দেবযানী, বয়স কতোই বা হবে? ৮/৯ বছর।
প্রেম – ভালবাসা কি জিনিস তা সে বোঝেনা। তবে ক্লাশের কিছু কিছু ছেলেরা যখন এল- ও- ভি- ই, লাভ এই কথাটা বলে তখন ভীষণ লজ্জা পায় দেবযানী। তার মনে হয় শুধুমাত্র এই কথাটা শোনাতেই তার চরিত্রের বারোটা বেজে গেছে।
তবে একটা জিনিস, সেইটা হলো –
গাছে উঠতে, মাছ মারতে, পুতুল খেলতে, হাডুডু কিংবা বদন খেলতে, ডাংগুলি খেলতে সর্বপুরি স্কুলে যেতে এবং ছুটির পরে বাড়ি ফিরতে একজনকে তার চাই-ই চাই।
সে হলো তাঁর পাড়ার ছেলে সূর্য ।
সূর্য ভীষণ ডানপিটে। নাওয়া- খাওয়া, স্কুল যাওয়া কোনো কিছুর তার ঠিক ঠিকানা নেই। রোজ রোজ স্কুল যাওয়ার সময় দেবযানী ওকে ডাকতে ওদের বাড়ি গিয়ে দেখে,ও কেবল পুকুর থেকে গোসল সেরে মাথায় গামছা দিয়ে পাগড়ি বেঁধে, ভেজা প্যান্টে বেসুরো গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে।
রোজকার মত আজও সেই দৃশ্য। অথচ একসাথে গোসল করতে গিয়ে দেবযানী সেই কখন চলে এসেছে। রোজ পুকুর থেকে আসবার সময় সে সূর্যকে তাড়া দিয়ে আসে । তবুও এই হাল।
বয়সে সূর্য দেবযানীর চেয়ে একবছরের বড় হলে হবে কি?দেবযানী ওকে তুই করেই বলে। সূর্যকে দেখেই ওর মা বকতে শুরু করল ,
— কিরে সূর্য? দেবী সেই কখন থেকে এসে বসে আছে আর তুই এখনো ভাত খাসনি স্কুল যাবি কখন?
দেবযানী বলল,
— বাড়িতে সেই কখন দেখে এসেছি ৯ টা পার হয়ে গেছে, নে নে তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে রেডি হয়ে নে।
দেবযানী ওদের সান বাঁধানো উঁচু বারান্দাটায় বই কোলে করে বসে রইলো। সূর্য ভাতের থালাটা নিয়ে এসে ওর পাশে খেতে বসল । গপগপিয়ে ভাত খেতে গিয়ে গলায় ভাত আটকে গেলো সূর্যের । দেবযানী তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
— নে নে পানি খা।
এই ঘটনা প্রায় দিনের।বেশিক্ষণ খকখক করলে মাথায় হাতর তালু দিয়ে দেবযানী থাবড়া দেয়।
ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছে সূর্য। কুসুমের অর্ধেকটা হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— দেবী হা কর।
দেবযানী লজ্জা পেয়ে আড়চোখে চাচিমার দিকে তাকিয়ে টুক করে গিলে ফেলল ডিমের কুসুমটুকু।
চাচিমা নিশ্চয় দেখে ফেলেছে। আর তাইতো সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল,
— কিরে দেবু ভাত খেয়েছিস?কি দিয়ে ভাত রেঁধেছে রে তোর মা? ভাত দেবো? খাবি?
দেবী বলল,
— না চাচিমা খাবোনা। খেয়ে এসেছি। বড় মাছ দিয়ে।
বড় মাছের কথা শুনে তখন চাচিমা বলল,
— কালতো হাটবার নয়রে, তোর মা বড় মাছ পেলো কই?
দেবযানী বলল,
— বাবা আমাদের পুকুরে জাল ফেলেছিল ভোরে।
শুনে চাচিমা বলল,
— তোর বাবা সংসারের কত কাজ করে। আর তোর চাচাকে দেখ জমিদারের মতো সারাদিন শুয়ে শুয়ে শুধু রেডিওতে গান শোনা। সূর্যটাও হয়েছে বাবার মতো।
একথা বলেই চাচি সূর্যকে হাঁক মারল,
— কিরে সূর্য আর কতো সাজগোজ করবি? স্কুলের বেলা যে বয়ে গেলো।
প্রায় দেড় কিলো মিটার দূরে পাশের গ্রামের স্কুল।ফসলের মাঠের ভিতর দিয়ে সরু আইলপথ। সূর্য আগে আগে আর দেবযানী পিছনে। পড়িমরি করে ছুটে চলছে দুজন।
ওরা স্কুল গিয়ে দেখে প্রায় দিনের মত আজও জাতীয় সমাবেশ শেষের পথে।
তখন স্যার দুজনকে মাঠের মধ্যে কান ধরে দাড়িয়ে রাখল। ক্লাশ রুমের বারান্দায় দাড়িয়ে ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করছে। দেবযানীর ভীষণ লজ্জা করছে। কিন্তু সূর্যটার লজ্জার বালায় নেই। সে বরং ওদের মুখ ভেংচি দিচ্ছে আর ইশারায় দেখাচ্ছে মাঠ থেকে গিয়ে কিভাবে ওদের পিটুনি দেবে। ওর পিটুনি খাওয়ার ভয়ে সবাই ক্লাশরুমে চলে যায়। কিন্তু এরপরেও দু’একজন হাড়বজ্জাত ছেলে রয়েই গেল যাদের পিটুনির ভয় নেই। তারা হাত তালি দিয়ে সূর্যকে ক্ষেপিয়ে তুলছে।
মাঠের শাস্তি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সূর্য দেবযানীর হাতে বই দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওদের চুলের মুঠি ধরেই এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি শুরু করল। মার খেকো ছেলেরা কাঁদতে কাঁদতে নালিশ নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো শিক্ষকদের অফিস রুমে।
দেবযানীর বুকের মধ্যে ভয়ে দুরুদুরু কাঁপুনি শুরু হলো। কারণ সে জানে এরপর শুরু হবে সূর্যের দ্বিতীয় দফা শাস্তির পালা।
Leave a Reply