1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

বকুল কায়সারের গল্প – – – শানজানা আলম

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২
  • ১৩৭ বার
আমি মিসেস বকুল কায়সার। বা শুধুই মিসেস কায়সার। আমার নাম ছিল বকুল, বাবার রাখা। কিন্তু সংসারের কোথায় যেন নামটা হারিয়ে গেল। বাবা মা যত দিন ছিল, নামটাও ছিল। এরপর ভাইবোনেরা ডাকে বড় আপা, ছেলে মেয়ে ডাকে আম্মু, আমার উনি ডাকেন, এ্যাই শুনছ!
আর বুয়া, ড্রাইভার, গার্ডের কাছে আমি “ম্যাডাম। ভাবী সমাজে কায়সার ভাবী, বাকি সবাই মিসেস কায়সার বলেই সম্বোধন করে থাকেন।
আমার হাজবেন্ড রাষ্ট্রয়াত্ত্ব একটা ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। অনেক ব্যস্ত মানুষ। ব্যাংকাররা ব্যস্তই হয়, অনেক দায়িত্ব তাদের, আমার মতো হাউজওয়াইফদের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না। সারাদিন পর যখন তিনি বাসায় ফিরেন, তখন তার মেজাজ থাকে খিটখিটে। আমি প্রথম কয়েক বছরে চেষ্টা করেছি বিষয়টা মানিয়ে নেবার। এখন আর চেষ্টা করিনা। কী দরকার তাকে বিরক্ত করার। টিভি দেখছে, মোবাইল এ গেম খেলছে বা নেট ব্রাউজ করছে, যা ভাল লাগছে করুক না। আমি কিছু বললে জিজ্ঞেস করবে,
হ্যা কিছু বলছিলে?
আমি উত্তর দেই, ‘না, তোমার কিছু লাগবে কিনা, চা- কফি! ‘ এটা কেন জিজ্ঞেস করছি সেটা নিয়েও বেচারা বিরক্ত হয়। তাই এখন আর ঘাটাই না। কাজের মেয়েকে দিয়ে পাঠিয়ে দেই।
আমার আসলে সারাদিন তেমন কোন কাজ থাকে না। সকালে উঠে কাজের মেয়ের নাস্তা বানানো তদারকি করি। বাচ্চাদের ব্রেকফাস্ট, টিফিন আমিই রেডি করি। কায়সার সাহেবের অফিসের জামাকাপড় গুছিয়ে দেই, তার নাস্তা রেডি করে দেই। বেবিদের স্কুল কলেজের জন্য তৈরি করি। কায়সার সাহেবের অফিসে লাঞ্চের ব্যাবস্থা আছে, যখন ছিল না, তখন টিফিন বাক্সটাও ঘুছিয়ে দিতাম। এগুলি আসলে তেমন কোন কাজ নয়। আমার কাজের মেয়ে আছে একটা, ছুটা বুয়া আছে, ওরাই বাকি সব করে! আমি বাচ্চাদের স্কুল কলেজে পাঠিয়ে রান্না গুলো নিজের হাতে করি। কায়সার সাহেব অন্য কারো রান্না খেতে চান না, বিরক্ত হন। আমার শাশুড়ী যত দিন ছিলেন, তাকে সময় মতো খাওয়ানো, ওষুধ খাওয়ানো, ইনসুলিন দেয়া আমিই করেছি। অথচ এমনি ভাগ্য, আমার মায়ের শেষ দিনগুলিতে আমি দেখতে যেতে পারিনি। বাচ্চাদের পড়াশোনা, কোচিং, টিচার আমাকেই সামলাতে হয়েছে। কার কবে কী পরীক্ষা, ক্লাশ টেস্ট এর রেজাল্ট, সায়েন্স না কমার্স, কোন স্কুল কলেজ এ ভর্তি করাতে হবে, সব কিছু। এগুলো অবশ্য তেমন কঠিন কোন কাজ না, এমনিই করা যায়, সবাই করে। তাই আমিও করেছি।
আমি চাকরি করতে পারিনি। বি.এ পরীক্ষা দেয়ার পর বাবা বিয়েটাও দিয়ে দেয়। যখন রেজাল্ট আসে সেকেন্ড ক্লাস, তখন আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে মিষ্টি পাঠানো হয়, তাদের বৌমা গ্রাজুয়েট হয়েছে!একটা স্কুলে কিছু দিন ক্লাশ নিয়েছি, কিন্তু কায়সার সাহেবের বদলীর চাকরী তখন। শ্বশুর বাড়ির বড় বৌ আমি। তিন চারজন দেবর ননদের বড় ভাবী, সব দায়িত্ব সামলে চাকরি করার সময় পেলাম না। সেসব দায়িত্ব সামলানো তেমন কঠিন কিছু ছিল না, যতটা কঠিন কায়সার সাহেবের অফিসের ঝামেলা!
