা খোলাখুলিভাবে সব কিছু বলবে না কিন্তু পরোক্ষভাবে জেনে নিতে চাইবে তার মনের কথা। বাচ্চা মানুষ কি বলতে কি বলবে কে জানে! তাছাড়া ওর বাবা শাম্মির সম্পর্কে না জানি কি বলবে! ভয় ছিল খুশবুর বাবার মিথ্যা বলা ও মিথ্যাভাবে নিজের দাবি প্রমাণের! খুশবুর সাথে বিষয়টা নিয়ে কখনও কথা হয়নি। দেখাই যাক আজ কি হয়! আজই সবপরিষ্কার হয়ে যাবে!

খুশবুর কথা মনে হতেই আজ মনে হতে লাগল গত তেরটা মাস খুশবুর তেমন কোন যত্নই নেয়া হয়নি! মেয়েটা সেকেন্ডারি স্কুলে কিভাবে সেটেল করল তার গল্পগুলোও তো শোনা হয়নি। এত বেশি ব্যস্ততা আর শারীরিক-মানসিক ধকল গেছে যে বাসায় ফেরার পর সারাক্ষণ শুধু ক্লান্তিতেই কেটে যেত সময়। অবশ্য খুশবুও আগের তুলনায় চুপচাপ হয়ে গেছে। বয়সের কারণে কিংবা মায়ের ব্যস্ততার কারণে হতে পারে। চাকরি বজায় রাখা, উকিলের সাথে যোগাযোগ, কোর্টে হাজিরা, ঘনঘন ডাক্তারের কাছে যাওয়া ইত্যাদি সব কিছু মিলে মেয়ের সাথে তেমন একটা সময়ও কাটানো হয়ে ওঠেনি!

খুশবুর সেকেন্ডারি স্কুলে ইয়ার সেভেনে একটা মাত্র প্যারেন্টস মিটিং হয়। এ বছর সেটাও মিস হয়েছে। মেয়েটার প্যারেন্টস মিটিং এ যাওয়া হয়নি! পরে টিচারদের সাথে চেষ্টা করেও আর এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়নি। টিচারদের সাথে মিটিং করতে না পেরে শাম্মি শেষে হেডটিচারকে একটা মেইল করে জানিয়েছিল অসুস্হতার কারণে প্যারেন্টস মিটিং এ ওর অনুপস্হিতির কথা। মেয়েটার পড়ালেখার কি অবস্হা সেটাও দেখা সম্ভব হয়নি বিগত বছরটাতে! খুশবু এখন ইয়ার এইটে যাচ্ছে। এবছর ওর দিকে অবশ্যই আরও মনোযোগ দিতে হবে।

কেসের পুরো সময়টাতে দু’টো ইদও এসে গেছে শাম্মি আর খুশবুর জীবনে। তবে সেসব উৎসবের দিন পালন করা হয়নি। শাম্মি দু’দিনই কাজের ওখানে ওভার টাইমের অফার পেয়ে নিয়ে নিয়েছিল। তখন টাকা পয়সা নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠা ছিল একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মা বাসায় না থাকায় খুশবুকেও সেই দু’দিন স্কুলে পাঠাতে হয়েছে। মেয়ে যদিও বলেছে স্কুলে ওর ভাল লাগে; ইদের দিন স্কুলে যেতে হলে কোন সমস্যা নেই কিন্তু মায়ের জন্য বেশ মন খারাপ করার ছিল দিন দু’টো।

খুশবুর বার্থডের দিনটাও ছিল এক শুনানীর দিন। সেদিন কোর্টে যেতে হয়েছে। আগে থেকে কাজ, অসুস্হতা, উকিলের সাথে মিটিং ইত্যাদি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে মেয়ের জন্য কোন গিফটও কেনা হয়নি; এমনকি নিজের হাতে কিছু রান্না করেও খাওয়ানো হয়নি মেয়েকে! মেয়ের জন্য বাইরে থেকে কেনা খাবারই ছিল একমাত্র সম্বল। মেয়েটাও কোন আপত্তি বা অসন্তোষ প্রকাশ না করে চুপচাপ খেয়ে নিয়েছিল! মা অবশ্য গোপনে চোখের পানি মুছেছিল ওর এত বুঝদার, শান্তিদায়ক মেয়েটার ভাগ্যের কথা ভেবে!

শাম্মি ঠিক করল আজ কোর্টের পাট চুকে গেলে ঠিক আগের জীবনে ফিরে যেতে হবে। সকাল, দুপুর আর রাতে মা-মেয়ের একসাথে খেতে বসা, নানা রকম গল্পে মেতে ওঠা কতই না মধুর! কতদিন মেয়েটার জন্য ভালমন্দ কিছু রান্নাও করা হয়নি! মেয়েটা এরমধ্যে কোনদিন কোন আব্দারও করেনি বরং মাঝে মাঝে নুডলস, পাস্তা, খিচুড়ির মত সহজ রান্না গুলো করে মাকে খেতে দিয়েছে। চা-কফিও তৈরি করে দিয়েছে সময় সময়। ওকে নিয়ে এর মধ্যে কোথাও যাওয়াও হয়নি। শুধু দুই একবার সুপারমার্কেট আর স্কুল এই ছিল মেয়েটার জীবন। কোন খেলনা, কাপড় বা শখের কিছুও কিনে দেয়া হয়নি!

“নাহ! আর এভাবে চলতে দেয়া যাবে না। আজকে থেকেই সব কিছু আগের মত করে ফেলতে হবে। আজকে সব চুকে বুকে গেলে মা-মেয়ের জীবন আবার প্রাণ ফিরে পাবে” মনে মনে নিজেকে এসব বলতে বলতে হঠাৎ মনে হলো ‘যদি ওর বাবা কাষ্টডি পেয়ে যায় তাহলে?’

খুশবুকে নিয়ে আর ভাবতে পারছিল না শাম্মি। চোখ মুছে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। শূন্য দৃষ্টি আর ফাঁকা মাথা নিয়ে আর কিছু ভাবার শক্তি ছিল না ওর।

 

(ক্রমশ)

 

২৮/১০/২০

 

 

 

 

 

-৯

বাসের সেই জার্নিতে শাম্মির আরও নানা সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল:

কেসে খুব অবাক হয়ে যাওয়ার মত একটা বিষয় ছিল শাম্মির সামাজিক সম্পর্ক গুলোর উপর নজরদারী ও সিদ্ধান্ত আরোপের দাবি। সাথে না থেকেও লোকটা শাম্মিকে ডমিনেট করতে চায় মেয়ের অজুহাতে। কার সাথে কথা বলা যাবে না, কাকে বাসায় আসতে দেয়া যাবে না, কার বাসায় মেয়েকে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কেন বর্তমান চাকরিটা করা যাবে না সেসব ছিল দাবিতে। কি আশ্চর্য!

সবচেয়ে আবেগের আর অশ্রু সম্বরনের ছিল আত্মহত্যার চেষ্টার সময়টা মনে পড়ে যাওয়া; সেসময় জীবনকে অর্থহীন, ব্যর্থ, অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ার কথা।সহ্য করতে না পারা মারাত্মক মানসিক বেদনার কথা! মৃত্যুকেই বেছে নিয়ে নিজের ব্যর্থ জীবন শেষ করে দেয়ার চেষ্টার কথা!

সবচেয়ে অদ্ভূত লেগেছে ওকে দায়িত্বহীন হিসেবে দাবি করা। নিজের দায়িত্বে অবহেলা করা তো দূর শাম্মি কোনদিন সেটা ভাবেওনি। স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ি, সন্তান কারো প্রতি দায়িত্বহীনতা দেখিয়েছে বলে মনে করতে পারে না। স্বামী হিসেবে সেই লোকটা সেসব দেখেছে-জেনেছে তারপরও সেই অভিযোগ কিভাবে সম্ভব!

কি ভয়ানক কুৎসিত ছিল ওর বিরুদ্ধে এক বা একাধিক বয়ফ্রেন্ড থাকার অভিযোগ! শাম্মির সাথে মালিকের মত আচরণ করেছে, কত অন্যায় করেছে, শারীরিক-মানসিক অত্যাচার করেছে কিন্তু তারপরও কি লোকটা কোনদিন দেখেছে কোন পুরুষের প্রতি শাম্মির আগ্রহ! শাম্মিকে লোকটা খুব ভাল করেই চেনে-জানে। কিভাবে সম্ভব এরকম কুৎসিত কথা বলা!

মানসিক অস্হিতিশীলতার দাবিটিও ছিল ভয়ানক মিথ্যা অপবাদের এক পীড়াদায়ক কাহিনী। যেখানে প্রথমে ভূক্তভোগী শাম্মি এবং পরে দোষীও শাম্মি! ভূক্তভোগীর ভূমিকায় থেকে, বাধ্য হয়ে খুঁজে পেতে আর্থিক সংস্হানের ব্যবস্হা করা এবং পরে আবার অপরাধী হয়ে সেই চাকরি ত্যাগ করা।

নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার সময় ছিল সেদিন; যেদিন মি: রিশি ফোন করে বলেছিল

-মিস শাম্মি তোমার কি মনে হয় যে তোমার এক্স আমার কাছে কল করতে পারে।

-তার তো তোমার কাছে কোন দরকার নেই!

-হ্যা সেটাই। কয়েকদিন যাবত একটা অচেনা নম্বর থেকে কল পাচ্ছিলাম। আজ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল তোমার কেসটা ছেড়ে দিতে। শাসানোর মত করেই বলল। সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম। কি মনে হয় এটা কি তার পক্ষে সম্ভব?

বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শাম্মি বলেছিল

-হ্যা সম্ভব

-ওহ আই সি!

-মি: রিশি তুমি কি কেসটা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছ?

-ডোন্ট ওয়ারি। আমি কেস ছাড়ার কথা একেবারেই ভাবছি না। তুমি কোন চিন্তা কোরো না। কেসতো মাত্র শুরু করলাম। আর তোমার এক্সই যদি এটা করে থাকে তাহলে আমি সেটা সর্ট আউট করে নিতে পারব

শাম্মি সেদিন এরপর কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। শুধু সেদিনই নয়; এরপরও কয়েকদিন ওর আর কারো সাথে কথা বলতে ভাল লাগত না। মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে! কোন প্রমাণ না থাকলেও এটা আন্দাজ করা কঠিন না যে কাজটা খুশবুর বাবারই! আগের উকিলের অদ্ভূত আচরণে এরকম একটা সন্দেহ তো ছিলই। তাই বলে দ্বিতীয় উকিলের সাথেও!

গত একটা বছরে মেয়ের কাষ্টডি বিষয়ক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, জটিল-কঠিন সব অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভ্রমনে শাম্মির বিরুদ্ধে যেসব নানা অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে শুধুমাত্র আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি সত্যি। তবে মেয়ের জীবনে মৌলিক কোন চাহিদা অপূর্ণ রাখেনি শাম্মি। মেয়েকে বিলাসী জীবন দেয়া প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না! তাহলে কোনদিক থেকে শাম্মি এই কেসে হারতে পারে? রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুই বোঝার উপায় নেই।

শাম্মির বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ আরোপ করা হলেও খুশবুর বাবার বিরুদ্ধে শাম্মি তেমন কোন অভিযোগই করেনি। শুধু নিজের অভিযোগ খন্ডনেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। শুধু একটা কি দু’টো অভিযোগ করেছিল সেই প্রতিষ্ঠানটির প্রশ্নের উত্তরে। পরে জোগাড় করেছিল কিছু প্রমাণ। সেটা কি যথেষ্ট হবে কেস জেতার জন্য? শাম্মি যে অভিযোগ করেছিল সেটা খুশবুর বাবা অস্বীকার করেছিল। তারপর তথ্য প্রমাণ জোগাড় করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। তারা খুব বেশি কিছু তথ্য প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। শাম্মি জানত যে ওর অভিযোগ সত্য এবং সেজন্য তথ্য প্রমাণ জোগাড় করাও সম্ভব। তথ্য প্রমাণ যোগাড় করতে শেষে ওকেও তৎপর হতে হয়েছিল এক সময়।

