1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৫৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বাবা – – – – – জেবুন্নেসা কাকলী “সাজাবো” – – – – ডাঃ ফিরোজ খান বশেমুরকৃবি শিক্ষক সমিতি নির্বাচন ২০২৫ এ প্রফেসর ড. মোঃ আবু আশরাফ খান সভাপতি ও প্রফেসর ড. মোঃ মসিউল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত এই (বাড়ি ও জমি এবং জমিসহ বাড়ি) গুলো বিক্রয় হবে গল্প – – সোনালী বিকেল – – – – সুবর্ণা রায় গণতন্ত্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো আলোচনা – – – – ফাতেমা বেগম শীতের গীত – – – – আলেয়া আরমিন আলো নতুন প্রজন্মের আস্থার প্রতিক আব্দুল লতিফ ………………………………………………… টাঙ্গাইলের মধুপুরে বন-বিভাগের উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভা ৩০ ডিসেম্বর–২০২৪, স্বাধীন আজম,  টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি  ওয়াটসঅন অ্যাওয়ার্ডস ও আইটি সার্টিফিকেশন ২০২৫ ………………………………………

।। একজন ‘রমা রায়’-এর সন্ধানে…………।।

  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৮৭ বার

‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই……’ গানটি শোনেননি কিংবা গুণগুণ করেননি কোনদিন, এমন শ্রোতা দুই-বাংলায় বিরল! গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও সুপর্ণকান্ত ঘোষের (মতান্তরে সুপর্ণকান্তি ঘোষ) সুরে এই গানটি গেয়েছিলেন কিংবদন্তী শিল্পী মান্না দে। এই গানটি নিয়ে মান্না দে’র সাথে আমার একটি চমৎকার স্মৃতি আছে। ব্যাপারটি একটু শেয়ার করতে চাই আপনাদের সাথে।

সময়টি সম্ভবত আশির দশকের মধ্যভাগ! টেলিভিশনে অভিনয়ের পাশাপাশি আমি তখোন- বিয়েবাড়ি, অফিস-পাড়া আর বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়াম ভিডিওতে ধারণ করে দিয়ে পেট চালাই। ভিএইচএস (VHS) ক্যামেরা তখোন আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনে জেঁকে বসেছে। প্রায় প্রতিটি ‘বিয়ে’তে ভিডিও ধারণ করা চাই তখোন। নইলে বর-বধু বিয়েই করবেনা যেনো  ! সেই সুযোগে, আমাদের আয়-রোজগারও মোটামুটি হচ্ছিল ভালোই!
ঠিক ওই সময়েই আমার সাংবাদিক বন্ধু আকবর হায়দার কিরণ (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) আমাকে একটি ‘খ্যাপ’ এনে দেন! কিরন বলেন- ‘আগামী এত তারিখে (তারিখটা মনে নেই) ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বাসায় পশ্চিম বঙ্গের শিল্পী মান্না দে গান গাইবেন। অনুষ্ঠানটি ওঁরা ভিডিওতে ধারণ করে রাখতে চান। আমাকে বলেছে্ন একজন ভালো ভিডিওগ্রাফার জোগাড় করতে। আমি আপনার কথা বলায় ওঁরা রাজী হয়েছেন। দশ হাজার টাকায় রফা করেছি প্রোগ্রামটা। এই নিন পাঁচ হাজার টাকা এডভান্স! চলবে তো, নাকি চলবেনা?
‘আবার জিগায়’- মনে মনে বলি! একটি সন্ধ্যার, একটি-মাত্র অনুষ্ঠান ভিডিওতে ধারণ করে দেবার সম্মানি- দশ হাজার টাকা! বাহ! ১৯৮৬-’৮৭ সালে এটা তো অনেক বড়ো অংকের টাকা (অন্তত আমার জন্য)! আমি তখোন তখোনই রাজী হয়ে যাই। এডভান্সের টাকাটা নিয়ে কিরনকে বগলদাবা করে চলে যাই ‘স্যুং গার্ডেন’ রেস্টুরেন্টে। তখোন চৈনিক খাবারের জয়-জয়কার চলছে! ** বলে রাখা ভালো- আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং আকবর হায়দার কিরন আবার ‘দেশী-ভাই’ (নোয়াখাইল্যা)  !
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন- সেবারে আজাদ যশোরী নামের একজন ‘ইভেন্ট এরেঞ্জার’ মান্না দে এবং পুলক বন্দোপাধ্যায়কে বাংলাদেশে এনেছিলেন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে। তার কিছুদিন পরে হেমন্ত মুখার্জিকেও তিনি এনেছিলেন গান করতে। যদিও সে যাত্রায় যশোরীকে জেল খাটতে হয়েছিল হেমন্ত বাবুকে অসম্মান এবং চুক্তির বাইরে কষ্ট দেবার জন্য। সে যাক।
যথাদিন যথাসময়ে আমি ‘লটঘট’ নিয়ে চলে যাই আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বাসায়। সন্ধ্যার একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম রেকর্ডিং-এর যথাযথ প্রস্তুতি নেবার জন্য। কিন্তু এত আগেভাগে এসেও দেখি- বসবার ঘরটি দর্শক শ্রোতায় ভরে গেছে অনেকটাই! সবাই সুবিধাজনক স্থানে বসে মান্না দে’কে উপভোগ করতে চান! অতিথিদের চোখেমুখে অনামিক এক উত্তেজনার ছাপ! দু’একজন তো মুখ ফুটে বলেই ফেললেন- ‘এত দেরি কীসের, আসে না কেনো মান্না দে’?
যন্ত্রশিল্পীদের সাথে নিয়ে মান্না দে এলেন সূর্য ডোবার একটু পরেই। বসার ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই শিল্পীর ওপরে! শিল্পীর সাথে হাত মেলানোর একটা মিনি-প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো যেন। অনেকেই অটোগ্রাফের খাতা মেলে ধরেন কিংবদন্তী এই শিল্পীর সামনে। শীতল মাথায় শিল্পী অটোগ্রাফ দিতে থাকেন। কয়েকটা সই দেয়ার পর মান্না দে বলেন- বাকীগুলো গানের পরে দেই? মহা-উত্তেজিত অনুরাগীদের ক’জন অগত্যা কাচুমাচু হয়ে শিল্পীর কাছ থেকে সরে আসেন। বসে পড়েন নিজ নিজ জায়গায়।
দর্শকের বসার জায়গা হয়েছে ফ্লোরে, কার্পেটের ওপরে। শিল্পী বসেছেন একটি সিঙ্গেল চেয়ারে। হারমোনিয়ামটি রাখা হলো তাঁর সামনে একটি তেপায়ার ওপর। তবলাবাদক (তবলা নেওয়াজ) বসলেন কার্পেটের ওপরে। গীটার এবং পিয়ানো একর্ডিয়ান নিয়ে দু’জন বসলেন মান্না দে’র দু’পাশে। আরেকটু দূরে কী-বোর্ড নিয়ে বসেছেন আমাদের দেশেরই একজন তরুণ (সেই সময়ের) কম্পোজার (নামটি মনে আসছেনা বলে দুঃখিত)। শিল্পী-দর্শক সবার হালকা ‘জলপান’শেষে এলো কাঙ্ক্ষিত সেই লগ্ন। শুরু হলো মান্না দে’র গান।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আমি মান্না দে’র গান শুনেছি কলের গানে, রেডিওতে; ক্যাসেটে শুনেছি স্বাধীনতার পরে। কিন্তু সামনাসামনি তাঁর গান শোনার অভিজ্ঞতা- সেটা ছিল ‘ওই প্রথম’! ফলে আমি নিজেও ছিলাম উত্তেজনায় বেশ উষ্ণ! হৃদয় ছিল আবেগে ভরপুর।
সর্ব প্রথম কোন গানটি দিয়ে মান্না দে সেদিনের অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন- ৩৮/৩৯ বছর পরে সেটা আজ আর সঠিক মনে করতে পারছিনা! তবে ‘টেপ’টা চালিয়ে দেখতে পারলে অবশ্য বিষয়টি আপনাদের জানাতে পারতাম! সেবারে ক্যামেরা নিয়ে আমি মান্না দে’র সাথে বোধহয় ৪/৫ দিন কাটিয়েছি মহা উত্তেজনায়! উনার কিছু কথাবার্তাও সে সময়ে ধারণ করে রেখেছিলাম। জানিনা, তিন যুগ পরে টেপগুলোর ‘মান’ কী অবস্থায় আছে!
তবে কিংবদন্তী এই শিল্পী একটার পরে একটা গান করে যাচ্ছিলেন- যার প্রতিটি লাইন আমার মতো অনুরাগী-শ্রোতাদের ঠাঁঠা মুখস্থ। ললিতা গো, ও চাঁদ সামলে রাখো, সুন্দরী গো, আমার একদিকে শুধু তুমি, সবাই তো সুখী হতে চায়, তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন, ও কেনো এত সুন্দরী হলো, আমি যে জলসা ঘরে-সহ অনেকগুলো গান গাইলেন শিল্পী। সাথে অবশ্য বেশক’টা হিন্দী গানও শুনিয়েছিলেন মান্না দে। ‘ইয়াশোমতি মাইয়াসে……’ গানটি তিনি একাই গাইলেন দর্শকদের অনুরোধে (মূল গানটি লতা মঙ্গেশকরের সাথে তাঁর দ্বৈতকন্ঠে)! এটা ছাড়াও আরো বেশক’টা হিন্দী গানও পরিবেশন করলেন মান্না দে।
মাঝখানে একটা চা-বিরতি দিয়ে শিল্পী প্রায় আড়াই-তিন ঘন্টার মতো গান গেয়েছিলেন সেদিন- সমজদার শ্রোতা পেয়ে! বন্ধুগণ- কলের গানে নয়, ক্যাসেটে নয়, রেডিওতে নয়- জলজ্যান্ত মান্না দে’র সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্জলা গান শুনেছি সেদিন! এমন সৌভাগ্য ‘এপার বাংলা’র খুব বেশীজনের নেই বোধহয়! তাও আবার শুধুমাত্র শোনা নয়, তাঁর গান রেকর্ডও করে গিয়েছি ধুমসে! সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বটে!
অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে শিল্পী পরিবেশন করলেন তাঁর গাওয়া কালজয়ী গান- ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা……’। এই গান পরিবেশনের সময় উপস্থিত সকল শ্রোতা নিজেরাই শিল্পী হয়ে উঠলেন হঠাৎ করেই! মান্না দে’র সাথে সবাই সুরে-বেসুরে গলা মিলিয়ে গানটাকে একটা ‘সমবেত সঙ্গীতে’ পরিণত করে দিলেন আর কী  ! যদিও এর আগের গানগুলোতেও শ্রোতারা কমবেশী গলা মেলাবার চেষ্টা করছিলেন; কিন্তু সেটা ছিল একটু হালকা চালে! ‘কফি হাউজের’ গানটাতে শিল্পীর সম্মতি পেয়ে সবাই গলা ছেড়ে গাইলেন সেদিন!
বিগত এতগুলো বছরে এই গানটি (কফি হাউজের……) প্রায় কয়েক’শ বার শুনেছি- কারনে অকারনে, ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়! লক্ষ্য করেছি এ গানের বাণী ‘বাঙালি-শ্রোতাদের’ ভীষণ স্মৃতিকাতর করে তোলে! ‘আড্ডা’ বিষয়টি পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশী আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ‘বাঙালি-মধ্যবিত্তের’ আড্ডার যে ‘রঙ’ যে উপাদানগুলো আছে, সেগুলো অন্য ভাষা কিংবা অন্য জল-হাওয়ার সংস্কৃতিতে- আড্ডায় কতখানি বিরাজমান- সে নিয়ে আমার অন্তত সন্দেহ আছে!
কালজয়ী লেখক বুদ্ধদেব বসু- ‘আড্ডা’ নামে একটি নিবন্ধ রচনা করেছিলেন সেই চুয়াল্লিশ (১৯৪৪) সালে (ইন্টারনেটে আছে)। আমার কলেজ জীবনে (সত্তর দশকের মাঝামাঝি) ওই নিবন্ধটি পড়বার সুযোগ হয়েছিল। বলা যায়- সেই তখোন থেকেই আমি ওই ‘আড্ডা’র মহাসাগরে ভাসছি  ! কবে যে ডুববো- কে জানে!
সেই নিবন্ধের এক জায়গায় বুদ্ধদেব বাবু লিখেছেন- “অত্যন্ত হাসি পায় যখন শুভানুধ্যায়ী ইংরেজ আমাদের করুণা করে বলে- আহা বেচারা, ক্লাব কাকে বলে ওরা জানে না। আড্ডা যাদের আছে, ক্লাব দিয়ে তারা করবে কী? আমাদের ক্লাবের প্রচেষ্টা কলের পুতুলের হাত-পা নাড়ার মতো, ওতে আবয়বিক সম্পূর্ণতা আছে, প্রাণের স্পন্দন নেই!
…………আড্ডা জিনিশটা সর্বভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশের সজল বাতাসেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায়, তেমনি আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল- সবই আড্ডার নীরব ঘন্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায়না।
যে-সব দেশে শীত-গ্রীষ্ম দুই অতি তীব্র বা বছরের ছ-মাস জুড়েই শীতকাল রাজত্ব করে, সেগুলো আড্ডার পক্ষে ঠিক অনুকুল নয়। বাংলার কমনীয় আবহাওয়ায় যেমন গাছপালার ঘনতা, তেমনি আড্ডার উচ্ছাসও স্বাভাবিক।
ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশংকা করেছিলেন যে- আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হ’লো। তাই শুধু উপাসক হয়ে আমার তৃপ্তি নেই, পুরোহিত হয়ে তার মহিমা প্রচার করতে বসেছি………।” বুদ্ধদেব বাবু গুরুজন, নমস্য ব্যক্তি- প্রাতঃস্মরনীয়। উনার পর্যবেক্ষণের বাইরে যাবার কোন জো নেই। বুদ্ধদেব বাবুর কথার খেই ধরে ফিরে আসি মান্না দে’র গানে।
‘কফি হাউজের সেই আড্ডা’ গানটি রচনা করার সময় গৌরী প্রসন্ন মজুমদার ঠিক কাকে দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। অর্থাৎ তিনি কোলকাতার ‘কফি হাউজ’ নাকি হাউজের ভেতরে ‘রোজকার আড্ডা’টা দিয়েই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সেটা সহজেই বোধগম্য। এখানে ‘কফি হাউজ’ একটি স্থান মাত্র, মূল উপাদান কিন্তু রোজকার আড্ডা’টাই।
গানটির ভেতরে গীতিকার যে ক’টা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন- তার প্রতিটিই নেহায়েত আটপৌরে বাঙালির প্রতিভু। মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিনিধি এরা। নিখিলেশ, মঈদুল, জিসু’দা, রমা রায়, অমল, সুজাতা- এরা সবাই নিখাদ বাঙালি। এদের যাপিত জীবন কিংবা জীবনাচরণের প্রতি ধাপে বাঙালি চরিত্রই কিন্তু উঠে এসেছে গনগনে বাস্তবতায়!
তবে, গানের চরিত্র কিংবা উপাদান হিসেবে- চারমিনার (সিগারেট), বিষ্ণু দে (কবি), যামিনি রায় (চিত্রকর), রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, এমেচার নাটক কিন্তু বাঙ্গালি-মানসকে নিয়ে যায় ফেলে-আসা সেই দিনগুলোতে।
জানিনা, কোলকাতায় ‘চারমিনার’ সিগারেট আজো পাওয়া যায় কীনা! পাওয়া গেলে আমার জন্য দু’প্যাকেট কেউ পাঠাবেন প্লিজ? না, সিগারেট আজকাল টানিনা, চারমিনার কোনদিন ঠোঁটে লাগাবারও সুযোগ হয়নি! তবে চারমিনার পেলে তার একটু গন্ধ নেবো ভেবেছি। তাতে যদি মান্না দে কিংবা গৌরী প্রসন্ন বাবুর একটু ঘ্রাণ পাওয়া যায়; অথবা নিখিলেশ-মঈদুলদের একটু ছোঁয়া যদি পেয়ে যাই- সেই ঘোরেই আগাম বুঁধ হয়ে আছি!
এসব চরিত্রের আনন্দ-বেদনাগুলো তো আসলে এই বৃহত্তর জনপদের মাটি ও মানুষের নিত্যকার সুর, প্রতিদিনের গান। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন থেকে এগুলো আলাদা করার উপায় নেই। এগুলো একেবারেই জীবনঘেঁষা, বাস্তবতার মধ্যিখানে এদের বসবাস।
এই গানে যখন লেখা হচ্ছে- ‘……অমলটা ধুঁকছে দূরন্ত ক্যান্সারে জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়’- তখোন কিন্তু গীতিকার নিজেও ক্যান্সার আক্রান্ত! গৌরী বাবু তখোন নিজেও ধুঁকছেন দূরারোগ্য ক্যান্সারে। প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস! হায়……!
শিরোণামে ‘একজন রমা রায়-এর সন্ধান’ করার কথা দিয়েই কিন্তু লেখাটি শুরু করেছিলাম। জ্বী, অন্যকোন রমা নয়- গৌরী বাবুর রমা রায়ের কথাই বলেছি তখোন। গানের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ অন্তরায় গৌরী বাবু লিখেছেন- ‘অফিসের সোশালে, এমেচার নাটকে রমা রায় অভিনয় করতো; কাগজের রিপোর্টার মঈদুল এসে রোজ কি লিখেছে তাই শুধু পড়তো……।’ এই ‘বর্ণন’ থেকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে- অন্যকাজের পাশাপাশি রমা অভিনয়ও করতেন! তবে, সেসব নাটক আর অভিনয় নিয়ে ‘কাগজের রিভিউ’র প্রতি মঈদুলের নিত্যকার আগ্রহ- যুগপৎ রমা রায় এবং নাটকের প্রতি তার ভালোবাসার কুসুম-গরম উষ্ণতার কথাই নির্দেশ করে; নয় কী  !
কিন্তু গানের প্রথম অন্তরায় গোরী বাবু লিখেছেন- ‘……কাকে যেনো ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে পাগলা গারদে আছে রমা রায়’! ** জ্বী হ্যাঁ, রমা রায়ের এই ‘পরিণতি’টি নিয়ে দু’টি কথা বলার জন্যই আসলে এতক্ষণ একটি গৌর চন্দ্রিকা (মুখবন্ধ, আসল কথা বলার আগে অতিরিক্ত অন্য কথা বলা) দিয়েছি  অন্যকিছু নয়!
আমার বড়ো আক্ষেপ, ‘কাউকে ভালোবেসে’ আজকাল আর কেউ পাগল হয়না! আমরা কমবেশী সবাই অর্থ-বিত্তের পেছনে ছুটছি কেবল! এখানটায় বড়ো আফসোস হয় আমার। লাইলী-মজনু শিরি-ফরহাদ কিংবা চণ্ডীদাস-রজকিনীর কথা নাইবা আনলাম; দেবদাস-পার্বতীরাও আমাদের বাঙালি সমাজ থেকে উধাও হয়ে গেলো! এটা মনতে খুব কষ্ট হয়!
শুনেছি, আজকাল ওসব ‘ধ্রুপদী প্রেম’ নাকি বড়ো সেকেলে! সেদিন সান্ধ্য-আড্ডায় এক তরুণ তুলে ধরছিলেন পোস্ট-মডার্ন প্রেমের একটি ‘ডিজিটাল রূপ’। একটা উদাহরণ দিয়ে তরুণ বললেন- ‘ধরুন, পটলা আর খেঁদি’র আজ ডেট করার কথা রমনা পার্কে, সন্ধ্যা সাতটায়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পরেও দু’জন ফ্রি হতে না পেরে একজন অন্যজনকে ফোনে যা বলছে সেটা এ রকম।
পটলাঃ কীরে খেঁদি, তুই এখনো রমনায় যাস নি?
খেঁদিঃ নারে, পিংকু হঠাৎ ফোন দিয়ে বললো- ওকে একটু সময় দিতে। হাজার হোক ও-আমার ‘এক্স’। ওর কথা তো আর ফেলে দিতে পারিনা! পটলাঃ ভালোই করেছিস, এদিকে আমিও আটকে গিয়েছি আমার এক এক্স-কলিগের সাথে। চাকরিতে থাকাকালে আমদের একটু ইয়ে-টিয়ে হয়েছিল আরকি! হাজার হোক, এক সময় দিলে দিল লাগিয়েছি; ওকে তো আর বিমুখ করতে পারিনা! তাই একটু ইয়ে……! খেঁদিঃ ভেরি গুড, তোর এক্স-এর সাথে কিছুক্ষণ ঠেকা দে, আমি পিংকুর সাথে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিয়েই তোর কাছে চলে আসবো রমনায়। বা…ই!
উপরের কাহিনীটা কিন্তু তরুণ বন্ধুটি সত্যি সত্যিই আমাকে বলেছে একদিন। হয়তো সে নিছক মজা করেছে কিংবা সিরিয়াসলি-ই বলেছে! তবে আমি কিন্তু অতোটা বিশ্বাস করিনি। আমরা এখনো এতোটা ‘ডিজিটাল’ (তথাকথিত) হয়ে গিয়েছি বলে আমি অন্তত মনে করিনা। ** এখানে ব্যবহৃত নামগুলো কাল্পনিক। বাস্তবে ওই তরুণ আমাকে ভিন্ন নাম বলেছিল।
তবে মাস কয়েক আগে এক ভদ্র মহিলার কথা শুনে আমি খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। উনি বললেন- “জানেন, আমার বড়ো মেয়েটি না খুব বোকা-ই রয়ে গেলো। বয়স প্রায় ২৭-এর কাছাকাছি; অথচ আজো কাউকে বিয়ে করলোনা! ওর উচিৎ ছিল তার ‘প্রথম বিয়েটা’ অন্তত সেরে ফেলা। প্রথম হ্যাজবেণ্ডের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে ফিরতে পারলে এর পরের বিয়েগুলোতে আর কোন সমস্যা হতনা।” ভদ্রমহিলার কথা শুনে মনে হয়েছিল- আমাদের সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতার বালাই কি একেবারে উঠেই গেলো!
তবে আশার বিষয় হলো, যত যা-ই বলিনা কেন- আমাদের হৃদয় থেকে প্রেম-ভালোবাসা এখনো উবে যায়নি। আজো মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসে- সেটা যে ‘ফর্মে’ই হোকনা কেনো! জীবন হলো বহতা নদীর মতো। জীবনের চলতি পথে অনেক কিছুর সাথেই যুক্ত হবে মানুষ। এরমাঝে গ্রহন-বর্জন চলতে থাকবে প্রতি নিয়ত। জীবন যাপনের ধরণ, উপাদান আর আচার পাল্টাবে নিজস্ব গতিতেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
তবে যত যা-ই করিনা কেন, ‘গ্রহন-বর্জন’ করতে গিয়ে আমরা এমন কিছু যেন গ্রহন না করি যেটা আমার সাথে, আমার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের সাথে বেমানান। আবার বর্জনের ক্ষেত্রে আমরা এমনকিছু যেন বর্জন না করি- যা বর্জন করলে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই।
গানটির শেষপ্রান্তে গৌরী বাবু লিখেছেন- ‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই……!’ হ্যাঁ, এই জগতে কারো জন্য কোন পেয়ালা কখনোই খালি থাকেনা। খালি থাকেনা আড্ডার টেবিল। নতুনরা এসে পুরনোদের স্থলাভিষিক্ত হয়। নতুন মানুষ নতুন গান গাইতে শুরু করে। পুরনো হয়ে যায় বিষ্ণু দে, চারমিনার কিংবা যামিনি রায়! এটাই নিয়ম জগতের। আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ সান্যালের কথা শুনতে এখন ক’জন মেয়ে ‘চোখভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে’ বসে থাকবে- সেটা একটা প্রশ্ন বটে!
তবে আশান্বিত হই গৌরী বাবুর ওই কথাগুলো ভেবে- যে ক’টা লাইন তিনি লিখেছিলেন গানের একদম শেষে- “কতো স্বপ্নের রোদ উঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়, কতো জনই এলো গেলো কত জনই আসবে- কফি হাউজটাই শুধু থেকে যায়……।”
বাঙালির জীবনে আড্ডা আসলে কোনদিনই থামবেনা! আড্ডার ধরণ বদলাবে, বদলাবে আড্ডার উপাদান। ক্ষতি নেই তাতে। যাপিত জীবনে বড়ো পরিবর্তন এলে, আড্ডার বিষয় কিংবা উপাদানে পরিবর্তন আসবেনা কেনো। তবে ‘রমা রায়’-এর মতো পাগলা গারদে যাওয়া মানুষগুলো যেন মরে না যায় চিরতরে- সেটাই একমাত্র প্রত্যাশা।
————————————-
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে নিয়েছি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..