হঠাৎ করে জেবা’র খুবই আরাম লাগছে। নিজেকে কেমন জানি ফুরফুরে লাগছে,জেবা কিচেনে গিয়ে নিজের জন্য একমগ কফি বানিয়ে আনলো। সিয়াম মনে হয় আড় চোখে ওকে একবার দেখলো অন্য সময় সিয়ামের সাথে ঝগড়া হলে জেবা গেস্ট রুমে দরজা লাগিয়ে বসে থাকে সেদিন কিছুই খায় না। আর আজ ঝগড়ার এক ঘন্টার মধ্যে নিজের জন্য কফি সাথে বিস্কুটের কৌটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো।
কফি খেতে খেতে জেবার মনে হচ্ছে, আরে এই আমি এত দিন ধরে কেন এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করছি? কেন একটা সহজ সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না?কেন সব সময় সিয়াম এ-র ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে পড়ে ছিলাম?
সিয়ামের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ শুধু সিয়ামে’র ভালো লাগা, মন্দ লাগা, কে কি বলবে? সিয়াম দের বাসায় নিয়ম এটা, সিয়াম ঝাল খেতে পারে না, তাই ঝাল খাওয়া বন্ধ! সিয়ামদের বাসায় সবজি দিয়ে মাছের তরকারি রান্নার নিয়ম নাই তাই জেবা’র প্রিয় ঝোল তরকারি খাওয়া বন্ধ। বিয়ের পরে জেবা’র নিজের পছন্দ অপছন্দ সব কি ভাবে হারিয়ে গেলো!
জেবা পছন্দ করে বাগান করতে, সিয়াম তাঁর গাছের দিকে তাকিয়ে বলবে বারান্দা তো জঙ্গল বানিয়ে ফেলেছো! এগুলো জেবা মুটামুটি ভাবে মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু দিন-দিন সিয়ামের আচরণ ভালো হওয়া তো দূরের কথা।সিয়ামের সব কিছু মেনে নেওয়াতে ওর মধ্যে একটা হুকুম দেওয়ার প্রবনতা বেড়ে গেছে। সিয়ামের ধারণা জেবা কে বিয়ে করে সিয়াম জেবা কে জাতে উঠিয়েছে।
ইদানিং মনে হয় সিয়াম আরো নিশ্চিন্ত হয়েছে জেবার বিষয়ে। যেহেতু তাঁদের বাচ্চা নাই আর যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে তাঁর, এখন তো আর সিয়াম কে ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন কারণই নাই। যখন অল্প বয়স ছিলো তখন হয়তো ওকে ছেড়ে চলে গেলে, আবার নতুনভাবে নতুন জীবনে জড়ানো যেতো। বাচ্চা না হওয়ার কারণ তো সিয়ামের সমস্যা। তা না হলে কবে জেবা কে ডিভোর্স দিয়ে দিতো।
সিয়াম সব সময়ই জেবা কে বলবে,” আমার ব্যবহার ভালো না লাগলে চলে যা-ও।দেখো কোথায় গিয়ে থাকতে পারো! তোমার ভাই এর বাসায় তো একবেলা থাকলে আরেক বেলা বাসায় এসে বলো, আর যাবো না ঐ বাসায়।” আসলে সিয়াম এর সাথে বিয়ের পর থেকেই জেবা তার পরিবারের সব কিছু শেয়ার করতো সিয়ামের সাথে ভালো মন্দ সব দিক। জেবার সব সময় মনে হতো হাসবেন্ড হলো সব চাইতে বড় বন্ধু যে তার ভালো লাগা মন্দ লাগা সব কিছু বুঝবে। তাকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিবে। আর বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো টা সিয়াম তার দুর্বলতা নিয়ে সময় সুযোগ বুঝে আঘাত করে।
