একদিন ঢাকুরিয়া লেকে মর্ণিং ওয়াক করতে করতে শুনতে পেয়েছিলাম একটি ছেলে আর একটি ছেলেকে বলছে, হ্যাঁ ব্বে, আল্ট্রা কিচাইন মাইরি,
কিষনো করলেই লীলা, আর তুই আমি করলেই বিলা।
বিলা শব্দের মানে সত্যি জানতাম না। গুগুল জানালো, বিলানো বা বিতরণ করা।
আশ্চর্য হয়ে ভাবছি কৃষ্ণের মতো একজন বহুবিধ গুণ সম্পন্ন, অত্যন্ত বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ কূটনীতিক, দুরন্ত প্রতিবাদী, রাজনীতির পাশা পালটে দেবার দুরন্ত মেধাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে লোকে কেন শুধু রাস লীলা, বাঁশি বাজিয়ে মেয়ে পটানো এগুলো দিয়ে হাইলাইট করে
আর রাধার পাশে বসিয়ে দোলনায় দোল খাওয়ায়।।
ভাবো একবার,
ওইটুকুন দুগ্ধপোষ্য বেলায় ছেলেটা কামড়ে পুতনা রাক্ষসীর স্তনবৃন্ত কেটে ছিঁড়ে নিলো।
আমাদের পুরাণ অবশ্য বলছে এই যে প্রেমময় রূপের আড়ালে এক লুক্কায়িত সংহারী সত্ত্বা তা আমাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা, লুকিয়ে রাখা বিবিধ দুরাচারের দমন করার একটা ক্লু।।
১.পুতনা —মায়ের ছদ্মবেশে এসেছিল। মা পরম গুরু। তাই পুতনার সংহার ছদ্মগুরুর সংহার।
২.শকটাসুর — আমাদের ভেতরে জমে থাকা গাড়ি বা শকট বোঝাই অহংকার এবং আলস্যের সংহার।
৩. তৃণাবর্তাসুর –বাতাসের ঘূর্ণির মতো আমাদের অন্তরকে মথিত উত্তাল করে রাখা অহংকার এর সংহার।
৪.বৎসাসুর — বাছুর বা শিশুসুলভ ছটফটে অদম্য ছোট খাটো লোভ বা নষ্টামির সংহার।
৫.বকাসুর– ধূর্ততা বা প্রতারণার সংহার।
৬.অঘাসুর — অঘ অর্থাৎ সর্পের মতো অতর্কিত হঠকারী রিপুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল শেখা।
৭.ধেনুকাসুর —আত্মজ্ঞানসম্পন্ন না হয়েও আমাদের ভেতরের সবজান্তা আধ্যাত্মিক মূর্খামির যে উদগ্র প্রদর্শন তার সংহার।
৮. কালীয় — কালসর্পরূপ বিশ্বাসঘাতকতার সংহার
৯. প্রলম্বাসুর –স্বার্থপরতার সংহার
১০. শঙখাসুর — শংখনিনাদের মতো তীব্র দিগন্ত বিস্তৃত খ্যাতির মোহ সংহার।
১১.অরিষ্টাসুর –অরিষ্ট অর্থ্যাৎ ষন্ডের মতো গোঁয়ার্তুমির সংহার
১২. কেশী– কেশী বা ঘোড়ার মতো জেদি দর্প এর সংহার
১৩. ব্যোমাসুর — ব্যোম বা শূন্যের মতো অন্তঃসারশূন্যতার সংহার
১৪.নরকাসুর — নরক বা অন্তরের ভেতর ঢেকে লুকিয়ে রাখা কদর্যবৃত্তির সংহার।
১৫. অর্জুন গাছের ছদ্মবেশে নলকুবের ও মনিগ্রীব — অদমনীয় ও সংহারক উচ্চাকাঙ্খার সংহার।।
১৬. শিশুপাল বধ — শিশুপালের ১০৮ টি অন্যায় ক্ষমা করে দেবার পরে ১০৯ নম্বরে এক্কেবারে ঘ্যাঁচাং। অর্থ্যাৎ সহ্য ভালো। কিন্তু সব সহ্যেরও একটা সীমা আছে। তার ওপারে গর্জে ওঠো।।
তা, এই লোকটাই রাসলীলা করে মেয়েদের সাথে বিলা করে বেড়িয়েছেন বলে যে বলছ তোমরা। তা এ বিলা যে সে বিলা নয় হে বাপ,
একটু গোদা বাংলাতেই যদি ধরো বলি,
নারীমুক্তি বোঝ নাকি?
বোঝ কাকে বলে পর্দাপ্রথার অবসান?
তা বুঝবে কি করে তোমাদের ভাষায় যিনি ধর্মপুত্তুর তিনি তো নিজের ইস্তিরি কে বাজি রেখে জুয়ো খেলেও দিব্যুই সজ্ঞানে সগগে যান গটগটিয়ে। ধম্ম আবার নাকি তাঁর পালতু কুত্তা। মাফ করবেন জনাব কুত্তা কয়ে ফেলসি গিয়া। সারমেয় কহন লাগে মায়বাপ।
তা আপনারা সব জ্ঞানের ভান্ড আর সমাজের নিয়ম কানুন প্রণেতারা
যখন চুপ করে বসে দুঃশাসনের বানানো এই চাক্কুসচাক্কাম, রগরগে ফিলিমটা রসিয়ে দেখতেছিলেন তখন সেই পাঁচ ভাইয়ের হাতে সারাজীবন ইচ্ছে অনিচ্ছেয় সহবাসে বাধ্য হওয়া মেয়েটার গায়ে এসে শাড়িটি জড়িয়ে দিয়েছিল কে বাপু? এই ছেলেটাই তো নাকি? আপনারা অবশ্য তাকে তাই দ্রৌপদীর বয়ফ্রেন্ড বলে কটাক্ষ করেছেন।
ওহ! বয়ফ্রেন্ড না বয়ফ্রেন্ড না সখা, তাই না?
সাধু ভাষা ব্যবহার করলে অবশ্য অনেক লেপে দেওয়া কাদাকেও বেশ চন্দন চন্দন লাগে।
তা পাঁচ ভাইয়ের যদি এত্তোগুলো করে একস্ট্রা বউ থাকে দ্রৌপদীর মনের কথা বলতে একটা সখা যদি থাকে আপনাদের কি তাতে?
না, না, আপনারা অবশ্য এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা বেশি জলঘোলা করেন নি। ঘরে ঘরেই আপোষে মিটিয়ে নিয়েছেন দ্রৌপদীর এই প্লেটোনিক লাভের ব্যাপারটা।
কারণ রাজামশাইরা আপুন লোগ খুবেই ভাল্ল করে জানেন আপনাদের একশটা মাথায় যত ঘিলু আছে ওই একটা ছেলের মাথায় তার চেয়েও বেশি আছে। তাই তার লিডারশীপ এবিলিটি, প্রতিপত্তি, মেধা সব কিছুর কাছে আপনারা সব এক একটি কেঁচো।। আপনাদের রাজত্ব চালাতে গেলে, যুদ্ধুমুদ্ধু জিতে ক্ষেমতায় থাকতে গেলে
এসব দিকে গা করতে নেই কো।।
আর কেঁচোদের পরম আনন্দ কিসে বলুন তো পাঁক খাওয়া আর পাঁক দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কেঁচিয়ে ফেনিয়ে শিল্প করা।।
আপনারাও আবহমান কাল ধরে তাই ই করে আসছেন। ছায়া দিয়ে আলোকে আটকানোর ধূর্তামি। কিন্তু সূর্যগ্রহণেও যে অসামান্য হীরক বলয় তৈরি হয় সে কী কারোর অজানা।।
এবারে একটু সুক্ষ্ম কথায় যাই চলুন।
আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা..
অসতো মা সদগময়ো,
তমসো মা জ্যোতির্গময়ো….
তিনি অন্ধকারকে ছিন্ন করে আলোর বেরিয়ে আসা দেখাচ্ছেন আর আমরা এর ভেতরে স্থুল শারিরীক কাপড় খোলা দেখছি। একটা ঘুলঘুলে পর্ণ ফিলিম গেলবার আশায় চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছি।
কি সাংঘাতিক ক্যাটারাক্ট রে বাবা।
আসুন মশাই, আপনার ছানিটা তাহলে একটু অপারেশন করেই দি আজ।
কৃষ্ণ শব্দটাকে ছুরি দিয়ে চিরে ফেললে হয় — কৃষ+ ণ
কৃষ অর্থ হলো গিয়ে কর্ষণ। খোঁড়ো ভাই, খোঁড়ো, নিজেকে নিরন্তর খুঁড়তে থাকো।
আর সেই ছোট বেলার ব্যকরণে পড়া ণত্ব বিধান ষত্ব বিধান মনে আছে কি?
যাতে পাশে থাকা স্পর্শ বর্ণের কারিকুরিতে ন থেকে ণ, স থেকে ষ এ উত্তরণ।।
তাই দিনান্তে একবার একটু নিজের এক্কেবারে ভিতরের উলঙ্গ আমিটাকে বিবেকের দীঘির কাকচক্ষু জলে মেলে দেখুন।
ওইটেই রাসলীলা।।
কারণ রাস শব্দের অর্থ হল অশ্ব বল্গা বা লাগাম।।
এই দোদুল্যমান জীবনের কামনা বাসনার দোলায়,
এবার আপনার ইচ্ছে আপনার লাগাম আপনি ক্যামনে রাখবেন নিজের হাতে।।
হেঁ, হেঁ, শুদুমুদু কাঁসর ঘন্টা নেড়ে আলো মন্ডপ সাজিয়ে উচ্ছব মোচ্ছব করে পুতুল পুতুল খেললেই হবে?
ধম্মের পেটে এট্টু গোঁত্তা মেরে ঢুকতে হবে নি? আসল সার তো ওখানেই।
এট্টু ঢুকুন, চাচা,
ঢুকুন মামা, ঢুকুন পিসিমা খালাম্মারা।
বিলা মানে যদি গুগুল জ্যেঠুর কথা অনুযায়ী বিলানো হয়, তবে আমিও একটু বাড়াবাড়ি রকমের জ্ঞান বিলা করে ফেললাম আজ বোধহয়।
সবার হজম হবে না এসব। অসুবিধে নেই। যাঁরা যাঁরা নিষ্ঠাভরে উপুসী আছেন তেনারা এক ছিপি জোয়ানের আরক খেয়ে নেবেন। অম্বলটা আর থাকবে না।।
তাপ্পর?? না, না, তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা,
যা কিছু শেখানো বুলি যে তোতা গাইতে চায় তারা তাই গা’ক না।।
তবে শেষমেশ এট্টা কতা আছে ভায়া,
যদি উপরোক্ত অসুর গুলান রে নিধন করতে পারেন, তবে পাইলে পাইতে পারেন
পরশমাণিক।।
নমস্কার।।
আজকের রাসলীলা এখানেই সমাপ্ত।। ত নি মা।।
( শেয়ার করতে পারেন কারণ তাতে আরও দুপাঁচ জনে আমার এই “বিলা” র হদিশ পেতে পারেন)
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply