অসংখ্য নাম না জানা শহীদের লাশের উপর পাকিস্তানি হায়নার দল যে ধংসলীলা চালিয়েছিলো তা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকান্ড। ১৯৭১ সালের এই দিন বৃহস্পতিবার ছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আজও বৃহস্পতিবার।
বেশ কতদিন যাবৎ দেশ এক চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আমার বড় বোন তখন বকশিবাজার বদরুন্নেসা কলেজে ১ম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।
বাসায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-ছাত্রীরা এসে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য বাবাকে অনুরোধ করতে আসলে একবারের জন্যেও মেয়ে বলে নিষেধ করেনি। বরং সহোযোগিতা করেছেন। বড় আপা বাবাকে দিয়ে বাশঁ যোগার করেছে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বন্দুকের ট্রেনিং নিবার জন্য। ছোট বলে আমাকে সাথে করে নিয়ে যেত। আমি মনেমনে গর্বিত হতাম। আমার বোন দেশের জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে ভেবে।
সবে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছি।তেমন না বুঝলেও এটা বুঝতাম দেশ এভাবে চলবেনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বুঝিয়ে দিয়েছে সামনে আমাদের কি করতে হবে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস,বাসায় পাকিস্থানী পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা লাগানো হচ্ছে।
আমার বাবা আমাদের বাসার উপরে পতাকা লাগালেন,তখন কি যে উত্তেজনা মনের ভিতর চলছিলো তা এখন বোঝাতে পারব না।
মাসের শেষ, সামনে সপ্তাহে বেতন হবে। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বেতন দেবার কথা বললেও বাবার বেতন হয় নাই। তাই মাসের শেষে একটু টানাটানি হতো। বাবা অফিস থেকে এসে কি যেন আলাপ করলেন মা ও বড় বোনের সাথে। মায়ের ভয়ার্ত মুখ দেখে অজানা আশংকায় গলাশুকিয়ে আসছিলো।
বাবা কোন এক পত্রিকায় পড়েছেন,চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে সাদা পোশাক পরা পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে অস্র সস্র নামাচ্ছে।এটা কোন ভাল আলামত না।
এটা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে তা সাধারণ জনগণ কল্পনা করেনি। আমরা সেদিন দেরীতে ঘুমিয়েছিলাম। বড় আপার কাছ থেকে রাইফেল ট্রেনিং এর কলাকৌশল শুনছিলাম। শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বলতে পারব না। হঠাৎ শরীরে এক ঝাকুনি অনুভব করলাম। বাবা বলছেন, তোমরা সবাই খাটের নিচে শুয়ে পর। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই রাস্তায় ভারী কোন যানের শব্দ শুনলাম যা আগে কখনো শুনিনি।
আমাদের বাসাটা ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়এর কাছাকাছি রাস্তা ঘেষে। তাই আমাদের ভয় ছিলো বেশি। আমার দাতের সাথে দাতের কটকট শব্দ থামাতে পারছিলাম না। আমাদের বাসার পাশে ছিলো ঢাকেশ্বরী মন্দির আমরা খুব ভোরে সেখানে আশ্রয় নিলাম।
বাবা আমাকে ও বড় আপাকে রেখে মা সহ অন্য ভাইবোনদের নিয়ে গেলেন আমার সেঝ চাচার বাসায়; শেখসাহেব বাজারে। একসঙ্গে নিলেন না, কারন যদি পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী গুলি করলে একসঙ্গে সবাই যেন মারা না পারি।
প্রায় ঘন্টা খানিক পরে বাবা এলেন, হাতে দুটো ইট নিয়ে। আমাদের দুই বোনের হাতে দিয়ে বললেন যদি যাবার সময় ওদের হাতে ধরা পরি তাহলে এই ইট যেন ওদের উপর নিক্ষেপ করি ঘৃনা প্রকাশ করার জন্য। সে সময় এর কোন উত্তর খুঁজে পাই নি।আজ বুঝি কি তীব্র ঘৃনা ছিল ও নরপশুদের প্রতি।
আজ বাবা বেচেঁ নেই। কিন্তু সেই দৃঢ় কন্ঠস্বর এখনো প্রতিধ্বনিত হয় আমার কানে। আমরা ২৬ তারিখ চাচার বাসা থেকে জিঞ্জিরার দিকে রওনা দিলাম। বিভিম্ন পথ দিয়ে আমাদের বাড়ি মানিকগঞ্জএর হরিরামপুরের ইব্রাহিমপুর গ্রামের দিকে। পথ যেন শেষ হয় না।কিভাবে যাওয়া হবে, আমরা আদৌ পৌছাতে পারব কিনা কে জানে।
আল্লাহর উপর ভরসা করে আমার বাবা ও সেঝ কাকা আমাদের সবাইকেই নিয়ে জিঞ্জিরা দিয়ে নবাবগঞ্জ, কলাকোপা বান্দুরা দিয়ে বিভিন্ন পথ ধরে চলতে লাগলাম।
কি দুঃসহ স্মৃতি। একেতো ক্ষুধার যন্ত্রণা , তার উপর হাটতে হাটতে পায়ে ফোসকা পরে গেছে। আমরা হাটছি আর হাটছি পথ কোথায় শেষ হবে জানিনা।
পথে পথে মানুষ শুধু জানতে চাচ্ছে ঢাকার কি খবর। মানুষ বেচে আছে তো? যে যেভাবে পারে সবাইকে সাহায্য করছে। ক্ষেতের তরমুজ, টমেটো, চিড়া,মুরি দিয়ে আশেপাশের মানুষেরা এগিয়ে এসেছে।
Leave a Reply