1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

☆’তুমি শুধুই আমার’ (গল্প) ☆ # ১ম পর্ব # (২য় পর্ব অন্তিম পর্ব ) # মাকসুদা খাতুন দোলন

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৮ মে, ২০২২
  • ৪৮৯ বার
চব্বিশ বছরের কুমারী জীবনের ইতি টেনে এক বুক আশা নিয়ে বাবার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে পা রাখলো দীপা। আজ তার বিয়ের প্রথম রাত। খুব কাছের প্রিয় বান্ধবী মিমির বিয়ের গল্প শুনে কতবার কল্পনার রাজ্যে ডুব দিয়েছে। একদিন নিজেরও বিয়ে হবে। ছোট্ট সংসার হবে,সন্তানের মা হবে। আদরের সন্তান সারা ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করবে। খুনসুটি,হাসি,গল্পে,আনন্দে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখবে প্রিয় মানুষগুলোকে।
ভার্সিটিতে পড়ার সময় ক্লাসমেট বন্ধু পলাশ প্রায়ই আড্ডা দেওয়ার সময় বলতো,
‘জানিস দীপা? আমার বউকে আমি খুব ভালোবাসবো। যে আমার বউ হবে সে খুব ভাগ্যবতী হবে। দীপা,তুই কি আমার লাইফ পার্টনার হবি?’
দীপা খিলখিল করে হেসে উড়িয়ে দিত। হাসতে
হাসতেই মজা করে বলতো,
‘ইশ্ কি আমার জামাইরে? তোকে বিয়ে করতে যাবো কোন দুঃখে? আমার জামাই দেখতে তোর চেয়ে কত হ্যান্ডসাম হবে দেখিস। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকবি সারাজীবন।’
পলাশও হেসেই জবাব দিল,’দেখবো তো কোন রাজকুমার স্বামী হিসাবে তোর কপালে জুটে?
আমার মতো গভীরভাবে তোকে আর কেউ বুঝবে না। কথাটা লিখে রাখ দীপা।’
পলাশকে দীপা সব সময় খুব ভালো বন্ধু মনে করতো। আজ পলাশের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে দীপার।
সব জল্পনা,কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণের মুখোমুখি দীপা। জীবনসঙ্গী যাকে পেয়েছে তিনি অজানা,অচেনা সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন।
দীপার বাবার ছোটকালের বন্ধুর ব্যবসায়িক পার্টনারের একমাত্র ছেলে মৃদুলের সাথে কিছুটা তড়িঘড়ি করেই বিয়েটা হয়ে যায়। ভালো করে কথাবার্তা,দেখা,জানাশোনা কিছুই হয়নি দু’জনের মাঝে। সুসজ্জিত খাটে এলোমেলো ভাবনার ভিতরে দীপার টেনশন,উত্তেজনা দুটোই কাজ করছে। সেই সাথে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। আচ্ছা মৃদুল ঘরে আসার সাথে সাথে কি পা ছুঁয়ে সালাম করবো?
নানু অনেক কথার সাথে ছোট্ট করে বলে দিয়েছিল,বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয়।
মৃদুলের কথার আওয়াজ শুনে দীপা দরজার দিকে তাকায়। মৃদুল মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে রাখতে ঘরে ঢুকলো। মৃদুল খাটের পাশেই রাখা ডিভানে বসে বলল,
‘দীপা,আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আশা করি আপনি আমাকে হেল্প করবেন।’
হঠাৎ এমন কথায় দীপার ভিতরে ধক করে শব্দ হলো। টেনশনের মাত্রা বেড়ে গেল। বিয়ের প্রথম রাতে বউয়ের মুখ না দেখে কি এমন জরুরি কথা বলতে চাইছে? দীপা এক পলক মৃদুলকে দেখে মাথা নীচু করে বলল,
‘কি জরুরি কথা?’
‘দীপা,আপনি কাউকে পছন্দ করতেন?’
দীপা চমকে উঠলো। নিজেকে প্রশ্ন করে,উনি কি বলতে চাইছে? চুপ থেকে আস্তে করে জবাব দিল,
‘না। তেমন কাউকে পছন্দ হয়নি।’
মৃদুল কথা শুরু করলো,
আমাদের বিয়েটা খুব তাড়াহুড়ো করে হয়ে গেলো। নিজেদের কথা কিছুই জানানো হলো না। আমার নিজের কথাগুলো জানার পর আমাকে
কাপুরুষ,প্রতারক অনেককিছু ভাবতে পারেন।
আপনাকে সত্যিটা জানানো খুব প্রয়োজন।
বিশ্বাস করেন,আপনাকে আমি ঠকাতে চাই না।
আমি নিরুপায় ছিলাম। পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি বিয়ে করেছি। আমি একজনের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ। ওর নাম ন্যান্সি। সাত বছর ধরে ওর সাথে সম্পর্ক। দু’জনেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রি ইকোনমিক্সের উপর মাস্টার্স শেষ করি। ন্যান্সি এখন এমএস করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছে। দু’জনেই একসাথে অনেকদিন ধরে ট্রাই করছিলাম। কথা ছিল দু’জনেই অস্ট্রেলিয়া সেটেল্ড হওয়ার পর বিয়ে করবো। আমারও যাবার প্রয়োজনীয় সব পেপারস প্রায় ঠিকঠাক হওয়ার পথে। এরই মাঝে বাসায় দুটো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দাদিজান দু’দুবার স্ট্রোক করলেন। দাদিজান বেঁচে ফিরলেও উনাকে নিয়ে আব্বার দুশ্চিন্তা বেড়েই যাচ্ছিল। কারণ,আব্বার জীবনে দাদিজানই সব। আমার কোনো চাচা,ফুপু নেই। আব্বার যখন এক বছর বয়স তখন দাদা মারা যান। দাদিজান নতুন করে সংসারে জড়াননি। আব্বাকে নিয়েই দাদিজানের পুরো পৃথিবী ছিল। আব্বার ধ্যান জ্ঞানেও শুধু দাদিজান। আব্বা দাদিজানকে সব সময় ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ছোটবেলা থেকেই তাই দেখে আসছি। দাদিজানের স্ট্রোকের অল্প কিছুদিন পর আব্বার হার্টে পাঁচটা ব্লক ধরা পড়লো। ডাক্তার দ্রুত অপারেশন করে রিং পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আব্বা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। উনি সুস্থ হলেও অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যান। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন। হঠাৎ দাদিজানের শরীর আবার খারাপ হতে শুরু করে। নিউমোনিয়ায় শ্বাসকষ্টজনিত কারণে হসপিটালে ভর্তি হলে আব্বা মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন। দাদি আব্বাকে ডেকে হাত ধরে বললেন,’বাবা, আমার দিন শেষ হয়ে আসতেছে। একটাই ইচ্ছে, মৃদুলের বউ দেখে মরতে চাই। ঘরে বউ আনার পর যেন মৃদুল বিদেশ পড়তে যায়।’
এই কথা শোনার পর আব্বা কাউকে কোনোকিছু বলার সুযোগই দিলেন না। তড়িঘড়ি করে আমাকে বিয়ে করিয়ে দাদিজানের মনের ইচ্ছে পূরণ করে উনার হুকুম পালন করলেন। আম্মা আমার পছন্দের কথা কিছুটা জানতেন। জেনেই বা কি করার ছিল? চোখের পলকে সব কিছু ঘটে গেলো।
মৃদুল কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলল,
‘দীপা,আমি আর ন্যান্সি দু’জন দু’জনকে খুব পছন্দ করি। আমি পরিস্থিতির স্বীকার। আপনাকে ঠকাতে চাই না। সত্যিটা আপনার জানা খুব দরকার ছিল। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
মৃদুল কথা শেষ ওয়াশরুমে গেল।
মুহূর্তের মধ্যে দীপার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের জমানো রঙিন স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চোখ থেকে নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। হাতে রাখা টিস্যু চোখ দুটোতে চেপে ধরে অঝোরে কাঁদে।
মৃদুল বাথরুম থেকে বের হলে চোখ মুছে প্রশ্ন করে,
‘আর কতদিন লাগবে আপনার সবকিছু গুছাতে’?
‘প্রায় দুই মাস।’
দীপা খাট থেকে নেমে অর্নামেন্টস খুলে মৃদুলের দিকে এগিয়ে দেয়।
‘এইগুলি ন্যান্সির জন্য রেখে দিন।’
মৃদুল মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘অর্নামেন্টস খোলার কি খুব দরকার?’
‘পরেই বা কি হবে? যার সাথে সংসার হওয়ার কথা সেইতো আমার না।’
মৃদুল দু’পা এগিয়ে দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘এইগুলো পরে নিন। সব অর্নামেন্টস আপনার। একটা রিকোয়েস্ট রাখতে হবে।
‘বলুন।’
‘বাড়ির মানুষগুলো যেন কোনোভাবেই দু’জনের দূরত্বের কথা বুঝতে না পারে। আপনার কষ্ট হলেও দাদিজান,আব্বার শরীরের দিক বিবেচনা করে সবার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতে হবে।’
দীপা মৃদুস্বরে বলল,
‘ভিতরে পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি রেখে আমি না হয় সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। সুখে থাকার অভিনয় করবো। যখন সবাই সবকিছু জানতে পারবে তখন আপনার প্রিয় ও কাছের মানুষগুলো কতটা কষ্ট পাবে জানেন? আমার বাবা,মা তাদের মেয়ের এতবড় ক্ষতি তারা সহ্য করতে পারবেন না। এখনি সব জানাজানি হোক।’
‘দীপা,প্লিজ ক’টা দিন সময় নিচ্ছি। আপনি হেল্প করলে আমরা দু’জনেই এর সমাধান করতে পারবো।’
হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। মৃদুল ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় চলে যায়। দীপা শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুমহীন চোখের পাতা দুটো বারবার ভিজে উঠে। আপনমনে বিড়বিড় করছে,জীবনে কাউকে ঠকাইনি,কষ্ট দেইনি। বিধাতা তুমি কেন আমার ভাগ্যটা এমন করলে? কি দোষ করেছি আমি?
কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দীপার স্যাঁতস্যাতে চোখের পাতায় ঘুম চলে আসে।
সকালে সজাগ পেয়ে দীপা দেখে মৃদুল ডিভানে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। দীপা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকলো,
‘মৃদুল,সকাল হয়ে গেছে। যদি আরও ঘুমুতে ইচ্ছে করে খাটে শুয়ে ঘুমান। এই মৃদুল উঠুন!’
দীপা দুইবার ডাকার পরও মৃদুলের কোনো সাড়াশব্দ নেই। দীপা আস্তে করে পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিল কয়েকবার। মৃদুল নড়েচড়ে চোখ মেলে দেখে দীপা তার পায়ের কাছে। শোয়া থেকে উঠে বসে।
‘আমি ঘুমিয়েছি এই একঘন্টা আগে। ন্যান্সি ফোন দিয়েছিল। ওর একটা সমস্যার চলছে।
ওর রুমমেট নাইজেরিয়ান একটা মেয়ে। প্রতিদিন মদ খেয়ে রুমে ফিরে ওকে খুব ডিস্টার্ব করে। ন্যান্সি খুব ভয়ে আছে।’
দীপা মৃদুলের কথা থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ন্যান্সির সাথে আপনার কি কথা হয়েছে তা শুনতে চাচ্ছি না,চাই না এবং কোনোদিন চাইবো না। আপনাদের দু’জনের বিষয় নিজেদের মাঝে রাখলেই ভালো। ঘুমুতে ইচ্ছে করলে ডিভান থেকে খাটে যান। এইজন্যই ডাকছিলাম।’
‘না,আর ঘুমাবো না। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে যাবো।’
‘ঠিক আছে। আপনি আসুন। আমি যাই।’
দীপা ডাইনিং রুমে আসতেই শাশুড়ি বললেন,
‘এই যে বৌমা ভালোই হলো তুমি সকাল সকাল উঠেছো। তোমার দাদি শাশুড়ি বায়না ধরেছে, তোমার হাতে খাবে। আমার হাতে খাবে না, তোমার শ্বশুরের হাতেও খাবে না এমন কি শিউলির মায়ের হাতেও না। বয়স যতই বেড়ে চলেছে উনিও স্বভাবে ততই ছোট বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। জানো সেইদিনও উনাকে চিপস কিনে দিয়েছি। চিপস উনার খুব পছন্দ।’
দীপা মৃদু হেসে বললো,
‘বেশ ভালো তো! আজ থেকে আমিই দাদিজানকে খাইয়ে দিব। মা,খাবারের প্লেটটা আমায় দিন।’
দীপা খাবারের প্লেট নিয়ে দাদী শাশুড়ির ঘরে আসলো। পঁচাত্তর বছর বয়স্ক কামরুন্নেছা বেগম শুয়ে চোখ বন্ধ রেখে তজবি জপছেন।
‘দাদিজান, আমি দীপা। আপনার খাবার নিয়ে আসছি।’
কামরুন্নেছা চোখ মেলে তাকালেন।
‘বইন তুই আসছোস? তোর হাতে খাইতে চাইছি মন খারাপ করোস নাই তো?’
‘কেন রাগ করবো দাদিজান? এ যে আমার সৌভাগ্য। আমার দাদি বেঁচে নেই। আজ থেকে আপনার সবকিছু আমিই দেখভাল করবো। আপনি শুধু বলবেন আপনার কখন কি খেতে ইচ্ছে করে।’
দীপা নাস্তার প্লেট পাশে রেখে দাদি শাশুড়িকে ধরে শোয়া থেকে বসালেন। মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। দু’জনে টুকটাক কথা বলছে।
মৃদুল খাবার টেবিলে কাউকে না পেয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে মা’কে ডাক দিল,
‘মা,নাস্তা দাও।’
মৃদুলের মা কিচেন থেকে হটপট হাতে করে টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন।
‘বৌ’মাকে নিয়ে খেতে বস। মায়ের ঘরে আছে।
তোর দাদি বায়না ধরেছে দীপার হাতে খাবে।’
মৃদুল দাদির ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
‘দুই সই বেশ জমিয়ে গল্প করছো। দেখতে দারুণ লাগছে।’
মৃদুল কথাটা শেষ করেই আড়চোখে দীপার দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো।
‘দাদি তোমার খাওয়া হয়েছে?’
