“তোর মধ্যে কি কখনোই ম্যাচুরিটি আসবে না সেতু।”
সেতুর মা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বললেন সেতুকে। সেতু মায়ের কথা শুনেও না শোনার ভান করে বলল, ‘মা তাড়াতাড়ি খাবার দাও, নাহলে আমি না খেয়েই চলে যাচ্ছি।’
মেয়ের কান্ডে সেতুর মায়ের রাগ আকাশ ছোঁয়া। রাগে গজগজ করতে করতে মেয়েকে খেতে দিতে লাগলেন। কারন উনি জানেন, ওনার গুনধর মেয়ে না খেয়েই বেড়িয়ে যাবে। মা খাবার দিতেই সেতু ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খেতে লাগল। যেন কিছুই হয়নি। সকালে লাফালাফি করতে গিয়ে মায়ের শখের ফুলদানি ভে’ঙ্গে ফেলেছে সেতু, তাই ওর মায়ের রাগ আকাশ ছোঁয়া।
খাওয়া শেষ করে সেতু মাকে বিদায় জানিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সেতুর মা মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলেন…
– ‘এই মেয়েটা কি কখনোই ম্যাচুউর হবে না।’
‘সেতু’ বাবা মায়ের আদরের মেয়ে। স্বভাবতই প্রচন্ড রকমের দুষ্টু একটা মেয়ে। সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়ায়। তার জন্য প্রচন্ড বকুনিও খেতে হয় অবশ্য। ওর মায়ের বড্ড চিন্তা হয়, এই আনম্যাচুউর মেয়েটাকে নিয়ে। কখন কি ঝা’মেলা বাঁধিয়ে বসে থাকবে কে জানে।
সেতু প্রাইভেট টিউশনির দিকে রওনা দিলো। আর কয়েকদিন পর থেকে কলেজে ক্লাস চালু হবে কিন্তু যেহেতু এডমিশন হয়ে গেছে তাই পড়াশোনা বন্ধ করে রাখাটা বোকামী ছাড়া আর কিছুই না। তাই এখন থেকেই টিউশনি শুরু করে দিয়েছে।
সেতু প্রাইভেটে গিয়ে দেখল ওর বেস্টফ্রেন্ড ফারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সেতু হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যাক বাবা দেরি হয়নি টাইমেই এসেছে। নাহলে ফারিয়া ওর পিঠের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত উঁহু।
– ‘এতক্ষনে মহারানির আসার সময় হলো, আমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’
ফারিয়া নাক ফুলিয়ে কথাগুলো বলল। সেতু ফারিয়ার মাথায় একটা চাঁটি দিয়ে বলল..
– ‘এই নাটক কম কর, আমি সময় মতোই এসেছি তুই যদি আগে থেকে এসে বসে থাকিস তো এতে আমার দোষ কোথায়,হুম।’
ফারিয়া আর কিছু বলল না। আসলে দোষটা ওরই, আগে থেকেই এসে দাঁড়িয়ে আছে তাই আর সেতুকে কিছু বলতে পারল না।
ফারিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে সেতু হাসল, অর্থাৎ ফারিয়া ধরা পড়ে গেছে। দুজনে আর বেশিক্ষন কথা না বলে টিউশনের দিকে পা বাড়াল। সেতু ফারিয়ার সাথে বকবক করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে সামনের দিকে তার খেয়ালই নেয়। আর তারই ফলস্বরূপ টাস করে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে যায়।
– ‘আহ্..
সেতু হালকা চিৎকার করে সামনে তাকিয়ে দেখল একজন হ্যান্ডসাম ছেলে দাঁড়িয়ে। ঘটনাটাতে তার কাছেও অনেকটা আকস্মিক তাও সেও খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
– ‘সরি, আসলে খেয়াল করিনি।’
সায়নের শান্তস্বরে কথাটা শুনে সেতুর মুখে হাসির রেখা দেখা গেল। মুখের হাসিটা বজায় রেখেই বলল,
– ‘না না সরি বলতে হবে না। আপনাদের তো এটাই কাজ মেয়ে দেখলেই তাদের গায়ে পড়ে যেতে হবে।’
সেতুর আচমকা আক্রমনে খানিকটা চমকে গেল সায়ন। এই মেয়েটা পাল্টা ফাঁদে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি আর সত্যিই ও খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে এই বজ্জাত মেয়ের গায়ে কিছুতেই পড়ত না।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন। আমি ইচ্ছা করে তোমার গায়ে পড়েছি।’
– ‘তবে নয়ত কি? আপনাদের মতো ছেলেদের আমার ভালো করেই চেনা আছে। প্রথমে ধাক্কা আর তারপরে বন্ধুত্ব তারপরে প্রেম। আর সব শেষে শখ মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।’
সেতু কথাগুলো নিজের মনমতো বলে যেতে লাগল। সায়নের দিকে তাকালে বুঝত, সেতুর কথাতে ও ঠিক কতটা রেগে গেছে।
– ‘স্টপ ইট।’
সায়নের ধমক শুনে সেতু চুপ করে যায়। চোখ পিটপিট করে ওর তাকিয়ে দেখে সায়নের চোখেগুলো লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিশাল রেগে আছে।
– ‘হেই তুমি নিজেকে কি ভাবো বলো তো বিশ্বসুন্দরী! যে সবাই তোমার পেছনে ঘুরবে। এই মেয়ে কান খুলে শুনে রাখো এই সায়নের পছন্দ এতটাও খারাপ হয়ে যায়নি যে তোমার মতো একটা মেয়ের পেছনে ঘুরবে।’
রাগে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলে চলে যায় সায়ন। সায়ন চলে যেতেই ফারিয়া বলল, ‘সেতু তুই ছেলেটাকে এতকিছু না বললেই ভালো করতিস। কে জানে এই ছেলে আবার কি করবে।’
সেতু মনে মনে একটু ভয় পেলেও মুখে কিছু বলল না। মেকি হাসি দিয়ে বলল, ‘ক্লাসে চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
দিন নিজের গতিতে চলতে শুরু করেছে। সেতুও নিয়মিত টিউশন করতে আসে তবে সায়নের মুখোমুখি হতে হয়নি। অনেকদিন হয়ে যাওয়াতে সেতু সায়নের কথা পুরোই ভূলে গেছে। নিজের লাইফ, দুষ্টুমি সবকিছু নিয়ে মেতে আছে।
টিউশনিতে শিক্ষক দিবস উপলক্ষে একটা বড়ো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। টিউশনির প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও আজকে সবাই উপস্থিত থাকবে। সেতুরা যেহেতু ক্লাসের সিনিয়র ছিল তাই ওদেরকেই সবথেকে বেশি দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
সেতু কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে বলল, ‘দ্যাখ কিপটে স্যারগুলো আমাদের দিয়ে কত খাটিয়ে নিচ্ছে।’
– ‘যা বলেছিস শা’লা আমার শরীর ব্যথা হয়ে গেল।’
সেতু ফারহানের পিঠে একটা থাপ্পর দিয়ে বলল, ‘ওই ছেলে তুই কি কাজ করেছিস শুনি।’
সেতুর কথা শুনে ফারহান দুইপাটি দাঁত বের করে বলল, ‘আরে ভাই দ্যাখ কত কাজ আমার, তোর বান্ধবীকে দেখাও তো আমার একটা কাজ নাকি।’
ফারহানের মুখে এই কথা শুনে ফারিয়া ওর দিকে তেড়ে আসলো, আর ফারহান সেতুর পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওই সেতু তোর বান্ধবী সবসময়ে আমার সাথে এইরকম করে কেন? একটু ভালোবাসলে কি হয় রে।’
– ‘ওই তুই চুপ করবি নাহলে কিন্তু আমি সবার সমানে তোর প্রেস্টিজ পাংচার করে দেব।’ ফারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলতেই ফারহানের মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। সেতু সবটা দেখে মুচকি হাসল। ফারিয়া আর ফারহান সবসময়েই এইরকম দুষ্টুমি করতে থাকে। সেতুর ভালো লাগে ওদের দুজনের বন্ডিংটা দেখে, আর ভাবে এরা কাপল হলে দারুন হবে।
স্যার ওদেরকে ডাক দেওয়াতে ফারিয়া আর ফারহানের ঝগড়া থেমে যায়। ওরা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দেখল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আছে একজন প্রাক্তন ছাত্র বিষয়টা সেতু আগে জানলেও মানুষটিকে দেখে চমকে উঠল!
#চলবে….
অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আছে সায়ন। এই টিউশনিতেই নিজের পড়াশোনা শেষ করেছে, পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না হওয়া সত্ত্বেও ব্যবহারের জন্য সকল শিক্ষকদের কাছে অতিপ্রিয় তাই তো এখনো অনুষ্ঠানের পরিচালনার ভার পড়েছে ওর হাতেই।
সায়ন অনুষ্ঠানের পরিচালনার মাঝে বিরতির সময়েই খেয়াল করল সেইদিনের ঝগড়া করা মেয়েটি কালো সালোয়ার কামিজে ওর দিকেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে, সায়নের ভ্রু কুঁচকে গেল। মেয়েটা ওর দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন!
অনুষ্ঠান শেষে এইবার বিদায়ের পালা। সকলেই ধীরে ধীরে বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছে, সেতু ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যেতে যাবে তখনি পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল, ‘এই যে বিশ্বসুন্দরী।’
নামটা শুনে সেতুর ভ্রু কুঁচকে গেল, কৌতুহল নিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল সায়ন ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। সায়নকে চিনতে অসুবিধা হলো না সেতুর, স্টেজে থাকতেই সায়নকে চিনতে পেরেছিল কিন্তু হঠাৎ করে এইভাবে ডাকার কারনটা ঠিক বুঝতে পারল না।
সায়ন এগিয়ে এসে সেতুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে ভালো করে দেখল, সেইদিন রাগের চোটে মেয়েটার দিকে সেইভাবে নজর দেয়নি হয়তো নজর দিলে ঝগড়া করতে পারত না। সেতুর চেহারায় একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব সায়নকে মুগ্ধ করলো।
– ‘কি হলো এইভাবে আমাকে ডাকলেন কেন?’
সায়ন আরো একপলক সেতুকে দেখে বলল, -‘সেইদিন তোমাকে বিশ্বসুন্দরী বলে খুব একটা ভুল করি নি।’
সেতু রাগী লুক নিয়ে সায়নের দিকে নজর দেয়। সেতুর রাগী লুক দেখে সায়ন মূচকি হেসে বলল, -‘সুন্দরী এইভাবে তাকিয়ো না প্রেমে পড়ে যাবো, আর দোষটা কিন্তু তোমারই হবে।’
সেতু বুঝলো এই লোকের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তাই পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সায়ন সেতুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
অনুষ্ঠান শেষে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেতু আর সায়নের আর দেখা হয়নি ঠিকই কিন্তু সায়ন আড়াল থেকে সেতুর উপরে ঠিকই দেখে গেছে। কয়েকদিন থেকেই সেতুর মনে হচ্ছে ওকে কেউ ফলো করছে, কিন্তু কাউকেই দেখতে পাইনি।
টিউশনি শেষ করে সেতু একাই আসছিল। আজকে ফারিয়া, ফারহান কেউই আসেনি তাই সেতুকে একাকেই যেতে হচ্ছে। সেতু নিজের মতো হেঁটে চলেছে তখনি কেউ একজন ওর পাশে এসে হাঁটতে লাগল। সেতু পাশে তাকিয়ে দেখল সায়ন দাঁত বের করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
– ‘আপনি?’
– ‘কেন, অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি।’
– ‘অন্য কাউকে আশা করলেই কি? আর আপনি আমার পাশে হাঁটছেন কেন?’
– ‘আচ্ছা আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি।’
সেতু সায়নের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সায়নের আসলে কি উদ্দেশ্যে সেটাই বুঝতে পারছে না।
– ‘এই আপনার আসল উদ্দেশ্য কি বলুন তো। সেইদিন ঝগড়া করলেন, আবার আজকে ফ্রেন্ড হতে আসছেন কি ব্যাপার।’
সায়ন মাথা চুলকে হাসল। সেতু সায়নের হাসির মানে কিছুই বুঝল না।
– ‘আপনি এইভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেন?’
– ‘কিছু না। বললে না তো আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি।’
– ‘ভেবে দেখবো।’
সেতু চলে যেতে গিয়েও কিছু একটা মনে করে পেছন ফিরে সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, ‘ওকে আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ড।’
– ‘সত্যি।’ (অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে)
– ‘হ্যাঁ।’
সেতু আর সায়নের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। পাশাপাশি ফারিয়া আর ফারহানের সাথেও সায়নের ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সেতু আর সায়ন মাঝেমধ্যেই দেখা করে, ফোন করে গল্প পড়ে, আড্ডা দেয়।
সেতু আর সায়ন কথা বলছে আর ফারিয়া আর ফারহান দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিয়া ফারহানকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘ওই আমার কি মনে হয় জানিস ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে।’
– ‘আমার ওহ মনে হয়।’
– ‘যাই বলিস সায়ন’দা কিন্তু জোস্ দেখতে। আমার ক্রাশটা। সায়ন’দার স্টাইল, এ্যাটিটিউট জাস্ট অসাধারণ।’
ফারিয়ার মুখে সায়নের প্রশংসা শুনে ফারহানের মনটা খারাপ হয়ে যায়। গম্ভীর হয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে যায়। হঠাৎ করেই ফারহানের মুড অফ হতে দেখে ফারিয়া কপাল কুঁচকে বলে, ‘কি হলো তোর, আমি এত কথা বলছি আর তুই ফোনে কি করছিস।’
– ‘তো কি করবো। সায়নের প্রশংসা শুনবো?’
-‘কি হয়েছে? তুই এইভাবে বলছিস কেন?’
– ‘কি হয়েছে তুই বুঝিস না।’
– ‘কি বুঝবো?’
– ‘কিছু না বাদ দে। আমি গেলাম।’
ফারহান রাগ দেখিয়ে চলে যায়। ফারিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়, ফারহানের যাবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘ভালোবাসিস অথচ মুখ ফুটে বলতে এত বাঁধা!’
মাঝে কেটে যায় কয়েকটা দিন। ফারহান সেইদিনের পর থেকে ফারিয়াকে একপ্রকার ইগনোর করে চলেছে, ফারিয়াও কিছূ বলেনি। সেতু বুঝে উঠতে পারছে না হঠাৎ করে ওদের কি হলো?
সেতুকে আনমনা দেখে সায়ন ওকে জিজ্ঞাসা করে, -‘কি ম্যাডাম আনমনা কেন? কি ভাবছো এতো।’
– ‘জানেন ফারিয়া আর ফারহান একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কিছু বলছে না। ফারহান বলছে না কারন ওরা সেম এজ, আর ফারিয়া বলছে না লজ্জায়।’
– ‘তো তুমি এখন কি ভাবছো?’
– ‘ওদের মিলিয়ে দেবো।’
– ‘গুড। না ম্যাডাম সবাইকে মেলানোর দায়িত্ব নিচ্ছো, আমার সাথে আমার ভালোবাসার মানুষটিরও মেলানোর দায়িত্বও নাও।’
– ‘আপনার ভালোবাসার মানুষ আছে?’
– ‘হুম।’
সেতুর মুখটা কালো হয়ে যায়। এই কয়েকদিন সায়নের সাথে কথা বলতে বলতে সম্পর্কটাকে বন্ধুত্বের থেকে বেশি জায়গা দিয়ে দিয়েছে।
– ‘আমার আসছি তাহলে।’
সেতু উঠতে গেলে সায়ন সেতুকে টেনে বসিয়ে দিলো।
– ‘কি হলো আবার বসিয়ে দিলেন কেন?’
– ‘কথা বাকি আছে আমার।’
– ‘আমার সাথে এত কিসের কথা, আপনার ভালোবাসার মানুষটি রাগ করবে শুনলে।'(অভিমান করে)
সায়ন মুচকি হেসে বলল, ‘আমার ভালোবাসার মানুষটি যথেষ্ট ভালো, তোমার মতো হিংসুটে নয়।’
– ‘কি আমি হিংসুটে!’
– ‘হূম কোনো সন্দেহ আছে।’
সেতু রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। সায়নকে হাসতে দেখে ওর রাগটা আরো বেড়ে যায়, রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
– ‘শয়তান ছেলে তোর বিয়ে হবে না দেখবি।’
– ‘ছিঃ ছিঃ এইসব বলতে নেই।’
– ‘দূর আমি গেলাম।’
– ‘আরে রাগ করছো কেন? শোনো না।’
সেতু গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সায়ন সেতুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে চাই, আজীবন বাঁচতে চাই। হবে কি আমার?’
সায়ন গুছিয়ে বলতে গিয়েও এলোমেলো করে ফেলছে। সেতু হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে,সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– ‘কি বলছেন আপনি এইসব?’
– ‘ভালোবাসি। বিয়ে করবে আমাকে।’
সেতু কিছু বলতে পারল না। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। সায়ন সেতুর লজ্জা মাখা মুখটা দেখে মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার হাসির কারন হতে চাই। তোমার লজ্জা রাঙ্গা মুখে হারাতে চাই বারবার। হবে কি আমার?’
– ‘হ্যাঁ।’
সায়ন শক্ত হাতে সেতুর হাতটাকে আগলে নিলো। নতুন করে পথ চলা শুরু হলো, ভালোবাসার মানুষটির সাথে।
সেতু আর সায়ন হেঁটে চলেছে, মাঝেমধ্যে দুজনের হাত স্পর্শ করছে, সেতু বারবার কেঁপে উঠছে। সায়ন মুচকি হাসছে, ভালোবাসার মানুষটির সাথে একসাথে হাঁটছে অনুভূতি গুলোই আলাদা। আর সেতুও নতুন নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে।
সেতু ফারহানের সাথে খোলাখুলি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো। এতদিন দুজনের মধ্যকার অনুভূতির কথা জানলেও কাউকেই জিজ্ঞেস করেনি।
– ‘ফারহান।’
– ‘হ্যাঁ সেতু বল।’
– ‘তোর আর ফারিয়ার মধ্যে কি হয়েছে? দুজন দুজনের সাথে কথা বলছিস না কেন?’
– ‘কিছু না বাদ দে।’
– ‘ফারিয়াকে ভালোবাসিস?’
– ‘বাদ দে এইসব কথা।’
– ‘ঠিক আছে, তাহলে ফারিয়া যখন তোর লাইফ থেকে অনেক দূরে চলে যাবে তখন হ্যাপি হবি তো।’
ফারহান চমকে উঠল। বুকের ভেতরে অজানা দহনের সৃষ্টি হয়েছে।
– ‘সেতু তুই এইসব কি বলছিস?’
– ‘হ্যাঁ ঠিক বলছি, নিজের অনুভূতিগুলো নিজের মাঝেই ক’বর দিয়ে দিস তখন।’
– ‘সেতু প্লিজ এইসব বলিস না। তুই তো আমাকে একটু হলেও বুঝিস বল।’
– ‘বুঝি বলেই তো জানতে চাইছি।’
– ‘হুম, আমি ভালোবাসি ফারিয়াকে।’
– ‘তাহলে ওকে নিজের মনের কথা বলছিস না কেন?’
– ‘সেতু আমি আর ফারিয়া দুজনেই স্টুডেন্ট। আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, তারপরে ওকে আগলে রাখবো।’
– ‘সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তুই ওকে ইগনোর করছিস কেন?’
– ‘আমি যদি প্রতিষ্ঠিত না হতে পারি তাহলে আমাদের এক হওয়া হবে না। ফারিয়া কষ্ট পাক আমি সেটা চাই না।’
সেতু ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ফারহানের দিকটা সম্পূর্ণ বুঝতে পারছে কিন্তু কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।
সময় নিজের গতিতে এগিয়ে যেতে লাগল। ফারিয়া আর ফারহানের মাঝে আগের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা আর নেই, কোথাও একটা জড়তা কাজ করে দুজনের মাঝেই কারন দুজনেই অপরপ্রান্তের মানুষটির মনের অনুভূতিগুলো জানে। চাইলেও একে অপরের সাথে ঠিক মতো মিশতে পারে না। সেতুর খুব খারাপ লাগে এইভাবে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাবার জন্য কিন্তু ওর যে কিছুই করার নেই। অপেক্ষা করে আছে সঠিক সময়ের।
একটা সময় পরে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের ক্যারিয়ারের পেছনে। মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। সময়ের সাথে অনেককিছুই বদলে গেছে শুধু বদলে যায়নি সেতু আর সায়নের সম্পর্কটা। সম্পর্কটা আগের মতোই আছে, ভালোবাসাটা আরো বেড়ে গেছে।
সেতুর মুড অফ, সায়নের চাকরি হবার পর থেকে ওর সাথে ঠিকমতো কথা বলা হয়ে উঠেনি। সায়ন প্রচন্ড রকমের ব্যস্ত হয়ে উঠেছে নতুন অফিস নিয়ে।
– ‘সেতু এই শাড়িটা পড়ে সুন্দর করে সেজে নে।’
– ‘কেন?’
– ‘আজকে তোকে দেখতে আসবে।’
মায়ের কথাতে সেতুর মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। মা রেডি হতে বলে চলে গেল, সেতু কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। সেতু যে সায়নকে ভালোবাসে তাকে ছাড়া কিভাবে অন্য কাউকে মেনে নেবে। মায়ের কথা অমান্য করার সাহস দেখালো না সেতু, কারন বিষয়টির সাথে ওর পরিবারের মানসম্মান জড়িয়ে আছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাড়িটা পড়ে দেখি হয়ে নিলো।
সেতুর মা মেয়েকে ডাকতে এসে দেখলেন মেয়ে শাড়ি পড়ে আছে। মুখে কোনো সাজ নেই।
– ‘কিরে সেতু এমনি সময়ে তো সেজে থাকিস আর আজকে কি হলো?’
– ‘কিছু না।’
– ‘তুই বস আমি আজকে তোকে সাজিয়ে দেবো।’
সেতুর মা সেতুকে সাজিয়ে দিলো সুন্দর করে। অন্যদিন হলে সেতু আনন্দে লাফিয়ে উঠত, কিন্তু আজকে ওর যে কিছুই ভালো লাগছে না।
সময়মতো সেতুকে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। পাত্রের মা টুকটাক প্রশ্ন করছে, সেতু উত্তর দিচ্ছে কিন্তু একবারও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।
পাত্রের সাথে সেতুকে কথা বলতে দেওয়া হয়। সেতু ছেলেটিকে নিয়ে ঘরে চলে যায়।
– ‘কি ব্যাপার ম্যাডাম, মুখের অবস্থা এইরকম কেন?’
চেনা কন্ঠস্বর শুনে সেতু চমকে উঠল। সামনে তাকিয়ে অবাক..
সায়ন মুখে হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সেতু অনেক অবাক হলো, সায়নকে এইখানে আশা করেনি।
– ‘তুমি এইখানে?’
– ‘কেন আসতে পারিনা বুঝি।’
সেতু কিছু উত্তর দিতে পারল না। আনন্দে কথা বলার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পাত্রপক্ষ চলে যাবার পর সেতুকে বেশ খুশি দেখাচ্ছিল আর দেখাবেই না কেন সায়নের সাথে ওর বিয়ের কথা চলছে এটাই তো চেয়েছিল।
সায়ন প্রতিষ্ঠিত, ভালো ফ্যামিলি দেখে সেতুর পরিবার রাজি হয়ে যায়। কয়েকদিন পর অনেক ধুমধাম করেই দুজনের বিয়ে হয়ে যায়। সেতু সায়নের ঘরে বউ সেজে সায়নের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ থেকে এই ঘরটা ওরও। অন্যদিকে, কাজিনদের ভিড় ঠেলে সায়ন নিজের ঘরে আসতে হিমশিম খেয়ে যায়। সেতু সায়নকে সালাম করতে গেলে সায়ন আটকে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। তারপরে দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে, বেলকনিতে বসে গল্প করতে থাকে।
সেতু সায়নের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
– ‘প্রথমে ঝগড়া, তারপরে বন্ধুত্ব, প্রনয় আর তারপরে বিয়ে তাই না।’
– ‘হুমম। জানো তোমাকে টিচার ডে উপলক্ষে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখে আমি থমকে গিয়েছিলাম। তোমার বোকা বোকা চাহনি আমার বুকে ঝড় তুলেছিল, চাইলেও তোমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। তাই তোমার সাথে বন্ধুত্ব করি…’
সেতু সায়নের বুকে মাথা রেখে বলল,
– ‘ভালোবাসি।’
– ‘আমিও ভালোবাসি। হবে কি আমার?’
সায়নের কথার অর্থ বুঝতে পেরে সেতু সায়নের বুকে মুখ লুকায়। সায়ন মুচকি হেসে তার প্রিয়তমাকে আপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মাঝে কেটে যায় ১টা বছর। সেতুর পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে, সায়ন নিজের কাজে ব্যস্ত তবুও ওদের মাঝে সম্পর্কটা প্রথমদিনের মতোই আছে। ফারিয়া আর ফারহানের সম্পর্কটা আগের মতোই আছে, ফারহান পড়াশোনা শেষ করার পরেই চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যকারোর হতে দেখতে পারবে না, সেতুকে কথা দিয়েছে চাকরি পাবার সাথে সাথেই ফারিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
সেতু ঘর গোছাতে ব্যস্ত ছিল তখনি ওর কাছে একটা ফোন আসে। ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে উৎফুল্ল কন্ঠে ফারহান বলে উঠে,
– ‘সেতু আমার চাকরি হয়ে গেছে।’
সেতু খুশি হয়ে যায়। এইবার তাহলে আরো একজোড়া কপোত কপোতির ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।
– ‘তাহলে ফারিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব কবে দিচ্ছিস?’
– ‘আজকেই।’
– ‘আচ্ছা। অল দ্যা বেস্ট।’
– ‘সেতু একটা হেল্প করতে হবে।’
– ‘কি বল?’
– …..
– ‘ওকে।’
– ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
ফারিয়া সেতুর জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে কিন্তু সেতুর পাত্তাই নেই। হঠাৎ করেই ফোন করে আসতে বললো, নাকি খুব দরকার। ফারিয়া সেতুকে কল করতে যাবে তার আগেই ফারহান ওর সমানে গিয়ে দাঁড়ায়। ফারিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়, ফারহান এইখানে কেন সেটা বুঝতে পারল না। তবে ওকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছাও ছিল না, তাই চুপ করেই বসে থাকল। যেন ফারহানকে দেখেই নি।
– ‘ফারিয়া।’
ফারিয়া চমকে উঠল। কতদিন পর মানুষটির মুখে নিজের নাম শুনছে।
– ‘কিরে কথা বলবি না।’
– ‘তুই এইখানে কেন?’
– ‘তোর সাথে কথা বলতে এসেছি।’
– ‘তোর সাথে আমার কিছু কথা নেই।’
– ‘আমার বউ হবি?’
ফারিয়া চমকে উঠলো ফারহানের মুখে এই কথাটা শুনবেন সেই আশা তো একেবারেই ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু কিছু একটা মনে করে বলল,
– ‘না হবো না।’
#পর্ব_৪ (শেষ পর্ব)
ফারিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
– ‘যখন তোকে দরকার ছিল তুই আসিস নি, অবহেলা করেছিল এখন আর তোকে আমার প্রয়োজন নেই।’
– ‘দ্যাখ ফারু আমার দিকটা একটু বোঝ প্লিজ।’
– ‘সবটাই তো বুঝছি। ঠিক আছে মানবো একটা শর্তে।’
– ‘কি?’
– ‘খুব তাড়াতাড়ি আমাকে বউ করে নিয়ে যেতে হবে।’
ফারহান হেসে দিল। ওহ জানত ফারিয়া কখনোই ওকে ফেরাবে না, তাই তো নিজেকে এতটা শক্ত রাখতে পেরেছে।
সেতু আজকে খুব খুশি। একপ্রকার লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে। সায়ন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– ‘ কি ব্যাপার আজকে এতটা খুশি কেন?’
সেতু খুশি হয়ে সবটা খুলে বলল। সায়ন মৃদু হেসে বলল,
– ‘এইজন্য এতটা হ্যাপি।’
– ‘হুমম।’
– ‘পাগলি বউ আমার।’
সায়ন সেতুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিল। সেতু লজ্জা পেয়ে ওর বুকের সাথে গুটিয়ে গেল।
ফারহান বাড়িতে ফারিয়ার কথা জানায়, দুই পরিবারে কথা বার্তা বলেন তারপর খুব ধুমধাম করে ফারিয়া আর ফারহানের বিয়ে হয়। সেতু তো খুব খুশি তার দুই বন্ধুর ভালোবাসা এতদিনে পূর্নতা পেল।
সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ করেই সেতু আর সায়নের জীবনে নতুন ঝড়ের আগমন ঘটে। সায়ন অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেতু পাগলের মতো আচরন করতে থাকে। ডক্টর রির্পোট করতে দেয়, সেইটা করার পর জানা যায় সায়নের ক্যানসার হয়েছে। সেতুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ধীর পায়ে সায়নের কেবিনের দিকে যায়, সায়ন বেডে শুয়ে আছে, হাতে স্যালাইন, মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। সেতু ঢুকরে কেঁদে উঠল।
– ‘কি হলো কাঁদছো কেন?’
সেতু কিছু না বলে কেঁদেই চলেছে।
– ‘আরে কাঁদছ কেন? দ্যাখো আমি একদম ঠিক আছি তো, ম*রে যায়নি।’
সেতু সায়নের মুখে হাত দিয়ে বলল,
– ‘খবরদার এইরকম কথা বলবে না। তুমি না কথা দিয়েছ সারাজীবন আমার সাথে থাকবে, বুড়ো বয়সে একসাথে গল্প করব আরো কত কি? সেগুলো করা না পর্যন্ত তোমার ছুটি নেই।’
সায়ন হাসল। সেতুর কান্না দেখে মনের ভেতরে কিরকম একটা খচখচানি হচ্ছে, মনে হচ্ছে ওর কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি?
প্রথমে সেতু প্রচন্ড ভেঙে পড়ে ভালোবাসার মানুষটির মরনরোগ জেনেও কিভাবে ঠিক থাকবে। সায়নের অবস্থা দেখে ডক্টর ওকে নিয়ে বাইরে ট্রিটমেন্ট করতে বলে, হয়তো সুস্থ হয়ে গেলেও হয়ে যেতে পারে তখন আশার আলো দেখতে পাই। সেতু শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। ভালোবাসার মানুষটিকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দেবে না, নিজের সবটা দিয়ে লড়াই করে যাবে।
সায়ন প্রথম প্রথম কিছু না জানলেও পরে সবটা জানতে পেরে যায় এবং মানসিক ভাবে কিছুটা ভেঙে পড়ে।
– ‘সেতু আমি মনে হয় বেশিদিন বাঁ*চব না বলো।’
– ‘খবরদার এই কথা বলবে না ,বারন করেছি না। ডক্টর বলেছে ট্রিটমেন্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।’
– ‘এই রোগ সারার নয়।’
– ‘ঠিক সেরে যাবে। চিন্তা করো না, যা হবে ভালোই হবে।’
১মাসের মধ্যেই সায়ন আর সেতু লন্ডনে পারি দেয় আর এইখানে শুরু হয় সেতুর নতুন লড়াই। লন্ডনে এসেই সায়নের ট্রিটমেন্ট শুরু করে দেওয়া হয়। সায়ন বারবার বারন করে, ওহ আসতে চাইনি পরিবার আর সেতুর জেদের কারনে আসতে হয়েছে। একপ্রকার আশাই ছেড়ে দিয়েছে বেঁ*চে থাকার।
– ‘সেতু কেন এতটা লড়াই করছো। আমার যা রোগ হয়েছে তাতে বাঁচার আশা নেই। বাদ দাও দেশে ফিরে চলো।’
– ‘চুপ একদম চুপ। তুমি ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবে, আল্লাহ কখনোই আমাদের খারাপ কিছু করবেন না।’
ট্রিটমেন্ট চলতে থাকে তার সাথে সায়ন আর সেতুর সম্পর্কটা আগের থেকেও স্ট্রং হয়ে উঠে। দুজনের ভালোবাসা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আনম্যাচুউর মেয়েটা কখন এতটা দায়িত্বশীল হয়ে উঠল সেটা নিজেই বুঝতে পারল না।
সায়নের ট্রিটমেন্টের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন, তাই সেতুকে চাকরি করতে শুরু করতে হলো। অফিস বাড়ি সায়নের দেখাশোনা সবটা একা হাতে সামলাতে লাগল।
সেতু অফিস থেকে আসার পরেই পানি দেওয়া, আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেওয়া। অফিসের কিছু কাজে হেল্প করা। ভালোবাসায় দিন কাটতে লাগল ওদের। সায়নের ছোট ছোট কেয়ার গুলো সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষেই দূর করে দিত।
এইভাবেই কেটে যায় কয়েকটা মাস, সেতুর অগাধ বিশ্বাস ভরসা ও ট্রিটমেন্টে সায়ন আগের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে।
সেতু আজকে অফিস যায়নি। সায়নের রির্পোট ভালো আসার আনন্দে আজকে লন্ডন শহরটা ঘুরতে বেড়িয়েছিল। আসার পর থেকে একটার পর একটা ঝামেলাই শহরটাকেই ঘুরে দেখা হয়নি। অনেকদিন পর দুজন মিলে এতটা আনন্দ করল।
রাতের রান্না করছি তখনি সায়ন পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– ‘থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম আজকের দিনটাকে এতটা স্পেশাল করে তোলার জন্য।’
– ‘শুধু থ্যাঙ্কস।’
– ‘আচ্ছা কি চাও বলো।’
– ‘তোমার সুস্থতা।’
– ‘হুমম। শোনা না আমি তো এখন সুস্থ হয়ে গেছি। একটা জব নিয়ে নিই আর তুমি সংসার সামলাও।’
সেতুর মনখারাপ হয়ে যায়। জবটা করতে ভালোই লাগে, আর সায়ন করতে বারন করছে!
– ‘কেন আমি কি সংসার সামলাতে পারছি না? জবটা ছেড়ে দিতেই হবে।’
সেতুর কন্ঠ শুনেই সায়ন বুঝে যায় ওহ জবটা করতে চাই। তাই আপত্তি না করে বলল,
– ‘ঠিকাছে করো, কোনো সমস্যা নেই।’
সেতু খুশি হয়ে সায়নকে জড়িয়ে ধরে। এই মানুষটাকে এই জন্যই তো এতটা ভালোবাসে, না বলা কথাগুলোও সহজেই বুঝে যায়। মানুষটা ওর কাছে বেস্ট।
বর্তমানে সেতু ও সায়ন দুজনেই লন্ডনের বুকে প্রতিষ্ঠিত। ওদের দুজনের কোনো কিছুর কমতি নেই, দুজন দুজনের জন্য যথেষ্ট।
সেতু ব্যস্ত শহরটাকে তাকে দেখতে ব্যস্ত। সায়ন দুই কাপ কফি করে নিয়ে এসে সেতুকে দিলো।
– ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়ল শহর দেখতে। সায়ন কিছু একটা ভেবে বলল,
– ‘আচ্ছা সেতু তোমার খারাপ লাগে না?’
– ‘কেন?’ (ভ্রু কুঁচকে)
– ‘এই যে আমি তোমাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিতে পারলাম না।’ (মনখারাপ করে)
– ‘আমার কাছে কোনোকিছু তোমার থেকে দামি কিছু নয়। তোমার ক্যানসার ধরা পড়ার পর আমি ভেবেছিলাম তোমাকে হারিয়ে ফেলব কিন্তু সেটা হয়নি তুমি আমার কাছে আছো সুস্থ আছো এই থেকে বড়ো পাওয়া আর কি হতে পারে।’
সায়নের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, সেতুকে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরল। অন্যজনের সন্তান দেখল, কাপল দের বেবি নিয়ে পিক দেখলে সায়নের নিজেকে বড্ড অক্ষম মনে হয় ওহ ব্যর্থ বাবা হতে, সেতুকে মাতৃত্বের স্বাদ দিতে কিন্তু এটা নিয়ে সেতুর কোনো অভিযোগ নেই। উল্টে ওহ কিছু বললে শাসন করে, এইসব ভেবে মনখারাপ করতে বারবার বারন করে। কিন্তু মন তো খারাপ হয়েই যায় তবে যখনি সেতু কথাগুলো বলে তখন সব মনখারাপ দূর হয়ে যায়। এইরকম একজন জীবনসঙ্গী থাকলে প্রতিটা মানুষের জীবন সুখময় হয়ে উঠবে। বিপদে আপদে সবসময়ে ভালোবাসার মানুষটিকে পারে পেলে আর কি চাই। সত্যি সায়ন এতটা লাকি সেতুর মতো একজনকে অর্ধাঙ্গিনী পেয়ে। ভালো থাকুক সায়ন আর সেতু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওরা যেন একসাথে থাকতে পারে সেই দোয়াই করবেন সকলে।
Leave a Reply