ঢাবির এস এম হলের সামনের এরিয়া। ঝুম বৃষ্টির মাঝে মুঠোভর্তি কৃষ্ণচূড়া হাতে ছেলেটা দৌড়োচ্ছে। লোকাল বাসের সামনের দিকের আয়নায় চেনা মুখটা দেখে জানালা দিয়ে উকি দিলো ইয়ানা। এই ছেলে এখানে কেনো? এমন তীব্র বৃষ্টিতে এভাবে দৌড়াচ্ছেই বা কেনো এ? জানালা দিয়ে খানিকটা মুখ উচিয়ে বললো,
ছেলেটার দৌড়ানোর গতি আরো বেড়ে গেলো ওকে তাকাতে দেখে। আরো দ্রুত দৌড়ে বাস অবদি পৌছালো সে। বাসের গায়ে দুটো চড় মেরে বললো,
বাসের গতি কমলো। সে দৌড়াতে দৌড়াতে উঠে দাড়ালো বাসে। সামনের সিটে বসে কপাল কুচকে তার হাতের কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ইয়ানা। প্রায় দেড়বছর পর দেখছে ওকে। চেহারায় বেশ ম্যাচিউরিটি এসে গেছে মাত্র দেড় বছরেই। ব্যাগ, বই কিছুই নেই ওর হাতে। এই কৃষ্ণচূড়া কুড়াতে অবশ্যই এভাবে ভিজছিলো না ও। নাকি এইটুকোন পুচকে ছেলেও গার্লফ্রেন্ডের জন্য কৃষ্ণচূড়া কুড়োতে গিয়েছিলো? মিনার বাসের দরজায় দাড়িয়ে। ইয়ানার দিকে তাকিয়ে, মাথার চুল উল্টেপাল্টে পানি ঝাড়লো। তারপর একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বললো,
কপালে আরেকটু ভাজ পরলো। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে থাকাকালীন এই ছেলেকে এডমিশনের জন্য মাস দুই পড়িয়েছিলো ইয়ানা। তারপর নিজের পড়াশোনার ব্যস্ততায় ছেড়ে দিয়েছে টিউশনিটা। যতোদুর মনে পরে, ওকে ছেলেটা তখন আপু বলেই ডাকতো। আজ হঠাৎ ম্যাম বলছে বলে ম্যাম ডাকটা কেমন যেনো হজম হলো না ইয়ানার। তবুও সৌজন্য বজায় রেখে বললো,
-আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তুই কেমন আছিস?
মিনার লাজুকলাজুক মুখ করে বললো,
-তোর বাসার সবাই? আঙ্কেল আন্টি?
-যাক। কোথায় ভর্তি হলি? ঢাবিতে?
মিনার গলা ঝারলো। আশপাশ একপলক দেখে নিয়ে বললো,
-সোহরাওয়ার্দী মেডেকেলে চান্স পেয়েছিলাম। ভর্তি হইনি। ঢাবিতে *** নিয়ে পড়ছি। আপনার প্রিয় সাব্জেক্ট।
সাব্জেক্টের নাম, ভার্সিটি শুনে খুশি হয়ে গেলো ইয়ানা। চেহারায় হাসি বাড়িয়ে বললো,
-বাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্! তো ট্রিট কবে দিচ্ছিস?
-দেখাই হয় না। তার উপর বলছিস সময় হলেই পেয়ে যাবেন। তাহলে তো আমার ট্রিট তালগাছের উপরেই ঝুলন্ত রইলো।
-সিরিয়াসলি ট্রিট দেবো আপনাকে। আফটার অল, আমার ঢাবিতে আসার পেছনের পুরো ক্রেডিটটাই তো আপনার।
আবারো কপাল কুচকালো ইয়ানা। মিনার জোরপুর্বক হেসে বললো,
-আমার কথা ছাড়ুন না! আ্ আপনার ক্লাস কেমন চলছে? ভার্সিটি কেমন লাগছে এখন?
-এইতো! মোটামুটি। যাচ্ছি, ক্লাস করছি, বেরিয়ে আসছি।
-আজকে একবার আমাদের ক্যাম্পাসে যাবেন ম্যাম? একটা জিনিস দেখানোর ছিলো।
হুট করে ওর এমন প্রস্তাবে আবারো বিস্মিত হলো ইয়ানা। ভাবলো মজা করছে হয়তো। কিন্তু ওর চেহারা দেখে মিনার আবারো ইশারায় বললো, বাস থেকে নামবে কি-না। ইয়ানা একটু ইতস্ততভাব দেখিয়ে বললাম,
-প্লিজ! বৃষ্টি লাগবে না আপনার গায়ে! জাস্ট একটা জিনিস দেখাবো। বাস তো এভেইলএভল এই রুটে। আজ একটু দেরিতেই যাবেন না হয়? আর কোনোদিনও এভাবে আবদার করবো না আপনার কাছে।
ইয়ানা বাইরে তাকালো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড তখন বৃষ্টিতে মুখরিত হতে ব্যস্ত। তার মোহ তো অনেক আগে থেকেই ছিলো ওর, আজ হঠাৎ সে মোহ গাঢ়ভাবে জেগে উঠলো যেনো। কি ভেবে সম্মতি জানালো ও মিনারকে। নেমে আসলো লোকাল থেকে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পা বাড়ালো কার্জনের সামনের রাস্তায়। কিন্তু দু পা এগোতেই থামতে হলো ওকে। হাটু গেরে, কৃষ্ণচূড়া মুঠোতে নিয়ে মিনার রাস্তা আগলে বসেছে। আহম্মকের মতো ভিজে ওড়না হাতে পেচিয়ে ইয়ানা তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। চারপাশ যেনো উচ্চস্বরে বলছে, এটা কি হলো? মিনার মাথা নিচু করে বসে। দুজনেই ভিজছে। আশপাশে আরো স্টুডেন্টস্ ছাতা নিয়ে, বা ভিজতে ভিজতেই যাচ্ছিলো যার যার গন্তব্যে। সবাই ওদের দুটোকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। ইয়ানা অনেকটাই তীক্ষ্ম গলায় বললো,
মিনার মাথা তুললো। আবেগে ভাসা প্রেমিকের স্বর ধ্বনিত হতে শুরু করলো ওর মুখ থেকে। একনাগাড়ে বললো,
-তোমার জন্য মেডিকেলে পড়লাম না। তুমি নাকি বিসিএসধারী পাব্লিকিয়ান বিয়ে করবে? তোমার ইন্টারমিডিয়েটের নোটখাতায় পড়া কম, ঢাবি লেখাই বেশি। তোমার হাতের মেহেদী ডিজাইনেও আমি ডিইউ লেখা দেখেছি। তুমি যদি এভাবে ঢাবিকে ভালোবাসতে পারো, তাহলে এরচেয়ে বেশি ঢাবিয়ানকেও ভালোবাসতে পারবে। সেই লোভে সোহরাওয়ার্দী ক্যান্সেল করেছি। আম্মুর ছেলেটাকে ডাক্তার হতে দেই নি। এখন যদি এই পাপীষ্টকে তুমি প্রেমিক হিসেবে স্বীকার না করো, এই কার্জনের প্রমিস, তোমাকে এমন বদদোয়া দেবো, কোনোদিনও বিসিএস জামাই পাইবা না তুমি। ভালোই যদি না বাসবে, তাহলে পড়াতে গিয়ে ভালোবাসা শেখালে কেনো? বায়োলজির হৃদপিন্ড আকানো শেখানোর সময় আমার হার্টবিট চুরি কেনো করলে তুমি? জ্যামিতি পড়াতে গিয়ে এই মনে আমাকে, নিজেকে আর ঢাবিকে নিয়ে বৃত্ত আঁকলে কেনো? মৌলগুলোর সংকেত না শিখিয়ে তোমার নামের ল্যাটিন বানান কেনো শিখলাম? আলো, শব্দের পরিবর্তে জীবনে খালি তোমার প্রতিফলন কেনো? কেনো বলোতো? হুয়াই?
তার কথায় ইয়ানা স্তব্ধ। সে আবারো বললো,
-অনেক বলে ফেলেছি। আমি আর কিছুই জানি না, তোমাকে ভালোবাসি ম্যাডাম। আই লাভ ইউ।
মিনারের কথা শুনে ইয়ানার একপ্রকার ইমারজেন্সির রোগী মনে হয়েছিলো নিজেকে। তখন একবার মনে হয়েছিলো, তুই ডাক্তারী পড়লেই ভালো হতো মিনার। ইয়ানা মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার উপক্রম হতেই মিনার তরিঘরি করে উঠে দাড়ালো। ফিল্মি স্টাইলে ধরতে যাচ্ছিলো ওকে। তেজ দেখিয়ে ইয়ানা লাফিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো,
-খবরদার হিরোগিরি দেখাবি না। কালকের বাচ্চা, আইসোস প্রেমিক সাজতে? আমাকে পাইতে হলে আরেকজন্ম নিয়ে আমার সিনিয়র হয়ে আয়। তারপর প্রেম না, ডিরেক্ট বিয়ে করুমনে তোরে। যা কার্জনের প্রমিস!
রাগের বশে বলেছিলো ইয়ানা। তবে মিনার সেদিন এককথাও বলেনি। আর তার পরিনতিতে হয়তো আজ সাতবছর পর ওই পাগলটাকেই বাচ্চার বাবা বলে পরিচয় দিতে হয় ইয়ানাকে। আরেকজন্ম তো নেয়নি। তবে ওর আগেই বিসিএস শেষ করেছে সে। সবটা ভেবে ইয়ানা বিমুঢ় হয় প্রতিবার। আজও বৃষ্টিমুখর দিনগুলোতে ও মিনারকে জিজ্ঞাসা করে বসে,
-কি থেকে কি হয়ে গেলো বলতো মিনার? এমন জেদী ছিলি তুই?
মিনার হেসে দিয়ে দেদারসে জবাব দেয়,
-জেদীই বটে। আপনার সব কথায় সবসময় খালি ইন্সপায়ার হইছি ম্যাডাম। এমন মোটিভিশনাল স্পিকার আজীবন সাথে রাখার সুযোগ হাতছাড়া কেমনে করি বলেন? আপনার লাস্ট কথা অনুযায়ী সিনিয়র হওয়ার এই একটাই উপায় ছিলো। আপনার আগেই বিসিএস ক্যাডার হওয়া। নেন। হইছি। এখন আপনি আমার প্রেমিকা, গার্লফ্রেন্ড, বাচ্চার মা, ঘরের বউ, দিন দুনিয়া, জান কলিজা সব। আই লাভ ইউ।
এমন কথা শুনে কে না বলবে ওইটা পাগল? কি আর করা? আই লাভ ইউ টু বলে, অতঃপর ওই পাগল নিয়েই সংসার করতে হয় ইয়ানাকে। দেয়ালে টানানো ওদের বিয়ের ছবিটায় লেখা, “জুনিয়রের জেদ হতে সাবধান”
[ কাহীনি কাল্পনিক। কোথাও কারো সাথে মিল থাকলে কর্তৃপক্ষ দায়ী না। বৃষ্টি, ভার্সিটির বাস, সিনিয়রদের গান (অবশ্য আমরাও গাইছি

) এই সব মিলিয়ে টাইপিং।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply