২০১০ সাল।
সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। একদিন কলেজ থেকে বের হতেই মুষলধারে বৃষ্টির কবলে পড়লাম।
আশেপাশে তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোন রিক্সা পেলাম না। এদিকে বৃষ্টিতে ইউনিফর্ম ভিজে একেবারে চুপসে যাবার উপক্রম হচ্ছি।
ঠান্ডায় আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। আমার সাইনাসের প্রবলেম আছে। যার কারণে মাথাব্যথা হলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
মাথা ব্যথার যন্ত্রনা আমাকে একেবারে কাবু করে তবেই ছাড়ে।
এদিকে ঠান্ডার কারণে আমার মাথাব্যথা ক্রমেই বাড়ছিলো। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে নিচে বসে পড়লাম। মিনিট দুয়েক যেতেই আমার মনে হলো,
সমগ্র শহরজুড়ে বৃষ্টির তান্ডব হলেও স্পর্শ করছে না বৃষ্টি কেবল আমাকে।
এই ধ্যান ধারণা হতেই আমি উপরে তাকালাম। মধ্যবয়সী এক যুবক আমার মাথার উপর ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমি তাকে একবার নিরীক্ষণ করলাম। গায়ের রং ফর্সা।
ফর্সা বললে ভুল হবে একেবারে তাজা হলুদের রং। গালে লেগে থাকা ছোপ ছোপ কালো দাড়ি হলুদ রঙের উজ্জ্বলতা যেনো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্ল্যাক প্যান্টের সাথে হোয়াইট শার্ট এ ছেলেটিকে সত্যিই অসাধারণ লাগছে। শার্টের ভিতর থাকা গেঞ্জীটাও যে ব্ল্যাক কালারের সাদা শার্ট টা ভিজে যাওয়ার কারণে সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
আমি দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়লাম। কি বলবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তার সৌন্দর্য দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, কেউ উপকার করলে তার বদলে থ্যাংক ইউ বলতে হয় এটাই ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি চুপ থাকলেও ছেলেটি কিন্তু চুপ থাকলো না।
আমার দিকে চেয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
_”মাথা ব্যথার সমস্যা আছে নিশ্চয়? বুঝতে পেরেছি ঠান্ডায় আপনার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই আপনার মাথার উপর ছাতা ধরে ছিলাম।যাইহোক আপনার অনুমতি ব্যতীত ছাতা ধরার জন্যে অবশ্যই ক্ষমাপ্রার্থী।
ক্ষমা করে দেবেন কিন্তু।
এবার আমার মুখের আঠা ছাড়লো। অনেকটা আমতা আমতা করেই আমি বললাম,
_”কি যে বলছেন!
আপনি তো আমার উপকার করেছেন। তবে ক্ষমা কেন?
_”আসলে এখন তো মেয়েরা আগ বাড়িয়ে তাদের সাহায্য করাটা পছন্দ করেনা।
তাই আর কি।
যাইহোক এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আপনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কারণ এখন রিকশা পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। আর রিক্সা যদি পেয়েও যান ভাড়া হয়তোবা আপনার মনপুতঃ হবে না। কারণ বৃষ্টির সময় রিক্সার ডিমান্ড কিন্তু অনেক বেড়ে যায়।
যদি কিছু মনে না করেন আমার বাইক আছে।
একজন উপকারী বন্ধু হিসেবে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।
ছেলেটির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। এ তো পুরো মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো হয়ে গেলো। মনে মনে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিলো। কারণ আমিও চাইছিলাম আরো কিছুটা সময় প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যাওয়া এই মানুষটার সাথে কাটাতে।
লোকে হয়তোবা শুনে হাসবে প্রথম দেখাতেই কোন মেয়ের কাছে একটা ছেলেকে এতো টা ভালো লেগে গেছে। তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধতা চলে এসেছে। এরকম পাগলামি টাইপ মনোভাব কাজ করছে। এসব তো ছেলেদের হয়ে থাকে। কিন্তু আমি সেটা মনে করি না। কারণ আমার কাছে ভালোবাসার অনুভূতির ক্ষেত্রে ছেলে আর মেয়ে দুজনেই সমান।
তাই হয়তোবা আমার থেকে এই সব পাগলামো প্রকাশ পাচ্ছে।
আমাকে এমন মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি বলে উঠলো,
_”যাবেন কি যাবেন না সেটা ভাবা শেষ হয়েছে?
আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললাম। কিন্তু আর বেশি ভাব না ধরে দ্রুত বাইকে উঠে বসলাম।
দু’ মিনিট পর ছেলেটি বলতে শুরু করলো।
_”চার মাস ধরে আপনাকে দেখছি। একাই কলেজে আসেন আবার একাই যান। সাথে কখনো বন্ধু-বান্ধব কাউকেই দেখা যায় না। এরকম একগুঁয়ে থাকতে ভালো লাগে!
আমি তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
_”আপনাকে তো আমাদের কলেজের আশেপাশে কখনো দেখিনি। আপনি আমাকে কি করে দেখেন?
তখন ছেলেটা হেসে ফেললো,
_”আসলে আমি যে আপনাকে রেগুলার দেখি তাও কিন্তু নয়। বাসায় ফেরার পথে তো এই পথেই ফিরতে হয়। এখন মাঝে মাঝেই আপনাকে দেখতাম।ব্যস এটাই।
_”ও আচ্ছা।
কি নাম আপনার?
_”শুভ।
কিছু মনে না করলে আপনার নামটা,,,,,
_”হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
আমার নাম মুক্তা।
_”ওহ্ মুক্তার মতই চকচক করেন আপনি!
_”মানে কী বলছেন!
_”শুধু মজা করলাম।
বাড়িতে কে কে আছেন আপনার?
_”আমার আসলে নিজের বলতে কেউ নেই। খুব ছোট বেলাতেই মা মারা যান। তারপর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কয়েক বছর আগে বাবাও মারা যান। এখন অবশ্য আমি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছেই থাকি।
_”এভাবে বলছেন কেন?
তাকে নিজের মায়ের জায়গাটা দিন। মা বলে সম্বোধন করুন! আর তাকে নিজের ভাবতে শুরু করুন।
_”হুঁ!
সব যদি আমার ভাবনা তে পাল্টে যেতো তাহলে তো ভালোই হতো। আমি উনাকে ভালোবাসতে চাইলেও উনি তো আমাকে চান না। তাই সম্পর্কটা সৎ মা মেয়ে তেই আটকে আছে।
_”আই এম সরি!
আমি আপনাকে দুঃখ দিয়ে ফেলছি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি আপনার ভেতরে এতো দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে।
_”ছাড়ুন এসব কথা!
এখন বলুন আপনার কে কে আছেন?
_”আমাদের জয়েন ফ্যামিলি। একসাথে অনেক মানুষ বাস করি। তবে হ্যাঁ ঢাকাতে কিন্তু আমি একাই থাকি। বাকি আমার পুরো পরিবার গাজীপুর থাকে।
_”ও আচ্ছা ।
বড় সৌভাগ্য আপনার! ভবিষ্যৎ জীবনে আনন্দের কোনো কমতি হবে না।
_”পড়াশোনা করছেন। এটাই তো আপনার ভবিষ্যৎ। এখন জীবনে যাই ঘটুক না কেন। তো কাঙ্ক্ষিত সেই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবেছেন? মানে ভবিষ্যতে কি হতে চান?
_”সেরকম কিছু ভাবিনি। ক্লাসে যাচ্ছি পড়ছি ব্যস এতোটুকুই। এমনিতেও পড়াশোনা করতে আমার তেমন একটা ভালো লাগে না।
_”আচ্ছা বুঝলাম। এটা কোন ব্যাপার না। ঘর সংসার ছেলেমেয়ে সামলাতে জানলেই হবে। বাকি যা পড়ালেখা করছেন সেটা দিয়ে ছেলে মেয়ে মানুষ করতে পারলেই হয়।মেয়েদের জন্য এটাই যথেষ্ট।
_”আমার কথা ছাড়ুন। আপনার ভবিষ্যৎ প্লান কি?
_”ইচ্ছে একজন ডাক্তার হবো।
এবছর সেই স্বপ্নের পথেই যাত্রা শুরু করেছি।
_”ও।
মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন?
_”হুম।
_”শুনুন!
আপনি আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। বাসার কাছে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।অপর থেকে মা দেখতে পারলে আরেক কেলেঙ্কারী হবে।
_”ঠিক আছে আপনি যা বলবেন।
শুভ আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। সেদিন সারাদিন আমার অস্থিরতায় কাটলো। এমনকি রাতেও ঘুমাতে পারলাম না। চোখের সামনে বারবার শুভর চেহারাটা ভেসে উঠছিলো। কাউকে দেখে আমি এতো বেশি মুগ্ধ হয়ে পড়বো সেটা কখনোই ভাবিনি’!
যাইহোক দিন গুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো। সেই পথে শুভর সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো। বিষয়গুলো প্রথম প্রথম হাই-হ্যালো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে দুজন দুজনের বন্ধু হয়ে উঠলাম। আমি সুখ-দুঃখের অনেক কিছুই শুভর কাছে শেয়ার করতাম। এভাবেই বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়ে উঠলো। কিন্তু এই বন্ধুত্ব চার মাসের বেশি দিন ছিলোনা। কারণ চারমাস পেরোতেই হঠাৎ শুভ একদিন আমাকে প্রপোজ করে বসলো।
সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। কারণ জীবনে আমার কোন শখ ইচ্ছে কিছুই পূরণ হয়নি। কিন্তু এই ইচ্ছেটা কিভাবে পূরণ হয়ে গেলো আমি নিজেও জানিনা। শুভকে তো প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগেছিলো। আর যতদিন গড়াচ্ছিলো এই ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিবর্তন হচ্ছিলো।হয়তো কখনোই শুভকে সাহস করে ভালোবাসার কথা বলতে পারতাম না।
যাইহোক আমার তরফ থেকে এই অব্যক্ত ভালোবাসা শুভর দ্বারা ব্যক্ত হয়ে গেলো। তবে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম!
শুভর জন্য নিজের জীবন দিতে পারে এরকম সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে চার পাশে রেখে শুভ আমাকে কেন ভালবাসতে গেলো।
শুভ আমাকে প্রপোজ করার এক মাস পরের কথা। রাতে শুভ আমাকে কল করলো। সেদিন মা আমাকে খুব মেরেছিলো। তাই মনটা ভীষণ খারাপ ছিলো। কয়েকবার রিং বাজার পর কলটা রিসিভ করলাম।
_”ফোন ধরতে এতো দেরি করলে!
মন খারাপ?
_”না।
আমি ঠিক আছি।
_”বললেই হলো?
তোমার মন খারাপ হলে আমি ঠিক বুঝতে পারি। এখন বলো তোমার মায়ের সাথে কি হয়েছে?
_”শুভ!
_”হুম বলো!
_”আমি না বলতে তুমি সবকিছু বুঝতে পেরে যাও কেমন করে?
_”যেমন করে তোমাকে ভালোবাসি তেমন করেই। এখন বলো কি হয়েছে?
_”মা আমাকে আজকে খুব মেরেছে।
_”কেন?
_”টিউশনির দুই হাজার টাকা হারিয়ে ফেলেছি তাই।
_”হ্যাঁ তাতে উনার কি?
সেটা তো তোমার টাকা।
_”ওটা কেবলমাত্র নামেই আমার টাকা। কি মাস শেষে সেটা উনার হাতে তুলে দিতে হয়।
_”আচ্ছা ছেড়ে দাও!
আর কয়েক বছরই তো তুমি এখানে থাকবে। এরপর তো ওই নরক ছেড়ে সারা জীবনের মতো স্বর্গে চলে আসবে।
_”জানো আমার মতো সৌভাগ্য হয়তো কারো নেই!
_”কিভাবে?
_”কারন আমি তোমাকে পেয়েছি।
আর তাই আমি সবথেকে বেশি সুখী!
_”তাই?
_”হ্যাঁ। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারিনি শুভ। তুমি তোমার চারপাশে থাকা এত এত সুন্দরী মেয়েকে ছেড়ে আমাকে কেন,,,,,
_”ভালবাসতে গেলাম তাইতো?
_”হ্যাঁ তাই।
_”তোমার কথার প্রথম ভুল হচ্ছে ভালবাসতে সুন্দরী মেয়ে লাগেনা। দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে সুন্দরী মেয়ে যদি লেগেও থাকে তুমি কি সুন্দরী নও? সত্যি বলতে আমার চোঁখে আমার দেখাতে সবথেকে বেশি সুন্দরী নারী তুমি।
তবে তুমি সুন্দরী বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি নি। আমি তোমাকে ভালবেসেছি মমতাময়ী বলে। যেসব নারী জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়ে থাকে, তারা অন্যের জীবনকে ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে ভরিয়ে তোলে। অন্য কাউকে দুঃখ দিতে পারেনা।
এই লজিক থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এছাড়াও শুধুমাত্র তোমাকে দেখলেই আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। অন্য কোন মেয়ের প্রতি এই ফিলিংস কাজ করে না। সবমিলিয়ে আমি শুধুমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি!
শুভর কথা শুনে আমার এতো বেশি খুশি লাগছিলো আমি বলে বোঝাতে পারবো না। শুভ আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে।
যাই হোক আমাদের এই ভালোবাসার জীবনে দুইটি বছর কেটে গেলো।
কলেজ যাবার পথে একটা গলি পড়ে। সেই গলির মুখে প্রায়ই কয়েকটা বকাটে ছেলে আমাকে উত্যক্ত করতো। শুধু আমাকে বললে ভুল হবে। হয়তো বা আরো অনেক মেয়েকেই ওরা উত্ত্যক্ত করতো।
শুভ আমাকে প্রায় সময়ই কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসতো। একদিন ওই ছেলেগুলো আমাকে বিরক্ত করার সময় শুভ এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করলো।
_”কি ভাই আপনাদের সমস্যা কি? মাঝরাস্তায় এভাবে একটা মেয়েকে বিরক্ত কেন করছেন?
বখাটে ওই ছেলেগুলোর যে লিডার তখন সে এগিয়ে আসলো।
_”হ্যাঁ তো বিরক্ত করছি।
তাতে তোর কি?
_”এভাবে কথা বলছেন কেন? আমিতো আপনার সাথে সুন্দর করে কথা বলছি।
_”বেশি পাকামো করতে আসিস না। কি হয় এ তোর? গার্লফ্রেন্ড নাকি বউ?
শুভ একদম চুপ হয়ে গেলো। শুধু তাই নয় সাথে সাথে সেখান থেকে চলে গেলো। এরপর টানা দুই দিন শুভর ফোন বন্ধ ছিলো। আমি কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। দুদিন পর হঠাৎ সকাল বেলা শুভর ফোন থেকে একটা মেসেজ এলো।
“বিকেল পাঁচটায় গ্রীন ক্যাফেতে দেখা করবে”
মেসেজ পাওয়া মাত্রই আমি কয়েক বার কল করলাম। কিন্তু শুভ রিসিভ করলো না। আমার অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে উঠছিলো। তাই বিকেল হতেই আমি পাগলের মতো ছুটে গ্রীন ক্যাফে চলে গেলাম।
বাঁ দিকের চেয়ারটায় শুভ বসে আছে। ব্লু টি-শার্ট পড়ে এসেছে শুভ। সাথে আরো তিন চারজন ছেলে বসে আছে। আমার বুকের ভিতরটায় ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। আমি শুভকে অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু পরিস্থিতিটাকে ভয় পাচ্ছি। কেউ শুভকে আটকে রাখে নি তো?
ধীরে ধীরে হেঁটে শুভর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখা মাত্রই শুভ দাঁড়িয়ে পড়লো।
_”ওইদিকে বসো!
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
আমি দ্রুত বসে গেলাম।
_”কি কথা?
_”আমি তোমার কে?
_”মানে?
_”বুঝতে পারছো না?
_”না বুঝতে পারছিনা।
_”আমি তোমার কি হই?
আমাদের সম্পর্কটা কি?
_”তুমি কি বলছো শুভ?
_”মুক্তা আমি তোমাকে ভালোবাসি!
অথচ যখন তোমাকে প্রটেকশন দিতে চাই তখন নিজের পরিচয় দিতে পারি না। কেন?
_”শুভ!
_”দেখো আমি তোমার বয় ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে চাই না। এর চাইতে বডিগার্ড হওয়াও ভালো। যদি তুমি রাজি থাকো আমি আমাদের এই সম্পর্কের একটা পরিচয় দিতে চাই।
_”কি?
_”বিয়ে করবে আমাকে তুমি?
_”শুভ তুমি এই সব,,,,,,,,
_”হ্যাঁ অথবা না।
এমনিতেও তো তোমার সৎ মা তোমার প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করে না। স্বামী হয়ে আমি তোমার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমাকে সেই সুযোগ দেবে না? দেখো আমার সাথে আমার বন্ধুরা এসেছে। বিয়েতে সাক্ষী হবে বলে।
আমি আর না করতে পারলাম না। সেদিনই মিরপুরের একটা কাজী অফিসে আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। তবে আমাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে নিজের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার কোন উদ্দেশ্য ছিলো না শুভর। বরং সব সময় আমাকে প্রটেকশন দিতো শুভ। কোথাও দ্বন্দ্ব হলে উচ্চস্বরে বলতো মুক্তা আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীকে কেউ বিব্রত করলে আমি তাকে ছেড়ে কথা বলবো না।
আমার প্রতি শুভর ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চলছিলো।বিয়ের দু’মাস পর আমাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হয়ে উঠলো। ভালোবাসা দিয়েই জীবনের কানায় কানায় ভরিয়ে দিচ্ছিলো শুভ। আমি ধীরে ধীরে নিজের সব কষ্ট ভুলেই যাচ্ছিলাম।
২০১৩ সালের ঘটনা।
মাস টা ছিলো ফেব্রুয়ারি মাস। এই মাসটা কে আমি কখনোই ভুলবো না। ভ্যালেন্টাইন্স ডের আগের দিন রাতে আমি শুভকে কল করলাম। আমার লাইন কেটে দিয়ে শুভ ব্যাক করলো।
_”কি করছিলে শুভ?
_”এই তো ডায়রি লিখছিলাম।
_”ডায়রি লিখতে তোমার ভালো লাগে?
_”তোমাকে নিয়ে লিখতে ভীষণ ভালো লাগে!
_”এই পর্যন্ত আমাকে নিয়ে কি কি লিখেছো?
_”অনেক কিছু লিখেছি। পড়তে চাও?
_”হ্যাঁ পড়তে চাই।
আর কত কাল লিখবে বলো তো?
_”যতদিন বেঁচে আছি।
কিন্তু খুব ভয় হয়।
_”কেন?
_”আজকে ১৩ তারিখ তাইনা?
_”হ্যাঁ।
_”যদি ১৪ তারিখ থেকে আর লিখতে না পারি তাই।
_”এসব তুমি কি বলছো?
আমি কিন্তু কান্না করবো।
_”ধুর পাগলী!
একদিন না একদিন তো এটা হবেই তাই না?
_”শুভ কাল কিন্তু ভালোবাসা দিবস।
আমাকে কিন্তু,,,,,
_”মুক্তা!
ভালবাসতে কোন নির্দিষ্ট দিবসের প্রয়োজন হয় না। তোমার জন্য আমার ভালোবাসা সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান। বুঝেছো?
_”বুঝেছি।
কিন্তু আমার কালকে গিফট চাই।
তোমার জন্য কিন্তু আমার কাছে একটা স্পেশাল গিফট আছে। শুনে তুমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে।
_”যদি এর আগেই হয়ে যাই?
_”ওহ্ শুধু বাজে কথা!
শুভ হেসে দিয়ে ফোন রেখে দিলো। পরদিন বেলা বারোটা বেজে গেলো কিন্তু শুভর কোন ফোন আসলো না। আমি ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রেগে গেলাম। ভেবেছিলাম সকাল-সকাল ফোন করে শুভ আমাকে উইশ করবে। কিন্তু সেটা তো হলো না। বিরক্ত হয়ে আমিই শুভকে কল করলাম।
কয়েকবার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেলো। একপর্যায়ে শুভ কল রিসিভ করলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলা শুনে মনে হচ্ছে শুভ অনেক অসুস্থ।
তবুও আমি রাগত স্বরে বললাম,
_”একটা কল পর্যন্ত করতে পারলে না?
