কোটা সংস্কার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডসহ যেসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, এসব ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি আন্দোলনকারীদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রায় আট মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করলে তা সংঘাতে রূপ নেয়। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার সারা দেশে ছয়জন নিহত হয়েছেন। গতকাল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে আবাসিক হলগুলো খালি করে সরকার।
এই পরিস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আন্দোলনে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি আরও ঘোষণা করছি, হত্যাকাণ্ডসহ যেসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেসব বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের পরিবারের সদস্যের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
যাদের উসকানিতে সূত্রপাত, বের করা হবে
কাদের উসকানিতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো, কারা কোন উদ্দেশ্যে দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল, তা তদন্ত করে বের করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে, তাই সবাইকে ধৈর্য ধরতে আহ্বান জানাচ্ছি।’
আন্দোলনের পেছনে দুষ্কৃতকারীরা আছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, কিছু মহল এই আন্দোলনের সুযোগটা নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এর ফলে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। অহেতুক কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে গেল। আপনজন হারাবার বেদনা যে কতটা কষ্টের, তা আমার থেকে আর কে বেশি জানে?’
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা কখনোই কাম্য ছিল না। চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুড়ে ফেলে অনেক ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। তাদের ওপর লাঠিপেটা এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, একজন মৃত্যুবরণ করেছে, অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। ঢাকা, রংপুর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবন ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়।
সাধারণ পথচারী, দোকানিদের আক্রমণ, এমনকি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে বাধা প্রদান করা হয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেয়েদের হলে ছাত্রীদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আবাসিক হলে প্রভোস্টদের হুমকি দেওয়া ও আক্রমণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়ে তাঁদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে।
‘দুষ্কৃতকারীদের সুযোগ করে দেবেন না’
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় আন্দোলনে নেমে দুষ্কৃতকারীদের সংঘাতের সুযোগ করে দেবেন না। সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য আমি সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’
সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপিল আদালতে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আদালতে শিক্ষার্থীদের কোনো বক্তব্য থাকলে তা শোনার সুযোগ আছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িতদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বলেন, ‘বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সংঘাত ও নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের পরিবারের জন্য জীবন-জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা দরকার, তা আমি করব।’
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা যেকোনো সময় সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি আমার আবেদন থাকবে, তাঁরা যেন তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ থাকেন।’ একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে নজর রাখার আহ্বান জানান তিনি।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল করা হয়েছিল জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোটা বহাল রাখার পক্ষে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের জারি করা সরকারের পরিপত্র বাতিল করে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয় এবং মহামান্য আদালত শুনানির দিন ধার্য করেন। এ সময় আবার ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। তিনি বলেন, এই আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে; বরং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করে। রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
অত্যন্ত বেদনা-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জাতির সামনে হাজির হয়েছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের নানা অর্জনের বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এ সময় বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তি-শান্তিতে ফেরে, তখন মাঝেমধ্যে এমন কোনো ঘটনা ঘটে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
ভাষণের একেবারে শেষের দিকে আবারও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান তিনি।
Leave a Reply