1. press.sumon@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০১:১৮ পূর্বাহ্ন

বাংলার ভূ-স্বর্গ পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণ কাহিনী ( ভ্রমণ বিলাস – ২) রাঙামাটি ট্যুর… সময় কালঃ ১৮ মার্চ থেকে ২০ মার্চ ২০১৯ ইং (নতুন ধারায় লিখার চেষ্টা প্রমিত ও আঞ্চলিকতার সংমিশ্রণে) পর্ব – ১ ও পর্ব – ২ – – – কোহিনূর রহমান

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ৩১১ বার
ছেলে(অর্নী) বল্লো আম্মু চল এবার তোমাকে রাঙামাটি নিয়ে যাবো। প্রথমে যাবো আমরা কাপ্তাই। এই কাপ্তাই হ্রদটা দেখার মতো আম্মু!অনেক মজা পাইবা। সবাইকে বলা হৈলো। এবার কেউ রাজী না। অর্নীর কথা আমরাই যখন যাবো তাহলে বড় গাড়ির দরকার নেই। তাছাড়া এটা কাছেও। দিনে দিনে আসা যায়। আমি প্রাইভেট কার নিয়ে যাবো। নিজেই ড্রাইভ করবো। সাহেব,আমি, বড় ছেলে, বৌমা তুলি, ছোট ছেলে তকী, কাজের মেয়ে সুমি সাথে এবার যোগ হলো আমাদের পরিবারের আল্লাহর দান নতুন প্রজন্ম দাদা তান। বয়স দেড় বছর।
এই কাপ্তাই হ্রদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহর থাইকা প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পূর্বে। ২৩ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা সুনসান ছোট করে ক্যাম্প হ্রদের কোল ঘেষে। এখানে অফিসার্স মেসে দু’টো রুম বুকিং নেওয়া হলো। ১৮ মার্চ ২০১৮ ইং বৃহস্পতিবার বি এম এ থাইকা লিঙ্ক রোডে কাপ্তাই আসি।প্রথমেই আমরা বানৌজা শহিদ মুয়াজ্জেম এ যাই। পাহাড় কেটে তৈরী দারুণ মনোরম একটা ঘাঁটি। পাশে দিয়ে বয়ে চলছে কাপ্তাই হ্রদ। নানাবিধ ফুল ফলে ঘেরা এই ঘাঁটি। ড্রাগন ফলের বাহার এখানে। ৩০ মিনিটের মতো ঘুরে দেইখা একটা লিঙ্ক রোডে অফিসার্স মেসে আসি। এই রোডটাও বেশ মনোহর। পথে পথে আদিবাসীদের টং দোকানে নানাবিধ পাহাড়ি ফলের পসরা।ছেলে বলছে,আসো গাড়ি থামিয়ে আনারস খাই।দোকানী আনারস কাটছে। ততন (তকী) কয়, আম্মু পিয়ারা খামু! আমি ঝুলানো পিয়ারা থাইকা একটা ছিঁড়ে ওর হাতে দেই।সবাই আনারস খাইলাম।বেশ মজাদার। সাথে বাংলা কলা,পেপে, বেল কেনা হৈলো। টাকা হিসেব কৈরা যখন সাথে পিয়ারাটার দাম দিচ্ছি লোকটা বলে উঠলো,
—তাক উথার তাকা দেয়া নাগবে না গুরু বাচ্চা খেয়েচে…!
আমি মানছি না। এরপরও নিলো না। সত্যিই এই গরীব আদিবাসীর মানবতা বোধ দেইখা আমি/ আমরা অবাক হৈছি।চলছে ফটোসেশান। তারপর গাড়ি করে সোজা অফিসার্স মেসে। রুমের সামনেই একটা টগর গাছ। ফুলে ভর্তি। আমি একটু হাত বুলালাম। দুইডা রুমের কি বিদঘুটে আদিবাসীদের ভাষায় নাম। উচ্চারণে দাঁত ভাঙ্গে। প্রায় তিন বছর আগের কথা। এখন মনে নেই।তাই লিখতে পারলাম না। তখন আমি নয়া লেখিকা। তাই হয়তো লিপিবদ্ধ মাথায় আসেনি। ছেলের বাল্য বন্ধুর বাসা এখানে। লেখাপড়াও একসাথে। সেও আর্মিতে। ছেলের এক টার্ম জুনিয়র।নাম লিঙ্কন। ও আমাদের ময়মনসিংহের ছেলে। তার বাসায় সন্ধ্যার চা নাস্তার দাওয়াত। মেস ওয়াইটার জিগ্যেস করছে স্যার রাতের ডিনারে কি মেন্যু? ছেলে বলছে, হ্রদের টাটকা মাছ খাবো। যেতে বেশিক্ষণ লাগেনি। তাই কষ্টও হয়নি। আমরা রুম থাইকা বের হয়ে হ্রদের পাড় ধরে হাঁটছি। সাথে একজন সৈনিক। প্রকৃতির কি অপরূপ নিদর্শন এই হ্রদ। দেখে চোখ জুড়ায়। আমরা প্রথমে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাই। এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ছেলের পরিচয়ে আর বাধা রৈলো না। বাঁধের উপরে সেতুটিতে দাঁড়িয়ে সব অবলোকন করছি। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত। ছেলেও আমাকে দেখিয়ে বোঝাচ্ছে। এক পাশে পানির নহর। আর এক পাশ কি শুকনা। এইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর সৈনিক আইসে বল্লো, স্যার আসেন? জল কিন্নরী ঘাটে আসছে। প্রায় দুই থাইকা আড়াই ঘন্টা আমরা ঘুরলাম। কি স্বচ্ছ জল টল টল করছে। কালারটা নীলচে সবুজাভ। আকাশও নীল। তার নীচেই ধুসর মেঘ। দূরের গাছ পালা যেন বুকে মেঘ লেপ্টে লৈয়া আবছা সবুজ হয়ে আছে। কাছের গাছগুলো গাঢ় সবুজ। মাঝে মাঝে দ্বীপ। এসব দ্বীপে আবার আকর্ষণীয় রিসোর্ট। রেস্টুরেন্ট। আদিবাসীদের ঘর বাড়ি।কতোভাবে বাঁক দিছে এই হ্রদ। স্বচ্ছ জলে ডুবা ভাসার খেলায় মত্তো পানকৌড়ি আর বালিহাঁস। এতোক্ষণ জলের উপর থাইকাও যেন তৃপ্তি হৈছে না। আশা যেন থাইকাই যাচ্ছে এই স্বর্গীয় জল রানীকে দেখতে। মনে মনে ভাবছি বাংলার প্রকৃতি কন্যার উছলে পড়া এতো রূপ রাইখা মানুষ ক্যান বিদেশ ঘুরে! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আইলো। এবার নামতেই হৈবে। পরে লিঙ্কনের বাসায় যেয়ে চা নাস্তা করি।ঘুরে ঘুরে পুরো ক্যাম্পটা দেখি। রাত ৯ টা নাগাদ মেসে ফিরি। ডিনারে টেবিলে যেয়ে দেখি তিন আইটেমের মাছ রান্না সাথে চিকেন, সবজি, ডাল। সত্যিই মাছ গুলো বেশ সুস্বাদু। সবাই খুব মজা করে খাই। রান্নাটাও অসম ছিলো।পরের দিন জার্নির জন্য রাত্র অধিক না করে বিছনায় গা এলাই…
ঘুম থেকে জাইগা ফ্রেস হৈয়া হাঁটতে যাই। রাস্তার পাশে পাহাড়ি গাছ গুলিতে ছোট বড় হিসেব ছাড়া বানর ঝুলছে। বিশেষ করে পাহাড়ের পাদদেশের আম গাছে মাত্রাধিক্য। কাঠা বিড়ালিও লাফাচ্ছে। দু’চার ‘পাঁচটা ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীও দেখেছি। ওদের চিনি না। এখানকার কোয়ার্টার গুলো খুব একটা সুন্দর না। গেটের ফাঁক দিয়ে বানর ঢুকছে বাহির হৈছে। আমি কতোক্ষণ হ্রদের রাস্তার পাশে দাঁড়াইয়া গাছে ঝুলানো বানর শিশুর উল্লোস্ফন দেখি। হুশ শব্দ করতেই আমার দিকে কটমটিয়ে তাকায়। বিশেষ কথা হৈলো হাতে মোবাইল ছিলো না। তাই ফ্রেম বন্দী কৈরতে পারিনি। ভয়ের লেশমাত্র নেই। তারপর হ্রদের কিনার ঘেষে হাঁটি। এই রাস্তাটা পানি বাঁধের। তাই শক্ত পোক্ত ও চওড়া। দেখতেও নান্দনিক। ভোর সকাল। কি শান্ত,সৌম্য রূপ হ্রদের। কি মধুর নীরবতা ঝকঝকে পরিষ্কার নিলাভো জলের। উপরে পাহাড়ি সবুজ। তারও শান্ত মৌন রূপ। বন থাইকা ভেসে আইতাছে হাজারো পাখির মিষ্টি কলতান। সুরে সুরে বলছে যেন ভোর হয়েছে জাগো এবার! ফুরফুরে পবিত্র বাতাস গায়ে লাইগছে। এইভাবে নীরবে প্রকৃতিকে খুব কাছ থাইকা দেখলাম ঘন্টা খানেক। আমার মনে হয় কোন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে গেলে রাত্রি যাপনের দরকার। তা না হৈলে প্রকৃতি মায়ের সব রূপ চোখে পড়ে না।
এই কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ।কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়।এরফলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ একর ফসলি জমি ডুইবা যায়। এবং এই হ্রদের সৃষ্টি হয়।মূল হ্রদের আয়তন প্রায় ১,৭২২ বর্গ কিলোমিটার। কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যান মেড হ্রদ…।
——–চলবে—–
পর্ব—২
১৯ মার্চ ২০১৯ বৃহস্পতিবার। আমরা রেডি রাঙামাটির জন্য। লিঙ্কন এসে বলছে, অর্নী যাস না। বাসায় ফিরে যা। কাল সন্ধ্যার পর রাঙামাটিতে শান্তি বাহিনীর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তিনজন মারা যায়। শহর খুব উত্তাল। অবশ্য রাতে টিভির খবরে আমরাও শুনেছি কিন্তু পাত্তা দেই নি। সাহেব এমনিতেও একটু ভয় কাতুরে। সে বেশ ভয় পাচ্ছে। ছেলে বলছে, আমার তাতে কি আমি লিঙ্ক রোড দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঢুকে যাবো। লিঙ্কনের কথা, না তুই তাহলে শহরের সোজা পথে যা। ঝামেলার দরকার কি? একপাশে পাহাড় আরেক পাশে হ্রদ। আমি এতোদিন আছি জানিস একদিনও এ পথ মাড়াইনি। ছেলে শুনে হেসে হেসে বলছে, শালা তুই তো একটা ভীতুর ডিম। আবার আর্মিতে আছিস! এই পথের সৌন্দর্যই দেখলি না তবে এতো দিন কি দেখলি! তোর তো কাপ্তাই থাকাই বৃথা। আমি যাবো রাঙামাটি। তবে এই পথেয় ইনশাআল্লাহ।
রাঙামাটি কাপ্তাই সংযোগ সড়কটি অনেক আঁকা বাঁকা উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ। এই সড়কের দুই পাশের মনেরম দৃশ্য পর্যটকদের নিকট খুবই উপভোগ্য।অনন্য বৈশিষ্ট্যের এমন সড়ক এদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। সড়কের একদিকে সবুজ পাহাড়ের সারি অন্যদিকে নীলজলের হ্রদ। পাহাড়ের উপরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হ্রদ আর পাহাড় দেখা পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।
কাপ্তাই থেকে রাঙামাটির দূরত্ব এই নতুন সড়কে ২৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার। চলছে গাড়ি। তবে খুব একটা জোরে না। দেখার সুবিধার্থে। এসি বন্ধ জানালা খোলা। এমনিতেও পাহাড়ি এলাকায় এসি বন্ধ রাখতে হয়। আমরা চিৎকার করছি ওয়াও! এত্তো সুন্দর পথ হয়! একপাশে পাহাড়ের ঘন সবুজ অন্য পাশে হ্রদের নীলজল। উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ বেয়ে চলছে গাড়ি। পাহাড়ের আগায় মাঝে মধ্যে বৌদ্ধ মঠ। গাড়ি উপরে উঠতেই সাহেব ভয় পায়। বলে নাচানাচি রেখে আল্লাহ আল্লাহ কর। বলছি, ক্যান তুমি ভয় পাচ্ছো? দু’চোখ ভরে সুন্দর দেখো আর আল্লাহর মহিমা গাও।ছেলে আবার ভালো পছন্দমতো জায়গা দেখেই গাড়ি থামায়। সবাইকে নিয়ে সেলফি নেয়। আর বলে আম্মু তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হ্রদ এবং পাহাড়ের দৃশ্য অবলোকন করো। প্রকৃতি রাণী অকৃপণ ভাবে রাঙামাটিকে ক্যামনে রাঙিয়েছে দেখো। এইভাবে কিছুটা দেরী হলেও সুস্থ মতেই আমরা রাঙামাটি ক্যান্টমেন্টের অফিসার্স মেসে আসি। দারুণ দু’টো রুম। এগুলাও আগে বুকিং দেওয়া ছিলো। রুমের নাম ভুলে গেছি। এসবের নামও আদিবাসীদের ভাষায়। অনতি দূরেই রিসোর্ট আরণ্যক। দেখতে খুবই মনোহর। সামনে পিছনে ফুল,ফলের গাছে ভর্তি। এখানে বসার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া। এমনকি রাস্তার উপরেও নানাবিধ ফুল যত্নে গড়া। এসবই নাকি সেনাবাহিনীর তৈরী। আরণ্যকের সামনে থেকে হ্রদ অবধি সুচারু রাস্তার মাথায় সুন্দর মজবুত ছাউনি। এখানে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা দৃষ্টি নন্দন হ্রদ অবলোকন করে। রাঙামাটি জেলার সেনানিবাস এলাকায়
মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্মিত এই রির্সোট। এটা পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র।কাপ্তাই হ্রদে ঘেরা শান্ত ও ছিমছাম পরিবেশে আরন্যক রিসোর্টটি সুনিপুন ভাবে ছবির মতো সাজানো গুছানো। রিসোর্টটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত। হ্রদের পাড়ে সবুজ ঘাসে মোড়ানো রিসোর্টের প্রথম অংশে আছে নান্দনিক ফুলের বাগান,নানা রকম ভাস্কর্য, রিসোর্ট,প্যাডেল বোট,স্পীট বোটে চড়ার সুবিধা ও কফি শপ। এবং দ্বিতীয় অংশ হ্যাপি আইল্যান্ডে আছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড,পার্ক,রাইডার,বোট রাইডিং এবং লেক ভিউ সুইমিং পুল। রিসোর্টের ভেতরে ও বাহিরে চলছে ফটোসেশান । পরে বোটে চড়ে হ্যাপি আইল্যান্ডে যাই…
—- চলবে—-

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..