“অমলদা শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করছ?”
অমলের জানালার ধারে দাড়িয়ে এক অষ্টাদশী তরুনীর কিছুটা রাগ এবং কিছুটা অভিমানে ভরা প্রশ্নে এতটুকু বিচলিত হলনা এবাড়ির একছত্র অধিপতি অমল। তাতে বোঝা যায় মেয়েটির এধরনের প্রশ্ন করার অধিকার অবশ্যই আছে। তাই সে তার চিরচেনা ভঙ্গিমায় মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাতে থাকা বইয়ে নজর দিয়ে বলল,
“বারে বয়স হয়েছে বিয়ে করব না?”
“ওমা তাই নাকি তা কত হলো তোমার বয়স আমিও একটু শুনি?”
“এইতো ত্রিশ মানে থার্টি প্লাস। বুঝলি চারু ছেলেদের বিয়ের আদর্শ বয়স হলো সাতাশ সেখানে আমি গুনে গুনে তিনটি বছর লেট করে বসে আছি।”
“তা এমন বোকার মতো কথা তোমায় কোন গাধায় বলল?”
“কোথায় যেনো পড়েছি।”
“ওসব আজেবাজে বই পড়া বাদ দাও বুঝেছ। ছেলেদের বয়স এত তাড়াতাড়ি বাড়ে না। আর বিয়ের চিন্তা কি তোমার মাথায় এসেছে নাকি কারো পরামর্শয়…..
“আরে আমি কি অত নির্লজ্জ নাকি নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলব। গেলবার পুজোয় দিদি জামাইবাবুরা সব এসেছিল তারাই..
“থাক আর বলতে হবেনা। আহা ভাইয়ের দুঃসময় যারা একটিবার খোজ নেয়না তারা এখন এসেছে ভাইয়ের বিয়ে দিতে। কি দরদ। আরে তখন কোথায় ছিল ওরা যখন তুমি জ্বরে পরেছিলে। তখনইবা কোথায় ছিল যখন জ্যাঠাইমার অসুখ করল। প্রতিদিন তুমি কি খাও তারও কি খোজ কোনোদিন নিয়েছে তারা। পুজো পার্বনে বছরে একবার আসবে নিজেদের মতো আনন্দ করে চলে যাবে এছাড়া কি পারে তারা। তোমার এসব কাজ তো আমিই দেখি। অসুখে পরলেও সেই আমিই ভরসা। এমনকি তোমার ঐ রাবনের গুষ্টি যখন পুজোয় এবাড়ি আসে তখন তাদের খাওয়ার ব্যাবস্থাও তো আমাকেই করতে হয়। হ্যা সব রান্না যদিও মা করেন তবে আমিও কি কম করি নাকি। বলতে পারবে জ্যাঠাইমা যাবার পর থেকে তোমার সব কাজকর্ম কে করে এই চারুই তো নাকি?”
“তা তো বটেই চারুলতা দাশ গুপ্ত না থাকলে যে অমল কুমার সেনের কি হতো ভগবানই জানেন।”
“খবরদার অমলদা ঠাট্টা করবে না। কিছু কি মিথ্যে বলছি আমি?”
“আচ্ছা ঘাট হয়েছে বল এখন আমার কি করা উচিৎ? তুই যা বলবি তাই হবে।”
“তবে শোনো দু বছরের মধ্যে বিয়ের নাম মুখেও আনবে না। আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা একবছর পর। পরীক্ষার পর আমি নিজে পাত্রী দেখে তোমার বিয়ে দেব। ততদিন বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে আমায় ভালো করে পড়াবে উচ্চমাধ্যমিকে যদি আমি খারাপ রেজাল্ট করি তবে তোমার বিয়ে আর কোনোদিনও হবেনা বুঝেছ।”
“তোকে আমি বিয়ের পরও তো ভালো করে পড়াতে পারি।”
“ও বাবা ওটি হচ্ছেনা। বিয়ের পর তো বউ নিয়েই থাকবে তখন আমি এবাড়িতে এলে তোমার বউ যেমন খুশি হবেনা তুমিও হবেনা। আর দিনে একবারের জন্য হলেও আমার এখানে আসা চাই চাই। তাই দুবছর নিয়েছি বাবা বলেছে উচ্চমাধ্যমিক শেষ হলে আমার বিয়ে দেবে। শশুরবাড়ি গিয়ে আমি তোমার জন্য মেয়ে দেখব তারপর তোমার বিয়ে হবে বুঝেছ।”
“এমনিতেই ত্রিশ পার হয়ে যাচ্ছে দুবছরপর তো টুনির মা ও আমাকে মেয়ে দেবেনা।”
“যদি না দেয় তো আমিই তোমাকে বিয়ে করে নেব।”
বলেই জিভে কামড় দিয়ে ছুটে পালাল চারু। অমল থম মেরে বসে আছে।হাতের বইটা নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কি বলল এটা চারু। ওকে বিয়ে করবে চারু। এটা আবার হয় নাকি। ওর কোলে হেসে খেলে বড় হয়েছে যেই মেয়ে সে কি করে…..
হঠাৎই অমলের খেয়াল হলো চারু তো সেই ছোট বাচ্চা মেয়েটি নয় যে অমলদা লজেন্স দাও বলে বায়না করত। এতদিনে কুড়ি ফুটে পুর্ণ গোলাপে রুপান্তরিত হয়েছে। ও ই শুধু খেয়াল করে দেখেনি। অবশ্য দেখার সময় পেয়েছে কোথায় বিশ বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার কাধে দিয়ে। তার ওপর অবিবাহিত দুটি বোন আর মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ল ওর উপর। বড় বোনদের বিয়ে বাবা বেশ ধুমধাম এবং বিস্তর অর্থ ব্যায়ের মাধ্যমেই দিয়েছিলেন। সেজন্য কিছু সম্পত্ত্বি তিনি বেচেঁ থাকতেই খোয়াতে হয়েছিল। বাবা ছিলেন সামান্য গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। তবে ওর দাদা যে সম্পত্তি রেখে গেছিল তার ফলে মোটামুটি সচ্ছলাতার মধ্যেই বড় হয়েছে অমলরা। তবে বড় দুইদিদির বিয়ে বেশ বড় ঘরেই দিয়েছিলেন তার বাবা। তাই অর্থকড়ি খরচা তো হবেই। বাবার যুক্তি ছিল অমল একা এত সম্পত্তি দিয়ে কি করবে বরং বোনরা যা ভাগ পায় তা তাদের বিয়েতে খরচ করে বাকি যা থাকে অমলের নামে উইল করে দেবেন। তবে শেষ মুহুর্তে তা পরেননি। তাই বোনরা ভাগ ছাড়লেও জামাইবাবুরা ছাড়েনি। এমনিতেও বাবা অনেক গুলো জমিই বিক্রি করেছিলেন। তাই ভাগবাটোয়ারা শেষে অমলদের ভাগে ছিল দাদার আমলে এই একতলা বাড়ি, কিছু ধানি জমি যা থেকে বছরে দশবারো মন চাল আসে আর দুটো ভিটে। তবে ওর বাবা একান্ত অমলকে কিছু দিয়ে গেছিলেন সেটা হলো প্রতিমাসের মাইনা থেকে দুহাজার করে তিনি অমলের নামে জমা করতেন। কখোনো কখোনো মাস শেষে কিছু বাচলে তাও তিনি অমলের নামেই জমা করতেন। তাতে চারলাখের মতো হয়েছিল। সেটা অমল খরচ করেনি। ছোট বোন দুটির বিয়ে ভিটে দুটি বিক্রি করে হয়েছিল। বিয়ের খরচের পরও বেশকিছু টাকা ছিল সেটা ওদের জমির ভাগ হিসেবে অমল দিয়ে দিয়েছে। এরপর শুধু বাড়িটা রেখে সব জমি বিক্রি করে দিয়ে সেটা দিয়ে এবং বাবার টাকা দিয়ে ব্যাবস্যা শুরু করে অমল। সেই ব্যাবসা দাড় করাতে অমলের পুরো ছয়বছর লেগেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্টে বি এ পরীক্ষাটা দিয়েছিল ও। দুবছর শহরে চাকরির অনেক চেষ্টা করেও যখন কিছু হলো না তখনই ব্যাবসার সিদ্ধান্ত নিল ও। তাই ছোটবোনদের বিয়ে দিয়ে তারপর ব্যাবসার কাজে হাত দেয় ও। কিন্তু বাবার মতো মা ও যেদিন ওকে ছেড়ে গেলেন তখন খুবই ভেঙে পড়েছিল ও। জামাইবাবুরা তখন ওর বাকি সম্পত্তি হাতানোর তালে ছিল। তখন চারু আর চারুর পরিবার পাশে না থাকলে বোধহয় আজ এ পর্যায়ে আসত না অমল। চারু ওর ঠিক বারো বছরের ছোট। ছোটবেলা থেকেই ওদের বাড়িতে অগাধ যাতায়াত অমলের। চারুর জন্ম ওর বাবা মার বিয়ের পুরো ছয়বছর পর হয়েছে। এর আগে থেকেই অমল যেতো ওদের বাড়ি। কোনো ছেলেপুলে না থাকায় চারুর মা অমলকে ছেলের মতই ভালোবাসতেন। চারুর জন্মের পরও তা একটুও বদলায় নি। ওর দুঃসময়ে এই পরিবারটিই তো ওর পাশে ছিল। কিন্তু এত বছরে চারুকে তো এভাবে কখনো কল্পনা করেনি অমল। বাচ্চাজ্ঞান করেই মিশেছে ওর সাথে। আজ সেই চারুকে একমুহুর্তে এত বড় মনে হচ্ছে কেন? একবার কাকিমা মানে চারুর মা মজা করে বলেছিলেন দেখনা অমল মেয়েটা আমার তোর কি নেউটা হয়েছে তুই না থাকলে শুধু কাদেঁ। রাতবিরেতে এ যন্ত্রনা সহ্য হয়। ওকে বরং তুই নিয়ে যা। তোর কাছেই থাকুক আজ থেকে। এ কথাটা অনেকদিন আগের হলেও মনে আছে অমলের তবে এর এমন অর্থ তো আগে কখোনো বের করে নি অমল। এসব অনেক কথাই ভাবছিল অমল কখন বিকেল হয়েছে খেয়াল করেনি। অমলের মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ওর খাওয়াদাওয়ার সমস্ত দ্বায়িত্ব চারুদের। এমন কি প্রতিদিন বিকেলে চা নাস্তাও চারুই ওকে দিয়ে যায়। সকাল দুপুরে চারুদের বাড়িতে খেলেও রাতের খাবার চারু এখানেই দিয়ে যায়। আজও এর ব্যাতিক্রম হলোনা। বিকেলের চা নাস্তা নিয়ে চারু অমলের পড়ার ঘরে চলে এল। এসে অমলকে আগের অবস্থায় দেখে ঘর কাপিয়ে হেসে উঠল ও। অমল চমকে ঘাড় ঘুরালে চারু বলল,
“কি গো অমল দা বিয়ে করতে বারণ করেছি বলে কি বিরহে ডুবে গেলে নাকি। ঠিকাছে বাপু করো বিয়ে কাল না না আজই করো কেমন।”
বলে আবারও হাসতে শুরু করল ও। অন্যদিন হলে ওর এই হাসার অপরাধে ওর মাথায় চাটির অভাব হতোনা তবে আজ অমল এক আশ্চর্য কাজ করল যা আগে কখনো করেনি। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চারুর দিকে। অমলের এই দৃষ্টি উপেক্ষা করা সম্ভব নয় চারুর পক্ষে তাই হাসি থামিয়ে লজ্জায় রাঙা মুখটি নিচু করে ফেলল ও। অমল এগিয়ে ওর মুখটি তুলে ধরে বলল,
“এই সম্পর্ক আবার কবে বানালি চারু কাকিমা জানলে..
কথা শেষ করতে না দিয়ে ওর মুখ হাত চেপে ধরে চারু বলল,
“তোমার ঐ বিলেতি নভেল থেকে চোখ তুলতে পারলে মা বাবা আর সবাই যা দেখেছে তুমিও তা দেখতে পেতে।”
বলেই এক দৌড়ে আবারো চলে গেল চারু। অমল এবার বসে থাকল না চারুর পিছুই ছুটল ও। টেবিলে চারুর রেখে যাওয়া চা নাস্তা তেমনিই পরে রইল শুধু।
Leave a Reply