সিয়ামের ধারণা জেবা কে সব সময় টাইট দিয়ে রাখতে হবে সারাক্ষণ দোষ খুঁজে বেড়ায়। সব চাইতে খারাপ লাগার বিষয় হলো জেবা’দের বাসায় গিয়ে সিয়াম যত আপ্যায়ণ পাক না কেন, বাসায় এসেই জেবা কে ওদের বাসার লোকজন কিছু জানে না, এটা সেটা দোষ ধরে জেবা কে অপমান করবে। জেবাদের বাসার কোন খাবার কিন্তু সিয়াম একটুও কম খাবে না যথেষ্ট পরিমানে তৃপ্তি নিয়ে খাবে। কিন্তু বাসায় এসে এমন কিছু সাধারণ বিষয় নিয়ে বার বার কথা বলবে যে, জেবা তখন রেগে গিয়ে বেফাঁস কিছু বলে বসবে। আর সেটা নিয়ে চলবে সারারাত কথা বলে বলে জেবার জান বের করে দেওয়া।
জেবা মুটামুটি ভালো জব করে জেবাকে সকালে উঠে অফিসে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে সিয়াম বিজনেস করে তার নিজের অফিস যখন খুশি তখন গেলেই হয়। কিন্তু সিয়াম রাতে তাকে একটুও ঘুমাতে দিবে না। ঘুরিয়ে, ঘুরিয়ে একই কথা বার বার বলবে।জেবা যে একদম ঝগড়া করে না, তা না। তবে জেবা যথেষ্ট পরিমানে চেষ্টা করে সহনশীল হয়ে থাকতে। এর পেছনে একটাই কারণ জেবা চায় একটা সংসার। একটা ছাদ, যে ছাদের নীচে সে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারবে। দিন শেষে একটা মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে তারা দু’জন গল্প করবে ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে। একজন আরেকজনের অবলম্বন হবে শেষ বয়সে।
জেবা তার মা’কে দেখেছে তার মা কখনো শান্তি পায় নাই তার বাবাকে ছেড়ে এসে। জেবা হওয়ার পরে জেবার মায়ের সাথে জেবার বাবা-র ডিভোর্স হয়ে যায়। কারণ জেবার মা ছিলো প্রচন্ড রকমের স্বাধীন চেতা ও আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন মানুষ। জেবার মা জেবার বাবা-র একটা অন্যয় কাজ কে মেনে নিতে পারে নাই। তা হলো জেবার বাবা-র অফিস সহকারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক। জেবার মা যখন বিষয় টা জানতে পারে তখন জেবার বয়স তিন বছর। তার পরেও জেবার মা জেবার বাবা কে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় জেবার নানার বাসায়। জেবার বাবা জেবা কে তার মায়ের সাথে যেতে দেয় নাই তখন এত কোট -কাচারি করে বাচ্চা’র অধিকার পাওয়ার বিষয় টা ছিলো না।
জেবা’র বাবা নতুন করে বিয়ে করে আবার। জেবার নতুন মার সাথে জেবার ভালো- মন্দ কোন রকমের সম্পর্কই ছিলো না। জেবা কে তার নতুন মা কখনো বকাও দিতো না। আবার আদরও করতো না।নতুন মায়ের সাথে জেবার সম্পর্ক ছিলো আবেগ হীন। জেবার নতুন মায়ের ঘরে জেবার একটা ভাই হয়। জেবার সব টান মায়া চলে যায় তার ভাই এর প্রতি জেবা তার ছোট ভাই টিকে খুবই ভালোবাসতো এখনো বাসে।ছোট ভাই টার জন্মের পর থেকে জেবার মনে হতো , সে আর তার ভাই মিলে একটা পরিবার বাবা আর নতুন মা আরেক দলে। জেবার নতুন মা এখন আর বেঁচে নাই। জেবার নতুন মা সব সময় তার ভাই জুবায়ের কে বলতো,” জুবায়ের জেবা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন তোর কোন চিন্তা নাই ,তোর বোন তোকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবে বাবা আর তুই কখনো জেবা’র মনে কষ্ট দিস না বাবা। “
না জুবায়ের কখনো জেবা’ কে কষ্ট দেয় নাই। আর সেই কারণেই সব সময় সিয়ামের অপমান কর আচরণ গুলো মেনে নেয় জুবায়ের। কিছুই বলে না বোনের সুখের জন্য। কিন্তু তার পরেও কি জেবা সুখী হয়েছে? না! জেবা সুখী না এর একটাই কারণ তার মা তাঁকে ফেলে ছোট বেলা চলে গিয়েছে। তার মা ভালো মেয়ে মানুষ হলে স্বামীর সংসার বাচ্চা ফেলে ডিভোর্স নিয়ে চলে যেতো না! এই একটা কারণ জেবার জীবনে বার বার ফিরে আসে।
একবার তার শাশুড়ীর কথায়, আর একবার তার স্বামীর কথায়। জেবা তাদের এই কথার উত্তরে কি বলবে? তার বাবা-র বদনাম! তার মায়ের নির্দোষ প্রমাণ করে কথা! সিয়ামের আচরণে যখন জেবা অসহ্য হয়ে বলে উঠে – সিয়াম তোমার এই আচরণ আর সহ্য করা আমার পক্ষে অসম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে সিয়াম বলে উঠবে, “আমার আচরণ অসহ্য লাগলে চলে যা-ও, আর তোমার পরিবার থেকে তো জন্মের পরেই শিক্ষা পেয়ে গেছো ডিভোর্সের ” জেবা সব সময় ভাবে সিয়াম – সিয়ামের পরিবার বা তার বন্ধু’দের পরিবার সবাই কি মজা পায় তার এই দুর্বলতায় আঘাত দিয়ে? একটা বাচ্চা ছোট বেলা থেকে তার মা – বাবা-র ডিভোর্স এর ফল ভোগ করছে! যেখানে জেবার কোন ভূমিকা ছিলো না।জেবার বাবা-মা র ডিভোর্স এর ফলে কেউ যদি কোন রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে সে জেবা। আর এখনো সেই একই কারণে জেবা কেই দোষী করা হয় এ কেমন বিচার!!
জেবার মা তার বাবা-র অন্যের প্রতিবাদ করেছে। আর তার ফলে জেবার মায়ের শাস্তি কম পেতে হয় নাই। জেবা কে জেবার বাবা তার নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। জেবা কে দেখার জন্য জেবা’র মায়ের অনেক কষ্ট করতে হতো।জেবা কে জেবার এক ফুপু এসে তার বাসায় বেড়াতে নিয়ে যেতো সেখানে জেবার মা এসে মেয়ের সাথে দেখা করতো।
এক সময় জেবার মা তার এক মামার সহায়তায় কানাডা চলে যায়। সেখানে তিনি বিয়েও করেন। জেবার মা জেবার জন্য কয়েক বার ভালো অংকের টাকা পাঠাতে চেয়েছে জেবা নেয় নাই। জেবার সব মনে সময় তার মায়ের উপরে একটা রাগ কাজ করে মনে হয় তার মার কারনে জেবার জীবনটা এমন হয়ে গেছে সবাই জেবা কে কথা শোনায়।
কয়েক দিন আগের কথা জেবা সিয়াম কে কথায় কথায় বলে যে – মা আমাকে একটা ফ্লাট কেনার টাকা পাঠাতে চাইছে।
সিয়াম এই কথায় বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে এবং বার বার জানতে চায় বলে,
– কত টাকা উনি পাঠাতে চাইছে? কি ধরনের ফ্লাট কিনে দিবে?
জেবা সিয়ামের আচরণের পরিবর্তন দেখে অবাক হয়! যে সিয়াম উঠতে বসতে জেবার মা’কে নিয়ে জেবা কে খোটা দেয় ছোট করে। সে তার মায়ের ফ্লাট কিনে দেওয়া নিয়ে বেশ আনন্দিত। জেবা তখন বলে,
– ফ্লাট তো আমি নিবো না আমার মা’র কাছ থেকে, আর তুমি সারাক্ষণ আমার মা’কে নিয়ে বাজে কথা বলো এখন তার টাকায় ফ্লাট কেনার জন্য হিসাব নিকেশ করা শুরু করেছো!
