আমার গলার সাদা চকচকে পাথরের হারটা দেখে বড় চাচী প্রায় গায়ের উপর ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
” এই, এটা হীরার না-কি রে? কত দাম পড়ল? নিশ্চয়ই লাখ দশেকের কম হবে না। বোকা রাত বিরাতে এত দামী জিনিস পরে হাটছিস যে! আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে। গতমাসে বাড়ি আসার পথে অহনার পাঁচ ভরি ওজনের বাইশ ক্যারেটের সোনার হারটা ছিনতাই হয়ে গেছে।”
বড় চাচী এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কোনো ভদ্রতার ধার না ধরে এবার গলায় হাত দিয়ে পাকা জহুরীর মতো করে নেড়েচেড়ে হারটা দেখছেন।
” খুব সুন্দর, তোকে ভীষণ মানিয়েছে। এরকম কয়টা আছে রে? অহনারও আছে দুইসেট। ওর বর আফ্রিকা থেকে এনেছে। অফ্রিকা তো হীরার খনি জানিস তো নিশ্চয়ই। সেও তোর মতোই এত দামী জিনিসের কদর করে না। হরহামেশায় পরে বের হয়। মানুষ ভাবে হয়তো বাজারের। অবশ্য এদেশের লোকজন সোনাই চিনে না, হীরা চিনবে কিভাবে।”
আমি এতক্ষণ নিবিষ্টমনে চাচীর কর্মকান্ড উপভোগ করেছি। এবার খুব আস্তে করে বললাম,
” বড় চাচী অহনার গলার সেটটা হয়তো হীরার ছিল। আমার এই সেট বাজারেরই। গতসপ্তায় নিউমার্কেট থেকে ৫৩০ টাকা দিয়ে কিনেছি।”
আমার কথা শুনে চাচী চমকে উঠলেন,
” ইয়ার্কি করছিস না-কি আমার সাথে। আমি হীরা চিনি না মনে করছিস। জানিসই তো এদেশে যখন অনেকের নাকে সোনার নাকফুলও ছিল না, তখন তোর বড় চাচা আমার জন্য হীরার নাকফুল কিনেছেন।”
” জানি চাচী। অনেকের বলছেন কেন? সে সময় তো আমার মায়ের কানেও সোনার দুল ছিল না। মা গয়না পরতে পছন্দ করতেন, তাই লেইসফিতাওয়ালার কাছ থেকে এমিটিশানের গয়না কিনে পরতেন। তাই আব্বা ছোট ফুফুর বিয়েতে মাকে একটা সোনার দুল বানিয়ে দিয়েছেন।”
চাচী আমার সেইসব দিনের গল্প শুনতে আগ্রহবোধ করলেন না,
” বাদ দে তো সে সব কথা। তোর মাকে দেখলাম কিছুক্ষণ আগে।”
” জি, আমি মা আর রুমকি আমরা একসাথেই এসেছি দাদীকে দেখতে।”
” তোর মাও কি এবার তোর সাথে যাবে?”
” জি, চাচী মাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব।”
চাচী তাচ্ছিল্য করে বললেন,
” অহনার কত বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল আমেরিকা, অস্ট্রলিয়া থাকা ছেলের জন্য। আমি রাজি হইনি। বিদেশি ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত হয় না। না হয় আমি কত আগে বিদেশ থাকতাম। অবশ্য আমার বিদেশ ভালো লাগে না।”
” বিদেশি ছেলেরা শিক্ষিত হয়না, আপনার একথাটা মনে হয় ঠিক নয়। আমার বরই তো….!
” জানি সব। আচ্ছা তোর মা যে বিদেশ যাবে সে কি ইংরেজি জানে? “
” বিদেশ যাওয়ার জন্য ইংরেজি না জানলেও কোনো কোনো অসুবিধা নেই। একসময় ভালো ইংরেজি আমিও জানতাম না।”
এমন সময় মা এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। তার চেহারায় উদ্বিগ্নতা। বড় চাচীর সাথে কথা বলা মানে তিনি উল্টাপাল্টা কিছু বলা, সেটা মা ভালো করেই জানেন।
” তুই এখানে ছিলি? আমি সারা বাড়ি তোকে খুঁজেছি।”
” হ্যাঁ মা। বড় চাচীর সাথে কথা বলছিলাম।”
” আমি তোর দাদীর রুমে ফ্যানের নিচে বসছি, যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে নিস।
মা চলে যেতেই বড় চাচী মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” বিধবা মহিলাদের সোনা পরা ঠিক না। তোর মা কিন্তু সোনা পরে।”
” চাচী আমার মা শুধু সোনার গয়না পরেন না, হীরা, মুক্তা সবই পরেন। এবং আজীবন পরবেনও। ঐ যে সোনা পরার নিষােধাজ্ঞার কথা বলেছেন। সেটা কেবল আপনাদের মুখেই প্রচলিত, অন্য কোথাও বিধবা নারীর সোনার গয়না পরার নিষােধাজ্ঞা নেই।”
” এভাবে কথা বলছিস কেন? আমি কি তোদের পর?”
” আপনি আমার বড় চাচী। পর হবেন কেন?”
চাচী আমার কথায় মনোক্ষুন্ন হয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
চাচী শুনতে না চাইলে যে করুণ গল্পের কথা তিনি আমার স্মৃতি খুঁড়ে বের করে এনেছেন সেটা তো আমি ভুলতে পারছি না।
ভুলতে পারার কথাও নয়, কারণ তখন কষ্টের স্মৃতি মনে রাখার মতো যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছিল। সেবার ছিল আমার ছোট ফুফুর বিয়ে। বিয়ের আপ্যায়িত অতিথি সবার পরনে নতুন শাড়ি, গায়ে সোনার গয়না।
বিয়েতে মা কি পরে যাবেন তাই বাবা তিল তিল করে তাঁর জমানো সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি আর এক জোড়া সোনার কানের দুল কিনে এনেছিলেন।
আমার দরিদ্র বাবার সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না, যেটা দিয়ে তিনি স্ত্রী, সন্তানের শখ মেটাতে পারতেন। শুধু ছিল সহনশীল এক প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। আর কলিজার টুকরো এক কন্যা সন্তান।
তারপরও তিনি নিজের জমানো সঞ্চয় দিয়ে সেবার আমার মায়ের শখ মিটিয়েছেন।
বিয়ের পর এই প্রথম আমার মায়ের কানে সোনার দুল উঠেছিল। প্রতিদিনের অাটপৌরে কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় উঠেছিল।
নতুন শাড়ি, গয়না পরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আমার মা যখন বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তখন এই বড় চাচীই উপস্থিত মেহমানদেন সামনে আমার মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” চুমকির মা আবার কার শাড়ি, গয়না পরে এসেছিস?”
মা যতবারই জোর গলায় বলেছিলেন,
” কার পরব ভাবি! আপনার দেবরই কিনে দিয়েছেন।”
আমার বড় ব্যাবসায়ী চাচার বউ তখন বিশ্বাস করতে পারেননি সাধারণ কেরানি আমার বাবা তাঁর স্ত্রীকে নতুন শাড়ি,দামী গয়না কিনে দিয়েছেন।।
তিনি সেদিন মুচকি হেসে সবার সন্মুখে আমার মাকে ডেকে নিয়ে কানের দুল ধরে ধরে সোনা আর এমিটিশানের পার্থক্য যাচাই করেছিলেন।
তারপর সবার সন্মুখে মিষ্টি হেসে বললেন,
” এই ডিজাইনের কানের দুল, জোড়া দশ টাকা করে নিউমার্কেটে বিক্রি করে।”
মা যতবারই জোর দিয়ে বলছেন,
” কী বলেন এসব! এইগুলো নিউমার্কেট থেকে কিনতে যাবেন কেন?”
” ভাইয়া হয়তো কিনে নাই। তবে অনেকে কিনে।”
চাচীর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হাসছিলেন।
চাচীর কণ্ঠে আর সবার হাসিতে সেদিন কিছু একটা ছিল, যে আমার মা সহ্য করতে পারেননি। তাঁর চোখে পানি টলমল করছিল, তারপরও তিনি হাসছিলেন।
তখন মায়ের পাশে আমি ছিলাম। উপস্থিত কেউ দেখতে পায়নি অপমানে, অসম্মানে মুষড়ে যাওয়া আমার মায়ের অন্তর। আমি দেখতে পেয়েছি, একজন মানুষ কিভাবে অসম্মানে মাটির সাথে মিশে গিয়েও হাসতে পারে।
এরপর অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। সেদিনের নয় বছরের শিশু চুমকি আমি ৩০ বছরের রমনী হয়েছি।
আমার মায়ের পরনে ময়লা কাপড়ের পরিবর্তে দামী কাপড় উঠেছে। বাবার ছোট খুপরি ঘরের পরিবর্তে আমি এখন অামেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে নিজের কেনা বাড়িতে থাকি। আমার কৃত্রিম পাথরের হারকে চাচীর কাছে হীরার হার মনে হয়।
বাবার খুপরি ঘর এখন বিলাসবহুল অট্রালিকা হয়েছে। শুধু আমার বাবাটাই নাই হয়ে গেছেন।
বাবা হয়তো অনেক কিছু দেখে যেতে পারেননি, তারপরও যতদিন জীবিত ছিলেন, আমি চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি বাবাকে খুশি রাখতে।
বাবার খুব শখ ছিল হজ্জ করার, মৃত্যুর আগে সেটাও করিয়ে এনেছি। গতবছর হঠাৎ স্ট্রোক করে বাবা মারা গেলেন, হাসপাতালে পর্যন্ত নেয়ার সুযোগ দেননি।
এরপর থেকে এরা আরও পেয়ে বসেছে আমার মাকে। আমার মা রঙিন শাড়ি পরতে পারবে না, সোনার গয়না পরতে পারবে।
অথচ একসময় যখন আমার মায়ের পরনে ছেঁড়া শাড়ি ছিল, রঙ জ্বলা এমিটিশনের গয়না ছিল তখন কিন্তু এরা কেউ বলেনি ভালো একটা শাড়ি পরো।
আজ তারাই আমার মায়ের পিছনে লেগেছে নিজেদের বানানো নিয়মনীতি নিয়ে।
পৃথিবী অনেক এগিয়েছে, মানুষের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। পাশাপাশি মনের দৈন্যতাও কটেছে, অথচ আমার বড় চাচীর মতো কিছু মানুষ এখনো অন্যের শাড়ি আর গায়ের গয়না হাতড়ে বেড়ান, কোনটা সোনার, কোনটা হীরার আর কোনটা বাজারের।
পৃথিবী এগিয়ে গেলেও কিছু মানুষ তার নিজের বৃত্তেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply