গতবছর নভেম্বার মাসের ৫ তারিখে এক প্রতিবেশি ভাবী মারা গেছেন। হঠাৎ করে ঘুরে পড়ে গেছেন,
সাথে সাথে মৃত্যু। হাসপাতালে নেয়ার সময়টুকুও পরিবারের সদস্যদের দেননি। অথচ সারাদিন তিনি কাজ করেছেন। গোসল করেছেন,নামাজ পড়েছেন। খেতে বসার আগেই আকস্মিক মারা গেলেন। বয়স বেশি না। ৫০ বা ৫২ হবে এমন।
ভাইয়া ভাবীর দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। এটা আত্মীয়- স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই জানেন। সমস্য এত প্রকট যে তারা কোনো ভাবেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারেননি। সমস্যা যতটা প্রকট বলছি, ততটা প্রকটও নয়। কারণ যতই মনোমালিন্য থাক, তারা কিন্তু একজন অপরজনের পরিপূরক ছিলেন। সারাদিন কথা কাটাকাটির পরেই তারা রাতেরবেলা একসাথে একই বিছানায় ঘুমাতে যেতেন। ভাইয়া আবার ভাবীর হাতের রান্না ছাড়া খেতেও পারতেন না।
ভাবীর আকস্মিক মৃত্যু, ভাইয়ার সেইসময় নির্বিকার হয়ে থাকায় প্রতিবেশিদের অনেকেই আলোচনা করতে শুনলাম।
ভাবীর মৃত্যুতে ভাইয়ার কোনো কষ্টই হয়নি কারণ পুরো দাম্পত্যজীবন তাদের জগড়া দিয়েই কেটে গেছে। ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে মোটেও সুখি ছিলেন না। অনেকেই নিজের মতো ধারনা করছেন, ভাইয়া ৪৫ দিন না যেতেই বিয়ে করে ফেলেবেন।
অথচ ৪৫ দিন গিয়ে ১৪মাসও চলে গেলে ভাইয়া কিন্তু বিয়ে করেননি।
আজ রাতেরবেলা আমরা বাচ্চাদের দেখতে তাদের বাসায় গেলাম। বাচ্চারা কিন্তু মোটেও ছোট না। বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে মাস্টার্সে পড়ে। ছেলেরাও বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে। পথিমধ্যে গেটের সামনে ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি আমাদেরকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসালেন। আমরা দু’ঘণ্টা ছিলাম। পুরোটা সময় ধরে তিনি ভাবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। একজন মানুষ নিভৃতে তার মৃত প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি এতটা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা লালন করেন, তিনি নিজ মুখে না বললে কখনোই আমাদের বিশ্বাসই হতো না।
আমরা চারজন মহিলার সন্মুখে ৬০ বছর বয়সী একজন পুরুষ শিশুর মতো শব্দ করে কান্না করলেন। ভাবীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখনো কাউকে স্পর্শ করতে দেননি। ভাবীর রুমে এখনো দরজা বন্ধ করে রাখেন, কাউকে ডুকতে দেন না। তিনিই কেবল মাঝেমধ্যে কিছুটা সময় নিজের মতো করে কাটিয়ে আসেন।
তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে স্ত্রীর সমস্ত গুনাহ মাপ করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
আমরা বিস্মিত হলাম, মানুষের জানার মাঝে, দেখার মাঝে কত ভুল থাকতে পারে।
ভালোবাসা এমন একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। সারাক্ষণ লুতুপুতু করলেই যে ভালোবাসা থাকে, সেটা নাও হতে পারে। আবার সারাক্ষণ খুনসুটি করলেই যে ভালোবাসা নেই সেটাও না।
আমি নতুন বছরে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা করি। কন্যার বাবার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।
স্বামী তার স্ত্রীর জন্য কান্না করছেন, প্রার্থনা করছেন এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য মনে হয় পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।
Leave a Reply