এই কথার পরে এক কথা দুই কথা বলতে বলতে বিশাল ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। তার পর সিয়াম আবার বলে, ” ভালো না লাগলে চলে যা-ও রাস্তা খোলা আছে।”
জেবা’র মনে আজ অনেক শান্তি লাগছে। কারণ জেবা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে তার মতো করে তার ভালো লাগা কে মূল্য দিয়ে চলবে। এতে করে যদি একাও হতে হয় তবে তাই হউক। আর কত শুধু মাত্র সংসারের শান্তির জন্য নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা বিসর্জন দিয়ে অপমানের জীবন যাপন করা! এর চাইতে এই ভালো জেবা তার নিজের মতো করে চলবে। যদি এতে করে সিয়ামের তাকে সহ্য না হয় তবে সিয়াম তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তার আর কোন দায় নাই!অনেক চলা হয়েছে সিয়ামের পছন্দ অনুযায়ী তার একফোঁটা মূল্য সিয়াম তাকে দেয় নাই।
জেবা বসার ঘরে এসে সিয়ামের সামনে বসে জুবায়ের কে কল দেয়।তার পর জুবায়ের কে বলে,
– জুবায়ের আমার বাসায় চলে আয় আজ রাতে আমকে পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খাওবি।জুবায়ের তো জেবার কথা শুনে অবাক! কারণ গত সপ্তাহে জুবায়ের জেবা কে সিয়ামের সামনে বলেছিলো “আপা চল আমরা তোর বিয়ের আগের মতো পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খেতে যাই,”এই কথা জুবায়ের বলার সাথে সাথে সিয়াম বলে উঠে “তোমাদের ভাই – বোনের রুচি দেখে আমি অবাক হই,এত ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে রেখে পুরাতন ঢাকার নোংরা গলির দোকানে বিরিয়ানি খেতে যাবে!” জুবায়ের মুখ সঙ্গে সঙ্গে অপমানে ছোট হয়ে যায়। জুবায়ের আস্তে করে বলে,” সিয়াম ভাই পুরাতন ঢাকারও অনেক ভালো রেস্টুরেন্টে আছে।” সিয়াম সেই কথা শুনেও নাই এমন ভাব করে। জেবা কে জুবায়ের বলে, ” আপা সিয়াম ভাই রাগ করবে না তো?” তখন জেবা সিয়াম কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
– জুবায়ের সিয়াম আমাদের সাথে যাবে না। আমি যাবো
শুধু। তুই আর সিমু এসে আমাকে নিয়ে যাবি বলেই জেবা কল কেটে দেয়।
সিয়াম আর থাকতে না পরে জেবা কে বলল,
– আমার অনুমতি না নিয়ে জুবায়ের কে আসতে বলেছো কেন?
জেবা সুন্দর করে বলল,
– আমার অনুমতি নিয়ে কি তুমি তোমার বোন বা তোমার বন্ধু’দের দাওয়াত করো?নাকি আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করো? আমি এখন থেকে তোমার কাছ থেকে যে আচরণ গুলি শিখেছি তাই করবো, আর শোন তুমি তো ১০০% সঠিক তাই তোমার আমার সাথে করা আচরণ গুলিও সঠিক। তার পরেও বলি আমি কখনো তোমার মতো আচরণ করবো না তবে আমি আমার ভালো লাগা গুলোর মূল্য এখন থেকে দিবো!
– আর শোন আমাকে ডিভোর্স দিতে বলবে না। আমাকে যদি তোমার ভালো না লাগে তা হলে তুমি তোমার মতো ডিসিশন নিতে পারো। এক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নাই।
Leave a Reply