_”সরি মুক্তা!
আসলে আমার শরীরটা খুব খারাপ। প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে শরীরে। এতো বেশি দুর্বল লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।
_”হয়েছে থাক।
ভুল করে আর অজুহাত দেখাতে হবে না।
তুমি এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে দেখা করতে আসবে লাভ ক্যাফেতে।
_”মুক্তা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ!
_”আসবে মানে আসবে।
আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।
আমি লাভ ক্যাফেতে চলে এসেছি। এখন তুমি না আসলে আমি সারারাত এখানে বসে থাকবো। এরপর যদি তোমার বউ কে কেউ তুলে নিয়ে যায়,,,,,
_”না ঠিক আছে আমি আসছি।
কিন্তু তোমার জন্য কোন গিফট আনতে পারবো না।
_”আমার কাছে তুমিই সবচেয়ে বড় গিফট। তবে তোমার ডাইরি টা কিন্তু নিয়ে আসবে।
_”আচ্ছা ঠিক আছে।
মুক্তা!
_”বলো!
_”খুব ভালোবাসি তোমাকে!
আমি হেসে দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। ভালোবাসার জবাবে পাল্টা ভালোবাসি কথাটা বললাম না। জমিয়ে রেখেছিলাম। প্রায় ৪ ঘন্টা কেটে গেলো। কিন্তু শুভর আসার কোন নাম গন্ধই নেই। যেখানে আধঘন্টায় চলে আসার কথা। সেখানে পুরা ৪ ঘন্টা কেটে গেলো? আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম।
একের পর এক কল করতে থাকলাম শুভর ফোনে। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন কলটা রিসিভ করলো।
আমি কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম,
_”আপনি কে?
এটা তো শুভর নাম্বার।
_”এই ফোনটা যার তিনি রোড এক্সিডেন্ট করেছেন।
আপনি যদি তার নিকটতম কেউ হয়ে থাকেন তাহলে মোহাম্মদপুর সিটি হসপিটাল চলে আসুন।
আমার মাথায় যেনো বজ্রপাত হলো। চোঁখের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। পুরো শরীর থেকে অঝোরে ঘাম ঝরছে । ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় ইচ্ছামতো পানি ঢাললাম। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সিটি হসপিটালে পৌঁছে গেলাম।
হসপিটালে পৌঁছে শুভকে খুঁজে বের করলাম।আমাকে দেখে ডাক্তাররা কিছুটা হতাশ কন্ঠে বললো,
_”সরি ম্যাডাম!
আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই উনি মারা গেছেন।
আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। নিজের কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার হাত থেকে প্রেগনেন্সি টেস্টের মেডিকেল রিপোর্ট টা পড়ে গেলো। আমিতো শুভকে খুন করতে ডাকিনি।
ডেকেছিলাম শুভর হাতটা আলতো করে আমার পেটে লুকিয়ে থাকা শুভর সন্তানের গায়ে বুলিয়ে দিতে। কিন্তু আমি তো শুভকে খুন করে ফেললাম।
সারপ্রাইজ দিতে ডেকে এনে আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। নিজেকে আর সংযত করতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই একজন নার্স বললো,
_”ম্যাডাম আপনি মুক্তা বলে কাউকে চিনেন?
যদি চিনে থাকেন তাহলে এই ডাইরিটা তাকে পৌঁছে দিবেন। বেচারা মরতে মরতেও কেবল মুক্তার নাম জপছিলো।
আমি ডাইরি টা হাতে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলাম। আমার শুভ নেই এ কথাটা আমি ভাবতেও পারছিনা। আবার একা হয়ে গেলাম আমি। খুব একা!
আজকে আবার সেই ভালোবাসা দিবস। শুভর মৃত্যুর পর আটটি বছর কেটে গেলো। আমার ছেলের নাম আমি শুভ রেখেছি। এখন তার বয়স সাত বছর। দেখতে সে হুবহু আর বাবার মতই।
“শুধু আফসোস শুভ কে জানাতে পারলাম না আমার মাঝে লুকিয়ে থাকা আরেকটা ছোট্ট শুভর কথা!”
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply