শারীরিকভাবে অক্ষম পুরুষটা যখন আমাকে দুশ্চরিত্রা অপবাধ দিয়ে,আমার সাথে সংসার করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন আমার স্বামীর ভালোবাসাহীন শ্বশুরবাড়িতে কাটানোর ছয়মাস পূর্তি দিবস।
সেই দিন আমি নিশ্চুপ হয়ে এক কাপড়ে ছোটভাইয়ের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছি। ঐদিন আমার পরনে ছিল নীল রংয়ের একটা ছাপার শাড়ি। অথচ বিয়ের দিন বাবা আমায় স্বামীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন
” লাল শাড়ি পরে স্বামীর বাড়ি প্রবেশ করবে, আমার কোনোদিন বের হলে সাদা শাড়ি পরে বের হবে।”
আমি জানতাম সাদা হচ্ছে বিধবার রং। স্বামীর মৃত্যুর পর একজন নারী আমাদের বাংলাদেশের কালচার অনুযায়ী সাদা শাড়ি পরেন। বাবা কি আমাকে বিধবা হতে বলছেন। এটা শোনায় আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। একঘণ্টা আগে বিয়ে হওয়া লোকটাকে এত আপন মনে হলো যে আমি মাথা তুলে তার মুখের দিকে চেয়ে, মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে তার দীর্ঘায়ু কামনা করলাম।
অথচ বাবা সাদা কাপড় বলতে কাপনের কাপড়কে বুঝিয়েছেন।
অথচ বিয়ের ছয়মাসের মাথায় আমাকে সাদা কাপড় নয়, নীল কাপড় পরেই বেরিয়ে আসতে হলো।
সুন্দর, সুঠাম, শিক্ষিত, ব্যক্তিত্ববান পুরুষটাকে স্বামী হিসাবে পেয়ে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে শোকর গোজার করেছি।
অথচ তিনি বিয়ের প্রথমদিন থেকে ছিলেন নিরব ও নিশ্চুপ। স্ত্রীর প্রতি তার স্বামী সুলভ কোনো আচরণ না দেখে আমার বিস্ময়ের শেষ ছিল না। আমি নিজের খুত আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার কোনো আচরণ বা আমাদের কোনো অাপ্যায়নে তিনি মনোক্ষুন্ন হয়ে আমাকে ইগনোর করছেন না তো!
এভাবে মাস কেটে গেল। অনেকে দুষ্টামি করে অনেককিছু জানতে চেয়েছেন। তাদের মূল বক্তব্য হলো স্বামী স্ত্রীর শারীরিক বা মানসিক সামঞ্জস্য কেমন? আমি সুখি তো!
দীর্ঘ একমাসেও যার সান্নিধ্য বা সহচার্য পাইনি, তার সাথে কেমন সামঞ্জস্য হচ্ছে, সেটা কীভাবে বলব। আমি মুচকি হাসি দিয়ে সবাইকে কৌশলে এড়িয়ে যেতাম।
আর সুগৃহীনি হয়ে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করতাম। সে মেয়ে নয়, যে মেয়েলি সমস্যা থাকবে।
তার কোনো প্রেম ছিল বা আছে বলেও কোনো কিছু চোখে পড়েনি। তাহলে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী?
বিয়ের দেড় মাসের মাথায় একদিন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করে বসলাম
” আমার সমস্যা কী?”
” না, তোমার তো কোনো সমস্যা নেই?”
” তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? আমি নিশ্চয়ই ভাত, কাপড়ের অভাবে আপনাদের বাড়ি আসিনি! আমি আপনার স্ত্রী হয়ে এসেছি। স্ত্রী হিসাবে আমার অধিকার ও মর্যাদা চাই।”
সেদিন অনভিজ্ঞ, আনাড়ি আমি শুধু মাত্র দাদী, নানী থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকে একান্ত কাছে পাওয়ার আসায় তার সাথে মিশে যেতে চেয়েছি।
অথচ আমি ভীষণভাবে আশাহত হলাম। হেরে যাওয়ার যন্ত্রণায়, অপমানে, লজ্জায় আমার কান্না বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো উপচে পড়ল, আমার চোখের সমুদ্র বেয়ে।
আমি সারারাত কান্না করলাম। কখনো চিৎকার দিয়ে, কখনো ঠুকরে, কখনো ফুঁপিয়ে। অথচ একই রুমে থাকা আরেকটা প্রাণ কোনো সান্ত্বনা না দিয়ে কেবল অনবরত সিগারেট পান করেই গেছে।
একটা সময় সিগারেটের ধোঁয়া আর ঠকে যাওয়া একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ চার দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে কেবল রাতের অন্ধকারে মিলে গেছে। কেউ টের পায়নি কেউ না।
আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে এভাবেই অনন্তকালও কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। অথচ কখনো অধিকার নিয়ে কথা বললেই কেবল চাচাত, মামাত ভাইদের জড়িয়ে নোংরা ভাষায় কথা বলত। যেটা সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষের পক্ষে শোনা সম্ভব হতো না।
এক দিন দুই দিন করে যখন বুকের ছাই চাপা আগুন চার দেয়ালের বাইরে বের হলো, তখনই অপবাধ জুটল, আমি দুশ্চরিত্রা। বিয়ের ছয়মাস না যেতেই স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছি।
প্রচণ্ড অভিমানে কষ্টে আমি পাথর হয়ে গেলাম, তাই কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ তুলতে চাইনি, কারণ প্রমাণ করতে পারব না।
আর যাকে বিয়ের আসরে ভালোবেসেছি তার অসম্মানও করতে চাইনি।
তাই সকল অপবাধ মাথায় করে আমি এক কাপড়ে বেরিয়ে এলাম শ্বশুর বাড়ি নামক জেলখানা থেকে। তখন ছিলাম আমি বাইশ বছরের তরুনী।
আজ বায়ান্ন বছর বয়সে যখন মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে আমি ছেলে পক্ষের কাছে ছেলের ফার্টিলিটি সনদ সবার আগে চাই, তখন অনেকেই আমাকে ছিঃ ছিঃ করছে।
এ নিয়ে মেয়েটার নিশ্চিত তিনটি বিয়ে ভেঙেও গেছে পাকা কথা বলার পর। আমি চাই আরও হাজারটা বিয়ে ভাঙুক, তবে বিবাহিত জীবন নয়।
যে ছেলে আমার মেয়ের বর হবে, তাকে অবশ্যই তার শারীরিক সক্ষমতার সনদ দিতে হবে।
কারণ ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।
আমি এত বড় সাহস করতে পেরেছি, কারণ আমার পাশে আছে মেয়ের বাবা। যিনি পঁচিশ বছর আগেও সব জেনেশুনে আমার পাশেই ছিলেন। আমার ভেঙে যাওয় সংসার হেরে যাওয়া জীবনকে ভালোবেসে জড়িয়ে দিয়েছেন সুখের পরশে।
আমার আবার বিয়ে হলো, সংসার হলো,আমি সন্তানের মাও হলাম। তারপরও আমি ত্রিশ বছর আগের সেই বিভিষিকাময় ছয়টা মাস ভুলতে পারিনি।
তাই বাইশ বছরের তরুনী আমি যে ব্যাপারটাকে ভয় পেয়েছি, বায়ান্ন বছরের পৌঢ় আমি আর নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে সেই একই ভুল করব না।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply