ব্যক্তিগত আলাপ-পরিচয় ছিলো না ওর সঙ্গে। একান্তে কিংবা জনকলরবেও কখনো বসা হয়নি আড্ডায়। কিন্তু আমার আগ্রহের তালিকায় আলাদা ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান ছিলো হুমায়ুন সাধু নামের মানুষটা। যাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম কানাডায় বসে, ‘ঊন মানুষ’ নামের একটা টিভি নাটকে। সত্যি বলতে কি চমকে উঠেছিলাম নাটকটা দেখে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে–সূর্যাস্তকালে নদীর তীরে বসে আকাশপানে তাকিয়ে অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলো অশ্রুসজল হুমায়ুন সাধু–‘কী? সমস্যা কি আমার? আমার সমস্যা কি?
ইয়েস আয়েম টকিং টু ইউ। আমার সমস্যা কি? আমি কী পারি না? আমি অংক পারি না? আমি চিন্তা করতে পারি না কল্পনা করতে পারি না আমি? হেই? আমি কল্পনা করতে পারি না ? বংশ বিস্তার করতে পারি না আমি? কী? চুপ কেনো? কথা বলো আমার সাথে! বলো উত্তর দাও! দৈর্ঘপ্রস্থে আর কতটুকু হলে একটা মানুষকে মানুষ বলা যায়? কে ঠিক করে দিছে এইসব ক্রাইটেরিয়া?’
বামনাকৃতির একজন মানুষকে নিয়ে নির্মিত নাটকের গল্পটা ছিলো হুমায়ুন সাধুর লেখা। আর পরিচালনা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর। খোঁজ নিয়ে জেনেছি খুব ভালো গল্প লিখতো সাধু। এবারের বইমেলায় ‘ননাই’ নামে গল্পের একটা বইও বেরিয়েছিলো তার।
‘ঊন মানুষ’ দেখার পর বুদ্ধেদেব দাশগুপ্তের অসাধারণ চলচ্চিত্র ‘উত্তরা’র কথা মনে পড়ছিলো আমার। উত্তরায় একটা গ্রাম দেখানো হয়েছিলো যে গ্রামে একদল বামন বাস করেন। যে গ্রামের সকলেই বামন। উত্তরা চলচ্চিত্রের শেষ অধ্যায়ের একটা দৃশ্যে আমরা দেখি–জীবনযুদ্ধে অপমানিত পরাজিত ও নৃশংসতার শিকার সব হারানো গড় উচ্চতার উত্তরা নামের নারী চরিত্রটির সঙ্গে রেলের বামন গার্ডের কথোপকথন–
বামন গার্ড: বাড়ি যাবে না? কি হয়েছে?
উত্তরা: ঘেন্না ধরছে
বামন গার্ড: কেনো?
উত্তরা: ওরা মানুষ নয়। কতো বললাম…
বামন গার্ড: কোথায় যাবে তাহলে? কেউ নেই তোমার?
উত্তরা: আছে। সেখানে যাবো না…উহারা আমার দেহটা কিনে লিয়েছে কীনা!
বামন গার্ড: আমার সঙ্গে যাবে?
উত্তরা: কোথায়?
বামন গার্ড: আমাদের গ্রামে।
উত্তরা: সে কতোদূর?
বামন গার্ড: ঐ পাহাড়টা পেরিয়ে একটা নদী। নদীটা পেরুলেই আমাদের গ্রাম। যাবে? থাকবে আমার সঙ্গে?
উত্তরা: তোমার সঙ্গে কী ভাবে থাকবো?
বামন গার্ড: কেনো? আমার বউ হয়ে। আমার বউ নেই। বিয়ে হয়নি। তুমি খুব ভালো। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে বাচ্চাগুলো তোমার মতো ভালো হবে।
উত্তরা: তারাও তো তোমার মতো ছোট ছোট বামন হবে!
বামন গার্ড: তাইতো হবে। আমাদের গ্রামে আমরা সবাই তাই।
উত্তরা: সবাই?
বামন গার্ড: সবাই। দাদু-ছেলে-নাতি-ঠাকুমা-মা-মাসি সবাই আমার মতো। লম্বা মানুষ তো দেখলে এতকাল। কিছু করতে পারল তারা? পৃথিবীটা বদলালো? খালি যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। জানো, আমাদের গ্রামে আমরা একটা স্বপ্ন দেখি।
উত্তরা: কী স্বপ্ন?
বামন গার্ড: দেখি আশপাশে সব আমাদের মতো বামনে ভরে গেছে। তারাই চালাচ্ছে সব। মানুষ ভালো আছে। সত্যি। তুমি স্বপ্ন দেখো?’
উত্তরা: দেখতাম। ছোটবেলায়। কানাই কাকা বলতো স্বপ্ন দেখা নাকি ভালো নয়। আয়ু কমে যায়!
বামন গার্ড: জানি না। তবে যারা স্বপ্ন দেখেনা তারা স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে সরিয়ে দিতে চায়। একদিন আর পারবে না। যাবে আমার সঙ্গে?……
‘উত্তরা’য় লম্বা মানুষদের পৃথিবীকে দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো বামন গার্ডরূপী প্রতীকি চরিত্রটি। আর ঊন মানুষে দেখি সাধু অভিনীত বামনচরিত্রটি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছে সৃষ্টিকর্তাকে। ইশ্বরকে। –দৈর্ঘপ্রস্থে আর কতটুকু হলে একটা মানুষকে মানুষ বলা যায়?
(বামন চরিত্রের অপমান অসম্মান আর বেদনা এক কথায় বডি শেমিংকে উপজীব্য করে লেখা গল্প নিয়ে সাধু অভিনীত আরেকটা নাটক ছিলো–‘চিকন পিনের চার্জার’।
খুদে মানুষের গল্প নিয়ে নোবেলজয়ী গুন্টার গ্রাসের বিখ্যাত বই দ্য টিন ড্রাম। টিন ড্রাম নামের চলচ্চিত্রটিও জগত বিখ্যাত। খুদে অবয়বের মানুষদের প্রেম ভালোবাসা স্বপ্ন বেদনা নিয়ে প্রিয় নির্মাতা কৌশিক গাঙ্গুলী নির্মাণ করেছেন অসাধারণ বাংলা চলচ্চিত্র ‘ছোটদের ছবি’। )
০২
বামন আকৃতি নিয়ে জন্মানোটা একটা অভিশাপ,আমাদের দেশে। শুধু আমাদের দেশেই বা বলি কেনো, পৃথিবীর অনেক দেশেই। প্রায় সব দেশেই। কিন্তু আমাদের দেশে এই আকৃতির মানুষদের প্রতি গড় উচ্চতার মানুষের বিরামহীন তুচ্ছ্বতাচ্ছিল্য, ঠাট্টা, অবজ্ঞা, অসম্মান, কটুক্তি, নিগ্রহ এবং ফিজিক্যাল য়্যাবিউজের মাত্রাটা সহ্যের সীমা অতিক্রমী। ইতরপনা কার্য ওদের ঘটে অহর্নিশি।
ক্লাশে-মহল্লায়-পরিবারে কিংবা পার্কে-রেস্তোরাঁয়-জনারণ্যে সর্বত্রই দিবানিশি টিজিং-এর শিকার হতে হয় খর্বাকৃতির মানুষদের। বামনাকৃতি নিয়ে জন্ম নেয়াটাই যেনো পাপ। যে জন্মের জন্যে সে নিজে দায়ি নয়। অথচ দায়টা বহন করতে হয় আজীবন,তাকেই।
একজনও কি নিখুঁত মানুষ পাওয়া যাবে এই পৃথিবীতে। যাবে না। নো বোডি ইজ পারফেক্ট। কেউই নিখুঁত নয়। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য নানান রকম ত্রুটি আছে আমাদের শরীরে।
আধুনিক দুনিয়ায় ‘বডি শেমিং’ খুব নিকৃষ্ট ধরণের একটা অপরাধ। উন্নত দেশগুলোয় কেউ কারো দিকে খারাপ দৃষ্টিতে এমনকি তাকাতেও সাহস পায় না। নাগরিকরা সভ্য আচরণে অভ্যস্ত এবং বাধ্য। অথচ আমাদের দেশে একজন খুদে মানুষ যেনো বা এজমালি সম্পত্তি। পথে-ঘাটে চলতে ফিরতে বামনাকৃতির কাউকে নাগালের মধ্যে পেলে এমনকি ভয়াবহ রকমের ভীতু লোকটাও বামনের পেটে একটা খোঁচা দিয়ে তৃপ্তিলাভ করে। হাসাহাসি করে। অশ্লীল ঠাট্টা ইয়ার্কি করে।
চারপাশে কিলবিল করে ইতরগুলো।
খুব ছোটবেলায় গ্রামে গিয়ে মুরুব্বীগোছের এক জেঠুর কাছে একটা প্রবাদবাক্য শুনেছিলাম–‘বেঁটে মানুষ খোদার দুশমন।’ বিস্ময়কর ব্যাপার সেই হারামজাদাই বলেছিলো সকল মানুষ নাকি খোদার সৃষ্টি!