‘হইছে ভাই। খুব তৃপ্তি নিয়া খাইলাম। আয় ভাই, তুই আমার কাছে বয় একটু।’
মৃদুল দাদির গা ঘেঁষে বসলো।
কামরুন্নেছা দীপার ডানহাতটি নিজের হাতের ভিতর রেখে বললেন,
‘দীপা,আমার মৃদুল দাদাভাই খুব ভালো মনের মানুষ। খুব নরম মনের মানুষ। দেখিস তোকে খুব ভালোবাসবে। ছোট থাকতে ও আমার গলা জড়িয়ে ঘুমাতো। কতবার যে নিজ হাতে ঔষধ খাইয়ে দিছে। মশারি টানায়ে দিছে। তুই আমার নাতিটাকে বেশি করে সেবা যত্ন করবি।’
দীপার চোখ দুটো টলমল। মাথা নীচু করে আছে। মৃদুলের দৃষ্টি দীপার সিক্ত চোখ দুটোকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য মৃদুল তাড়াতাড়ি বলল,
‘দাদীজান, তোমার নাত বৌ’কে নিয়ে নাস্তা করে আসি। দীপা চলো মা অপেক্ষা করছেন।’
দীপা নিজেকে কোনো রকম সংযত করে বলল,
‘দাদী,এখন কোনো ঔষধ খেতে হবে?’
‘এই যে ঔষধের বক্স কাছেই আছে। একটু পর খেয়ে নিব। তোরা খেতে যা!’
দীপা শাশুড়ি,মৃদুলের সাথে খেতে বসে। দীপার কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। পানি দিয়ে অল্প একটু খাবার কোনো রকম গিলে নেয়। মাথা উঁচু করে কারো দিকে ভালো করে তাকাতেও পারছে না। চোখ দুটো বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। মৃদুল খাওয়ার ফাঁকে দীপাকে খুব খেয়াল করছে। দীপা হাত ধোয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে শাশুড়ি বললেন,
‘সে কি বৌ’মা উঠছো কেন? কিছুই তো খেলে না
মা! খাবার স্বাদ হয় নাই?’
‘না মা আমার পেট ভরে গেছে। সকালে এত খাবার খেতে পারি না। রান্না খুব মজা হয়েছে।’
মৃদুল তড়িঘড়ি করে দীপার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মা,দীপারটা আমাকে দাও। আমি খেলেই ওর খাওয়া হবে।’
‘তুই থাম! আমি বৌ’মার সাথে কথা বলছি।’
দীপা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে শাশুড়ির দিকে ফিরে বলল,
‘মা,চা বানায়ে নিয়ে আসি?’
‘শিউলির মা খুব ভালো চা বানায়। বানিয়ে রেখেছে। তোমার কিছু করতে হবে না মা! তুমি হাত ধুয়ে আমার কাছে বসো। অনেক কথা আছে।’
দীপা হাত ধুয়ে শাশুড়ির কাছে বসে। শিউলির মা মগভর্তি চা দীপার সামনে দিয়ে হেসে বললো,
‘মামী,আমার হাতের চা খাইয়া দেহেন।’
দীপা কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলো।
শাশুড়ি হাত ধুয়ে বসতে বসতে বললেন,
‘বৌ’মা কয়েকদিন শাড়ি পরেই থাকবে। সাথে হালকা অর্নামেন্টস পরবে। এখনি সালোয়ার কামিজ পরার দরকার নেই।’
দীপা মাথা নীচু করে চুপচাপ কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।
মৃদুলের দিকে ফিরে উনি বললেন,
‘শোন,দুপুরে তোদের দু’জনের দাওয়াত আছে।
তোর নাজনীন খালার বাসায়। তারা স্বামী,স্ত্রী দু’জনে আমেরিকা মেয়ের কাছে চলে যাচ্ছে।
বৌভাতের অনুষ্ঠানে তারা থাকতে পারবে না। তাই খুব সকালে ফোন দিয়ে দাওয়াত দিল।’
মনি দুই বাচ্চা,জামাইসহ কামরুন্নেছা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডাইনিং রুমে আসলো।
সবাইকে একসাথে দেখে বলল,
‘তোমাদের এখনও খাওয়া হয়নি? শাশুড়ি বৌ’য়ের এত কি গল্প চলছে?
‘তোরা এখনি বের হচ্ছিস?’ মৃদুলের মা বললেন।
‘কিছু করার নেই মা। আমার অফিস ভনি,রনির স্কুল খোলা। সামনে ওদের এক্সাম। জামিলেরটা তো বাদই দিলাম। অনেক ঝামেলা। সামনে বৌভাতের অনুষ্ঠানে তো আবার আসবোই।’
মনি দীপার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ভাবি তুমি ভাগ্যবতী। এমন নির্ভেজাল সোনার সংসার পেয়েছো। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ
তোমাকে খুব ভালোবাসবে। তুমিও তাদের ভালো রাখার চেষ্টা কইরো।’
দীপা শুধু বলল,’মাঝেমাঝে জামাই,মেয়ে দুটোকে নিয়ে এ বাড়িতে সবার সাথে কাটিয়ে গেলে খুব খুশি হবো।’
দীপার কথা শুনে সবাই হাসলো। মৃদুল ঘুরেফিরে
দীপাকেই দেখছে। দীপা বুঝতে পেরে একবারও মৃদুলের দিকে তাকায়নি।
রনি,ভনি মৃদুলের দু’পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মামা,তোমার হলুদ,বৌভাতের অনুষ্ঠানে আমরা কিন্তু অনেক দামি ল্যাহেঙ্গা আর শাড়ি পরবো। ক্যাটালগ দেখে পছন্দ করে তোমাকে ল্যাহেঙ্গার
ডিজাইন পাঠাবো। শাড়িটা মা পছন্দ করে কিনে দিবে।’
মৃদুল টুইন ভাগ্নিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ওকে মাই ডিয়ার রনি,ভনি। তোমাদের ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে। ভালোভাবে পরীক্ষাগুলো শেষ করো।’
মনি পাঁচ মিনিট কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
মৃদুল নিজের রুমে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।
দীপা দাদি শাশুড়ির ঘরে যায় গল্প করার জন্য।
কিছু কথা বলে কিচেনে আসে শাশুড়ির কাজে হেল্প করার জন্য। শাশুড়ি দীপাকেই দেখেই বলল,
‘দু’দিন এ ঘরে আসার দরকার নেই। মৃদুলের সাথে গল্প করো গিয়ে। যা কাজ আছে শিউলির মা’কে নিয়ে শেষ করতে পারবো।’
দীপার চোখ দুটো আবারও ছলছল। কোনো কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না। চুপ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলছে, মা কি করে বলি আপনার ছেলেটা যে আমার না। সব পেয়েও হারাতে হবে সবকিছু।
‘দীপা,যাও দাওয়াতের জন্য রেডি হও।’
শাশুড়ির কথা শুনে চমকে উঠে দীপা।
‘জি,মা যাচ্ছি।’
দীপা শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো। পরনে হালকা পার্পেল রঙের সুতি শাড়ি। মৃদুল খাটে শুয়ে এফবিতে চোখ বুলাচ্ছে। দীপা ভেজা চুল মুছে টাওয়েল বারান্দায় মেলে দিয়ে ঘরে আসার সময় দেখলো মৃদুল বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপার চোখে চোখ পরতেই আবার মোবাইলে দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
দীপা ড্রেসিং টেবিলের সামনের ছোট্ট টুলে বসে ভেজা লম্বা চুল নেড়েচেড়ে শুকিয়ে নিচ্ছে।
দু’জনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
দীপা আধশুকনো চুল আচড়ে পিঠে ছেড়ে রাখল।
দীপা হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলল,
‘এই দিকটা পশ্চিম দিক তাই না? এদিকেই নামাজ পড়ে?’
মৃদুল মোবাইল রেখে বলল,
‘হুম। ঐটাই পশ্চিম দিক।’
দীপা ওযু করার জন্য বাথরুমে গেল। মৃদুল মোবাইল চার্জে দিয়ে জায়নামাজ পশ্চিম দিকে বিছিয়ে রাখলো। দীপা বের হয়ে অবাক চোখে বলল,
‘কি দরকার ছিল? আমি বিছিয়ে নিতাম।’
‘দরকার আছে। তাই দিলাম।’
দীপা জায়নামাজে দাঁড়াতেই মৃদুল শাওয়ার নিতে বাথরুমে গেল।
দীপা তিনটে শাড়ি নেড়েচেড়ে দেখছে। মৃদুল তার পছন্দের লাল রঙের জামদানি শাড়ি দীপার সামনে মেলে ধরে বলল,
‘এই জামদানিটা পরেন দীপা ম্যাডাম।’
‘কোনো প্রয়োজন নেই আপনার পছন্দের শাড়ি পরার।’
মৃদুল মুচকি হেসে বলল,
‘সবকিছুর প্রয়োজন আছে।’
দীপা কোনো কথা না বলে লাল জামদানির আঁচল ঠিক করে সেফটিপিন গেঁথে নিল।
ক্রিম কালারের গরদের বিয়ের পাঞ্জাবিটাই পরে নিল মৃদুল। নিজে রেডি হয়ে মোবাইলটা হাতে করে ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়ানোর আগে বলল,
‘আমি ড্রইংরুমে যাচ্ছি। এই ফাঁকে চট করে শাড়িটা পরে নাও।’
মৃদুল চলে যাওয়ার পর দীপা দরজা আটকিয়ে শাড়ি পরলো। হালকা সাজগোজ করে নিল।
একহাতে মানতাসা অন্য হাতে গোল্ডের চিকন চুড়ি পরে নিল। গলায় কন্ঠহার পরে পিছনে চেইনের হুক আটকানোর চেষ্টা করছে। কিছুতেই পারছে না। দরজা খুলে বের হতেই মৃদুলের মুখোমুখি।
‘সব কমপ্লিট?’
‘না’
‘কোনো সমস্যা?’
‘চেইনের পিছনের হুক লাগানো যাচ্ছে না। মায়ের ঘর থেকে আসছি।’
‘সামনে একটা আস্তো মানুষ থাকতে কষ্ট করে মায়ের ঘরে যাওয়ার কি প্রয়োজন ?
দীপা বলল,
‘প্রয়োজন আছে।’
‘কোনো প্রয়োজন নেই। মা নামাজে দাঁড়িয়েছেন।’
দীপা ঘরে আসতেই মৃদুল পিছন দিক থেকে চেইনের হুক আটকে দিল। দীপা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে।
মৃদুল পিছন থেকেই বলল,
‘দেখো ঠিক আছে কিনা’
‘ঠিক আছে।’
মৃদুল সামনে এসে দীপাকে ভালো করে দেখছে।
শাড়ির কুঁচির দিকে চোখ যেতেই বলল,
‘দাঁড়াও। শাড়ির ভাঁজের কারণে একটা কুঁচি অসমান মনে হচ্ছে।’
মৃদুল নীচু হয়ে প্রত্যেকটা কুঁচি ধরে সমান করে দিচ্ছে আর দীপা মুগ্ধ হয়ে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুল উঠে দাঁড়াতেই দীপা আয়নার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
মৃদুল বলল,
‘চলো এবার বের হই।’
দীপা ছোট্ট পার্সে মোবাইল নিয়ে মৃদুলের পিছন পিছন যাচ্ছে। ডাইনিং রুমে আসতেই দেখতে পেলো শাশুড়ি,দাদি শাশুড়ি বসে আছেন।
মৃদুলের মা বললেন,
‘চার কেজি দই মিষ্টি নিয়ে যাইস। খালি হাতে আবার দাওয়াত খেয়ে আসিস না।’
‘না মা। আমার মনে আছে মিষ্টি নিতে হবে।’
‘ দেখো বৌ,আমার নাত বৌ’মাকে পরীর মতো লাগতাছে। দোয়া করি, আল্লাহ তোদের সব সময় সুখে রাখুক।’
দীপা দাদি শাশুড়িকে পা ছুঁয়ে সালাম করে শাশুড়িকে সালাম করার জন্য মাথা নুয়াতেই শাশুড়ি দীপার হাত দুটো ধরে বুকের কাছে নিয়ে বললেন,
‘সালাম লাগবে না। আল্লাহ সব সময় তোমাদের সহায় হবেন।’
‘মা,দাদিজান আসছি।’
বলেই মৃদুল দীপাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। দশ মিনিটের হাঁটার পথ। তাই রাস্তার কার্নিশ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মৃদুলের হাতে রাখা মোবাইল হঠাৎ বেজে উঠে। স্কিনের দিকে তাকিয়ে দীপার দিকে তাকায় মৃদুল। মোবাইল বেজেই যাচ্ছে। দীপা বলল,
‘ন্যান্সির কল।
‘হুম।’
‘রিসিভ করুন। কেটে যাবে তো।’
মৃদুল বলল,
‘সমস্যা নেই। ও আবার কল করবে। রাস্তায় কি কথা বলবো?’
কল কেটে গিয়ে আবারও বেজে যাচ্ছে।
মৃদুল কল রিসিভ করে বলল,
‘ন্যান্সি আমি পথে আছি। বাসায় ফিরে তোমাকে
কল ব্যাক করবো।’
ফোনের ঐপাশ থেকে ন্যান্সি শুধু বলল,
‘আমি খুব অসুস্থ।’
মৃদুল জিজ্ঞেস করার আগেই কল কেটে গেল।
…………….
#’তুমি শুধুই আমার’ (২য় পর্ব অন্তিম পর্ব )
খাওয়ার পর্ব শেষ করে মৃদুল,দীপা ড্রইংরুমে গল্প করতে বসলো। মৃদুলের ইচ্ছে পাঁচ দশ মিনিট কথা বলে দীপাকে নিয়ে বের হয়ে আসবে। মৃদুলের মায়ের খালাতো বোন নাজনীন চৌধুরী দীপাকে ডেকে উনার বেডরুমের খাটে বসালেন। উনার শ্বশুরবাড়ির এক ঘটনা দিয়েই
কথা শুরু করলেন। বিয়ের পর গ্রামে উনার শ্বশুরবাড়িতে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি চারণ করছেন। দীপা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হাসির কথা শুনলে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। দীপার খুব ভালো লাগছে। সময় কীভাবে চলে যাচ্ছে দীপা টেরই পাচ্ছে না। মৃদুলের গল্প শুনতে ভালো লাগছে না। দু’বার এসে দীপাকে নিঃশব্দে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে গেছে ড্রইংরুমে চলে আসার জন্য। দীপা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকে। মৃদুল তার খালাকে খুব ভয় পায়। দীপাকে নিয়ে এখনি চলে আসার কথা বললে নির্ঘাত ধমক শুনতে হবে।
তাই কিছু বলছে না। মৃদুলের অস্থির লাগছে। মনে মনে দীপাকে বকা দিচ্ছে,
‘এই গাধিটা বুঝে না কেন আমি ডাকছি। নিজে তো কিছু বুঝেই না। আমি দু’বার ইশারা দিলাম। সেটাও বুঝে না।’
মৃদুল আবার বেডরুমে আসে। নাজনীন চৌধুরী
তার নিজের কথার রেশ ধরেই আওয়াজ তুলে হাসছেন। মৃদুলকে দেখেই বললেন,
‘তুই আমাদের সিক্রেট কথা শুনে কি করবি?
এখানে আমাদের মেয়েদের গল্প চলছে।
ড্রইংরুমে যা। তোর খালুর কাছ থেকে হাদীস শোন গিয়ে। মৃদুল বলল,
‘খালা,আজ চলে যাই। অন্যদিন আবার আসবো।’
‘রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবি। তোদের বাড়ি পাঁচশো মাইল দূরে না। বুঝলি? তোর বেশি কাজ থাকলে তুই চলে যা। দীপা থাকুক। খাবারের সময় হলে আসিস খেয়ে দীপাকে নিয়ে চলে যাবি। এখন খুব ইন্টারেস্টিং গল্প চলছে। দীপাকে কোনোভাবেই ছাড়া যাবে না।’
দীপা মৃদুলের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে মুচকি হাসছে।
মৃদুল আবার শান্তস্বরে বলল,
‘খালা বুঝই তো। এখন বাসায় অনেক কাজ। কাছের লোকজন আসবে বাড়ির বৌ দেখার জন্য। দীপাকেই এখন সবার প্রয়োজন।’
নাজনীন চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন,
‘তোর যে বেশি প্রয়োজন। সেটা বলছিস না কেন?’
‘সেটা বুঝলে তো দু’জনকে আটকে রাখতে না।’
কথাটা বলেই মৃদুল দীপার দিকে তাকিয়ে
হাসলো। নাজনীন চৌধুরী খাট ছেড়ে দেয়াল ক্যাবিনেট খুলে দুটো প্যাকেট বের করলেন। একটা প্যাকেট দীপার হাতে দিলেন। অন্যটি মৃদুলের হাতে দিলেন।
‘তোকে ব্লেজারে খুব সুন্দর দেখায়। ব্লেজারের কাপড় দিলাম। বানায়ে নিস। শীতে পরবি।’
মৃদুল এক গাল হাসি দিয়ে বলল,
‘খুব ভালো। বানানোর খরচাটা কবে দিবে খালা?
‘তুই আগে বানাতে দে। তারপর দেখছি।’
নাজনীন চৌধুরী আবার খাটের কোণায় দীপার কাছে বসলেন।
‘কালো মসলিন শাড়ির জমিনে,পাড়ে আর আঁচলে গোল্ডেন সূতার ভরাট কাজ। শাড়িটা তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
দীপা খালা শাশুড়ির কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘খালাম্মা,শাড়িটা যেমনি হোক। যে দামেই কিনেন না কেন। আপনার ভালোবাসা মিশ্রিত এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান।’
কথাটা শেষ করে দীপা মাথা নুইয়ে হাত বাড়িয়ে সালাম করতে নিলে খালা শাশুড়ি দীপাকে বুকে মিশিয়ে নিলেন।
‘অন্তরটা ভরে গেল মা! দোয়া করি সুখী হও। জীবনে সফলতা আসুক।’
খালা,খালুকে সালাম দিয়ে,দোয়া চেয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলো মৃদুল,দীপা। দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মৃদুল দীপার হাত থেকে শাড়ির প্যাকেটটা নিজের কাছে নিল।
‘এখন হাঁটতে সহজ হবে। সন্ধ্যা হতে এখনও প্রায় একঘন্টা বাকি। সময়টা দু’জনে কাজে লাগাতে পারি।’
দীপা বলল,
‘কীভাবে?’
কাছেই ছোট্ট একটা লেক আছে। ঠিক লেক বলা যাবে না। খালের মতো কিছু একটা ছিল। বেশ নোংরা থাকতো। সিটি কর্পোরেশনের লোকজন সদয় দৃষ্টি দিলে খালটিতে নতুনত্ব আসে। এখন পানিও স্বচ্ছ,টলটলে। কিছু গাছপালাও আছে। বসার জায়গাও আছে। পাশেই খেলার মাঠ। ঝালমুড়ি, ফুচকা,চটপটি,সবই পাবে। বিকালে প্রকৃতির হিমেল হাওয়ায় খানিকটা প্রশান্তি পেতে অনেকেই এখানে আসে। মা দাদিজানকে নিয়ে হাঁটতে প্রায়ই এখানে আসেন। কথা বলতে বলতে লেকের কাছেই চলে আসে মৃদুল। দীপা চারপাশটা দেখেই বলল,
‘পরিবেশ মন্দ না।’
‘হুম।’
‘কি খাবে? চটপটি না ফুচকা?’
‘কিছুই না।’
মৃদুল আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,
‘চলো ঐ জায়গাটায় বসি।’
দীপা কথা না বলে বসার জায়গায় এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে পিছনে মৃদুল হাঁটছে। দু’জনে দূরত্ব রেখেই পাশাপাশি বসেছে। চুপচাপ কিছু সময় চলে যায়। হঠাৎ দীপা শান্তগলায় বলল,
‘কিছু কথা ছিল।’
‘বলো।’
নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। একজন ছাড়া অন্যজন পরিপূর্ণ না। প্রত্যেকেই চায় একজন মনের মতো জীবনসঙ্গী আসবে। যে কিনা হবে অনেক বেশি নির্ভরতার,বিশ্বস্ততার এবং ভালোবাসার। আমিও স্বপ্ন দেখেছি। এমনটাই প্রত্যাশা করেছি। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মিল হলেও কিছুদিন পর সবকিছু হারাতে হবে। অযথা কেন মিছে মায়া,ভালোবাসায় জড়িয়ে নিচ্ছেন। আবেগের স্রোতে ভাসাচ্ছেন।
আমার যে কতখানি কষ্ট হচ্ছে এবং পরে অনেক বেশি কষ্ট হবে সেটা বুঝেন আপনি??
দীপার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো মৃদুল।
এরপর বলল,
দীপা,আমি সবকিছুতে স্বচ্ছতা পছন্দ করি।
মানবিক মানুষদের শ্রদ্ধা করি,ভালোবাসি। নিজেও মানবিক হওয়ার চেষ্টা করি। কতটা পারি জানি না। ভুলত্রুটি সবার জীবনে থাকে। আমার জীবনে যা ঘটেছে তার সবকিছু তোমাকে বলেছি।
বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণপোষণ,মানসিক,শারীরিক
সুস্থতা,সবদিক সার্পোট দেওয়া,তাকে সব সময় ভালো রাখা, হাসিখুশি রাখা,সুখে রাখা একজন স্বামীর দায়িত্ব,কর্তব্য। ন্যান্সির আর আমার সর্ম্পক গোপন রেখে স্বামীর অধিকার নিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ভালো হতো?? ধর্মীয়,সামাজিক রীতিতে তুমি তো আমার বৈধ স্ত্রী। আমাদের বন্ধন পবিত্র। তোমার উপর আমার পূর্ণ অধিকার আছে। বলো ঠিক কিনা? অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ন্যান্সিকে বিয়ে করে পরে তোমাকে জানালে অথবা তোমাকে না জানিয়ে ঐখান থেকে বিচ্ছেদ ঘটালে তুমি কতটা আঘাত পেতে বলো? এই সক্ট কীভাবে কাটিয়ে উঠতে? তুমি তো কোনো দোষ করোনি। আমি কেন তোমার সারাজীবনের কান্না হয়ে বেঁচে থাকবো? আমি কেন তোমার দীর্ঘশ্বাস হবো? আমি সেরা হতে না পারি কারো চোখে খারাপ হতে চাই না।
এই জন্য তোমার সাথে সবকিছু খুলে বলেছি।
বিয়ের প্রথম রাতেই আমার কাছ থেকে বড় একটা ধাক্কা খেয়েছো। আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। তোমাকে হাসিখুশি রাখতে,একটুখানি আনন্দে রাখতে চেষ্টা করছি। বাড়ির প্রিয়,কাছের মানুষগুলোকে সব সময় সুস্থ ও ভালো রাখতে চেয়েছি এবং চাই। আমার কারণে কোনো কিছু ঘটে যাক তা চাই না। তোমার চোখে হয়তো অন্যায় করছি,ভুল করছি। ঠিক এই সময়ে আমার কি করা উচিত তুমিই বলো। এইজন্য প্রথম রাতেই তোমার পছন্দের কথা জানতে চেয়েছি। কাউকে ভালোবাসো কিনা। নিজের কথাগুলো অকপটে তোমাকে বলেছি।’
মৃদুল কথা শেষ করে চুপ করে থাকে। দীপার মুখেও কোনো কথা নেই। মৃদুল হেসে আবার বলল,
তোমার মতো সুন্দরী,শিক্ষিতা,মায়াবী,মিষ্টি মেয়ের যে পছন্দ ছিল না তা বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই কাউকে ভালোবাসতে না? কেউ তোমার প্রেমে পড়েনি?
দীপা স্মিত হেসে বলল,
‘একজন পড়েছিল।’
‘নাম কি তার?’
‘পলাশ। ক্লাসমেট ছিল।
‘তুমি পছন্দ করতে না?’
‘না। শুধু বন্ধু হিসাবে পছন্দ করতাম।’
দীপা খোলা আকাশের অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘এখন একজনের প্রেমে পড়েছি।’
‘কার?’
‘বলবো না।’
‘ঠিক আছে। শুনতে চাই না।’
বাদামওয়ালা দেখে মৃদুল জিজ্ঞেস করলো, ‘বাদাম খাবে?’
দীপা না সূচক মাথা নাড়লো।
‘মাগরিবের আযান দিয়ে দিবে। চলুন এবার উঠি।’ দীপা কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো।
দু’জনে নিঃশব্দে হাঁটছে। মসজিদ থেকে
মাগরিবের আযানের সুমধুর সূর ভেসে আসে কানে।
বাসায় ফিরে দীপা সব চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি ওযু করে দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে নিজে একটিতে নামাজ পড়তে শুরু করলো। মৃদুল ল্যাপটপ হাতে নিয়েও রেখে দিল। দুটো জায়নামাজ বিছানো দেখে ওযু করতে ওয়াশরুমে গেলো।
দীপা নামাজ শেষ করে গিফটের প্যাকেট দুটো নিয়ে শাশুড়ির ঘরে গেলো। উনাকে দেখতে না পেয়ে দাদি শাশুড়ির ঘরে গেলো। কামরুন্নেছা বেগম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। শাশুড়ি হাতেপায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। দীপা প্যাকেট দুটো রেখে দাদি শাশুড়ির মাথার কাছে বসে কপালে হাত রাখলো।
‘মা,কখন দাদিজানের শরীর খারাপ করেছে?
ফোন দিলেই তো হতো। চলে আসতাম।’
মা’র শরীর খারাপ করে নি। সকাল আর সন্ধ্যায় হাতে পায়ে তেল মালিশ করতে হয়। স্ট্রোকের পর থেকে হাত পা ঝিমঝিম করে। শিউলির মায়ের গ্রাম থেকে এক কবিরাজ এই তেলটা দিয়েছে। সকালে শিউলির মা এসে মালিশ করে দেয়। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর আমি দেই। দীপা বলল,’মা,আমাকে দিন আমি মালিশ করে দেই।’ শাশুড়ি বললেন,’আজ আর দিতে হবে না।’ এর মধ্যে দীপার শ্বশুর মসজিদ থেকে আসলেন। দীপা দেখেই কাউকে কিছু না বলে চা করার জন্য কিচেনে আসে। চা করে বিস্কিটের কৌটা খুঁজে সবার জন্য ট্রে-তে চা,বিস্কিট নিয়ে
আসে। মৃদুলকে চা দিতে গিয়ে দেখে মৃদুল মোবাইলে কথা বলছে। সামনে চায়ের মগ রেখে আবার দাদি শাশুড়ির ঘরে চলে আসে দীপা।
চা শেষ করে প্যাকেট দুটো থেকে শাড়ি আর ব্লেজারের কাপড় বের করে দীপা বলল,
‘মা,নাজনীন খালা দু’জনকে এইসব গিফট করেছে। শাশুড়ি শাড়িটা মেলে বলল,’শাড়িটা খুব সুন্দর। বেশ গর্জিয়াস।’ দাদি শাশুড়ি চায়ে বিস্কিট ভিজিয়ে চা খাওয়া শেষ করলেন।
শাড়ি চোখের সামনে ধরে বললেন,’চশমা ছাড়া কিছুই তো দেখি না। দীপা বইন চশমাটা দে! কী শাড়ি কাপড় দিল বৌ’য়ের বইন।’ দীপা টেবিল থেকে চশমা নিয়ে দাদি শাশুড়ির চোখে পরিয়ে দিল। শাড়ি দেখে এবার উনি বললেন,’শাড়ি কাপড় ভালাই হইছে। তোরে মানাইবো।’
দীপা রাতে একবারের জন্যও মৃদুলের ঘরে যায় নি। তার খেতেও ইচ্ছে করছে না। একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। চুপচাপ দাদি শাশুড়ির খাটে শুয়ে ভাবতে থাকে। এই মূহুর্তে চাকরিটা ভীষণ প্রয়োজন ছিল। চাকরি নিয়ে আমার মতো করে সময় কাটাতে পারতাম। সরকারি হাই স্কুলে লিখিত পরীক্ষা দিলাম সেই কবে। রেজাল্ট কবে হবে কে জানে? কোনো বইপত্রও সঙ্গে আনিনি যে লেখাপড়া শুরু করবো। আল্লাহ তুমি আমার একটা সুখবর দিও। দাদি শাশুড়ি,শাশুড়ি কয়েকবার দীপাকে ডেকে উঠানোর চেষ্টা করছেন। দীপা উঠে নি। মৃদুল ভাবছে দীপা হয়তো তার দাদির সাথে গল্প করছে। খেতে এসে দীপার খোঁজ করলে তার মা বললেন,’দীপা সেই কখন তোর দাদির ঘরে ঘুমিয়েছে। কতবার ডাকলাম। উঠলোই না। ‘মৃদুল সাথে সাথে কামরুন্নেছার ঘরে আসলেন। মৃদুলকে দেখেই উনি বললেন,
‘তোর বউ বেভোর ঘুম দিছে। কোনো চেতন নাই।
কোলে করে তোর ঘরে নিয়ে যা। আমি তাহাজ্জুদ,ফজরের নামাজের জন্য ভোরে
ঘরের বাতি জ্বালাই। দীপার ঘুম হইবো না।’
মৃদুল দীপার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো,
‘থাক। ও আজ তোমার কাছেই ঘুমাক। এখন ডাকলে মাথা ব্যথা করতে পারে। আমি বরং তোমার খাটের মশারি টাঙিয়ে দেই।’
মৃদুল মশারি টাঙিয়ে চারপাশে গুঁজে দিল।
দীপা কোনো সাড়াশব্দ না করে চুপ করে সবার কথাগুলো শুনলো। প্রতিদিন কোনো অজুহাতে দাদির ঘরেই ঘুমাবো। মৃদুলকে কষ্ট করে ডিভানে শুতে হবে না। মৃদুলের কেন জানি খেতে ইচ্ছে করলো না। টেবিলে বসেও উঠে গেলো। মা পিছন থেকে কয়েকবার ডাক দিলে বলল,
‘পেট ভরা আছে। খালার বাসায় অনেক খেয়েছি।’
সকালে দাদি শাশুড়িকে খাইয়ে দিয়ে নাস্তার টেবিলে সবার সাথে দীপা খেতে বসলে মৃদুল এক ফাঁকে কানের কাছে বলল,
‘রাতে না খেয়ে ঘুমালে কেন?’
‘এমনি’
‘আমিও খাইনি’
‘খুব ভালো।’
সংসারের টুকটাক কাজ,দাদি শাশুড়ির সেবা, যত্ন নিয়েই দীপার সময় যাচ্ছে। মৃদুল বাসায় নেই। বিকালে মলিন মুখে বারান্দার গ্রিল ধরে আনমনে ভাবছে দীপা। শাশুড়ি কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে। শাশুড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই উনি বললেন,
‘ঘরে চলো। কথা আছে।’
‘কি কথা মা? এখানেই দু’জনে বসি। বিকালের হাওয়াটা আমার খুব পছন্দ।’
‘ঠিক আছে। সেই ভালো।’
উনি বসে কথা শুরু করলেন,
‘দীপা, বিয়ের আগে অনেক ছেলেমেয়ের পছন্দ থাকে। অস্বাভাবিক কিছু না। মৃদুল তার এক বান্ধবীর কথা বলছিল অস্ট্রেলিয়া লেখাপড়া করতে চলে গেছে। সে সম্ভবত ঐ মেয়েটাকে পছন্দ করে। মৃদুলও চলে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। মৃদুল আমার একমাত্র ছেলে। আমি চাই না,তোমার শ্বশুরও চায় না মৃদুল বিদেশ চলে যাক। লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করে ঐখানেই থেকে যাক। মা,বাবার জন্য অনেক টাকা পয়সা পাঠাক। ব্যস্ততার জন্য মা,বাবাকে ভুলে যাক।আমরা খালিঘরে পড়ে মরে থাকি। আমার এত টাকা,খ্যাতির দরকার নাই। যতটুকু আছে তা নিয়ে খুব ভালো আছি। একটাই ইচ্ছে মরার পর ছেলেটা যেন মা,বাবা,তার দাদির লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে শোয়ায়। নামাজ পড়ে সবার জন্য দোয়া করে। তুমি কোনোমতেই ওকে বিদেশ যেতে দিবে না। ওর মাথা থেকে বিদেশের ভূতটা দূর করে দাও। ধর্মীয় এবং আইন অনুযায়ী তুমিই তার স্ত্রী। তুমিই বর্তমান তুমিই ভবিষ্যত। তুমি তোমার মায়া,আদর,ভালোবাসার বন্ধনে আটকে রাখো। তুমি কষ্ট পেয়ে,অভিমানে মৃদুলের কাছ থেকে দূরে থাকবে না। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
মৃদুলকে চোখের আড়ালে রাখবো না বলেই ওর দাদির সাথে পরামর্শ করে তড়িঘড়ি করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। এই পাঁচ ছ’মাস কি যে টেনশনের মধ্যে ছিলাম তোমাকে বুঝাতে পারবো না। তোমার শ্বশুর,দাদি শাশুড়ির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আল্লাহকে ডাকছি আর ডাক্তারের কাছে ছুটে গেছি। শোন দীপা,সামনে বৌভাতের অনুষ্ঠান। মৃদুলকে নিয়ে যা যা লাগে শপিং করে নিও। দীপা বলল,
‘না মা। বিয়ে তো হয়েই গেছে। হলুদ,বৌভাত এসব দরকার নাই। বিয়ের দিন যে গয়না,শাড়ি দিয়েছেন যথেষ্ট। প্রয়োজন হলে আমি মৃদুলকে নিয়ে কিনে নিব। দাওয়াত করে লোকজন খাওয়ানোর চেয়ে ঐ টাকা দিয়ে কোনো এতিমখানায় গরীব বাচ্চাদের দু’দুবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিলে খুবই ভালো হবে মা।’
‘খুবই ভালো আইডিয়া মা। তুমি মৃদুলের সাথে কথা বলো দেখো ও কি বলে। আবার মনে মনে আক্ষেপ করো না গায়ে হলুদ,বৌভাত হলো না।
বিয়ের অনুষ্ঠানগুলি তো বারবার হয় না। তোমরা ভেবেচিন্তে ঠিক করো।
দু’দিন পর দুপুরে দীপার বান্ধবী আনজু হঠাৎ ফোন দিয়ে বলল,’দীপা সরকারি হাই স্কুলের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট হইছে। আমি টিকে গেছি। আজকের দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় দেখ। না হলে ইন্টারনেটে দেখ।
দীপার রোল কত ছিল ভুলে গেছে। তাড়াতাড়ি বাবার কাছে ফোন দিয়ে রোল নাম্বার সংগ্রহ করে দৌড়ে গেল মৃদুলের কাছে। মৃদুল শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। দীপা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে মৃদুলের কাছে বসে শরীর ছুঁয়ে ডাকছে,এই মৃদুল উঠুন! একটা বিশেষ খবর আছে। দেরি সহ্য হচ্ছে না দীপার। আবার শরীর নেড়ে বলল, ‘ইশ্ উঠুন তো!’ মৃদুল সজাগ শুয়ে থাকে। মৃদুল চাইছে দীপা তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আরও কিছু সময় ডাকুক। কাছে থাকুক। দীপা মৃদুলের কপালে হাত রাখলো। এখন আর আওয়াজ করে মৃদুলকে ডাকছে না। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে আঙ্গুল নাড়ছে। মৃদুস্বরে বলছে,
‘আজ কি হলো? ঘুম থেকে উঠছে না কেন?
শরীর খারাপ করে নাই তো? মৃদুলের মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে গভীরভাবে দেখছে। মৃদুল চোখ বন্ধ রেখেই দু’হাতে দীপাকে জড়িয়ে ধরে। দীপা লজ্জায় নিজেকে ছাড়িয়ে খানিকটা সরে আসে। দু’জনেই কিছু সময় চুপচাপ।
নীরবতা ভেঙে মৃদুল বলল,’কি জন্য ডাকছিলে?’
‘আপনি সজাগ ছিলেন?’
‘হুম’
‘উঠেন নি কেন?’
‘প্রথমে উঠলে কি তুমি এতবার আদর করে ডাকতে?’
‘আপনি একটা…..’
‘কি?’
‘পাজি’
‘হুম,অনেক পাজি। বুঝতে পারবে। এখন বলো
কি দরকারে ডাকছিলে?’
‘ইন্টারনেটে একটা রেজাল্ট দেখতে হবে। এই যে রোল নাম্বার।’
‘কিসের রেজাল্ট?’
‘সরকারি হাই স্কুলে।’
‘ওও তাই নাকি? খুব ভালো।’
মৃদুল দ্রুত ল্যাপটপ বের করে খাটে বসে নেট ঘাঁটতে শুরু করলো। দীপা মৃদুলের পাশে বসে আছে। চোখে,মুখে টেনশনের ছাপ। মৃদুল দীপার নাম্বারটি বারবার মিলিয়ে দেখছে। নাম্বারটি দেখতে পেয়ে মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করলো,
‘পরীক্ষা কেমন হয়েছিল?’
‘ভালো। আমি আশাবাদী। আমি লিখিত পরীক্ষায় টিকবো।’
‘খুঁজে পেলাম না তো’
দীপার মুখটা মলিন হয়ে যায়। চুপচাপ বসে থাকে। মৃদুল ল্যাপটপ বন্ধ করে চলে যায় ফ্রিজের কাছে। ছোট্ট প্লেটে দুটো মিষ্টি নিয়ে দীপার কাছে আসে।
‘হা করো। তোমাকে মিষ্টি খাইয়ে সুখবরটা দিব।’
দীপা চোখ বন্ধ করে হা করে। মৃদুল দীপার মুখে আধেক মিষ্টি পুরে দিয়ে দুটো চোখের পাতায় আলতো করে অধর ছুঁয়ে দেয়।
দীপা চোখ খুলে প্লেট থেকে বাকি আধেক মিষ্টি মৃদুলের মুখের সামনে ধরতেই মৃদুল দীপার হাত ধরে মিষ্টি মুখে নেয়।
মৃদুল,দীপা দু’জনেই সুখবরটা বাসার সবাইকে জানায়। শ্বশুর,শাশুড়ি খুব খুশি হন। সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। দীপা দাদি শাশুড়িকে ঔষধ খাইয়ে নিজের ঘরে আসলো। মৃদুলের হাতে মোবাইল নেই। টিভি ছেড়ে শুয়ে গান শুনছে।
দীপা খানিকটা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ন্যান্সি কেমন আছে?’
‘অনেকদিন কথা হয় না।’
‘আপনার বিয়ের কথা জানে?’
‘হুম’
‘কি কথা হয়েছে চ্যাটে দেখো।’
মৃদুল ইনবক্স ওপেন করে মোবাইল দীপার হাতে দিল। দীপা সব পড়ছে,
‘ন্যান্সি,আমার কোনোকিছু তোর কাছে অজানা নয়। নিজের কথা,পরিবারের কথা আজ পর্যন্ত কোনোকিছু গোপন করিনি। দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকেই একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়েছি। দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেছি। প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। তুই তো জানিস দাদিজান প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। দাদি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে যান। দাদির ইচ্ছে পূরণ করতেই বাবা আমাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নেন। আমি গতকাল বিয়ে করেছি।’

অভিনন্দন

। জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে সৃষ্টিকর্তার হাতে। বিধাতা হয়তো দু’জনের মিল করবেন না তাই পড়ার সুবাধে দু’জন অনেক দূরে আছি। আমি ভাগ্যে খুব বিশ্বাস করি। মৃদুল,আমরা দু’জন যথেষ্ট এডাল্ট। টিএনজার বয়সটা পার করে এসেছি। একটা বয়সে মনে হতো আজই ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করে ফেলি। বড় হয়েছি,বাস্তবতা শিখেছি। স্বপ্ন দেখেছি জীবনে অনেক বড় কিছু হবো। প্রতিষ্ঠিত হতে হবে বুঝতে শিখেছি। আবেগকে প্রাধান্য দিলে,মা,বাবার অবাধ্য হলে প্রেমে পড়ার প্রথমেই বিয়ে করে ফেলতাম। আমি আর দেশে আসবো না মৃদুল। আমি ছাড়া তো আব্বু,আম্মুর কেউ নেই। আব্বু অবসরে গেলে দু’জনকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আমার খুব কান্না পাচ্ছে মৃদুল। খুব কান্না পাচ্ছে। ভালো থাকিস। রাখছি…..

দীপা ন্যান্সির মেসেজ পড়ে চুপ হয়ে যায়। মৃদুলকে আর কোনো কথাই জিজ্ঞেস করেনি।
মৃদুলও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
দীপা বাসায় ফোন করে মা,বাবাকে তার রেজাল্ট জানালো। বাসার সবার সাথে কথা বলল। মৃদুলকে ঘুমাতে দেখে দীপা দাদি শাশুড়ির ঘরে গেল। চুলে তেল দিয়ে পাকা চুলে বিনুনি করে দিল। কামরুন্নেছা বেগম বললেন,’কতদিন বাইরে যাই না।’ দীপা বলল,’দাদিজান চলেন আপনাকে বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনি।’
দীপা কামরুন্নেছা বেগমের হাত ধরে আস্তে আস্তে কিছু সময় হেঁটে চিপসের প্যাকেট
কিনে বাসায় আসলো।
সন্ধ্যায় দীপা চা করে মৃদুলকে খোঁজ করছে। বাসায় ছিল। এখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। ফোন দিবে মোবাইল হাতে নিতেই মৃদুলের নাম্বার স্কিনে ভেসে উঠলো। তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করতেই মৃদুল বলল,
‘দ্রুত ছাদে আসো’
‘ঠিক আছে আসছি।’
দীপা ছাড়া চুল আচড়ে খোঁপা করে দুই মগ চা হাতে ছাদে চলে আসলো। চায়ের মগ এগিয়ে দিল। দু’জনে চা শেষ করলো। দীপা মগ দুটো পাশে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুল দীপার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। মৃদুল ডানহাতে
দীপাকে নিজের দিকে টানলো। দীপা মৃদুলের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে আছে। দু’জনেই চুপচাপ। বেশ কিছু সময় কেটে গেল অসীম নীরবতায়। মৃদুল শান্তস্বরে বলল,
‘দীপা,আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি না। তোমাকে, মা,বাবা,দাদিজানকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না। এই মানুষগুলোকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না। দীপাকে ছাড়া মৃদুল অসম্পূর্ণ। দু’জনেই পুরোদমে লেখাপড়া শুরু করবো। দেশে থেকে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে থেকে অনেক ভালো কিছু করবো। দীপা আবেগাপ্লুত হয়ে শুধু বলল,’তুমি শুধুই আমার। আর কারোর না’………..
————————সমাপ্ত—————

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..