1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

‘বিদেশ’ হইতে কুদ্দুস দপাদারের সর্বশেষ স্টাটাস > বিদেশ একটা অদ্ভুত চিড়িয়াখানার নাম – – – লুৎফর রহমান রিটন

  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ২৬৫ বার
[ এই রচনার সহিত কোনো ব্যক্তি বিশেষের মিল ঘটিলে তাহা কাকতালীয় বলিয়া গণ্য হইবে। কেহ এই রচনায় নিজেকে প্রত্যক্ষ্য করিলে লেখক দায়ী নহেন। অনভিপ্রেতভাবে এই রচনায় কেহ নিজেকে আবিস্কার করিলে চাপিয়া যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলিয়া বিবেচিত হইবে।]
‘বিদেশ’ একটা সংক্রামক ব্যাধির নাম।
‘বিদেশ’ একটা অদ্ভুত চিড়িয়াখানার নামও।
বাংলাদেশ নিয়া সবচে বেশি চিন্তিত মানুষটা থাকে বিদেশে!
চান্স পাইলেই বাংলাদেশকে সকাল বিকাল গালাগাল করা মানুষটাও সেই বিদেশেই থাকে!
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিবানিশি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা মানুষটাও থাকে সেই বিদেশেই।
বিদেশ একটা অদ্ভুত চিড়িয়াখানার নাম!
চিড়িয়াখানায় সাধারণত জোর করেই আটকে রাখা হয় জীব-জন্তুদের।
কিন্তু বিদেশ নামের চিড়িয়াখানায় মানুষ নিজের উদ্যোগেই বন্দী হতে আসে দলে দলে। বিদেশে এসেই অদৃশ্য একটা খাঁচায় সমর্পন করে সে নিজেকে। দামি সুদৃশ্য খাঁচার ভেতরে নিজেকে দেখতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয় মানুষ।
সেই খাঁচায় থরে থরে সাজানো থাকে ‘ইমিটেশন প্রাচুর্য’। সেই প্রাচুর্যের ঝলমলানিতে জীবন তার আনন্দমুখর। অর্থবহ।
আমার পরিচিত একজনের কাহিনি এইখানে পেশ করি। তিনি ডিবি লটারিতে আমেরিকা এসেছেন। গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে একবারও দেশে যাননি।
তার নামটা প্রকাশ না করি।
নাম বললে চাকরি থাকবে না।
দেশে থাকাকালীন নিমের ডাল কিংবা ছাই দিয়ে দাঁত মাজা আমার পরিচিত সেই মানুষটা বিদেশে রোজ সকালে এলার্ম ঘড়ির হুংকারে ঘুম থেকে জেগেই ডেন্টিস্ট রেকমেন্ডেড মেডিকেটেড টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজে। জিলেট ফোম আর জিলেট ট্রিপল ব্লেডের রেজরে শেভ করে। সকালে মাফিন ব্রেড অমলেট কিংবা ঠান্ডা দুধ সিরিয়াল দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারে। তারপর ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে ফেসবুকে ঢোকে। তারপর বাংলাদেশের কোনো একটা ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে স্ট্যাটাস দেয়–দেশটার হইলো কি! বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র।
অতঃপর সে কাজে যায়। ঘড়ি ধরে ঘাড় গুঁজে দায়িত্বশীল লোকের মতো স্পিকটি নট অবস্থায় চাকরি করে। ডানে বাঁয়েও তাকায় না। লাঞ্চ ব্রেকে একটা চিজ বার্গার কিংবা টুনা স্যান্ডুইচ খেতে খেতে গরম কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ফের ফেসবুকে ঢোকে। তারপর সকালে আপলোড করা নিজের স্ট্যাটাসটি চেক করে। নিজের স্ট্যাটাসে ছত্রিশটা লাইক তিনটা লাভ আর পাঁচটা কমেন্ট পড়ে সে খুব মনোযোগ দিয়ে। চিত্ত প্রফুল্ল হয় তার একজনের মন্তব্য পড়ে–আপোনার মতো করিয়া কেহ দ্যাশের কথা বাভে না। আমোও আপোনার মতো বিদেশ যাইতে চাই।
রাতে বাড়ি ফিরে ফ্রিজ থেকে দুই সপ্তাহ আগের রান্না করা কাচকি মাছ আর গত মাসের পুরনো ডাল মাইক্রোওভেনে গরম করে পারবয়েল্ড চাউল দিয়ে পাকানো ভাত মাখিয়ে রাতের ডিনার শেষে ঘুমুতে যাবার আগে টিভি পর্দায় বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলের একটা টকশো দেখে। বিশেষ করে জনপ্রিয় টক শো ‘মক্ষির সহস্র অক্ষি’ দেখে বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে আরেকটা স্ট্যাটাস আপলোড করে সে–দ্যাশে গনোতন্ত্রো নাই। মক্ষির অক্ষিতে দেখিলাম বক্তারা বলিতেছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। সরকার কথা বলিতে দিতেছে না। সুতরাং ইহাতে কুনুই সন্দেহ নাই যে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র।
তারপর ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুম। ভোরে জেগে উঠে দ্রুত ব্রেকফাস্ট করতে করতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেসবুকে ঢোকে। আহা তিরানব্বুইটা লাইক, সাতটা লাভ আর এগারোটা কমেন্ট দেখে নিজেকে একজন জনপ্রিয় ফেসবুকার ভাবতে ভাবতে দৌড় লাগায় কাজের উদ্দেশ্যে। তারপর প্রায় একই পদ্ধতিতে ঘাড় গুঁজে চাকরি লাঞ্চ ডিনার ইত্যাদি করে টরে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আরেকটা স্ট্যাটাস মারে–ত্যাল নাই গেস নাই কারেন নাই, দ্যাশে গুম খুন চলিতেছে। কুনু বিচার নাই। দেশটা রসাতলে গিয়াছে। সরকার খালি উন্নয়নের কথা প্রচার করে। আদতে কুনু উন্নয়ন হয় নাই।
পরদিন ছুটির সকালে ফেসবুক চেক করে দেখে সাতানব্বুইটা লাইক, চৌদ্দটা লাভ আর কুড়িটা কমেন্ট! একজন কমেন্টে লিখেছেন–আপনাকে সেলুট ভাই। আপনের মতো সাহসী মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। অভাগা দেশের এখন আপোনার মতো দেশোপ্রেমিক মানুষের দরকার।
কমেন্টটা পড়ে পাখির পালকের মতো খুশির হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সিএনএন নিউজের পর্যালোচনা মূলক অনুষ্ঠানে চোখ রাখে সে–আমেরিকায় গত বছর খুন হয়েছে তেরো শ মানুষ, নিখোঁজ হয়েছে আড়াই হাজার, রাস্তায় পার্কে বর্ণবাদী পুলিশ প্রকাশ্যে হত্যা করেছে দুই ডজন নিরিহ ও নিরস্ত্র কালো মানুষকে। বাচ্চাদের একাধিক স্কুলে গানশুটে মোট ২৩ জন শিক্ষার্থী নিহত।
দ্রুত সে চ্যানেল চেঞ্জ করে ফেলে। কিন্তু ‘ইমিটেশন সোনায় মোড়া বিদেশ’ নিয়ে সে ফেসবুকে কোনো বিপ্লবী স্ট্যাটাস দেয় না।
অতঃপর সে প্রবেশ করে বাংলাদেশের ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ নামক প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে। অতঃপর খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের দর্শকনন্দিত টকশো ‘আমি কিন্তু কইয়া দিমু’ দেখে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকারের একটা কথা তাঁর খুবই পছন্দ হয়। পিকাশ করিম বলেছেন–যত্রতত্র উড়াল সেতু বা আন্নেসেসারি পদ্মা সেতুর পিছনে যে বিপুল ব্যয় হয়েছে আগামী দেড়শো বছর সেই ব্যয়ের কাফফারা গুণতে হবে জনগণকে। পদ্মা সেতু একটি দৃশ্যমান ব্যর্থতা। ম্যাট্রো রেল দৃশ্যমান আরেকটি অনাবশ্যক প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ ব্যর্থ রাষ্ট্রের দায় নিয়ে এক্ষুণি পদত্যাগ করা।
সুদৃশ্য সেই খাঁচায় শুয়ে বসে দিন গুজরান করতে করতে বহু বছর আগে একবার কোনো এক প্রসন্ন সকালে নিজের জন্মভূমির জন্যে একটা কিছু করার বাসনা জেগেছিলো তার হৃদয়ে। কিন্তু চাকুরি লইয়া ব্যস্ত থাকায় কিছু করা হয় নাই জন্মভূমির জন্যে।
আজ ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ছুটির দ্বিতীয় দিবসে অর্থাৎ কিনা রবিবার সকালে হঠাৎ তার মনটা খারাপ হয়ে যায়–আহারে দ্যাশের জন্যি কিছু একটা করা দরকার। কত যোগ্যতা নিয়া সে এই বিদেশে আসিয়াছিলো। সেই যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় নাই। যৌবনে চিত্রালীতে যে পরিমান চিঠিপত্র সে লিখিয়াছে তাতে এই বিদেশে সে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার মালিক হইতে পারিতো। একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হইতে পারিতো। অদ্ভুত সুন্দর এই বিদেশে তার চাইতে কম যোগ্যতা লইয়া কতোজন সম্পাদক সাজিয়া বসিয়া আছে!
তার সঙ্গীত প্রতিভা লইয়াও কাহারো কোনো ধারনা নাই। খুব গুপনে সে যে নিয়মিত কবিতা রচনা করে তাহাও কেহ সনাক্ত করিতে পারে নাই! কী লাভ হইলো বিদেশে আসিয়া! প্রোতিভার বিনাশ ব্যতিতো! অথচ দ্যাশের জন্যি কতো কিচু করার ছিলো।
কিচু একটা করা দরকার। না হইলে জন্ম আমার ধইন্য হলো মাগো গানটা গাহিবো কোন মুখে?
অতঃপর সে চিঠি লেখে মিসেস হিলারিয়াসকে–হে আমাদের বাংলাদেশের মহান বন্দু। বড়দিনের বড় শুবেচ্ছা লউন। বাংলাদেশে গনোতন্ত্রো নাই। আপনি কিচু করেন। শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করিতে সাহাইয্য করেন হে মানবতার মহান প্রতীক। আপোনি ছাড়া আমাদের আর কেহ নাই। আপোনিই বাংলাদেশের মহান বন্দু। দ্যাশে একন একমাত্র প্রপেচার ইনুচ স্যার ছাড়া আর কুনু দ্যাশোপ্রেমিক নাই। তাঁহাকে পেসিডেন পদে দেখিতে চাই।
আশা করি আপোনি বাংলাদ্যাশের গার্মেন শিল্পের সকল অর্ডার ক্যান্সেল করিবেন। সকল সাহাইয্য সহযুগিতা বন্দ করিবেন। সরকারের একটি শিক্কা হওন একান্ত দরকার। মেরি কিরিস্মাস! ইতি গণতন্ত্রো প্রত্যাশী দ্যাশোপ্রেমিক বাংলাদেশি আম্রিকান–কুদ্দুস দপাদার।
মেডাম হিলারিয়াসকে চিঠিটা পাঠিয়ে আমার পরিচিতজন সেই কুদ্দুস দপাদার দিলে বড়ই শান্তি অনুভব করলেন। তার মনে হতে লাগলো–এতোদিন পরে একটা কাজের কাজ করিলাম। দ্যাশের কুনু কাজে আসি নাই এই কথা আর কুনু শালা কহিতে পারিবে না। আমি দ্যাশের উপকারে আসিয়াছি। এইবার বাংলাদ্যাশ সরকার টের পাইবে কতো ধানে কতো চাউল। কতো গমে কতো আটা। কতো দুধে কতো মাঠা।
অতঃপর গেলো সপ্তাহে রান্না করা ফ্রোজেন বাইল্লা মাছের তরকারি ও ভাত একটি ওয়ান টাইম ইউজ কাগজের থালায় বেড়ে মাইক্রো ওভেনে গরম করতে দিয়ে সে একটা বিশেষ স্ট্যাটাস লিখতে বসলো। লিখলো–শ্যাখ মজিবর আমাদের পেয়ারা কান্ট্রিটা বেঙ্গে দিয়াছিলো! বাইয়ে বাইয়ে গলা জড়াইয়া থাকা হইল না তাহার পোলিটিক্সে।
অতঃপর এতোকালের লুকিয়ে রাখা গোপন দীর্ঘশ্বাসটা সে আর লুক্কায়িত রাখিতে পারিলো না। সে লিখিলো–বলিতে দ্বিদা নাই পাকিস্তান আমলেই আমরা ভালো ছিলাম……
২৫ ডিসেম্বর ২০২২
[ ক্যাপশন/ নকল সান্তাক্লজ লুৎফর রহমান রিটন। এঁকেছেন সুজন চৌধুরী। ]
May be a cartoon

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..