বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি শুরু করেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজ। দেশ পুর্নগঠনে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন তিনি, যার মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে বৃক্ষসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন বৃক্ষরোপণ অভিযান। গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করেন জনগণকে। এজন্য গণভবন এবং বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে রোপণের উদ্যোগ নেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন প্রকৃতি প্রেমিক। একজন পরিবেশ প্রেমিক। দেশমাতৃকার প্রতি যে দরদ ও ভালোবাসা বঙ্গবন্ধু সব সময় অনুভব করতেন, ঠিক তেমনি দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিও ছিল অন্যরকম ভালোবাসা। কারাগারের মধ্যে থেকেও পরিবেশের প্রতি একটুও টান কমেনি। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে দেখা যায়, ১৭ জুলাই ১৯৬৬ সালের ঘটনায় বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘বাদলা ঘাসগুলি আমার দুর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিতেছে। কত যে তুলে ফেললাম। তুলেও শেষ করতে পারছি না। আমিও নাছোড়বান্দা। আজ আবার কয়েকজন কয়েদি নিয়ে বাদলা ঘাস ধ্বংসের অভিযান শুরু করলাম। অনেক তুললাম আজ। আমি কিছু সময় আরও কাজ করলাম ফুলের বাগানে।’ একজন প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব সময় সুজলা সুফলা স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে আত্মনিয়োগ করতেন।
বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলেন বাংলার মাটি, মানুষ, পরিবেশ, প্রকৃতিকে। তিনি সর্বস্তরে বৃক্ষরোপণের ডাক দিয়েছিলেন, উপকূলীয় বনায়ন করেছিলেন, বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন প্রণয়ন করেছিলেন, জলাভূমি রক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করে বহুমুখী কর্মকান্ড গ্রহণ করেছিলেন, যা ছিল সুস্থ এবং পরিবেশবান্ধব সমাজব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ।
সদ্য একটি স্বাধীন দেশে বৃক্ষসম্পদের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে, সে ক্ষতি পূরণের জন্য ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঘোরদৌড় বন্ধ করেন বঙ্গবন্ধু। এই ময়দানে গাছ লাগিয়ে নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গণভবন ও বঙ্গভবনে গাছ লাগিয়ে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, দেশজুড়ে শুরু করেন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বাড়ির আশেপাশে, পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণে সবাইকে আহ্বান জানান তিনি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহবানে যেভাবে সবাই দেশমাতৃকাকে রক্ষার শপথ দেন, ঠিক তেমনি পরিবেশ রক্ষা ও বৃক্ষরোপণে জাতির জনকের আহবানে সবাই সাড়া দেন। দেশের জনগণ বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ উপ-কমিটি কর্তৃক সবুজ পরিবেশ আন্দোলন দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে। আওয়ামী লীগ কর্তৃক ইতোমধ্যে ১ কোটি ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।
উপকূলীয় এলাকাকে সবুজায়ন করার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। একজন পরিবেশ প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব সময় পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য দিতেন। উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপণের বিষয়টি অনুধাবন করেন এবং জনসচেতনতা আনয়ন করেন। আজকের বাংলাদেশের রাস্তার দুপাশে যে সারি সারি বৃক্ষরাজি আমাদের প্রকৃতিকে অপরূপ করেছে, দৃষ্টিনন্দন করেছে, এর সূচনা হয়েছিল জাতির জনকের হাত ধরেই। আর তাই তো দুর্যোগ মোকাবিলায় সারাবিশ্বে বাংলাদেশ রোলমডেল হিসেবে পরিচিত।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ কর্মসূচি উদ্বোধনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য, বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়া যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এটা হলো বেরিয়ার, এটা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ পর্যন্ত এরিয়া সমুদ্রে তলিয়া যাবে এবং হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মত আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার সুন্দরবন যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোন উপায় আর নাই।’ আসলেই, আজকের বাংলাদেশে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই সুন্দরবন আমাদের রক্ষায় কাজ করে। জাতির জনক মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন এ সুন্দরবন ও উপকূল রক্ষার বিষয়টি।
পরিবেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়াটার পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিনেন্স ১৯৭৩ জারি করেন। ১৯৭৩ সালেই পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের সূচনা হয়। পরবর্তীতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমান পরিবেশবান্ধব সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি অত্যান্ত স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছে।
উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করে ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম, যা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই। দেশের উদ্ভিদ প্রজাতির উপর মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য-উপাত্তসহ শুষ্ক উদ্ভিদ নমুনা সংরক্ষণ ও শ্রেণিবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান এ হার্বেরিয়াম। উদ্ভিদ প্রজাতির সংরক্ষণ এবং বংশ পরম্পরায় যাতে এটির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে, তাই দেশের নানা প্রান্তের উদ্ভিদ এখানে সংরক্ষণ করা হয়। যা পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। মহাসড়কের দু’পাশে, উপকূলীয় এলাকায় বৃক্ষরোপণের সূচনাও হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। দেশের হাওর, নদ-নদী ও জলাভূমি রক্ষার প্রতিও জোর দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এসব উন্নয়নে রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
দেশের বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে এদের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বঙ্গবন্ধু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেন। ওই আইনের মাধ্যমেই দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালে দেশে ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ আজ সবুজায়নের চাদরে আচ্ছাদিত। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় জাতির জনকের পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার। সারাদেশে নানা প্রজাতির বৃক্ষে শোভিত নির্মল পরিবেশ। পরিবেশপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ অনন্য উচ্চতায়। মুজিব শতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধা হে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: প্রফেসর, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
Leave a Reply