1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৩:৫০ পূর্বাহ্ন

সংসার সমাচার > পরাণের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে — লুৎফর রহমান রিটন

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১
  • ২১২ বার
এলিফ্যান্ট রোড কাঁটাবনের সোনালি ব্যাংকের ঢালে একটা শান্তস্নিগ্ধ পুরনো ধাঁচের তিনতলা বাড়িতে তখন ভাড়া থাকি। সাল ১৯৯৬। আমার ‘ছোটদের কাগজ’-এর অফিস তখন শাহবাগের আজিজ মার্কেটের তৃতীয় তলায়। ছা-পোষা লেখক-সাংবাদিকের জীবন। নানা টানাপড়েন। এইদিকে টেনে ধরলে ওইদিকের ফাঁক-ফোঁকর বেরিয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত্বের নিত্য উপহার–স্ত্রীর সঙ্গে জঞ্ঝাট। সংসারের হ্যাপা সামাল দিতে দিতে প্রায় হ্যাপাটাইটিসে আক্রান্ত হবার উপক্রম শার্লির। মাঝে মধ্যেই ফোঁস করে ফনা তুলে তেড়ে আসে শান্তশিষ্ট নরম স্বভাবের শার্লি। একদিন সকাল সকালই কী নিয়ে যেনো বেঁধে গেলো তুলকালাম। আমার সঙ্গে সংসার করতে এসে জীবনে কী রকম ভুল সে করেছে তার একটা সারসংক্ষেপ প্রথমেই পেশ করলো সে। এই সময়টায় ছোট্ট নদী খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবার দিকেই ওর মৌন সমর্থন থাকে। যদিও সেটা গোপন করতে সচেষ্ট থাকে সে প্রাণপণে। সেদিন এইরকম একটা পরিস্থিতিতে শার্লির সারসংক্ষেপ পেশ করার সময় মুখ ফস্কে কী যেনো একটা বেফাঁস কথা বলে ফেললাম। আর যায় কোথায়! রাজনীতিবিদদের মতো শার্লি প্রায় সাতচল্লিশ সাল থেকে আরম্ভ করলো–আমার সঙ্গে সংসার করতে এসে কবে কখন কোথায় কীভাবে সে হেনস্থা হয়েছে তার নিখুঁত একটা বর্ণণা পেশ করতে থাকলো একের পর এক! আশ্চর্য, সাম্প্রতিককালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা ভুলে গেলেও আমার কৃত অপরাধসমূহ শার্লির মনে থাকে দাঁড়ি কমাসহ! ওই একটি ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি তাঁর ঈর্ষণীয় রকমের উজ্জ্বল। একটা কিছুও ভুল করে ভুলে যায় না সে মুহূর্তের জন্যেও! তো সেদিন দীর্ঘ তালিকার ফিরিস্তি সমাপনান্তে কী যে হলো শার্লির, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে–তোর জন্যে খাঁটতে খাঁটতে বুড়ি হয়ে গেলাম আমি…।
আর কথা না বাড়িয়ে মানে মানে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে তৈরি হয়ে গেলাম। শার্লি তখন বেড রুমে গিয়ে নিঃশব্দে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে। নদীকে আদর করে অতি দ্রুত প্রস্থান করছি যখন, ফিঁসফিঁস করে নদী শুধু জানতে চাইলো–এখন কী হবে বাবা?
আমি বললাম–চিন্তা করিস না মামনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি অফিস থেকে এসে সব ঠিক করে ফেলবো দেখিস।
সারাদিনের কর্মব্যস্ত ধকল কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে এলিফ্যান্ট রোডের ক্যাসেটের দোকান থেকে একটা গানের ক্যাসেট কিনে নিলাম। তারপর সেটা জিন্সের ব্যাকপকেটে ঢুকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে ডোর বেল বাজালাম। সমবয়েসী কাজের মেয়েটার সঙ্গে এসে দরোজা খুললো নদী। জিজ্ঞেস করলাম পরিস্থিতির কতোটা উন্নতি বা অবনতি ঘটেছে।
অতিসংক্ষেপে নদী ওয়েদার ফোরকাস্ট করলো। আমি অতি দ্রুত পকেট থেকে ক্যাসেটটা বের করে আমাদের ক্যাসেট প্লেয়ারে চালান করে দিলাম। তারপর নদীকে বললাম–যা মামনি তোর মাকে গিয়ে বল আমি ডাকছি। খুব জরুরি কথা আছে। নদীও কিছু একটা মজার ঘটনা ঘটবে বুঝতে পেরে লাফিয়ে লাফিয়ে মাকে ডেকে আনতে গেলো।
নিতান্ত অনিচ্ছায় নদীর সঙ্গে এলো শার্লি। নদী একটা হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে মাকে। ড্রয়িং রুমে এসে খুব গম্বীর মুখে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে শার্লি। আমি নদীকে ইশারায় আমার কাছে চলে আসতে বললাম। নদী আমার কাছে আসিবা মাত্র আমি ওকে বললাম ক্যাসেট প্লেয়ারের প্লে বাটনে পুশ করতে। নদী ঠেঁসে ধরলো প্লে বাটন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ফুল ভল্যুমে গেয়ে উঠলো কাঙালিনী সুফিয়া–পরাণের বান্ধব রে বান্ধব, বুড়ি হইলাম তোর কারণে…।
গোমড়ামুখো শার্লি হেসে ফেললো ফিক করে। তা দেখে আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠলো নদী। একঝাঁক আনন্দ আমাদের ঘরটায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সকালের অভিমানের ভয়াবহ জমাট বরফ গলে গিয়ে আশ্চর্য এক ঝর্ণার অপরূপ সিম্ফনি তৈরি হলো। আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের ছোট্ট সংসারটাতে নতুন একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরটাকে বর্ণিল আলোয় রাঙিয়ে দিলো ওয়াহিদুর রহমানের কথায় আনিসুর রহমান তনুর সুরে নির্মিত কাঙ্গালিনী সুফিয়ার দুর্ধর্ষ সেই গানটা–পরাণের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে…
রচনাকাল/ ৩১ অক্টোবর ২০১৪
[ক্যাপশন/ ১৯৯৩-৯৪ সালে টাঙ্গাইল শফিপুর পার্কে শার্লি-নদী-রিটন। আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ির ঘটনার কাছাকাছি সময়ের ছবি এটা। শার্লির বুড়ি হওয়ার নমুনা!]
May be an image of 3 people, people standing, tree and outdoors

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..