ইতরপনা কার্য ওদের ঘটে অহর্নিশি…
০৩
গেলো বছর হিউস্টনে কন্যা-জামাতার বাড়িতে অবসর যাপনকালে দেখেছিলাম পৃথিবী কাঁপানো টিভি সিরিয়াল–গেম অব থ্রোন্স। এই সিরিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র টায়রন ল্যানিস্টার। চরিত্রটিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন পিটার ডিঙ্কলেজ নামের একজন বামন অভিনেতা। চার ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার ডিঙ্কলেজ এখন তুমুল জনপ্রিয়, বিশ্বব্যাপি। সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার–এটা ফের প্রমাণ করেছেন এই মার্কিন অভিনেতা ও প্রযোজক। গেম অব থ্রোনস ছাড়াও কাজ করেছেন এক্সম্যান: ডেইজ অব ফিউচার পাস্ট, দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া: প্রিন্স ক্যাসপিয়ানের মতো চলচ্চিত্রে। চার ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি এরই মধ্যে জিতে নিয়েছেন গোল্ডেন গ্লোব, প্রাইমটাইম অ্যামি অ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কার।
গেম অব থ্রোন্স-এ দেখেছি–কাল্পনিক এক পৃথিবীর এক কিংডমে টারগেরিয়ান রাজবংশের উত্তরাধিকারী টায়রন ল্যানিস্টার নিজের বাবাকে খুন করেন। কেনো? কারণ বামন হওয়ার কারণে বাবা তাঁকে দোষারোপ করতেন। অবজ্ঞা করতেন। অপমান করতেন। টায়রনকে ছোট থেকেই শুনতে হয়েছে তাঁর দ্বারা নাকি কিছুই হবে না। সেই রাগের প্রতিশোধ নিতেই কি বাবাকে খুন করেন তিনি?
অর্থাৎ কীনা কাল্পনিক একটা পৃথিবীর গল্পেও, যার কোনো অস্তিত্ব নেই এই দুনিয়ায়, সেখানেও উচ্চতায় বামন হওয়ার অপরাধে পোহাতে হয় নিগ্রহ, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য, অপমান, অসম্মান এবং কটুক্তি। এবং সেটা পরিবার থেকেও!
টায়রনরূপী পিটার ডিঙ্কলেজকে দেখে বারবার আমার মনে পড়েছে ঊন মানুষের হুমায়ুন সাধু নামের অভিনয় শিল্পীটিকে।
কোনো একটি বক্তৃতায় বা সাক্ষাৎকারে পিঙ্কলেজ বলেছিলেন–‘সারা বিশ্বকে একথা বলার দরকার নেই যে আপনি প্রস্তুত। এটা করে দেখান।’
করে দেখিয়েছিলো আমাদের সাধু। বামন অবয়বের সমস্ত প্রতিকুলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্রমশঃ দীপ্যমান হয়ে উঠছিলো সে। প্রমাণ করেছিলো–সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার।
এই জীবনে একবারও দেখা না হওয়া বন্ধু হুমায়ুন সাধু, তোমার জন্যে অনেক অনেক ভালোবাসা। বামনের দেশে তুমি ছিলে এক অপরূপ উচ্চতাসম্পন্ন মানুষ।
সভ্য দুনিয়ার অসভ্যতা আর নিগ্রহ থেকে আপাত মুক্তি পেলে তুমি। সুতোর ওপারে আশা করি কোনো ইতরপনা স্পর্শ করছে না তোমাকে।
অটোয়া ২৬ অক্টোবর ২০১৯
Leave a Reply