৪র্থ বার কল দেওয়ার পর কিছু বলে ওঠার আগেই ওপাশ থেকে রিসিভ করা মানুষটা অনর্গল শুনিয়ে গেলো, কল যখন রিসিভ করিনি,তারমানে ব্যস্ত ছিলাম! এতোবার কল দিয়েছো কেনো? জানো না ওটা আমার অফিস টাইম ? সরকারি চাকরী! এতো আরামে চলি না তো!
– না বাবা, সকালে কল দিয়েছিলাম কারণ তোকে মনে পড়ছিলো খুব। কল ধরলি না, তাই ভাবলাম এখন আরেকবার চেষ্টা করি।
– মনে পড়ছিলো? টাকা তো পাঠিয়ে দিয়েছিলাম মাসের শুরুর দিকেই। আবার কি?
– না রে, টাকার জন্য না । আজকে সকালে মেজো বৌ গরুর গোস্ত রান্না করলো। আমার তো কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়,তাই খাইনি। তবে হঠাৎই মনে পড়লো তোর কথা। একটা সময় কতো কাঁদতি, ‘মা একটু গোশত রান্না করো না! ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করে!’
-এগুলো মনে করানোর মানে কী ? আমার ছোটবেলা দুঃখ দূর্দশায় কেটেছে তা আমাকে মনে করাতে হবে নাহ! কী করেছো? খাওয়া,পড়া কোনটার জন্য কষ্ট না করেছি? আজ এই সরকারী উঁচু পোস্ট টার জন্য ও তো বহু খাঁটতে হয়েছে !
সত্যিই তো,তোর কত শখ আহ্লাদ অপূর্ণ থেকে গেলো। আমি বড় অভাগা রে। কম বয়সে বাপ-মা বিয়ে দিয়ে দিলো। পড়ালেখা ও হলো নাহ্। আর বিয়ের ক’বছর বাদেই তোর বাপটাকে আল্লাহ নিয়ে গেলো। তোর নানা নানী তো বিয়ে দিয়ে বহু আগেই দায়িত্ব সারা !
আহ্!! থামো তো। এসব শোনাতে কল দিয়েছো নাকি? আমরা একটু বেরোচ্ছি।তোমার নাতী কাল থেকে একটা খেলনার বায়না করছে। নিজে অভাবে বড় হয়েছি বলে তো আর ছেলের কোনো শখ অপূর্ণ রাখতে পারি না!
হ্যা। তাই তো। এই হতভাগা মা টাকে মাফ করে দিস বাপ, যতবার তোর থেকে এসব শুনি ভেতরে হাহাকার টের পাই।
এ নরক যন্ত্রণা যদি তোকে বোঝানো যেতো রে। পোস্ট অফিসে চিঠির খাম তৈরীর আর স্ট্যাম্প রেডি করার সামান্য বেতনের একটা চাকরী ছিলো। ঐ টাকা দিয়ে তো চাল, ডাল,তেল নুন আনতে ই হিমশিম খেতে হতো রে । আমার অবস্থা ছিলো এমন, ভিক্ষুককে দেখেও সুখী মনে হতো! ভিক্ষা চাইতে তো পারছে! আমি তো লোকলজ্জার ভয়ে তা ও পারতাম নাহ। অফিসে রিক্সা দিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই জোর করতো। কিন্তু ওদের তো আর বলতে পারতাম না, ঐ দুইটা মাইল পথ পায়ে হেটে গেলে দশটা টাকা বাঁচে। ছেলে আমার কতসময় কত আবদার করতি । কয়টা ই বা ফিরিয়ে দিবো বল ! পা ব্যথা হয়ে যেতো রে, তবুও! তোর হাসিমুখের চেয়ে তা কি আর বেশি নাকি!!
কাশির জন্য বাকি কথা শেষ করতে পারলেন না রহিমা বেগম।
কী ব্যপার কাশছো অনেকক্ষণ ধরেই ! কাশি নাকি তোমার?বৃষ্টির সময় জানলা দরজা লাগিয়ে দিও!তোমার অবস্থা জিজ্ঞেস করা হলো না, আছো কেমন মা?
কাশি হয়েছে হালকা। জানলা লাগিয়ে নিই। আমার রুমের টিনের চালটা ফুটো বহুদিন ধরে। এতদিন অসুবিধা হয়নি তেমন।কেবল রাতে ঠান্ডাটা অসহনীয় ছিলো। এখন বর্ষা এসে যাওয়াতে সমস্যায় পড়ে গেলাম। বৃষ্টিতে তোষক টাও ভেজা থাকে সবসময়।
টিন ফুটো হয়ে গেছে, আগে বলোনি কেনো?
বলেছিলাম তোকে গত মাসে, গ্রীষ্মের শেষে। তুই বললি এতবার বলতে হবে না। তুই সময়মতো ঠিক করে দিবি। আর ছোট হতে পারিনি তাই।
দু’পাশেই আর কোনো কথা নেই । কেবল মায়ের চোখের নিরব জলের ধারার সাক্ষী হয়ে রইলো টিনের চালে ঝুমঝুম শব্দ আর চালের ফুটো দিয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply