1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন

আজ শহীদ ‘তাগড়া’র ঊনপঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকী….

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০
  • ২৬৮ বার
🖐 ছবিটি শহীদ তাগড়া’র নয়। নাম না জানা একজন মুক্তিযোদ্ধার। তাঁরা সৈয়দ বা চৌধুরী খ্যাত আয়েশি জীবনের প্রতিনিধি নন। তবে, তাঁরাই বাংলাদেশ, একাত্তরে এবং আজও 🖐
সেদিন বুধবার ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ সাল। দুই থেকে তিনদিন আগেই সুন্দরবন এলাকা থেকে ১৫/১৬ টি মুক্তিযোদ্ধা দল ভিন্ন ভিন্ন পথে ধরে বরিশাল অঞ্চলে পাকিস্তানী হার্মাদ বাহিনীকে পরাভূত করতে যাত্রা করেছে। তেমনই একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সাঈদ। দলে ছিলেন ৫১ জন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মাঝে ছিলেন আকবর, রণজু, কাওসার, মানিক, হিরণ, ধীরেণ, কামাল, সঞ্জয়, রইস, মান্নান, লাল এবং আমাদের আলোচিত ‘তাগড়া’।
তাগড়া নামে পরিচিত হওয়া এই জনযোদ্ধার প্রকৃত নাম তিনি নিজেও ভুলে গিয়েছিলেন। যৌবনের শুরু থেকেই চর দখলের লড়াইতে নেতৃত্ব দিয়ে আসা ছাব্বিশ বছর বয়সী তাগড়া উপকূলের চরাঞ্চলের বাসিন্দা বলেই জানা যায়। জোতদারদের কাছে তাঁর কদর ছিল ভিন্নরকম। একাত্তরে তাগড়ার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট বদলে গেল সহসাই। জোতদারের হয়ে চর দখলের বদলে সে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল জন্মভূমির বুকে নেমে আসা হায়েনা দমনে।
৪৯ বছর আগের আজকের দিনে, কম্যান্ডার সাঈদের দলটি সাতক্ষীরার দেবহাটা-ভেটখালি দিয়ে শিবসা, পশুর, বলেশ্বর নদ অতিক্রম করে পাটগাতির বিল এলাকা, কোটালিপাড়া পূর্বে রেখে কোদালধোয়া নামক স্থানে পৌঁছেছে, ঠিক সে মুহূর্তেই অকস্মাৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দলের মুখোমুখি হন মুক্তিযোদ্ধারা।
💚” তাগড়া, বুলেটে ঝাঝরা হতে হতে বেঁচে উঠেছে অমরত্বের পুণর্জন্মে”💚
অপ্রস্তুতভাবে সামনা সামনি দেখা হওয়া পাকিস্তানী সেনা এবং কম্যান্ডার সাঈদের দলের মাঝে দুরত্ব মাত্র ২০০/২৫০ গজ। এখান থেকে নিরাপদে কোনো পক্ষেরই যুদ্ধ ছাড়া পশ্চাদপসরণ করা সম্ভব না। দু’পক্ষই কেবল মাটিতে শুয়ে অবস্থান নিয়ে আছে।
অপেক্ষার অবসান টানলো শত্রুর এক বিশালদেহী সৈনিক। এসএমজি’র ব্যারেল ডান হাতে এবং কাঠের স্টক বাট মাথার উপর উঁচু করে বাম হাতে ধরে দাঁডিয়ে গেল। কমান্ডার সাঈদের প্রতিরক্ষা থেকে অবাক যোদ্ধারা কেউই গুলি করলো না। ন’মাসের ক্লান্তিকর যুদ্ধ বোধকরি একে বিরক্তির চুড়ান্ত সীমান্ত পৌঁছে দিয়েছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো,’হ্যায় কোয়ি মা কি লাল? মা কি দুধ পিয়া হো তো বেগায়ার হাতিয়ারকে সামনে আ যাও।’ (আছো কোনো মায়ের ছেলে? মা’র দুধ যদি পান করে থাকো তাহলে বিনা অস্ত্রে সামনে এগিয়ে আসো)।
কথা শেষ করে সবার সামনে এসএমজিটা ১০/১৫ গজ দুরে ডান দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর একটানে ইউনিফর্ম খুলে ফেললো। মুক্তিযোদ্ধারা হতবাক হয়ে দেখছে শত্রু সৈনিকের কান্ড। এবার সে এক পা দু’পা করে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে এগুতে থাকলো।
লুঙ্গিপরা উদাম দেহের ভোলার চর দখলের লড়াকু বিশালদেহী তাগড়া আর সইতে পারলো না। তার দেশে হানাদার শত্রু দ্বন্দযুদ্ধ আহ্বান করে বিনা মোকাবেলায় চলে যাবে? হঠাৎ করে দাঁডিয়ে লুঙ্গির কোচ গুঁজতে গুঁজতে কাউকে উদ্দেশ্য না করেই বলতে লাগলো,’মরদো মনে হরছে কি? বাঙালিগো মধ্যে কি কেউ নাই যে ওর লগে বোঝতে পারে? মেবাই তাগড়ারে আর ধইরা রাখতে পারলেন না। হালার পো হালায় বে-জাগায় হাত দেছে’।
‘জয় বাংলা’ বলে তাগড়া শত্রু সৈন্যটির দিকে এগুতে লাগলো। সবাই নির্বাক,বোধহয় শত্রুও। দু’পক্ষেরই যেন এ দ্বন্দযুদ্ধ দেখবার মৌন সমর্থন।
দু’জনই এগুতে এগুতে সামনা-সামনি হলো। আধুনিক যুদ্ধে এক মধ্যযুগীয় মল্লযুদ্ধের দৃশ্যপট। কয়েক সেকেন্ড দু’জনই মুখোমুখি দাঁডিয়ে রইলো। এবার তাগড়া তার ডান হাতের খোলা আঙ্গুলের সজোর থাবা বসিয়ে দিল শত্রুর বাম বুকের উপর। থাবার প্রচন্ড ভরবেগে শত্রুর সৈনিক পিছিয়ে গিয়ে পড়তে পড়তেও দু’পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পারলো।
তাগড়াও পিছিয়ে গেল কয়েক পা। এসময় দুরত্ব বেড়ে হলো ৪/৫ গজ। দূরত্ব বেড়ে যাবার সাথে সাথে পাকিস্তানী সেনাদের অবস্থান থেকে স্বযংক্রীয় অস্ত্রের কয়েকটি বার্স্ট এসে তাগড়াকে ঝাঁঝরা করে দেয়। তিনি পিঠের উপর ভর করে আর একটুও বসতে পারেননি। একই সাথে পাকিস্তানী সৈনিকটি লাফিয়ে চলে যায় তার প্রতিরক্ষা অবস্থানে।
এহেন হঠকারীতা দেখে কম্যান্ডার সাঈদের দলের সবার তখন মাথায় রক্ত উঠে গেছে। কম্যান্ডার সাঈদ তাঁর সিগন্যাল পিস্তল থেকে পরপর দু’টি লাল রাউন্ড আকাশে ছুঁড়লেন। মুহুর্তেই নিরস্ত্র এলাকাবাসীসহ সম্মুখ আক্রমনে দখল করা হলো পাকিস্তানীদের অবস্থান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দ্বন্দযুদ্ধ আহবানকারী সৈনিকটি মরে পড়ে আছে শরীরে গুলির আঘাত নিয়ে।
একশ’রও বেশি সৈন্যের মধ্যে পাঁচজনকে মাত্র জীবিত পাওয়া গেল,আর সবাই মৃত। যুদ্ধবন্দী সৈন্যরা জানালো যে,তাগড়ার ওপর গুলি করার পর সৈনিকটি ফিরে এসে মৃত একজনের একটি এসএমজি নিয়ে নিজেদের সব সৈনিকদের গুলি করে হত্যা করেছে আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছে কাপুরুষের মতো তাগড়াকে গুলি করার জন্য।
তাগড়া, চর দখল করতে গিয়ে মরেননি। তিনি শহীদ হয়েছিলেন ‘অযোদ্ধা’ আর ‘খবর্কায়’ বাঙালি’র অপবাদ ঘোচাতে। আর বুলেটে ঝাঁঝরা হতে হতে বেঁচে উঠেছে অমরত্বের পুণর্জন্মে। সেই সঙ্গে ছিনিয়ে এনেছে রণাঙ্গণে জয়-পরাজয়ের বাইরের এক মহত্তম বিজয়, সাহসের অক্ষরে লেখা বাঙালির আত্মমর্যাদা।
👉 তাগড়া, আজ ১৭ নভেম্বর আপনার ঊনপঞ্চাশতম মৃত্যু দিবস, বাংলাদেশে পালিত হবার প্রয়োজন ও সম্ভাবনা কোনোটাই নেই। যে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে আপনি ছিলেন অবারিত মাঠ থেকে উঠে আসা বীর। আমাদের মধ্যে যারা মানুষ তাদের চোখ এ মুহুর্তে অবশ্যই আর্দ্র। আপনাকে স্মরণ করতে পেরে আমরা গর্বিত। এই বাংলা জননী আপনার মতো বীর গর্ভে ধারণ করেছিলো।
★★ 👉 লেখাটি অতি সংক্ষেপিত । মূল লেখাটি আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধেয় মেজর (অব:) মরহুম কামরুল হাসান ভুঁইয়া রচিত ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’ নামের অসাধারণ বইতে।
★★★ 👉 গেরিলা ১৯৭১ পরিবার, শহীদ তাগড়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে, স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গর্ব ভ’রে চিৎকার করে বলি ‘আমি শহীদ তাগড়ার উত্তরসূরি, এই দেশ শহীদ তাগড়াদের।
ভালো থাকবেন ওপারে, পরম করুনাময় আপনাকে সম্মানের সাথে চিরশান্তির স্থানে রেখেছেন জানি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..