আমার লেখা প্রথম বই ‘একজন শিক্ষকের আত্মজীবনী’ ২০১৯ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। অনেকেই পড়েছেন আবার ফেইজবুকে নতুন নতুন পাঠক তৈরী হওয়ায় অনেকেই পড়তে পারেননি। সে কারণে পুনরায় শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
একজন শিক্ষকের আত্মজীবনী
প্রথম খণ্ড, অধ্যায় এক
আমার জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার বোড়াশী ইউনিয়নের উত্তর ভেন্নাবাড়ী গ্রামে। শৈশবের প্রথম বেলাটা কেটেছে আমার এ জন্মভূমিতে। জীবন যে এতো মধুর, পৃথিবী যে এতো সুন্দর এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা, তার প্রথম উপলব্ধিটা ছিল শৈশবকে ঘিঁরে। দু’নয়নে যা-কিছু দেখতাম, সবকিছুতেই ছিল বিস্ময়। আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা-এটা কী ছড়া না কবিতা? নাকি শতাব্দি পার হয়ে আসা সূরের মূর্চ্ছনা! অবাক বিস্ময়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখতাম, কল্পনায় ভেসে উঠতো কতনা দৈত্য-দানব। মনে পড়ে ঠিক সন্ধ্যায় নানুকে ঘিরে রূপ কথায় বগা-বগীর করুণ কাহিণী, আব্বা-মা’র কন্ঠে সুর দিয়ে পুঁথি পড়া- ‘ইউসুফ-জুলেখার প্রেমের উপখ্যান’ সব কিছুই মনে হয় এখনও জীবন্ত হয়ে আছে হৃদয়ের মনিকোঠায়। জীবন এগিয়ে চলছে, আমি বড় হচ্ছি; কিন্তু শৈশবের সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই আমি চমকে উঠি; চোখের পাতা জলে ভরে যায়। আমরা যে-যেখানেই থাকিনা কেন, আমাদের বারে-বারে ফিরে যেতেই হয়, ফেলে আসা সেই শৈশবের কাছে।
বছর দশেক হবে গ্রামেই কেটেছে আমার জীবন। বাড়ীতে আব্বা, মা, ভাই-বোন; পাশেই বড় চাচার সংসার-ছেলেমেয়ে এবং বিশাল আম বাগানে ঘেঁরা নানু বাড়ী, মাত্র দু’মিনিটে পায়ে হাঁটা পথ; সবকিছু মিলে মুখরিত ছিল আমার শৈশব। আমার লেখাপড়ার হাতে-খড়ি শেখ মুজিব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্তু এখানেই পড়েছি। স্কুল, গ্রামের ঠিক মাঝ-খানটায়। বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না। হেঁটেই স্কুলে যেতে হতো। সহপাঠিদের সবার নাম এখন আর মনে করতে পারছিনা। স্কুলে যাদের সাথে পাশা-পাশি বোসতাম তার মধ্যে দিলু, আলেয়া, নিরু, জাকিয়া, সেলেনা, জামাত, উসমান, সবুর, বসার, হান্নান, বোরাক, জাকির, নূর ইসলাম কালু, বাবুল, জাহানারা, মুর-ছেলিন, নসু এবং সেলিম অন্যতম। আমার সহপাঠীদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া অনেকেই অভাব-অনটনের জন্য খুব বেশীদূর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি।
এখন যেমন সাদা কাগজের উপর কাঠ-পেন্সিল দিয়ে লেখাপড়ার জীবন শুরু হয়; আমাদের সময়ে বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে তখন এ ব্যবস্থা ছিল না। ক্লাসের অনেকেই তাল পাতায় লিখতো। কালি হিসেবে ব্যবহৃত হতো রান্নার পর হাড়ি-পাতিলের নীচে যে কালি জমতো, সেটা ঝিনুকের সাহায্যে আঁচড়িয়ে ছোট্ট দোয়াতে ভরে, বাঁশের কঞ্চির আগা কেটে কলম বানিয়ে তা দিয়ে লেখা হতো। মনে পড়ে প্রত্যেক ছাত্রের কাছে ৭/৮ টা তালপাতা দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকতো, ওখান থেকে একটা-একটা বের করে এ তালপাতায় ‘অ’ ‘আ’ ‘ই’ এবং ১, ২, ৩ ইত্যাদি লিখে হুজুরকে লেখা দেখাতে হতো। এ লেখা লিখতে গিয়ে কোন একটা ভুল হলে মোছার জন্য সবার হাতে কাপড়ের নেকড়া থাকতো। স্কুল শেষে বাড়ী ফিরলে ছাত্র-ছাত্রীর চেহারা দেখলেই বোঝা যেত, বিদ্যালয়ে লেখাপড়া আজ কিছু করেছে কীনা! কেননা, লেখনির সেই কালি সারা শরীরে এমন ভাবে লেগে থাকতো, সত্যিই বহু বছর পর আধুনিক সভ্যতার উপর দাঁড়িয়ে মনে হয় কতনা কৃপা ভিক্ষার উপর টিকে ছিল আমাদের সেই শৈশবের শিক্ষাটুকু। তবে তাল পাতায় আমি কখনো লিখিনি; আমরা কয়েকজন শ্লেটের উপর ধূঁসর রঙের এক ধরনের চুনা মাটির তৈরি পেন্সিল দিয়ে লিখতাম।
স্কুলের যে লম্বা টিনের ঘরখানা ছিল; সেখানে উপরের ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের ক্লাস চলতো। বিশাল লম্বা বারান্দায় পেতলের একটা ঘণ্টা ঝুলানো ছিল। আমরা যেখানে ক্লাস করতাম কোন ঘর ছিল না। আমাদের ক্লাস চলতো ফাঁকা জায়গায়, মাঠের ঠিক দক্ষিণ পাশে আম বাগানের ছায়ায় বসে। প্রতিদিন বগলে করে একটা করে খেজুর পাতার তৈরী পাটি নিয়ে আসতাম বসার জন্য। একজন হুজুর স্যার ছিলেন, নামটা আজ আর মনে নেই, তিনি একটা কাঠের চেয়ারে বসতেন; আর আমরা সবাই গোল হয়ে হুজুরের চতুর্দিকে বসতাম। আমি শুরুতে ওখানে থাকলেও কিছুক্ষণ পর প্রতিদিনের ন্যায় হুজুর আমাকে ডেকে কাছে নিতেন; আমার দায়িত্ব ছিল-হুজুরের ঠিক পার্শ্বে মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে দুই অক্কে দুই, দুই দুগুনে চার, তিন দুগুনে ছয় -এভাবে সুর দিয়ে নামতা পড়ানো।
আজ এ নামতা পড়ানোর কথা মনে পড়ে হুজুরের কত কথাই না মনে পড়ছে। বড় হলে শুনেছি হুজুরের বাড়ী ছিল নোয়াখালি। পরিবারের অন্য কোন সদস্য ছিল কিনা সেটা জানা নেই, তবে এ স্কুলটাকে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রামেই একা একা সারাটা জীবনই কাটিয়ে দিয়েছেন। ক্লাস যখন চলতো বেতের একটা লাঠি হুজুরের হাতে সবসময় থাকতো; কারণে-অকারণে এ বেতের লাঠি ছাত্রদের পিঠে পড়ত ঝুমুর দিয়ে তালে-তালে। এ স্কুলে যারা লেখাপড়া করেছে এমন কোন ছাত্র বলতে পারবে না যে, সে হুজুরের ঐ বেতের লাঠির বাড়ি খায়নি।
হুজুরের একটা অভ্যাস ছিল উনি দাওয়াত খেতে পছন্দ করতেন। প্রতিদিন একজনকে ডেকে বোলতেন, “এই শুন-শুন বাড়ীতে পৌঁছে তোর মাকে বলিস, আজ দু’বেলা তোদের বাড়ীতে খাব।” যে কথা সেই কাজ, এভাবেই সারা বছর পালাক্রমে চলতো হুজুরের খানা-পিনা। আমাদের ক্লাস চলতো ঘণ্টা দু’য়েক, অর্থাৎ সকাল ০৮টা থেকে ১০টা পর্যন্তু। মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য স্কুলে আসা, তা সত্বেয় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম; কখন বাজবে সেই ঘণ্টা! অবশেষে এ অপেক্ষার পালা শেষ হতো! ছুটির ঘণ্টা বাজলেই ‘পাটি গোছানোর সময় কেউ পেতোনা; কে কোথা দিয়ে দৌঁড়াবে, কার আগে কে যাবে’- সেই -যে কী আনন্দ, সেটা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। এই দৌঁড়-ঝাঁপ, চিল্লা-চিল্লির মধ্যে হুজুরের আর একধাপ বেতের বাড়ি পিঠে নিয়ে আমরা যে-যার মতো করে বাড়ী ফিরতাম। তবে হুজুর আমাকে খুব পছন্দ করতেন, ভালো বাসতেন। রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থণা করি, তাঁকে যেন বেহেস্ত নসীব করেন।
এখন কত বন্ধু-বান্ধব হয়েছে, কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে ; কিন্তু সেই-যে তালপাতা, আদর্শলিপি, সুর দিয়ে নামতা পড়া সহ-পাঠীদের কথা মনে পড়লেই প্রাণটা কেঁদে ওঠে। বিশেষ করে নিরুর কথা খুব মনে পড়ে, তখন কী-ইবা বুঝতাম? বন্ধুত্ব কাকে বলে, কী জিনিস এসব জানা ছিল না। অথচ নিরু স্কুলে আসতে একটু দেরী করলে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম! শেষমেষ আমার পাশে ওর জন্য জায়গা রেখে দিতাম; তখন কেন এটা করতাম, সেটা তখন বুঝে উঠতে না পারলেও, এখন বুঝি-এর নামই ‘বন্ধুত্ব’।
চলবে————–
Leave a Reply