গত তের মাসের কথা ভাবতে ভাবতে কোর্টে পৌছাল শাম্মি। কোর্টে পৌছে ও ভীষণ অবাক! ডক্টর জায়েন সেখানে উপস্হিত!

-হ্যালো ডক্টর! তুমি এখানে?

-আজ আমার ডে অফ শাম্মি। রিশির মুখে শুনলাম আজ ভার্ডিক্ট হবে। তাই এলাম তোমার পাশে থাকার জন্য। ভার্ডিক্টে যাই হোক। আমি তোমার পাশেই আছি।

-মি: রিশি তোমাকে তাহলে কেসের কথা সব সময় বলে!

-ও তো প্রায় ঘরেরই মানুষ! বলা হয়ে যায় আরকি!

-বুঝলাম না!

-রিশি আমার আর আমার হাসবেন্ডের ফ্রেন্ড।

শাম্মী খুব অবাক হলো না। মনে মনে সেরকমই একটা ধারণা ছিল।

-ও! এ ব্যাপারে আমার আর মি: রিশির মধ্যে কখনও কোন আলাপ হয়নি।

-হ্যা ভালই করেছ। সেটার দরকারও ছিল না। রিশি প্রফেশনালি ওর কাজ করছে আর তুমিও ওর সাথে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছ। সব কিছুই ঠিকঠাক। তবে এটা সত্যি যে রিশি আমাদের ফ্রেন্ড বলেই খুব সহজে তোমার কেসের জন্য রাজি করাতে পেরেছিলাম।

ডক্টর জায়েনের সাথে কথা বলতে একটু হাল্কা লাগছিল শাম্মির। সত্যিই এরকম মানুষও আছে চারপাশে যারা আরও দশজন ঠোকর দেয়া মানুষের তুলনায় একাই অনেক বড় সাপোর্ট দিতে পারে! তবে সেসময় এসব নিয়ে আর বেশি ভাবার অবকাশ ছিল না। কোর্ট শুরু হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।

শাম্মি ওর জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসল। আজকে চূড়ান্ত রায়ের দিন। আজ জাজ যা বলবে তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে খুশবুর বাবা-মা। খুশবুর বাবা-মা তাদের মেয়ের কাষ্টডির বিষয়ে কোনভাবেই একমত হতে পারছিল না। বাবার দাবি ছিল মেয়ের পুরো কাষ্টডি পাওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার তার। সে পুরো কাষ্টডিই চায়। নতুন উকিল শাম্মিকে একটা পরামর্শ দিয়েছিল খুশবুর বাবার কাছে উপস্থাপনের জন্য। পরামর্শটি ছিল

‘প্রতি সপ্তাহে উইকেন্ডে খুশবুর বাবা মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে। সোমবার বাবা মেয়েকে স্কুলে পৌছে দেবে এবং পরের শুক্রবার আবার স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে যাবে। তাছাড়া বিশেষ দিনগুলোতেও যেমন জন্মদিন, ইদের দিন বা অন্য কোন বিশেষ দিনে বাবা চাইলে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারবে’

শাম্মি এতে রাজি হতে পারেনি। কারণ সারা সপ্তাহে মা-মেয়ে দু’জনই খুব ব্যস্ত। শুধু উইকেন্ডেই তাদের সারা দিন একসাথে কথা বলার, অনুভূতি শেয়ার করার এবং এক সাথে সময় কাটানোর সুযোগ। সেই সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেলে মা-মেয়ের একসাথে সময় কাটানোর কোন সুযোগই থাকে না। বিশেষ গুলোতেও শাম্মি মেয়েকে কাছে রাখতে চায়। বাবার কাছে প্রতিটি বিশেষ দিনে মেয়ে চলে যাবে সেটা সম্ভব নয়। সম্মতিক্রমে কোন কোন বিশেষ দিনে বাবার কাছে যেতে পারে খুশবু।

শাম্মি বরং ওর উকিলকে দিয়ে খুশবুর বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল যে,

‘প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ উইকেন্ডে বাবার কাছে যেতে পারে খুশবু। বিশেষ দিনগুলোতে আলোচনা ও শর্তসাপেক্ষে, সম্মতিক্রমে বাবার কাছে মেয়ে যেতে পারে’

শাম্মির সেই প্রস্তাবে খুশবুর বাবা রাজি হয়নি। তার একটাই কথা; ‘পুরো অভিভাবকত্ব বা ফুল কাষ্টডি চাই’

 

(ক্রমশ)

 

২৯/১০/২০

 

 

 

 

 

 

 

১০

(শেষ পর্ব)

এরপর আর ব্যক্তিগত পর্যায়ের কোন আলোচনার অবকাশ ছিল না। এখন সমস্ত কাগজ-পত্র, তথ্য-প্রমান ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত ফয়সালা শোনাবে জাজ।

শাম্মি হাতে একটা পানির বোতল নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের বাবা একই রুমে তার উকিলের সাথে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বসে আছে। তাকে দেখে অনেকটা বোঝাই যাচ্ছে যে, শাম্মির পুরনো উকিলকে হাতিয়ে নিয়ে এবং নিজের আর্থিক শক্তির জোর খাটিয়ে সে এখন তৈরি হয়ে আছে শাম্মিকে শেষ আঘাতটা করার জন্য। লোকটা ভুল না সঠিক সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। শাম্মির কাছে যদিও মনে হচ্ছিল খুব লম্বা সময় তবুও এক সময় ওর অপেক্ষার পালা শেষ হলো।

রায় শুরু হলো; কয়েক পৃষ্ঠার রায় থেকে মূল বক্তব্য বের করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে,

‘খুশবুর বাবার ব্যক্তিগত জীবন বেশ উশৃঙ্খল। সে একজন এ্যলকহোলিক। তার ব্যক্তিগত জীবনধারা অনুযায়ী একজন শিশুর দায়িত্ব নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাবা তার আর্থিক সামর্থ্যের জোরে মেয়েকে উন্নত জীবন যাপনের ব্যবস্হা করে দিতে পারবে এটা হয়ত সত্য কিন্তু বাবার কাছে থাকলে খুশবু তার মাতৃস্নেহ থেকে এবং পিতৃস্নেহ দু’টো থেকেই বঞ্চিত হবে সে বিষয়ে কোর্ট নিশ্চিত। খুশবুর সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভালবাসা, যত্ন ও নিরাপত্তা। যা খুব দায়িত্বশীল কারো পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব। অতীতে বাবার দায়িত্বহীনতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া গেছে এবং এ্যালকহোলিক হওয়ার কারণে তাকে ভবিষ্যতেও একটি বাচ্চার দায়িত্ব দেয়ার মত নির্ভরশীল মনে করা ঠিক নয়। তাছাড়াও ব্যক্তিগত ও পেশাগত কারণে বছরের অনেকটা সময় তিনি দেশের বাইরে কাটান। সেকারণেও তার পক্ষে একজন শিশুর সার্বক্ষণিক দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়।

অপরদিকে আর্থিক সামর্থ্য কম থাকা সত্বেও খুশবুর মা বরাবর যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে এসেছে বিধায় একটি শিশুর পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য তার উপর নির্ভর করা সম্ভব। সকল দিক বিবেচনা পূর্বক, খুশবুর অভিভাবকত্ব দেয়া হলো তার মাকে। মায়ের অনুমতি সাপেক্ষে বাবা তার মেয়ের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে পারবে তবে বাবার সাথে একই বাড়িতে রাত্রিযাপন করবে না’

ভার্ডিক্ট শেষ হওয়ার পর, শাম্মি তাকাল ডক্টর জায়েন এর দিকে। দু’জনই দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসল। শাম্মির হাসিতে ছিল কৃতজ্ঞতা আর ডক্টর জায়েন এর মুখে ছিল আপনত্বের ছোয়া। যাদের জন্য কাছের মানুষরা সাপোর্টিভ হতে পারে না তাদের জন্য বোধহয় ডক্টর জায়েনের মত মানুষরাই পাশে এসে দাঁড়ায়। তাছাড়াও অপ্রত্যাশিতভাবেও কারো সাহায্য পাওয়া যেতে পারে যেমনটা শাম্মি ওর এক সহকর্মীর কাছে পেয়েছিল!

মূলত অ্যালকোহলিক হওয়ার জন্যই খুশবুর বাবা মেয়ের অভিভাবকত্ব পেল না। রায় হওয়ার পর তার মুখের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছা করেনি শাম্মির। তবে আন্দাজ করা যায়, লোকটা চিন্তাও করতে পারেনি যে তার মদ্যপানের বিষয়টা কখনও এভাবে সামনে আসতে পারে। শাম্মির দিক থেকে অভিযোগটা আসার পর তিনি তা অস্বীকারও করেছেন। তেমন কোন তথ্য প্রমাণও ছিল না। শাম্মি যে এতদূর যেতে পারে তা তার কল্পনায় ছিল না! শাম্মিকে স্ত্রী হিসেবে বরাবর তুচ্ছ করে দেখে হয়ত তৃপ্ত হতে পেরেছেন কিন্তু এবার বড় ভুল করেছেন একজন মাকেও তুচ্ছ করে দেখে! এবার সেই তৃপ্তি আর হলো না! খুব ধূর্ত, স্মার্ট, সফল মানুষদের হিসেব নিকেশেও অনেক সময় ভুল থাকে!

তিনি বুঝতেই পারেননি একজন মায়ের মরিয়া হয়ে ওঠার শক্তির সাথে পৃথিবীর অন্য শক্তিগুলো সময় সময় ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র হয়ে যায়। মায়ের চেষ্টার সাথে যোগ হয় আরও কিছু অপ্রত্যাশিত সহযোগীতা। ভাগ্য এবং বিধাতাও সুপ্রসন্ন হন মায়ের চেষ্টা আর চাওয়ার কাছে।

সেই দিনগুলোর কথা শুধু শাম্মিই জানে যে কিভাবে নানারকম চেষ্টায় খুশবুর বাবার সম্পর্কে নানারকম তথ্য উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পেরেছিল। সত্য কিন্তু লুকায়িত সত্য। লোকটার এই দূর্বল দিকটা খুব কম মানুষই জানে। সৌভাগ্যক্রমে সেই কম মানুষগুলোর একজনই শাম্মির এক সহকর্মী। শাম্মির সহকর্মী হলেও সে পার্ট টাইম কাজ করে একটি নাইট ক্লাব কাম বারে। যেখানে খুশবুর বাবার মত প্রতিষ্ঠিত লোকেরা যাতায়াত করে। যদিও কাষ্টমারদের সকল ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখারই নিয়ম, শাম্মির সহকর্মী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এক মাকে সাহায্য করার। সেই সহকর্মী শাম্মিকে সাহায্য করেছিল তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে। দিন, তারিখ এবং জরিমানার প্রমাণ সহ কাগজ গুলোই শাম্মির জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে যায় একসময়।

হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোয়া পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শাম্মি। ডক্টর জায়েন বলে উঠল,

-কনগ্রাচুলেশনস শাম্মি! তুমি তো মাতৃশক্তি দেখিয়ে দিলে! যা হওয়া উচিত তাই হয়েছে। খুশিতো এখন?

-অনেক অনেক খুশি ডক্টর।

-এ সপ্তাহেই একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমার চেম্বারে এস। আমি তোমার হেলথ কন্ডিশন আবার রিভিউ করব। এবার মনে হয় তোমার কিছু ঔষধ কমিয়ে দেয়া যাবে।

-ডক্টর জায়েন তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই। তুমি আমাকে সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ করলে।

-ওভাবে বলো না; আমি তোমার জিপি। তোমার হেলথের দিকে খেয়াল রাখা আমার কাজেরই একটা অংশ। তোমার স্বাস্হ্য হঠাৎ করে বেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বলেই তোমাকে জিজ্ঞেস করা। আর তোমারও এমন একটা হেল্প দরকার ছিল যেটা আমি করতে পারি। সব মিলে আমি নিজেও খুব খুশি।

ডক্টর জায়েন এবং মি: রিশির সাথে কথা শেষ করে শাম্মি রওনা হলো স্কুলের দিকে। স্কুলে আজ অনেকদিন পর বিশাল হাসি নিয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করবে, মেয়েকে নিয়ে ফিরবে ওদের ছোট্ট সুখের নীড়ে। যাওয়ার পথে মেয়ের পছন্দের কোন খাবারও কিনে নিয়ে যাবে কোন টেক ওয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে।

আরও একজনের সাথে কথা বলা বাকি ছিল; ওর সেই সহকর্মী। ওকে ফোন দিল,

-কেসের রায়ে জিতে গেছি ডানিয়েলা

-ওয়াও! কনগ্রাচুলেশলস শাম্মি। খুশবুর বাবা কোন রাইটস পাচ্ছে এই ভার্ডিক্টে?

-হ্যা চাইলে নিতে পারবে তবে কয়েক ঘন্টা বা সারাদিনের জন্য

-তুমি তো বলছিলে খুশবু ওর বাবার বিষয়ে পজিটিভ না

-ওয়েল ডানিয়েলা, খুশবুর যে বয়স সে বয়সে মন বা পছন্দ-অপছন্দ স্হিতিশীল না। বাবার সাথে বহুদিন দেখা সাক্ষাত বা এ্যাটাচমেন্ট নেই বলে হয়ত পছন্দ করছে না। ধীরে ধীরে বাবাকে পছন্দ করতেও পারে। ওর বাবাকে ওর বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। না পারলে সেটা তার সমস্যা।

-তবে ফোর্স কোরো না

-কখনই ফোর্স করব না। বাবা বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে খুশবুর সাথে অবশ্যই কথা বলে নিব। ওর বাবা যদি মেয়ের নিরপত্তার বিষয়ে দায়িত্বশীল হয় তাহলেই শুধু মেয়ের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাবে।

-পারফেক্ট

কয়েক ঘন্টা আগের বাস জার্নি আর এখনকার বাস জার্নিটার মধ্যে বিশাল পার্থক্য! বুকের উপর চাপা পড়ে থাকা একটা ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল শাম্মির ভিতর থেকে। সেই মুহূর্ত থেকে ও যেন পৃথিবীটাকে আবার নতুন করে দেখতে শুরু করল। বৃষ্টি শেষ হয়ে খুব সুন্দর মোলায়েম একটা রোদ উঠেছে, দিনটি আলো ঝলমলে হয়ে উঠেছে। জানালা দিয়ে আলোর ছটা এসে পড়ছে কোর্টরুমের সামনে; ঠিকযেমনটা পড়েছিল খুশবুর জন্মের পর। সেই সকালটাতে মোলায়েম সূর্যের আলো পড়ছিল বেবি কটে রাখা ছোট্ট খুশবুর মুখে। শাম্মির জন্য সেদিনের মত আজও খুশবুকে পাওয়ার দিন,জীবন সুন্দর হওয়ার দিন!

 

(সমাপ্ত)

 

৩০/১০/২০

 

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..