কিছু বন্ধু থাকে যাদের সঙ্গে আমাদের শুধু দরকারের সম্পর্ক। দরকার পড়লে কথা হয়, নতুবা মাসের পর মাস যোগাযোগ থাকে না। রিমী আমার তেমনই এক বন্ধু। হসপিটাল থেকে ফিরে সবে বাড়িতে ঢুকেছি। এমন সময় ওর ফোন পেলাম। রিমী ইতস্তত করে বলতে লাগল,
“নীলা, তুই ঠিক আছিস?”
প্রেগ্ন্যান্সির শুরু থেকেই আমি অসুস্থ। পরিচিত সকলেই তা জানে। রিমীও জেনেই খোঁজ নিচ্ছে ভেবে খুশি হলাম। বললাম,
“শরীরটা ইদানীং খুবই খারাপ যাচ্ছেরে। সবে চার মাস, তাতেই একদম ভেঙে পড়েছি। আজই ডক্টর দেখিয়ে ফিরলাম।”
“ভেঙে পড়ার মতোই তো অবস্থা। দুলাভাই যে এমন কাজ করবে আমি তো ভাবতেই পারিনি। তুই প্লিজ শক্ত থাক। আমরা আছি তোর পাশে।”
রিমীর কথায় আমি বিব্রত হলাম। অর্ণব ও আমার আকাঙ্ক্ষিত প্রেগন্যান্সি এটা। রিমী কেন এমন করে বলল বুঝে উঠতে পারলাম না। রিমীও বিশেষ কথা না বাড়িয়ে ফোন রাখল। সবে ফ্রেশ হয়ে একটু সুস্থির হয়ে বসতেই আম্মা এসে বললেন একটু কিছু মুখে দিতে। আজ চার মাস আমার খাওয়া-দাওয়ার বেহাল অবস্থা। কোনোকিছু খেতে পারি না গন্ধের জন্য। আমিষ জাতীয় খাবারের সঙ্গে একপ্রকার ছাড়াছাড়ি মতো অবস্থা। অথচ প্রেগন্যান্সির আগে পর্যন্ত একবেলা নিরামিষ খাওয়া হতো না আমার। এখন যাও একটু গলাধঃকরণ করি, একটু বাদেই উগরে দেই। হজম হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে পারি না। নাড়ি ছিঁড়ে আসতে চায় যেন। বমি করার ভয়ে রীতিমতো খাবার এড়িয়ে চলছি। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। অর্ণবকেও কম জ্বালাচ্ছি না। বেচারা সারাদিন অফিস করে এসে আমার ছটফটানিতে একটুও বিশ্রাম পাচ্ছে না। আমি ভয়ে ভয়ে একটা আপেল ও দুটো পাউরুটি খেয়ে বিছানা পড়ে রইলাম। এমন সময় ফোনটা আবারো বেজে উঠল। ফোন করেছে অর্ণবের বন্ধুর বউ, টিনা ভাবী।
“নীলা ভাবী, আপনি ঠিক আছেন?”
আমি একটু অবাক। টিনা ভাবী কেমন করে জানল আমার অসুস্থতার কথা? অর্ণব গল্প করেছে হয়তো বন্ধুর কাছে। তার মাধ্যমেই জেনেছে বোধহয়। প্রসন্নচিত্তে বললাম,
“জি ভাবী, আমি সুস্থ আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“অর্ণব ভাইয়ের কান্ড শোনার পর আর ঠিক নেই ভাবী। লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। এতদিন শুধু শুনেছি বউ প্রেগন্যান্ট হলে নাকি পুরুষের নিয়ত বদলে যায়। শেষে অর্ণব ভাইও! আমি তো কয়েক বছরেও বাচ্চা নেব না ঠিক করেছি।”
এমন কথার কোনো মানে বুঝলাম না। টিনা ভাবী বলে চলেছেন,
“আপনি কষ্ট পাবেন না ভাবী। আল্লাহ এর বিচার করবেন।”
আমি বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না,
“কীসের বিচার ভাবী? অর্ণব কী করেছে?”
“ওমা আপনি এখনো জানেন না? নাকি আমাদের থেকে লুকোতে চাইছেন? দেখুন ভাবী আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। সন্তানের কথা ভেবে চেপে যেতে চাইছেন তো? কিন্তু এভাবে অর্ণব ভাইকে ছেড়ে দেবেন না। লাই পেয়ে বসলে আর শোধরাতে পারবেন না।”
“ভাবী আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না আপনি কীসের কথা বলছেন। একটু খোলাসা করবেন প্লিজ!”
“পুরো সোস্যাল মিডিয়া জেনে গেল আর আপনি জানলেন না? অর্ণব ভাই তো প্রেমিকা নিয়ে পালিয়েছে।”
কানের কাছে বজ্রাঘাত হলো যেন। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল আমার। অর্ণব পালিয়েছে! আজ সকালেই তো সে আমায় ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছে দিয়ে অফিস গেল। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছিল। কোনো জবাব দিতে পারলাম না। টিনা ভাবী হ্যালো হ্যালো করে ফোন রেখে দিলেন। নিজেকে সামলে সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের ফোনে কল করলাম। কী আশ্চর্য! ফোন সুইচ অফ। একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছিলাম। ফলাফল শূন্য। টিনা ভাবীর কথাটা কী তবে সত্যিই! কিন্তু কীভাবে সম্ভব! অর্ণব আমায় প্রচন্ড ভালোবাসে। আমাদের সংসারে কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, মনমালিন্য নেই। শুধু কয়েকটা দিন অসুস্থতায় একটু জ্বালিয়েছি এই যা। অর্ণবের সঙ্গে আমার দুই মাসের পরিচয়ে বিয়ে হয়৷ দুই বছরের মধুর সংসারের পর আমাদের অনাগত সন্তানের সুসংবাদ পেয়েছি। অর্ণব কখনো স্বামীর দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনি। আমার খন্ড খন্ড ভাবনার মাঝে আবারো ফোন বাজল। অর্ণব নয়, ফোন করেছে তার এক পারিবারিক বন্ধু হাসিব। রিসিভ করতেই আবারো সেই এক কথা। অর্ণব প্রেমিকা নিয়ে পালিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে ফোন করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাসের দেয়ালে যেন মুগুর দিয়ে আঘাত করা হচ্ছিল। হাসিব ভাই বললেন,
“নীলা ভাবী, আপনি মন খারাপ করবেন না। আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না অর্ণব এমন কাজ করবে। ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম। এমন অপরূপা বউ ফেলে কেউ অন্য নারীতে জড়াতে পারে! অর্ণবের আসলে চোখই নেই সৌন্দর্য উপভোগের। আপনি ওই প্রতারককে নিয়ে বেশি ভাববেন না। আমরা আছি আপনার পাশে। কোনো দরকার পড়লে আমায় ফোন করবেন। আমি চলে আসব আপনার হুকুম পালন করতে। ভরসা করতে পারেন আমায়। পাশে আছি সব সময়।”
হাসিব ভাইয়ের সুর আমার অচেনা ও অস্বস্তিদায়ক মনে হলো। ইতিপূর্বে কখনোই এমন সুরে কথা বলেননি তিনি। সম্মান দিয়ে যথেষ্ট আদবের সাথে কথা বলতেন। হঠাৎ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত, কুৎসিত বস্তুর ওপর থেকে পর্দা সরে গেলে যেমন ভয় ও ঘৃণা জেঁকে বসে, আমারও তেমনই অনুভব হলো। বমি বমি ভাবটা ফিরে এলো। ফোন রেখে ছুটে গেলাম ওয়াশরুমে। পেটের সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের সাথে, ঘৃণা, বিদঘুটে অনুভূতি উগরে দিয়ে যখন একটু ধাতস্থ হয়ে বের হলাম, শ্বশুরের চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। তিনি রা’ই’ফেল হাতে আমার ঘরে ছুটে এসে বললেন,
“ওই কু’লা’ঙ্গার কোথায়? আমার মান-ইজ্জত ডুবিয়ে কোথায় পালিয়েছে? চোখের সামনে পেলে গু’লি করে মা’রব।”
এবার আর কান্না সামলাতে পারলাম না। আমি ছাড়া দেখি সকলেই জেনে গেছে। তাহলে কী সত্যিই অর্নব আমায় ধোঁকা দিল! আমার পূর্ণিমায় ঝলমল করা সংসারে চন্দ্রগ্রহণ লাগল! কান্নায় ভেঙে পড়তেই বাবা এগিয়ে এসে আমায় সান্ত্বনা দিলেন। বললেন,
“তুমি ভেবো না, মা। আমার কাছে ন্যায় সবার আগে। পরের ছেলের বেলাতে যা, নিজের ছেলের বেলাতেও তা। ওই কু’লা’ঙ্গারের সংসার তোমায় করতে হবে না। আজ থেকে ওর এ বাড়িতে ঢোকা চিরতরে নিষিদ্ধ। তুমি আমাদের মেয়ে হয়েই এখানে থাকবে আজীবন।”
আমার শ্বশুর বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। সারাজীবন সততা ও ন্যায়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। ছেলের অধঃপতনেও তিনি ন্যায় ভুললেন না। আমি কোনো জবাব না দিয়ে বিছানা নিলাম। বাইরে থেকে আম্মার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি বুক চাপড়ে বলছেন,
“কী সর্বনাশ হলো আমার! এই শিক্ষা দিয়েছিলাম অর্ণবকে? সম্মানের কথা বাদই দিলাম, অনাগত বাচ্চাটার কথাও ভাবল না?”
আমার এতটাই দুর্বল লাগছে যে কান্নার শক্তিটাও পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে পড়ল টিনা ভাবীর কথা। সোস্যাল মিডিয়া থেকে জেনেছে উনারা অর্ণবের ঘটনাটি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিলাম। কোন বিশ্বসুন্দরীর কাছে ওর ব্যক্তিত্বের স্খলন হলো জানতে আমার মড়িয়া মেজাজ উঠেপড়ে লেগেছে। ওয়াইফাই চালু করতেই একের পর এক নোটিফিকেশন পপ আপ করতে লাগল। বেশিরভাগ এসেছে ফেইসবুক থেকে। ঢুকতেই দেখলাম ফ্রেন্ডলিস্টের অনেকেই মেনশন করেছে বিভিন্ন পেইজের পোস্টে। পোস্ট দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। অর্ণবের একটা ছবি ভাইরাল হয়েছে বড়ো বড়ো পেইজগুলোতে। যেখানে দেখা যাচ্ছে সে বাসে দাঁড়িয়ে আছে এবং ওর পেটে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে এক বোরকা পরিহিত নারী, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অর্ণবের একটা হাত সেই নারীর মাথায়। আর ক্যাপশনে লেখা,
“পরিবার মেনে না নেওয়ায় রাজপ্রাসাদ ছেড়ে প্রিয় মানুষের সঙ্গে অজানায় পাড়ি জমিয়েছে তারা। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রেমিক পুরুষটি নিজের আরাম ভুলে প্রিয়তমাকে আগলে রেখেছে। ভালোবাসা সুন্দর।”
কমেন্ট, শেয়ার হচ্ছে অসংখ্য। ট্রু লাভ, নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা, প্রেমিক তো এমনই হবে, এভাবেই আগলে রাখতে শেখো প্রিয় ইত্যাদি ইত্যাদি কমেন্ট করে ভরিয়ে ফেলছে। আমি হতবুদ্ধি হয়ে দেখলাম সেসব। এই দৃশ্যটা আজ সকালের। আগেই বলেছি আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। যখন হসপিটালে যাচ্ছিলাম বাসে একটা মাত্র সিট খালি পেয়ে আমি বসেছিলাম। আর সে অবস্থাতেই ঘুম নেমে আসে। বাড়ির পরিষ্কার চাদরে শুয়ে যে ঘুম আসল না, বাসের নোংরা, তেলচিটে সিটে তা অনায়াসে নামে। তখন আমাকে আরেকটু আরাম দিতে অর্ণব নিজের পেটে মাথা রাখতে দেয়। আমিও ওর সদ্য উঁকি দেওয়া ভুড়িতে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সেই সময়ই কেউ কৌশল ছবিটা তুলে নিয়েছে। আর মনগড়া ক্যাপশন দিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে বানিয়ে দিয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকা। ঘন্টা দুইয়ের মাঝে পোস্ট হুড়হুড় করে ফান পেইজগুলোতে ভাইরালও হয়ে গেছে। সকলে অর্ণবের ঘামে ভেজা ক্লান্ত মুখটা এবং ক্যাপশন দেখল। অথচ সাথের মেয়েটা কে তা কেউ জানল না। আমাকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেও না আসলে। বাসের সিটের দ্বারা ঢাকা পড়েছে বোরকা পরিহিত দেহখানি। ঢাকা না পড়লেও বা, এই যে লাইক, কমেন্টের আশায় কারো ব্যক্তিগত ছবি তুলে, মনগড়া গল্প বানিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। এই ভ্রান্ত কাজে একটা মানুষ সামাজিকভাবে কতটা হেয় হতে পারে তার খোঁজই বা কয়জন রাখবে? চিলে কান নিয়েছে শুনে কানে হাত না দিয়েই আমার স্বামীকে নিয়ে পরিচিতজনদের মাঝে ছি ছি পড়ে গেছে। এমনকি সেই সুযোগে কেউ কেউ নোংরা মুখোশ খুলতে ছাড়ছে না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি অনলাইন পোস্ট দেখেননি। তারা মানুষের মুখে শুনে, ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। শাশুড়ির প্রেশার বেড়ে গেছে। এই অস্থিতিশীল অবস্থার দায় কে নেবে? এই ভাইরালের যুগ ভাই-বোনকে বানিয়ে দিচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা, চাচা-মামাদের সঙ্গে বের হলেও বাঁকা নজরে তাকায়। মস্তিষ্কে আবর্জনা ঠাসা মানুষগুলো অন্যদের মাঝেও আবর্জনা ছড়াচ্ছে। আর এর দুর্গন্ধ ভুক্তভোগীদের নিশ্বাসকে করে তুলছে অতিষ্ট। এই অসুস্থ মানসিকতার চিকিৎসা কোথায়?
কিছুক্ষণ বাদেই অর্ণবের ফোন পেলাম। ও অসহায় কণ্ঠে বলল,
“এই নীলা, এসব কী হচ্ছে আমার সাথে?”
আমি শান্ত হয়ে বললাম,
“তুমি কোথায় আছো?”
“এই তো অফিসে। মিটিংয়ে ছিলাম বলে ফোন বন্ধ ছিল এতক্ষণ। খুলতেই একের পর এক ফোন আর কীসব উদ্ভট কথা বলে চলেছে। আমি তো কিছুই বুঝছি না।”
একটু ভেবে বললাম,
“অর্ণব, তুমি এখন ছুটি নিয়ে বের হতে পারবে। ইট’স ইমারজেন্সি।”
“বাড়ি আসব? তুমি ঠিক আছো তো?” অর্ণবের কণ্ঠ উতলা শোনায়।
“বাড়ি এসো না। বাবা রা’ই’ফেল নিয়ে ঘুরছেন, তোমাকে দেখতে পেলেই গু’লি করবেন বলে মনস্থির করেছেন।”
“কী আশ্চর্য! আমার দোষ কোথায়?”
“তুমি বের হও তো। আমিও বের হচ্ছি। তোমার কাছে আসছি।”
দুজনের কিছু কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আমি আবারো সকালের পোশাকটাই পরে নিলাম। অর্ণবের কাছে পৌঁছে ওকে নিয়ে রওনা হলাম বান্দরবান। দুজনে একটা সেলফি তুলে সাথে সেই ভাইরাল ছবিটা পোস্ট করে ক্যাপশন দিলাম,
“বরের সাথে পালাচ্ছি। ভালোবাসা সুন্দর।”
Leave a Reply