এখন আমার মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছেলেটা এবার এ লেভেল দিবে। আমি হাত পা ঝাড়া হয়ে গেছি। তেমন কোন কাজ থাকে না সারাদিন। শুধু বাসার রান্না, ওদের কে কি খাবে সেটা বানানো, কায়সার সাহেবের জামা কাপড় গুছানো, ঘরটা গুছিয়ে রাখা এসব টুকটাক কাজ আর কি।
কায়সার সাহেবের অফিসের কয়েকজন কলিগের দাওয়াত আছে আজ। আমার শরীরটা বেশি ভাল না দুদিন ধরে। জ্বর আসছে না, কিন্তু মাথা ভার হয়ে আছে। তাকে বলেছিলাম রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসো, কিন্তু আমার যেহেতু তেমন কোন কাজ থাকে না, তাই সে রাজি হলো না। বাসায় ডেকে কেন বাইরের খাবার খাওয়াবো।
তাই রান্না করতে হবে। অল্প কিছু আইটেম ই তো। বিরিয়ানি, পোলাও, ফ্রায়েড রাইস যে যেটা খাবে আর কি, মাছ দুটো পদে, কোরাল, রুই, চিংড়ি মাছের মালাইকারী টা করতেই হবে। সেবার সবাই খুব প্রশংসা করেছিল। চিকেন রোস্ট, খাসির রেজালা, বিফ মিট বল, সবজির একটা আইটেম সাথে আলু বোখারার চাটনী টা। ডেজার্ট হিসেবে পুডিং, পায়েস, স্নোবল।বোরহানী টা বানাতেই হবে। স্টার্টার হিসেবে বাদাম সরবতটা লাগবে। অল্প কিছুই তো। আর একটা কেক কিন্তু বানাতেই হবে।
আমার যেহেতু কোন কাজ থাকে না, এটুক আমি করে ফেলতেই পারব।আর হ্যা, সোফার কভার গুলো চেঞ্জ করিয়ে রাখতে হবে, বেডশিট গুলো পাল্টাতে হবে। সামনের সোপিস গুলো মুছে ফাইনাল টাচ দিতে হবে।
আমি মিসেস কায়সার। সারাজীবন এসব টুকিটাকি কাজ করেই জীবনের ৪৫ বছর পার করে দিলাম।
শাহিনা বেগমের কথা-
আমি শাহিনা বেগম, একটি বেসরকারি সংস্থার এইচ আর ডিপার্টমেন্টে কাজ করছি। আমার অফিস শুরু হয় সকাল ৯.৩০ এ। এর মধ্যে আমাকে অফিসে পৌছাতে হয়। অফিসটা ঢাকার সাইডে, হেমায়েতপুরে। ঢাকা আরিচা মহাসড়কে। রোজ সকাল পোনে আটটা থেকে আটটার মধ্যে শ্যামলী ওভারব্রিজ এর নিচ থেকে অফিসের বাসে উঠতে হয় আমাকে। কোনদিন যদি বাস মিস করে ফেলি, তাহলে কষ্টের শেষ থাকে না। তখন এই রুটের লোকাল বাসগুলোই ভরসা। এই সময়টা সবার অফিসে যাবার সময় হওয়ায় লোকাল বাসে সিট পাওয়া তো দূরের কথা, ওঠাই যায়না।
আমার স্বামী কন্ট্রাক্টর। তিনি ব্যস্ত মানুষ। তিনি আটটার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর পাঁচটায়। এরপর কাজের মেয়েকে ডেকে তুলে নাস্তা তেরি করি, নিজের টিফিনটা রেডি করি। ছেলে মেয়ে খাবে পরোটা, শ্বাশুড়ি আর স্বামী খাবে রুটি। সে রুটি নরম হতে হবে। কোনদিন যদি একটু শক্ত হয়েছে তো কথা শুনতে হয়, ‘পেয়েছ তো এক অফিস। সংসার তো করলেই না। সারাজীবন টাকার পিছনে ছুটলে।’ এখন আর আমি কিছু মনে করি না। গায়ে সয়ে গেছে এতদিনে।
মনে পরে প্রথম দিকের কথা। আট ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। লেখাপড়ায় বরাবর ভালোই ছিলাম। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পরে বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন। বয়স হয়ে যাচ্ছিল নাকি, পরে পাত্র পাওয়া যাবে না।
তখন শখ করে প্রাইমারী স্কুলে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। চাকরীটা হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের পরে বউ চাকরি করবে! এটা কিছুতেই মানা যায় না! শ্বশুর শাশুড়ী কেউ চাকরীটা করতে দিলেন না। এর মাঝে একবার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কলেজে বি.এ ভর্তি হয়ে এলাম। বাবা খুব চেঁচামেচি করলেন।
-বিয়ে দিয়েছেন, এখন শ্বশুর বাড়ির কথা কেন শুনবে না, কি দরকার এত পড়ার!মেয়ে কী জজ হবে নাকি! মা কে সহ্য করতে হয়েছিল অনেক কথা!
শ্বশুর বাড়িতেও ছি ছি পরে গেল। গোপনে কলেজে ভর্তি হয়েছে ! কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার স্বামী আমাকে পরীক্ষাটা দিতে দেন। ৷ সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করে গিয়েছিলাম।
এরপর স্বামীর সাথে ঢাকায় চলে আসতে হয়। সংসার করা শুরু করি। বি.এ পাস করে বসে ছিলাম, একদিন পাশের বাসার এক ভাবীর ভাইয়ের মাধ্যমে খোজ পেলাম এইচ. আর ম্যানেজমেন্টে কোর্স করা যায়। আমার স্বামী প্রথমে রাজি নাহলেও সারাদিন একা থাকার অজুহাত দেখিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম কোর্সে। ওই ট্রেনিং সেন্টার এ বিভিন্ন চাকরীর বিজ্ঞাপন নোটিশ বোর্ডে থাকতো। কোর্স শেষ হলে ওখান থেকে চাকরীটা পেয়ে গেলাম। এর মধ্যে মা হলাম প্রথমবার। সে আরেক যুদ্ধ। তিন মাসের মেয়েকে কার কাছে রেখে যাবো!! সারা রাত ঘুমাতে পারি না। চাকরী ছেড়ে দিতে হবে,এমন ভাবছি যখন, তখনকার মতো আমার মা এসে সামলে দিলেন।
কিন্তু বছর দুয়েক বাদে যখন আবার কনসিভ করলাম, তখন মা নিজে অসুস্থ। ডাকতে হলো শাশুড়ি কে। সেই থেকে শাশুড়ি আছেন সাথে। সব সময় কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন -জন্ম দিলেই মা হয় না! বললাম চাকরী করার দরকার নেই!! অথচ আমার চাকরিটা আছে বলেই বাচ্চারা ভাল স্কুল কলেজে পড়তে পেরেছে। খরচে টান পড়েনি কখনো।
আমি সকালে নাস্তা বানিয়ে অফিসে যাই। দুপুরটা শাশুড়ি কাজের মেয়েকে নিয়ে সামলান আর আমাকে শাপশাপান্ত করেন। অফিস থেকে ফিরেই সন্ধ্যায় রান্না বসাতে হয় আমাকে। কে কি খাবে, রাতে আমার রান্না না হলে কারো মুখে রোচেনা। অথচ আমার স্বামী বাইরে থেকে ফিরে টিভি নিয়ে বসেন, তিনি কষ্ট করে ফিরেন, তাই তাকে চা নাস্তা আমার শ্বাশুড়ি এগিয়ে দেন। আর আমাকে ফিরেই রান্না ঘরে ঢুকতে হয়, সারাদিন ফাঁকিবাজি করেছি, এখন রাতের রান্নাটাও করবো না! কোনদিন কেউ এক গ্লাস পানিও এগিয়ে দেয় নি। ছুটির দিনগুলো আরো কষ্টের। সেদিন তিনবেলার রান্না থেকে সারা সপ্তাহের জমে থাকা কাজগুলো করতে হয়। অথচ যে ভাবীরা চাকরি করেনা, হয়ত সুখে সংসার করছেন । রান্নাবান্না, ঘর সংসার নিয়ে আছেন। বাইরের ভাবনাটা নেই তাদের। আমার স্বামী সব সময় তুলনা করেন, অমুকের বউয়ের রান্না কী চমৎকার, কী অমায়িক ব্যবহার।
একদিন অফিস থেকে ফিরলাম জ্বর নিয়ে। রাতে রান্না ঘরে যেতে পারলাম না। শুয়ে শুয়ে শুনলাম স্বামী ছেলে মেয়েদের বলছে, তোদের মা সারাজীবন ফাঁকিবাজি করেই কাটিয়ে দিল, সংসার করলো না! অফিস অফিস করেই জীবন কাটালো।
আমি শাহিনা বেগম, চল্লিশ বছরের জীবনে সারাজীবন ফাঁকিবাজি করে গেলাম। কিচ্ছু করলাম না। কিন্তু চাকরি করেছি বলেই বাবা যখন অসুস্থ, তখন তার চিকিৎসা করাতে পেরেছি, শ্বশুরবাড়ির ঘর পাকা করতে টাকা দিয়েছি, ননদের বিয়ের শপিং এর সিংহভাগ করেছি,বাচ্চাদের ভাল স্কুল কলেজে পড়িয়েছি। বুকিং দেয়া ফ্লাটের ইন্সটলমেন্টও ১ মাস অন্তর আমি দেই। চাকরি করার পরেও সকালের নাস্তা, বিকেলের খাবার আমিই করছি গত আঠারো বছর ধরে। বাচ্চাদের পড়াশোনার দায়িত্বটাও আমার ছিল। এগুলো হয়তো ফাঁকিবাজিই ছিল !!

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..