লাল বেনারসী পড়ে রাতবিরাতে কোনো মেয়েকে যদি ছাদে অবাধে বিচরণ করতে দেখে; সেই মেয়েকে নির্ঘাত সবাই পাগল ভাববে। বিয়ের শোকে এমনই একটি পাগলপ্রায় অবস্থা হয়েছে মেহেরের। কই এসেছিলো নিজের বেস্টুর বিয়ে খেতে আর এখন নিজেরই বিয়ে হয়ে গেলো। তাও আবার কাকে বিয়ে করলো? ওই কুত্তিটার ভাইকে।
এটা ভাবতে ভাবতেই ছাদের একপাশ থেকে অন্যপাশে পায়চারি করে যাচ্ছে আর বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলছে। আজ বিশ্ব উল্টে গেলেও ওই আদ্রাফ এহসানের ঘরে সে যাবে না।
.
—নিচে আসছো না কেন?
.
আদ্রাফের কন্ঠ শুনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে মেহেরের । পেছনে ফিরে আদ্রাফকে দেখতেই তার জান যেন যায় যায় অবস্থা । সে নিজের উদ্দেশ্যেই বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে……
.
—এখন ভয় পাওয়ার টাইম না মেহের। এই ব্যাটারে কিছুতেই সুযোগ দেওয়া যাবে না।
.
আদ্রাফ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। পরনে সাদা শেরওয়ানী যা ওর শরীরে মারাত্নকভাবে ফুটে উঠেছে। উপরের ঠোঁটটা নিচের ঠোঁটে চাপ দিয়ে এমনভাবে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে যে মেহেরের এমন উদ্ভট কাজে প্রচুর বিরক্ত সে।আমতা আমতা করে মেহের বলে ওঠে…….
.
—আ…আমি নিচে যাবো না।
আদ্রাফ কড়া গলায় তাকে প্রশ্ন করে,
.
—নিচে যাবা না মানে?
.
এবার বিরক্ত হয় মেহের। এই ছেলে কি বুঝে না কোনো কিছু? কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী গলায় বলে ওঠে……
.
—তেলাপোকায় কামড়াইসে আমারে যে আমি তোমার সাথে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবো? কচি খুকি না আমি । সব বুঝি যে আজ কি রাত?
.
আদ্রাফ এবার হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েরে জব্দ করতে হবে। তাই ধীরপায়ে মেহেরের খুব কাছে এগিয়েই অদ্ভুদ স্বরে প্রশ্ন করে……….
.
—আমি তো জানিনা আজ কি রাত?
.
হঠাৎ আদ্রাফের এমন কাছে আসাতে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে মেহের। আদ্রাফের ঘন নিঃশ্বাস ওর মুখে আছড়ে পড়াতে যেন অস্বস্তির চরম শিখরে পৌছে গিয়েছে সে।আয়াতের গহীন কালো চোখে সে ডুবে যেতে চাচ্ছে না তাই পরিস্থিতিটা সামলানোর জন্য কড়া গলায় বলে ওঠে……
.
—আহারে ! কচি খোকা। যেন কিছুই বুঝে না।আজ আমি তোমার সাথে যাবোনা। দরকার পড়লে সারারাত ছাদে পড়ে থাকবো। তবুও তোমার সাথে যাবো না।
.
—কিন্ত কেন?
.
—তোমারে দিয়ে ভরসা নাই। বউ হয়ে গিয়েছি দেখে কি না কি করে বসো…….
.
মেহেরের প্রতিটা কথা শুনলে যে কেউ রেগে ভস্ম হয়ে যেতো কিন্ত আদ্রাফ তার ব্যতিক্রম। সে নীরবেই ওর প্রতিটা কথা শুনে যাচ্ছে যেন সে জানতো এই পাগলীটা এরকম কিছুই করবে। মেহেরও পড়েছে বিপাকে। ওর মূল উদ্দশ্যই ছিলো যে আদ্রাফকে রাগাবে আর রাগের বশে সে যেন চলে যায়। কিন্ত ব্যাটায় তো পুরা পাল্টি মারলো। আদ্রাফ একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আবারো বলে ওঠে………
.
—দেখো মেহু ? লক্ষী মেয়ের মতো আমার সাথে চলো। তোমায় আমি একা রেখে যেতে পারবো না। তাছাড়া বাড়িতে আব্বু-আম্মু সবাই আছে। বিষয়টা ভালো দেখাবে না।
.
—তারা কি তোমার ঘরে গিয়ে উকিঝুকি মারবে যে আমি আছি কি না?আর আমি তোমার কোন জনমের মেহু লাগি? আমার নাম মেহের এই নামেই ডাকবা। এত আলগা পিরিত দেখাতে হবে না।
.
আদ্রাফের এবার ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে……..
.
—লাস্টবার জিজ্ঞেস করছি তুমি যাবে নাকি যাবে না?
.
মেহেরও এবার কটাক্ষ গলায় বলে ওঠে………
.
—যাবোনা……….যাবোনা………যাবোনা।
.
মেহেরের এই উত্তরটা শোনার সাথে সাথেই হুট করে ওকে কোলে তুলে নেয় আদ্রাফ।এই মেয়ে সোজা কথার মানুষ না। আর মেহের তো ওর বুকে পিঠে কিলঘুষি মারতে মারতে নিজের অবস্থা আধমরা করে ফেলেছে তবুও আদ্রাফ যেন তার দিকে প্রবল। হঠাৎই মেহের এক ভয়ঙ্কর কাজ করে বসলো যা ছিলো আদ্রাফের কল্পনার বাইরে।
.
মেহের আচমকা আদ্রাফের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় যার কারনে স্তব্ধ হয়ে যায় আদ্রাফ।মেহের চোখবন্ধ করেই আদ্রাফের ঠোঁটে নিজের স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। ঘটনারচাপে হুট করে মেহেরকে ছেড়ে দিতেই মেহের নিচে পড়ে যায়। ব্যস মেহেরকে আর পায় কে? হালকা একটু ব্যথা পেলেও সে উঠে আদ্রাফের কাছ থেকে নিরাপদ দুরুত্বে চলে আসে…….
.
—ভালোয় ভালোয় চলে যাও। আমি দস্যুরাণী মেহের। এত সহজে কারও পাল্লায় পড়ি না।
.
আদ্রাফ না পারছে এই যন্ত্রণা সইতে আর না পারছে এড়িয়ে নিতে। কেন যে বাবার কথা শুনে এই মেয়েকে বিয়ে করতে গেলো?সবাই ওদের বিয়েতে মহাখুশি থাকলেও ও বুঝে গিয়েছে যে ওর বিবাহিত জীবনে এই দস্যুরাণী বউ জীবনটা ঝাল্লাপাল্লা করে দেবে।
.
.
.
.
~চলবে~
.
(ফিরে এলাম নতুন একটি গল্প নিয়ে । আপনাদের আগ্রহের ওপর ভিত্তি করেই আদ্রাফকে নতুনভাবে নিয়ে এসেছি এই গল্পে। আশাকরি রৌদ্দুর তোমার নামে গল্পটির মতো এই গল্পেও আপনাদের ভালোবাসা পাবো। কেমন হয়েছে জানাবেন)
পর্ব:২
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে কারও বেডরুমে আবিষ্কার করেই অবাকের চরম সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে মেহেরর। এখনও লাল বেনারসী পড়া সে। মেহের মনে করতে থাকে যে সে তো রাতে ছাদে ছিলো ; তাহলে এখানে এলো কিভাবে?রুমটির একপাশে আদ্রাফের কিছু ছবি দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা আদ্রাফেরই রুম আর সেই তাকে নিয়ে এসেছে ।
.
মেহের শুধু পারছে না রেগে-মেগে নিজের চুলগুলো ছিড়ে ফেলতে।আদ্রাফ কেন তাকে নিয়ে এলো ; এটা ভাবতেই মেহেরের মন চাচ্ছে আদ্রাফকে জাস্ট খুন করে ফেলতে। ওর পাশে নিশ্চিন্তেই ঘুমিয়ে আছে আদ্রাফ। মেহেরের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চাপে।
বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে………..
.
—আমার কথা না শুনে শেষমেষ আমায় এখানে এনে এখন আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছিস ব্যাটা ! দেখাচ্ছি মজা।
.
মেহের এবার ওয়াশরুম থেকে এক মগ পানি নিয়ে পুরো মগের পানিটা আদ্রাফের ওপর ঢেলে দিলো। সাথে সাথেই উঠে যায় সে। ওর টিশার্ট , কম্বল , বিছানা অনেকটাই পানি দিয়ে চুপসে গেছে। আদ্রাফের এ দৃশ্য দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মেহের।
আদ্রাফ কটাক্ষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও গম্ভীর গলায় বলে ওঠে……..
—এসব কি মেহের? সকাল সকাল কি শুরু করেছো?
.
—যা করেছি……..ঠিক করেছি। আমায় রুমে নিয়ে আসার শাস্তি এটা।
.
আদ্রাফ শুধু পারছে না এই পাগলটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। এত সহজে রাগে না সে। কিন্ত এখন রাগটা কন্ট্রোল করা খুবই কঠিন হয়ে গিয়েছে ওর জন্য । একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে……….
.
—পাগলামীটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
.
—মোটেও না।
.
ব্যস আদ্রাফকে আর পায় কে। মেহেরকে কোলে নিয়ে একেবারে বাথটাবে ফেলে দিতেই মেহের ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে যায়। চোখের পলকে আদ্রাফের এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে। আর আদ্রাফ তো ডোণ্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। মেহের গর্জে বলে ওঠে……
.
—এটা কি করলে তুমি?তোমারে আমি একমগ পানি ঢেলে দিয়েছিলাম আর তুমি আমায় বাথটাবে ফেলে দিলে?
.
আদ্রাফ বাকা হাসি দিয়ে ঝুকে পড়ে মেহেরের দিকে । তারপর প্রতিউত্তরে বলে ওঠে……….
.
—তুমি যেমন দুস্যুরাণী আমিও তো সেই দস্যুরাণীর বর। আদ্রাফ এহসানকে এতই কাচা খেলেয়ার মনে করো মেহু?
.
বেচারী মেহের তো চুপসে গেসে। এতক্ষণ জ্বলন্ত গ্যাসের ন্যায় থাকলেও এখন হয়ে আছে ভিজা বিড়াল। গায়ে বেনারসীটা লেপ্টে থাকার কারনে আদ্রাফ তা দেখে অদ্ভুদ হাসি হাসে। তারপর বলে ওঠে……….
.
—-বিয়ের শোকে এখনো বেনারসী পাল্টাতে মন চাচ্ছে না নাকি? আমি জামা এনে দিচ্ছি তোমার ব্যাগ থেকে জলদি ফ্রেশ হয়ে আসো।
.
.
.
সারা বাড়িতে গমগম করছে মেহমান। আর মেহের তো পুতুলের ন্যায় এককোণে বসে আছে। আর থাকবেই না কেন? পাড়ার আর বিয়ে বাড়ীর সকল মহিলা যে ওকে ঘিরে বসে আছে।কেউ ওর গাল টিপছে তো কেউ ওর হাতে উপহার তুলে দিচ্ছে। এসব কাজ শেষ করে এখন মেহের সম্পূর্ণ ক্লান্ত।
.
—কি গো ভাবিজান………..রাতে কি হলো?
.
ডাইনিং রুমে একাই বসে ছিলো মেহের। পেছনে ঘুরে দেখে ১৬-১৭ বছর বয়সী তিনটি মেয়ে। ওদেরকে মেহের ভালোমতোই চিনে। আদ্রাফ আর নাদিয়ার চাচাতো বোন।আর এগুলো ভারি দুষ্টু। মেহেরও কম কিছু না। একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে ওঠে ,
.
–শুনতে চাও।
.
–শোনার জন্যই তো এসেছি।
একথা বলতে বলতেই চেয়ার পেতে বসে পড়ে তিনজন।মেহের এবার বলা শুরু করে…………
.
—বাসররাত ! বাসররাত ! বাসররাত ! কথায় বলে মেয়েদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাত এটা।
এমন কিছুই খাটে বসে ভাবছিলাম আমি। আশেপাশে গোলাপের সুগন্ধে যেন সারা ঘর মৌ মৌ করছে। আমার ভাবনার মধ্যে কখন যে আদ্রাফ এসে পড়েছিল আমি বুঝতেই পারিনি। আমি সাথে সাথেই যেন লজ্জায় কুকড়ে যাই। তোমাদের আদ্রাফ ভাই আমার হাতে আলতো করে নিজের হাত রেখে বলে……”ছাদে যাবে”
.
মেহের এবার ওদের তিনজনের দিকে তাকায়। ওদের উৎসুক দৃষ্টি দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে মেহের ডাহা মিথ্যা কথাগুলো বলছে। একজন তো অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে………
.
—তারপর কি ভাবি?
.
—ছাদে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা রুমে এসে পড়ি।সময়টা যেন কেমন যেন থমকে গিয়েছিলো। আদ্রাফ আমার দিকে তাকানো আর আমি আদ্রাফের দিকে। হঠাৎ বাতাসের দাপড়ে সারা ঘরের মোমগুলো নিভে যায়।
.
ওদের উৎসুক দৃষ্টি দেখে মেহের শুধু পারছে না মাটিতে গড়াগড়ি করে হাসতে। এই নাদান মেয়েগুলো আসলেই ওর কথাগুলো সত্যি মনে করছে।
.
—আমাদের কাহিনী শোনানো হয়েছে?
.
আদ্রাফের কন্ঠ পেয়ে চোখগুলো বড় বড় করে ফেলে মিহির। পিছে ঘুরি দেখে আদ্রাফ গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওরা তিনজন বিরক্তসুরে বলে ওঠে………
.
—উহ্ ভাই ? কত সুন্দর তোর বাসররাতের কাহিনী শুনছিলাম।
.
—তাই নাকি মেহু?
দাঁত চেপে বলে ওঠে আদ্রাফ।মেহের তো এবার শেষ। কোনোমতে আমতা আমতা করে বলে ওঠে……….
.
—মা…..মা….মানে ওরা শুনতে চ…….চেয়েছিলওওও।
.
মেহেরকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে ওর হাত চেপে রুমে নিয়ে আসে আদ্রাফ। মেহেরকে দেয়ালের সাথে চেঁপে দাঁড় করিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সে।আদ্রাফ মিহি গলায় বলে ওঠে………
.
—কাহিনী তো গতরাতে কম করো নাই। আবার বারিয়ে বানিয়ে কি শুনাচ্ছো ওদের? আগে আমায় বলো। মোম নিভে যাওয়ার পর কি হয়েছিলো?
.
মেহেরতো না পারছে পালাতে আর না পারছে সরে আসতে। আদ্রাফ ওর মুখের কাছে মাথা নামিয়ে বলে.
.
—গতকাল যে তুমি আমায় কিস করেছিলে এটা বললে আরও বেশি ভালো হতো। যাইহোক ! মিথ্যা বলা মহাপাপ। এখন তোমার বলা কথাগুলো আমি নাহয় সত্য করে দেই?
.
.
.
.
~চলবে~
পর্ব:৩
.
আদ্রাফের কথা শুনে চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে যায় মেহেরের। হঠাৎ ওকে এত কাছাকাছি অনুভব করাতে মেহের যেন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমতা আমতা স্বরে বলে ওঠে………..
.
—ম…মানে ক….কি? কি সত্য ক….করতে চাও!
.
আদ্রাফ বুঝেছে এবার হয়েছে কাজ। এমন একটা দস্যু মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর পাবে না। মেহেরের মুখেরর কাছে ঝুঁকে কিছুটা তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে……….
.
—তুমিই তো বলেছিলে যে তুমি কচি খুকি না? তাহলে এতটুকু কথাও বুঝতে পারো না। তুমি তো ওদের কাছে আমাদের বাসরের গল্পই শোনাচ্ছিলে? তো আমি ওই কাজটা প্র্যাকটিকাল করে দেখাবো নাকি?
.
—একটুওওও না !
.
মেহের এই কথাটা এতই জোরে বললো যে আদ্রাফের কানের পর্দা তো ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম। মেহেরের চোখ গুলো তো ভয়ে কুচকে গিয়েছে। আদ্রাফ এবার একটা ঠোঁট কামড়ানো হাসি হেসে বলে………
.
—নেক্সট টাইম যে কোনো উদ্ভট কাজ করতে আমি তোমাকে না দেখি। নাহলে কি হবে…………..তা তো ভালো করেই জানো। এখন লক্ষী মেয়ের মতো নিচে চলো।
.
একথা বলেই সিটি বাজাতে বাজাতে আদ্রাফ চলে যায়। মেহেরও এতক্ষণে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই ছেলেটা যতই শান্ত হোক না কেন ; মাথায় ভয়ঙ্কর সব বুদ্ধিগুলো কিলবিল কিলবিল করে। মেহের তো চেয়েছিলো এই আদ্রাফের শান্তশিষ্টতার সুযোগ নিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলতে। কিন্ত সেদিকে হলো উল্টো ; বরং আদ্রাফই ওর অবস্থা কাহিল করে দিলো।
.
.
.
বিকেলের দিকে নাদিয়া ওর বরকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসেছে। বিয়ে হওয়ার পরের দিনই বরকে নিয়ে নিজের বাড়িতে আসতে লাগে এটা এহসান বাড়ির একপ্রকার নিয়ম। নাদিয়াকে ফিরে আসতে দেখে মেহেরের খুশি এবার দেখে কে? যতই এখন ওর ননদ হোক না কেন ; সবার আগে বেস্টু বলে কথা।
ড্রইংরুমে সবাই একমনে বসে খুশির আলাপচারিতা চালাচ্ছে তবে নাদিয়া আর মেহের সেই আলাপচারিতার ধার কাছেও নেই। নাদিয়ার নিজের প্রাক্তন ঘরেই দুজনে বসে হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে।মেহের তো খুশিতে টগবগিয়ে বলে ওঠে……….
.
—দোস্তোওওও……….তোর বাসরটা কেমন হলো রে?
.
নাদিয়া আর আদ্রাফ দুজনের স্বভাব বরাবরই শান্তশিষ্ট ধরনের। তবে নাদিয়া যেমন একটু বোকাসোকা টাইপের তাই মেহেরের উদ্ভট কথায় মাঝে মাঝে লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়ে। হঠাৎ মেহেরের এমন প্রশ্ন শুনে নাদিয়া তো লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে।
(আর মেহেরকেই দেখো ! কি সুন্দর বানানো বাসর কাহিনী মানুষকে শোনায়
)
.
নাদিয়া মিহি গলায় বলে ওঠে…….
.
—ছিঃ মেহু? এসব কথা না তোরে বলছি আমারে জিজ্ঞেস করবি না?
.
নাদিয়ার এ কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে মেহের। এই মেয়েটারে জীবনেও শুধরাতে পারলো না সে। ভ্রু কুচকে মেহের বলে ওঠে…….
—এত লজ্জা কই রাখস রে নাদিয়া? আমিই তো। আমারে বলতেও সমস্যা হবে?
.
—এখন কিন্ত তুই আমার ভাইয়ের বউ আই মিন ভাবি। আচ্ছা আগে তোর ঘটনা বল না? গতকাল কে জানে কি হলো? আঙ্কেল আর আব্বু মিলে হুট করে তোর আর ভাইয়ের বিয়ে করিয়ে দিলো। সব ঠিকাছে তো?
.
—মোটেও না । তোর খাটাইশ ভাইটা আমার জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিসে………….জানোস আজ সকালে ওই বদ পোলায় আমারে বাথটাবে ফেলে দিসিলো?
.
—আদ্রাফ ভাই এমনি এমনি এমন করে নি আগে তুই বল তুই কিছু করেছিলি?
.
সন্দিহান কন্ঠে বলে ওঠে নাদিয়া। মেহের এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে ওঠে……
.
–ইয়ে……আসলে……উনার গায়ে একমগ পানি ঢেলেছিলাম।
.
—আমিও তো বলি……….আদ্রাফ ভাইরে যেমন আমি চিনি ; তোরে তার থেকে আরও ভালো করে চিনি। সে যে এমনি এমনি তোরে বাথটাবে ফেলেনাই তা আমি বুঝেই গিয়েছিলাম।
.
—-এইযে? বিয়ে হলো একদিনও হয়নি আর তুই আমার সাথে টিপিক্যাল ননদ টাইপ বিহেভ শুরু করে দিসোস?এটা কিন্ত ঠিক না।
.
নাদিয়া কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে মেহেরের দিকে। এই মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই এমন। ওর সাইডে কেউ কথা না বললে সবসময়ই এমন করতো। কিছু একটা ভেবে নাদিয়া ছোট ছোট চোখ করে বলে ওঠে……….
.
—আমার তো ভাইয়ের থেকে তোর জন্য বেশি মায়া লাগছে রে। তোরে সাইজ করতে ভাইয়ের যদিও কাঠখড় পোড়াতে হবে তবেই তোরে সাইজ করতে পারবো। ভাইযে কত স্ট্রিক্ট আমি জানি।
.
নাদিয়ার কথা শুনে মেহের ভ্রু কুচকে ফেলে। কেননা আদ্রাফের নামটা শুনলেই মেহেরের কেমন যেন পিত্তিটা জ্বলে ওঠে।
.
—আল্লাহর ওয়াস্তে তোর ভাইটার নাম এখন আমার সামনে নিবি না; নইলে…………..
.
—নইলে কি?
.
হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠ শুনে থমকে যায় মেহের। ক্রমাগত ঢোক গিলছে সে। যদি আদ্রাফ থাকে তবে তো মেহের শেষ। আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে মেহের পেছনে ফিরলেই স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে। নাদিয়ার হাজবেন্ট সাদাত ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে দরজায় হেলান দিয়ে। মেহেরকে পেছনে ঘুরতে দেখে বলে ওঠে……….
.
—আমার একমাত্র আদরের বউয়ের একমাত্র বড় ভাইয়ের বদনাম করা হচ্ছে বুঝি?
.
সাদাতের মুখে আদরের বৌ কথাটা শুনে বেচারি নাদিয়ার তো গালগুলো টমেটোর মতো হয়ে গিয়েছে।মেহের একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে…………
—অভ্যাস করে নাও ভাইয়া , এ আর তেমন কিছু না?
.
—তবে আমি এখন একটু কনফিউশনে আছি। এতদিন তো তোমায় শালিকা বলেই জানতাম………..কিন্ত এখন তো তোমায় মনেহয় ভাবি বলতে হবে।
.
—আমায় নাম ধরেই তো ডাকতে পারেন ভাইয়া। আচ্ছা………..অনেক কথা হয়েছে । এখন আমি যাই। আর আপনারা রোম্যান্স শুরু করতে পারেন।
একথাটা বলেই মেহের উঠে চলে যায় ওদের রুম থেকে।
.
.
নিজের রুমে স্টাডি টেবিলে বসে অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে আদ্রাফ ব্যস্ত। প্রায় একঘন্টা ধরে মেহের ওর দিকে উকিঝুকি দিচ্ছে কিন্ত আদ্রাফের যেন সেদিকে কোনো হেলদোই নেই। অনেকটা অধৈর্য হয়ে পড়ে সে। কেননা একজন চঞ্চল মেয়ের এতক্ষণ নীরব থাকা মোটেও সহজ কোনো বিষয় নয়। মেহের এবার আদ্রাফের কাছে গিয়ে বলে ওঠে…….
.
—আদ্রাফ ভাই?
.
আদ্রাফ নিশ্চুপে ফাইল চেক করতে ব্যস্ত।মেহের কিছুক্ষণ চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বলে ওঠে……..
.
—আরে ওওওও আদ্রাফ ভাই?
.
—এক থাপ্পড়ে তোমার সব দাঁত ফালায় দিবো। তোমার কোন জনমের ভাই লাগি আমি?
.
মেহেরের এই কথাটা বুঝতে প্রায় দুই মিনিট লাগলো। আদ্রাফ কাজ করতে করতে কথাটা এত গম্ভীরভাবে বলছিলো যেন কেউ বলতেই পারবে না এটা থ্রেড ছিলো নাকি অন্যকিছু।এত ইউনিক স্টাইলে ধমকানোর স্টাইল মেহের কাছে অনেক চোখ ধাধানোর মতো মনে হলো। ঠোঁট উল্টে সে বলে ওঠে………..
.
—আরে……..আগের অভ্যাসটাই রয়ে গিয়েছে।
.
আদ্রাফ এবার চেয়ার থেকে উঠে মেহেরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথাটা মেহেরের মুখের দিকে হালকা ঝুকিয়ে বলে ওঠে……….
.
—বুঝতে পেরেছি। আমায় দেখে হাজবেন্ট হাজবেন্ট টাইপ ফিলিং আসছে না তোমার। বাট তোমায় দেখে তো আমার বউ বউ ফিলিং আসছে। বিকজ আমায় ফার্স্ট কিসটা তুমিই দিয়েছিলে। এখন আমিও নাহয় দেই। তারপর আমায় দেখে হাজবেন্ড হাজবেন্ড ফিলিং আসবে।
.
.
.
.
~চলবে~
গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো।
পর্ব:৪
.
মেহের এবার পিছাতে পিছাতে একপ্রকার দেয়ালের সাথে ঠেকে গিয়েছে আর আদ্রাফ গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। শ্যামবর্ণের ছেলের এমন গম্ভীর দৃষ্টির জালে মেহেরের চোখ যেন আটকে গিয়েছে। তবুও সে আপ্রাণ চেষ্টায় মগ্ন এ দৃষ্টিকোণ থেকে আস্তে করে সরে আসার জন্য। একপাশ দিয়ে সরে আসতেই আদ্রাফ হাত দিয়ে ওকে আটকে দেয়।
মেহের এবার যায় কোথায়। ক্রমাগত শুকনো ঢোক গিলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মেহেরকে প্রয়োগ করতে দেখে একটা অদ্ভুদ হাসি হাসে আদ্রাফ।মেহেরের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে…
.
—আজ আর কিছু বললাম না। next time তুমি যদি আমারে ভাই বলে ডাকো তার ফলাফল কিন্ত খুবই ভয়ঙ্কর হবে। so be careful মেহু !
.
আদ্রাফের গম্ভীরভাবে ফিসফিসানোর ধরন দেখে চোখ ছোট ছোট করে ফেলে মেহের। ঠোঁট উল্টে মিনমিনিয়ে বলে ওঠে….
.
—কসম আল্লাহর !আর জীবনে তোমারে ভাই বলবো না।এখন তো আমারে যেতে দাও জামাই?
.
—হুম।
.
আদ্রাফের কাছ থেকে ছাড়া পেতেই ঝড়ের গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে মেহের। এতক্ষণ কেউ যেন ওর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলো।যদিও আদ্রাফকে ওর কখনোই পছন্দ ছিলো না। কেননা মেহের হলো চঞ্চল প্রকৃতির , যে নিজের চাঞ্চল্যতা দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখে । আর আদ্রাফ হলো ওর পুরোটাই উল্টো…..শান্তিশিষ্ট, চুপচাপ স্বভাবের। তাই মেহের এতকিছু করার পরেও সহজে রাগে না সে। কিন্ত যখন ওর উদ্ভট কান্ডের মাত্রা পেরিয়ে যায় তখনই সে মেহেরকে শায়েস্তা করে।
.
যা মেহেরের মোটেও পছন্দ না। কিন্ত আদ্রাফের প্রতিটা মুভমেন্ট ছোটবেলা থেকেই ওর কাছে চোখ ধাধানোর মতো মনে হতো। আগে নাদিয়ার সাথে দেখা করার জন্য প্রায়ই এবাড়িতে আদ্রাফের সাথে দেখা হয়েছে ওর। কিন্ত আদ্রাফ সবসময়ই নাদিয়ার সব ফ্রেন্ডসদেরই এড়িয়ে চলতো।যার কারনে আদ্রাফ সম্পর্কে তেমন ভালোভাবে অবগত হতে পারেনি সে।
কিন্ত এখন আবারও অদ্ভুদ কারনে আদ্রাফের মতো শান্তশিষ্ট মানুষের প্রতি মায়া নামক অপ্রত্যাশিত অনুভূতির জন্মেছে মেহেরের। ওকে নিজের কাছে অনুভব করলেই যেন সকল ভাবনাগুলো গোলমেলে হয়ে যায়। কেন?তার উত্তর মেহের কাছে এখন নেই।
.
.
.
সন্ধ্যার সময়ে রান্নাঘরে নিজের শ্বাশুড়ির সাথে চা বানানোর আমেজ নিয়ে গল্পের আসর জমিয়েছে মেহের।ছোটবেলা থেকেই এই মানুষটাকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড নাদিয়ার থেকেও বেশি ভালোলাগে মেহেরের। কারন তনুআন্টি খুবই বন্ধুসুলভ আর মিশুক স্বভাবের। মুখে সর্বদা একপ্রকার যেন মিষ্টি হাসি ঝুলেই থাকে। অন্যন্য টিপিক্যাল মা’দের তুলনায় উনি বেশ অন্যরকম বলেই তাকে মেহেরের বেশ পছন্দ।
.
—আন্টি , দেখোতো চা তে চিনি হয়েছে কি-না?
.
মেহেরের এই প্রশ্নে যেন ভীমড়ি খেয়ে পড়ে তনু বেগম। কটাক্ষ গলায় বলে ওঠে…..
—এই মেয়ে?দেবো এক থাপ্পড়। তোমায় আমি সবসময় বলেছি যে তুমি আমার মেয়ের মতো। তবুও তোমার মুখে কখনো আন্টি ছাড়া আর কিছু শুনলাম না। আর তুমি এখন আমার ঘরের বউ আর এখনও তুমি আমায় আন্টি বলেই ডাকবে?
.
কটাক্ষ গলায় কথাগুলো বললেই সেখানে অভিমানের সুর মেহের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আলতো হেসে সে প্রতিউত্তর দেয়..
.
—আচ্ছা সরি। আর কখনোই তোমায় আন্টি বলবো না। কত্ত কিউট তুমি? আমি বুঝলাম না তোমার ছেলেমেয়ে গুলা কেন এমন কচুপাতা টাইপ হলো? একেবারে রসকসহীন !
.
মেহেরের কথা শুনে হেসে দেয় তনু বেগম। রান্নাঘরের কাঠের তাক থেকে টোস্ট বিস্কুটের বক্স বের করতে করতে মেহেরের উদ্দেশ্য বলে…..
.
—ওরা দুজনেই অবশ্য ওর বাবার মতো হয়েছে। নাদিয়া তো তোমার সাথে মিশে একটু দুষ্টুমি মজলিশে মেতে ছিলো। কিন্ত আদ্রাফ কখনোই এমন ছিলো না। কিন্ত মন থেকে ও অনেক ভালো।
.
—হুহ ! ভালো না ছাই ! বেশশরমের হিডেন সফটওয়্যার ওর মধ্যে আগে থেকেই ইনস্টল করা ছিলো। (মেহের মনেমনে)
.
.
.
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে মেহেরের চোখের ঘুম যেন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। আদ্রাফও একটু জরুরি কাজে বাইরের থেকে এসেই সেই যে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো চারিদিকের আর কোনো হুশঁ জ্ঞানই নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে একঘন্টার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসটি পড়ে ফেললো। কিন্ত এখনও আদ্রাফকে সেই আগের জায়গাটিতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে সে।
কারও সাথে এখন যদি মেহের কথা না বলে সত্যিই দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে সে। শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে আদ্রাফের কাছ থেকে ল্যাপটপটি কেড়ে নেয় সে। আদ্রাফ হঠাৎ মেহেরের উদ্ভট কান্ডে খনিকটা হতভম্ব হয়ে যায় যার রেশটি ওর চশমার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পারছে মেহের।
.
আদ্রাফের সবসময়ই কাজ করতে গেলে চশমার প্রয়োজন হয়।আর যখন ও চশমা পড়ে ওকে দেখতে মেহেরের কাছে চরম লাগে।তাই হঠাৎ আদ্রাফের চশমা ভেদ করে নজরকাড়া সেই দৃষ্টি দেখে মেহেরের বিরক্তিটা কেমন করে যেন পাল্টে যায়।
.
আদ্রাফ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে……
.
—কাজ করছিতো আমি? এভাবে ল্যাপটপটা নিলে কেন?
.
মেহের নিশ্চুপ। তার অনুভূতিটা যেন গুলিয়ে গিয়েছে । কোনোমতে আমতা আমতা করে বলে ওঠে….
.
—আমার ভালোলাগছে না।
.
—ভালোলাগছেনা মানে?
.
—কতক্ষণ ধরে এমন করে বসে আছি। আর তুমি তো সেই যে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছো আমার দিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছোনা।
.
—তো আমি এখন কি করতে পারি।
.
আদ্রাফের তীক্ষ্ণ চাহিনী দেখে আবার চুপসে গিয়েছে মেহের। কিছুক্ষণ নীরবতা পার হওয়ার পর মেহেরের কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে আদ্রাফ বলে ওঠে…….
.
— আচ্ছা। আমি এখন আর কাজ করবো না। তোমার ভালোলাগছেনা তাইতো? আর আমার মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করতেছে। তাই তুমি এখন আমার মাথা টিপে দাও।
.
—কি?
.
আদ্রাফ চট করে খাটে শুয়ে পড়ে।এমন ভাব করছে যে এই মুহূর্তে প্রচণ্ড ক্লান্ত সে। মিহি গলায় সে বলে ওঠে….
.
—দেখো মিহু….মাথাটা আমার এখন প্রচন্ড ব্যাথা। তাছাড়া তোমারও ভালোলাগছে না তাই এখন গুড গার্লের মতো আমার মাথা টিপে দাও। জলদি !
.
মেহেরকে এখন কোনো হতাশাগ্রস্থ থেকে কোনো কম কিছু মনে হচ্ছে না। মিনমিনিয়ে সে বলে ওঠে….
.
—আল্লাহই জানে কতক্ষণ আমারে দিয়ে এই ব্যাটায় মাথা টিপাবে?
.
.
.
~চলবে
পর্ব ৫+৬
.
একরাশ আগ্রহ নিয়ে ভার্সিটির চারিপাশে চোখ বুলাচ্ছে মেহের। আজ তার ভার্সিটিতে প্রথম দিন। তার পাশেই স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রাফ। কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে আদ্রাফ বলে ওঠে………..
.
—সিনিয়র কারও কাছ থেকে তোমার ক্লাস কোনটা জেনে নাও। নাদিয়া একটু পরেই এসে পড়বে।
.
আদ্রাফের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা অনবরত বেজে চলছে । কিন্ত আদ্রাফ পার্কিং সাইটে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরের সাথে। শেষমেষ মেহের বিরক্তি প্রকাশ করে বলে…….
.
—কখন থেকে ফোন বেজে চলছে ফোন তুলছো না কেন?
.
—অফিস থেকে ফোন করছে তাই। জরুরি মিটিং আছে।
.
—তাহলে যাচ্ছো না কেন?
.
—তোমাকে একা রেখে যাবো ? Impossible ! এমনিতেও আজ তোমার প্রথম দিন। তাও আবার নিউ স্টুডেন্ট;Versity Fresher যাকে বলে। তোমার কি মনে হয় নিউ স্টুডেন্ট তুমি , আর কোনো র্যাগিং এর শিকার হবে না? তাই নাদিয়া সাদাতকে নিয়ে আসুক , তার দায়িত্বে তোমাকে না রাখলে আমার শান্তি হবে না আফটার অল সাদাত ভাই ভার্সিটির প্রফেসর।
.
আদ্রাফের কথায় মেহেরের চোখ যেন কপালে উঠে গিয়েছে। কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী গলায় বলে ওঠে……….
.
—কি বললে ? কি মনে হয় তোমার ? আমি ; এই মেহেরকে র্যাগিং করবে? আর এই ভয়ে তুমি আমাকে একা রেখে যাবে না? তাহলে সেটা হবে বেস্ট জোক অব দ্যা ইয়ার। আমারে র্যাগিং করা এত সহজ না বস্ !
.
আদ্রাফ এবার সশব্দে হেসে দেয়। যার কারনে মেহের বোকার মতো তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। তার মতে সে কোনো হাসির কথা বলেনি যে এই কুমড়োপটাশ আদ্রাফকে সশব্দ হাসতে হবে।আদ্রাফ এবার হাসি থামিয়ে বলে………
.
—তোমার এটা মনে হচ্ছে মেহু? ওই সিনিয়রদের ভয়ে তোমায় একা রাখানি এটা নিতান্তই তোমার ভ্রান্ত ধারনা। বরংচ আমার তো এটা নিয়ে ভয় হচ্ছে তুমি না জানি ওদের সাথে কি খুন-খারাপি করে বসো। তারপর ভার্সিটির authority আমায় ডাকবে এটা আমি মোটেও চাইনা।
.
ভ্রু কুচকে মেহের তাকাতেই আদ্রাফ আস্তে করে চোখ ফিরিয়ে নেয় মেহেরের কাছ থেকে। আদ্রাফ জানে এখন মেহেরের দিকে তাকালেই মেহের পারলে চোখ দিয়ে ওকে ভস্ম করে ফেলবে। তাই আনমনে মোবাইল চালানোও এর থেকে অনেক ভালো।
.
.
কিছুক্ষণ পরেই নাদিয়া আর সাদাত এসে পড়ে। দুজনকে আজ দেখতে চমৎকার লাগছে। মেহের হাসিমুখ নিয়ে সাদাতের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে……..
.
—আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া , কেমন আছেন?
.
—এইতো আলহামদুলিল্লাহ । তুমি?
.
—আমিও আছি ! কোনোরকম……
.
মেহের দাঁতে দাঁত চেপে একথা বলে ওঠে। এমনিতেও আদ্রাফের কথায় এই মেয়ের মাথা আউট অফ কন্ট্রোলে আছে না জানি কখন আদ্রাফের উপর আগ্নোয়গিরির মতো ব্লাস্ট হয়ে যাবে এটা ভেবেই মনে আগুন পিষে রেখেছে সে।আদ্রাফ সাদাতকে বলে ,
.
—সাদাত ভাই ! মেহুর একটু খেয়াল রেখো। তুমি তো জানোই , মাথা গরম করা মেয়ে। না জানি কখন কার সাথে কি করে বসবে।আর নাদিয়া ! তুই কিন্ত মেহুর সাথে সাথে থাকবি।
.
অন্যদিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে মেহের। আদ্রাফ এমন ভাবে ওর খেয়াল রাখতে বলছে যেন ও কোনো বাচ্চা একটি মেয়ে। আদ্রাফের কথা শুনে নাদিয়া হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছে না। কোনোমতে হাসি আটকিয়েবলে ওঠে……..
.
—রিলেক্স ভাই। এত টেনশন করার কিছুই নাই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মেহু। আর তুমিতো এমনভাবে ওকে ট্রিট করতে বলছো যেন একটা বাচ্চা পালবো আমি।
.
—আগে তোমর বেসণটফ্রেন্ড ছিলো কিন্ত এখন তো আমার বউ । সো আমি যা বলছি তাই করো।
.
আদ্রাফের কড়াকড়ি প্রয়োগের জন্য নাদিয়া আর কিছু বলে নি। মেহের এবার রেগেমগে বলে ওঠে……
.
—ওই নাদিয়া ! চল তো ! তোর ভাইয়ের মর্মবাণী শেষ হলে এখন তাড়াতাড়ি চল।
.
এই বলে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে মেহেরের হাতের কব্জি আকড়ে ধরে আদ্রাফ। একপ্রকার নির্লিপ্ত চাহিনী নিয়ে তাকিয়ে আছে সে মেহেরের দিকে। নাদিয়া আর সামাদ ভার্সিটির গেটের ভেতরে এতক্ষণে ঢুকে পড়েছে। আদ্রাফের নির্লিপ্ত চাহিনীর মায়ায় হারিয়ে মেহেরের রাগটা যেন হাওয়ার তালে উড়ে গেলো। আদ্রাফের হালকা আকাশী শার্ট পড়েছে । শ্যামবর্ণের ছেলে হলেও সবধরনের রঙের শার্ট পড়লেই বেশ সুর্দর্শন লাগে আদ্রাফকে দেখতে।
.
মেহেরের গালে আলতো করে নিজের হাত রেখে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে…….
.
—কারও সাথে ঝগড়া করোনা কেমন? সবসময় নাদিয়ার সাথে থাকবে। কোনো প্রবলেম হলে অবশ্যই আমায় কল দিবে অথবা সাদাত ভাইয়ের কাছে যাবে। হয়তো আমিই তোমাকে নিতে আসতে পারি। আমি না নিতে আসলে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেবো নে। টেক কেয়ার অফ ইউরসেল্ফ।
.
আদ্রাফের প্রতিটি কথার জালে মেহের যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। আদ্রাফ ওকে ইশারা করে ভারণসিটির প্রান্তে যেতে বলেই গাড়ি নিয়ে চলে যায়। মেহের তখনও একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আদ্রাফের প্রতি এ অদ্ভুদ অনুভূতির কোনো সূক্ষ্ণ নাম তার কাছে নেই।
.
.
.
আজ প্রথম দিনটা মোটামুটি ভালোই গিয়েছে মেহের আর নাদিয়ার। ক্লাস শেষে দুজন ক্যান্টিনে বসে হালকা-পাতলা কথা বলছে । সামনেই নবীন বরণ অনুষ্ঠান। মূলত এ বিষয় নিয়ে একটা আবছা পরিকল্পনা বানাচ্ছে দুজনে।ওদের কথার মাঝেই পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে………..
.
—হেই স্টুপিট গার্লস ! ভার্সিটিতে নতুন নাকি? এই জায়গায় বসার কেউ সাহস পায় না আর তোমরা দুজনে জমপেশ বসে আড্ডা দিচ্ছো?
.
মেহের পেছনে তাকিয়ে দেখে তিনজন ছেলে আর দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই মূলতো একটু ওয়েস্টান কালচারের ড্রেস পড়া তবে উগ্র ধরনের না । ছেলেগুলোও এমনভাবে তাকিয়ে আছে মেহের আর নাদিয়ার দিকে যেন ওরা এমন দৃশ্য জীবনেও দেখেনি। আর মেয়ে দুটো তো দেখতে চমৎকার। একটু আগে সম্ভবত চুইংগাম চাবানো মেয়েটি তাদের উদ্দেশ্য কথা বলেছিলো এটা ভেবে নাদিয়া বলে ওঠে…….
.
—সরি আপু আমরা জানতাম না আমরা এখনি সরে যাচ্ছি।
.
নাদিয়া মেহেরের হাত চেপে সরে আসতে নিলেই চইংগাম চাবানো মেয়েটির পাশে পনিটেইল চুল করা মেয়েটি বলে ওঠে……..
.
—এমনি এমনি চলে যাবে freshers? আমাদের পার্মিশন ছাড়া আমাদের জায়গায় বসেছো একটা শাস্তি তো দিতেই হবে।
.
ভ্রু কুচকে ফেলে মেহের।নাদিয়ার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে মেয়েটিকে প্রতিউত্তরে বলে.
.
—আমরা তো সরি বলেছি আমাদের না জানা সত্বেও। তাছাড়া এটা কোনো অপরাধ না। তাহলে শাস্তি কিসের?
.
মেহেরের কন্ঠে একপ্রকার চাপা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্ত এখন মোটেও কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছে না সে শুধুমাত্র আদ্রাফের কথার জন্য।মেহেরের রাগ দেখে ওদের মধ্যে একজন ছেলে টিটকারির সুরে বলে ওঠি……….
.
—ওমা ! মেয়ে দেখি এখনি ফেটে পড়বে ! এখানে রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।শাস্তি তো পেতেই হবে।
.
—হ্যালো ! বিহেব ইউরসেল্ফ। তোমরাও যেমন সিনিয়র আমাদের কাছেও authority power আছে। সাদাত স্যার এখানে আমাদের gurdian হিসেবে আছে।
.
মেহেরের প্রখর গলা শুনে ওরা ভয় পাওয়ার ভান করে বরে যে,
.
—OMG ! We are scared !
একথা বলেই যেন হাসিতে মেতে ওঠে। চুইংগাম চাবানো মেয়েটি মেহেরের কাছে গিয়ে বলে………
.
—সাহসের দাম দিতে হবে তোমার। আর কি যেন বললে? তোমার কাছে authority power আছে?(তাচ্ছিল্যের স্বরে) listen , এখানে আমাদের পাওয়ার চলে। ভাইস প্রিন্সিপালকে নিয়ে আসো তবেও কিছু করতে পারবে না। আজ আমাদের ভিসি নেই তাই তোমাকে ছেড়ে দিলাম। তোমার ব্যবস্থা আমি তাকে দিয়েই করাবো।
.
.
মেহের কোনোমতে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে।অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমিয়ে রেখেছে সে। ওই মেয়েটার সাহস কি করে হলো মেহেরের সাথে উচু গলায় কথা বলে? পার্কিং সাইটে গিয়ে দেখে আদ্রাফ গাড়িতে হালকা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
আদ্রাফকে নিজের রাগটা মেহের দেখাতে চাচ্ছে না। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে মেহের চুপচাপ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে পড়ে।আদ্রাফ খানিকটা অবাক হলেও মেহেরকে এ বিষয়ে কিছুই বলে না।
.
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে সমান্তরালে।দু পাশে ব্যস্ত গাড়ি আর রিকশার আনাগোনা। মেহের আড়চোখে বারবার আদ্রাফকে দেখতে মগ্ন। বরাবরের মতোই সে প্রতিক্রিয়াহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। কানের একপাশে ব্লুটুথ এয়ারফোন গোঁজা। গরমের প্রবাহটা এতটাই বেশি যে আদ্রাফের কপালে একটু একটু ঘাম দেখা যাচ্ছে।
.
মেহের কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। ভার্সিটির ওই ঘটনাটার জন্য কিছুই যেন ভালোলাগছে না ওর।
.
— মিহু ? হঠাৎ এত চুপচাপ কেন?
.
এবার সত্যিই ক্ষেপে যায় মেহের। ওই মেয়ের ওপর জমানো ক্ষোভটা আদ্রাফের ওপর ঝাড়ার জন্য বলে………
.
—কেন? কোনো সমস্যা? তুমিই তো চাও আমি সবসময় এমন থাকি। চুপ থাকলেও দোষ না থাকলেও দোষ !
.
মেহেরের প্রখর কন্ঠ শুনে ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি রাখে আদ্রাফ। মেহের সাথে সাথে ভ্রু কুচকে ফেলে। এই ছেলেরে এত ধৈর্যশক্তি আল্লাহ কিভাবে দিয়েছে?মেহেরের কাছে আদ্রাফের প্রতিটা কাজই বড় অদ্ভুদ লাগে যা ওর ধারনার বাহিরে।আদ্রাফ তার মনের কথা বুঝে বলে ওঠে…….
.
—রাগ সবকিছুর সমাধান না। একটা সম্পর্কে যেমন রাগ থাকে তেমনি ধৈর্যও থাকা উচিত। দুজনেই যদি মনে রাগ , ক্ষোভ , অভিমান রাখি তাহলে সম্পর্কটা আগাবো কিভাবে?
.
আদ্রাফ নামের এই ব্যক্তিটা নিজের কথা আর কাজের জাদুতে অদ্ভুদভাবেই আগলে নিয়েছে মেহেরকে। এতটা গভীরভাবে মেহের কখনোই ভাবেনি এই সম্পর্কটি নিয়ে। হয়তো অনুভূতির এক সুপ্ত কোণে অজান্তেই সে লুকিয়ে রেখেছে আদ্রাফকে। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের সাথে তা প্রকাশ করার………..
.
.
.
.
.
~চলবে
.
আগামী বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার আমার আত্নীয়ের বিয়ের উপলক্ষে গ্রামে যাবো। আর বিয়ে বাড়িতে যদি গল্প লিখতে বসি , সবাই আমারে কেলানি দিবে। তাই আজ দুটো পর্ব একসাথে দিলাম। শুক্রবার দিতে পারবো কিনা জানিনা তবে চেষ্টা করবো।
আশা করি বিষয়টা সবাই বুঝবেন।
.
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply