প্রতিদিনের মতো আজকেও আরিয়া ডায়েরি খুলে বসে আছে।এটা তার প্রতিদিনের নিয়ম সন্ধ্যা নামতে সে এটা খুলে বসে আর পড়তে থাকে পড়তে পড়তে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।এটা এখন নিত্যদিনের অভ্যাস । এই ডায়েরিতে কি আছে সেটা সে ছাড়া কেউ জানেনা।সে ছাড়া কখনো এই ডায়েরি কেউ ছুঁয়ে দেখেনি।ছুঁয়ে দেখেনি যে তা নয় তার ছোট বোন সাইরা চেষ্টা করে ছিল কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।তার এই নিত্যদিনের অভ্যাসে তার প্রতদিন এভাবে কান্না সহ্য করার চেষ্টা অভ্যাস তার পরিবারের ও হয়ে গেছে।
ভেড়ানো দরজা ঠেলে সাইরা রুমে ঢুকে আর সে রুমে ঢুকতে আরিয়া ডায়েরি বন্ধ করে কান্না মুছে ফেলে।চুপ করে বসে পড়ে খাটের কোনায়।
সাইরা এসে পাশে বসে,,,
তাসরিফ ভাইয়া চলে গেছে আজকে ৩ বছর ৩ মাস হতে চললো,,তুই চলে যাওয়ার দিন থেকে এভাবে প্রতিদিন কেঁদে যাস,,কেন কাঁদিস এভাবে কাঁদলে কি ফিরে আসবে?ডায়েরি টাই কি এমন আছে কেউ জানেনা কাউকে দেখতেও দিস নাহ।আম্মু আব্বু বিয়ের কথা বললেও তুই রাজি হস না,, এভাবে কি জিবন কাটিয়ে দিবি? আরিয়ার কোনো উত্তর আসেনা।সাইরা জানে উত্তর যে আসবেনা।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে চলে যায়।
আরিয়ার স্মৃতি চারণ করতে থাকে
**এইতো চার বছর আগের কথা নতুন বাসা নিয়ে তাদের বর্তমান এরিয়ার শিফট হয়ে আসে তারা।আরিয়ার বাবা একজন সরকারী ব্যাংকার সেই সুবাদে এখানে বদলি হয়ে আসা।আরিয়া তখন সবে মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে আর সাইরা তখন সবে মাত্র ক্লাস ৯ এ উঠেছে।আরিয়া তখন সব কিছু নতুন ছিল জায়গা,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানুষ। আরিয়া একটু আন্তঃমুখী হওয়ায় সে সহজে কারো সাথে মিশতে পারতোনা। তাই সারাদিন বাড়িতে কাটানো খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কলেজ যেতোনা। আর সারা বিকাল কাটাতো ছাদে।তেমনি একদিন ছাদে উঠে হাটছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ে পাশের বিল্ডিং ছাদে বসে কেউ মিষ্টি সুরে গান গাইছে।আরিয়া গানের আওয়াজ শুনে তাকাতে দেখে খুব সুন্দর একটা ছেলে। পুরাই যেনো সুদর্শন পুরুষ। পুরাই যেনো রাজকুমার। তার চেয়ে বেশি সুন্দর তার গানের কন্ঠ। আরিয়া চুপটি করে দাঁড়িয়ে গান শুনছে। ছেলে টার কোনো হেল দুল নাই একমনে সে গান গাইতেছে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাই ছেলেটা তখনো গান গাইছে।আরিয়া অন্যদিন সন্ধ্যা নামার আগে চলে যায় আজকে সে ছাদেই দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ ভেসে আসে দূর থেকে মাগরিবের আযান।গান তখন থেমে যায় আরিয়ার ঘোর কাটে।আরিয়া তখন দেখে ছেলেটা ছাদ বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।আরিয়া ও চুপ করে নিচে নেমে যায়।এভাবে প্রায় প্রতিদিন একই নিয়মে চলে থাকে আরিয়া নিয়ম করে ছাদে আসতো আর ছেলেটাও ছাদে এসে নিয়ম করে গান গাইতো।কিন্তু কখনো আরিয়ার দিকে ছেলেটা তাকিয়েছে কিনা আরিয়া জানেনা। কখনো দেখেনি তাকাতে।কিছুদিন যাওয়ার পর আরিয়া প্রতিদিনের মতো সেদিন ও ছাদে আসে কিন্তু সে কাউকে দেখতে পায়না।ভাবছে হয়তো দেড়ি করে আসবে আরিয়া দেয়াল ঘেষে দাঁড়ায় আর অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু অনেক্ষন গড়িয়ে যায় সে আসেনা।আরিয়া মন খারাপ করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে দেখে একটা ভারি কিছু পড়ে আছে উল্টিয়ে।আরিয়া হাতে নিতে দেখে দেখে একটা ডায়েরি ঠিক মাঝপৃষ্টা কিছু লেখা।আর ডায়েরি টা কেউ ছুড়ে মেরেছে তাই উল্টে পড়ে আছে।আরিয়া লিখাটা পড়তে দেখে লিখা আছে।প্রিয় মায়াবতী আজকে ছোট আপুর অপারেশন তাই আসবোনা। গান শুনাতে পারবোনা।অপেক্ষা করোনা। কালকে আসবো ইনশাল্লাহ।আরিয়া লিখাটা পড়তে আরিয়ার মন খুশিতে ভরে উঠে। সে ভাবতে থাকে যে ছেলেটা তাহলে তাকে খেয়াল করতো কিন্তু চোখে পড়েনি কেন?কিন্তু আরিয়ার মনে কিঞ্চিত সুখের পাখি নীড় বাঁধতে শুরু কর।
আরিয়ার বাসায় এসে ডায়েরি আরেক পৃষ্টায় লিখতে থাকে আপনি তাহলে আমাকে খেয়াল করতেন?কিন্তু আমি কখনো দেখিনি কেন?আর আপনি এতো মিষ্টি সুরে গান কিভাবে গান।মনে হয় যেনো মধুর সুর ঢেলে দিয়েছে আপনার। আর সেটা পরেরদিন আরিয়া তার ছাদ থেকে সামনের ছাদে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
ছেলেটা আজকে আসে জায়গা মতো বসে গান গায়।গাওয়া শেষে ডায়েরিটা হাতে তুলে লিখাটা পড়ে নেয়।আর এভাবে প্রতিদিন গান গাওয়া শোনার সাথে সাথে এভাবে ডায়েরি মাধ্যমে চিঠি আদান প্রদান হতো এক প্রকার।কিন্তু কোনোরকম মুখে কথা বলাবলি হতোনা।এভাবে কিছুদিন যায় তার পরিচয় আর বন্ধুত্ব হয়। তখন আরিয়া জানতে পারে ছেলেটার নাম তাসরিফ,, সম বয়স। সম ক্লাসে তারা কিন্তু কলেজ ভিন্ন।
তারা ২ বোন ১ভাই। সম বয়সি হওয়ায় সখ্যতা খুব ভালোভাবে গড়ে উঠে।এভাবে নিয়ম করে ডায়েরি আদান প্রদান চলতে থাকে।প্রায় ১মাস পর তেমনি একদিন আরিয়া ছাদে বসে হাতে ডায়েরি নিয়ে গান শুনছিল।হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়। আরিয়া তাকিয়ে দেখে তাসরিফ তার হাতের গিটার রেখে তাদের ছাদ টপকায় আরিয়াদের ছাদে চলে এসেছে।ছাদ টা পাশাপাশি হওয়ায় টপকাতে বেগ পেতে হয়নি তেমন। আরিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাসরিফ আরিয়া সামনে এসে দাঁড়ায়।
কি ম্যাডাম এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন?(তাসরিফ)
তুমি এখানে তাও প্রথম বার আর এভাবে (আরিয়া)
ভাবলাম কাছাকাছি থেকেও কেমন একটা দূরত্ব। তুমি তো জানো তুমি ছাড়া এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই।তুমি যেমন নতুন আমিও তেমন নতুন এখানে।(তাসরিফ)
আচ্ছা আমরা তো দুজন দুজন কে চিনি অনেক দিন হয়ে গেলো।তোমার কি মনে হয় আমি কেমন? (তাসরিফ)
তুমি অত্যন্ত নম্র ভদ্র অমায়িক একটা ছেলে যে খুব ই ভালো(আরিয়া)
আরিয়া আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। যেটা ডায়েরি তে বলা যেতো না। বললেও কেমন দেখাতো।যদিও এই ডায়েরি আমাদের মাধ্যম আমাদেত প্রথম সাক্ষী। (তাসরিফ)
হ্যা বলোনা কি বলবে (আরিয়া)
তাসরিফ আরিয়া হাত ২টে ধরে নিজের হাতে মুঠোয় নেয়।আর বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি আরিয়া।
আরিয়া অনেক আগে থেকে তাসরিফ কে ভালোবাসতে শুরু করেছে কিন্তু সে বুঝতে দেয়নি।কিন্তু এখন তাসরিফ বলায় আরিয়া যেনো নিজের ভেতর বাধা সুখের নীড়ে শক্ত খুটির সন্ধান পায়। আরিয়া তাই দেড়ি না করে জানিয়ে দেয় সেও তাকে ভালোবাসে।২জনের ভালোবাসায় এগোতে থাকে দিন। কথা মুখে বলার চেয়ে ডায়েরি আদান প্রদান টাকে তারা প্রাধান্য দিতো বেশি।এটা যেনো তাদের কাছে একটা আলাদা সুখ আলাদা মাধ্যম।যাতে সবাই অভ্যস্ত নয়।এভাবে কাটে দিন।
প্রায় ৫মাস পর।আরিয়া আজকাল লক্ষ্য করে তাসরিফ কেমন জানি তাকে খুব এরিয়ে চলার চেষ্টা করে। এই ৫মাস কেনো সমস্যা হয়নি। তাসরিফ অনেক ভালবাসতো খেয়াল রাখতো। একদিন না দেখলে মরি মরি অবস্থা হতো।সেই তাসরিফ এখন তাকে এরিয়ে চলে।তাকে জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলেনা।তবে আরিয়া দেখে আজকাল তাসরিফ খুব একা থাকতে পছন্দ করে দিন দিন খুব শুকিয়ে ও যাচ্ছে।আরিয়া জিজ্ঞাসা করলে কোনো উত্তর ই পায়না। আরিয়া কিছুর করার সে শুধু অপেক্ষা করে আগের তাসরিফকে ফিরে পাওয়ার। আরিয়া অনেক কষ্ট হয় তাও কিছু করতে পারেনা।এভাবে দিন পার হতে থাকে।কিন্তু আরিয়া প্রতিদিন একই সময় ছাদে আসে। অপেক্ষা করে কান্না করে আবার চলে যায়। এভাবে সময় গড়িয়ে যায়।আরিয়ার কাছে ডায়েরিটাও নেই।ডায়েরি টা তাসরিফের কাছে রয়েছে।
হঠাৎ একদিন আরিয়া ছাদে গেলে দেখে ডায়েরি ছাদে রাখা। আরিয়া খুশি হয়ে যায় অনেক।কারণ অনেকদিন পর সে ডায়েরি উত্তর পেয়েছে।সে ডায়েরি হাতে নেয়।তাসরিফের জন্য এদিক সেদিক তাকায় ছাদে কিন্তু সে কোথায় নেয়।আরিয়া মন খারাপ নিয়ে ডায়েরি টা পড়তে আরিয়ার নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি পড়ে যায়।তার মনে হয় সে যেন দুনিয়ায় নেই।ডায়েরিটায় লিখা ছিল।
“প্রিয় মায়াবতী আরিয়া।
আমি তোমাকে ভালোবাসি । সেই শুরু থেকে আজ অব্দি।আমি ভালোবেসে যাব আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি।কিন্তু আমার শেষ নিঃশ্বাস টার নিতে বোধহয় আর সময় লাগবেনা।তুমি যখন ডায়েরিটা পাবে আমি তোমার কাছে থাকবোনা।কোথায় থাকবো আমি জানি না।হয়তো পৃথিবীর বাইরে না হয় এই শহরের কোনো এক হসপিটালে। আমাকে এই কয়েকদিন জন্য মাফ করে দিও।আমি চেয়ে ছিলাম তুমি আমাকে ভুলতে শিখো।আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখ।কারন আমি যখন থাকবনা এই দুনিয়ায়। তুমি সবচেয়্র বেশি একা অনুভব করবে।তাই আমি যেদিন প্রথম জানতে পারি আমার ব্লাড ক্যান্সার আমি আর বেশিদিন তোমাদের মাঝে থাকবোনা।সেদিন থেকে আমি তোমাকে এরিয়ে চলেছি তোমাকে জানতে চেয়েছি কিন্তু পারেনি তাই এরিয়ে গিয়েছি।যাতে তোমার কষ্ট সহ্য করার শক্তি আল্লাহ আগে থেকে দেয়।জানো আরিয়া তোমার সাথে বাঁচার অনেক ইচ্ছে ছিল।কিন্তু দেখোনা আল্লাহ কি নির্মমভাবে তোমার কাছে থেকে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।আমার অনেক খুব কষ্ট হয়েছিল এখনো হচ্ছে অনেক হচ্ছে।আমি তোমাকে প্রতিদিন তোমাকে লুকিয়ে দেখতাম। তুমি ছাদে অপেক্ষা করতে কাঁদতে। আমার খুব কষৃট লাগতো।মনে হতো তোমার কাছে গিয়ে তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি।কিন্তু পারতাম না আমিও খুব কাঁদতাম।কত রাত ঘুমায়নি কত কেঁদেছি। আল্লাহ কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছি। কিন্তু আয়ু যে আমার শেষ। আমি না থাকলে কাদবেনা। ডায়েরি সবসময় সাথে রাখবে।এটাই যে আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী। ভালো থেকো সবসময়। আমাকে মাফ করে দিও।সবসময় হাসি খুশি থাকবা।আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। ভালো থেকো আমার মায়াবতী। ভালোবাসি খুব।
আরিয়া ডায়েরি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে আরিয়া নিচে নামে হাউমাউ করে কেদে কেদে।সেদিন সবাই জানতে পারে আরিয়া তাসরিফের একটা সম্পর্ক ছিল।আরিয়া ওদের বাসার সামনে যায় গিয়ে দেখে তালা মারা।দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতে বলে কাল কে তাদের ছেলে মধ্য রাতে অসুস্থ হলে হসপিটাল নেওয়া হয়।আর আজকে ভোরে মারা যায়।তাকে গ্রামে বাড়িতে নেওয়া হয়েছে দাফনের জন্য।আরিয়া এইসব শুনা মাত্র ওখানে অজ্ঞান হয়ে যায়।আর সেই থেকে শুরু আরিয়া শোকাহত দিন।আরিয়া প্রতিদিন ডায়েরিটা নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতো।এখনো কাদে।কতদিন এভাবে কাদবে কারো জানা নেই।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply