আমার আপার নাম চারু। আদনান ভাই ডাকতেন চারুলতা বলে। আদনান ভাই যখন আপাকে আর আমাকে পড়ানো শুরু করেন আপা তখন ১৬ বছরের কিশোরী। সদ্য নবম শ্রেণীতে উঠেছেন। আর আমি তখন সপ্তম শ্রেণীতে। আদনান ভাই লম্বা, ভরাট মুখের শ্যাম বর্ণের তাগড়া যুবক ছিলেন। তিনি তখন ভার্সিটিতে পড়তেন। তার বাবা নেই। তিন ভাই বোনের মধ্যে বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের ভার তার উপরই ছিল। একই মহল্লাই থাকতাম আমরা। বড় বোন বিবাহিত ছিল। অসুস্থ মা আর ছোট বোন নিয়ে তার সংসার। টিউশনির টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলত। আপা বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। আদনান ভাইয়ের সামনেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চুপচাপ বসে পড়াশোনা করত। আদনান ভাই যখন পড়া বুঝাতেন তখন বইয়ের দিকে চুপ করে চেয়ে থাকত। তার দিকে কখনো তাকাতে দেখিনি। বুঝানো শেষে আদনান ভাই জিজ্ঞেস করত বুঝেছো? আপা মাথা উপর নিচ করে ইশারায় হ্যা বলত। মুখে শব্দ করত না। পড়া না বুঝলে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করত। এমন ভাবে জিজ্ঞেস করত যে আপার পাশে বসে মাঝে মাঝে আমিই শুনতে পেতাম না আপা কি জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু আদনান ভাই বুঝতে পারতেন। উনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেও কিভাবে বুঝতে পারতেন এই কথাটা কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমি এটা সেটা প্রশ্ন করে আদনান ভাইকে অতিষ্ঠ করে দিতাম। তিনি কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলেও মুখে কখনো বলেনি। যখন অতি মাত্রায় প্রশ্ন করতাম আপা আমার হাত চেপে ধরে চোখ দিয়ে ইশারা দিত। এভাবে আপার নবম শ্রেণী পেরিয়ে গেল। দশম শ্রেণীতে উঠার পর আমি অন্য এক আপাকে দেখতে পেলাম। আমার চুপচাপ শান্ত আপাটা হঠাৎ বদলে গেল। আদনান ভাইয়ের চোখে চোখ রাখতে শুরু করল। তার দিকে চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যেত। লাজুক হাসি দিয়ে বারবার কানের পেছনে চুল গুজত, ওড়না ঠিক জায়গায় থাকার পরেও বারবার টানত। আপা চোখে কাজল দিতে লাগল। আদনান ভাই এসে যখন আপার চোখের দিকে তাকাত আপার ফর্সা গাল দু’টোকে গোধূলি ছুয়ে যেত। ঠোঁটের কোণে মৃদু লাজুক হাসি আর চোখে তৃপ্তি খেলা করত। তাদের পড়াশোনার বাইরে কোনো কথা হত না। পাড়ায়, রাস্তার মোড়ে হঠাৎ তাদের দেখা হলেও কথা হত না। তখন মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিল না। চিঠি আর টেলিফোনের যুগ ছিল। আমাদের বাড়িতে টেলিফোন থাকলেও আদনান ভাইয়ের বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। আপা চিঠিও দিত না। কি অদ্ভুত! তাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ ছিল না কিন্তু প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল।
একদিন আমি আপাকে বললাম আপা তুমি কাউকে চিঠি লিখো না কেন? চিঠি লিখো আমি পৌঁছে দেব। আপা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে স্বভাবচরিত্র ধীর গলায় বলল,
“কাকে দেব?”
আমি বললাম,”কেন আদনান ভাইকে।”
আপার শান্ত মুখটা হঠাৎই বদলে গেল। কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা ভয় তার চোখেমুখে ভর করল। নিজেকে সামলে বলল,
“আমি তাকে চিঠি কেন দেব?”
আমি নিজের কথায় নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। আসলেই তো আপা কেন চিঠি লিখবে? এখন আপাকে আমি কী বলব। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপা কিছুক্ষণ আমাকে পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল,
“পড়তে বস।”
আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। দৌড়ে গিয়ে বই খুলে বসলাম। আপা আমাকে কিছু না বললেও সব আমি টের পেতাম। আপাকে সব সময় চোখে চোখে রাখতাম। এসব আপা জানতো না। কিন্তু আজ আমার বোকামির জন্য আপা সব জেনে গেল। সময় দ্রুত পেরিয়ে গেল। এভাবেই চোখে চোখে তাদের প্রেম চলছিল। আপার এসএসসি পরীক্ষাও শেষ। আদনান ভাইয়ের কাছে এখন আমি একাই পড়ি। আপার সাথে তেমন দেখা হয় না তার। মাঝে মাঝে আপা নানান বাহানায় পড়ার ঘরে আসে। আদনান ভাই আড়চোখে আপাকে দেখে। আপা তার দিকে তাকায় না। কেন জানি না।
বাবা আপার জন্য সমন্ধ দেখছেন। সে সময়ে মেয়েদের এসএসসি পাশ করা অনেক বড়সড় ব্যাপার ছিল। আপা যে পাশ করবেন সে বিষয়ে মা এবং বাবা দুজনেই শতভাগ নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়ের জন্য ভালো সমন্ধ দেখছেন। দু এক জন এসেছিল কিন্তু বাবার পছন্দ হয়নি। তিনি তার মেয়ের জন্য সেরাটা খুঁজছিলেন। আপা তেমন লম্বা না হলেও রূপবতী কিশোরী ছিল। নম্র,ভদ্র কোনো দিকে কমতি ছিল না। আমার বাবা বাজারের নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। তাই তিনি তার মেয়ের জন্য সর্বগুণ সম্পূর্ণ পাত্র খুঁজছেন। আপা ইতিমধ্যে বিরক্ত হলেও বাবা কিংবা মা’কে কিছু বলতে পারছিল না। তিনি বরাবরই চাপা স্বভাবের। কখনোই তাদের কোন সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেনি।
ইদানীং আদনান ভাইয়ের চোখে মুখে ভীষণ ক্লান্তি আর হতাশা দেখতে পাই আমি। তিনি কি জেনে গেলেন আপার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে? কিন্তু কী করে? আপা তো উনার সাথে কথা বলে না। বাড়ি থেকেও বের হন না। আমি অযথা ভেবে ভেবে কলমের খাপ কামড়ে শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু কারণ উদঘাটন করতে পারিনি। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় উনার বোনের চার বছরের ছেলেকে দেখেছি। আজ পনেরো দিন পরেও ওদের এখানেই দেখছি।
আমি এখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। সেই নবম শ্রেণিতে পড়া আপার মতো নয়। আগের মতোই চঞ্চল কিশোরী বালিকাই রয়েছি। হঠাৎ বিকেল বেলায় পড়ার ঘরে আপা এলেন। আমি তখন অংক করছিলাম। আপার চোখ মুখ ফোলা লাগছিল। ঠোঁট অনবরত কাঁপছে। আমি কলম টেবিলের উপরে রেখে উঠে দাঁড়ালাম।
“আপা, কী হয়েছে তোমার?”
আপা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সরাসরি বলল,
“আমার সাথে একটু আদনান ভাইয়ের বাসায় যাবি?”
আমি বুঝতে পারলাম না কিছু।
“উনাদের বাসায় কেন? আদনান ভাই আগামীকালই পড়াতে আসবে।”
“আমার উনার সাথে দরকার আছে। খুব জরুরি। তুই মা’কে বলবি তোর অংকে একটু সমস্যা হচ্ছে তাই উনার কাছে যাচ্ছিস। একা যেতে ভালো লাগে না তাই আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস।”
আপা কথাগুলো বলে দম নিলেন।
যে মেয়ে এত বছরে আদনান ভাইয়ের সাথে একটিবার দেখা করতে চায়নি, আলাদা কথা বলতে চায়নি তার সিরিয়াস বিষয় না হলে আজ দেখা করার কথা বলত না। তাই আমি আর প্রশ্ন করলাম না। আপাকে নিয়ে উনাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলাম। একটু দূরে গিয়েই তাকে পেয়ে গেলাম। এই বিকেল বেলায়ও ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের পুরনো শার্টটা ভিজে শরীরের সাথে লেগে গেছে। আপার কথায় তাকে ডাকলাম। আদনান ভাই আমাকে আর আপাকে দেখে চমকে উঠে। কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল।
জায়গাটা কোলাহলমুক্ত। আপা আর আদনান ভাই কথা বলছে আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। তাদের দিকে কান পেতে রেখে অন্য দিকে চেয়ে আছি। দেখছি কেউ চলে আসে কি না। আবার মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাদেরও দেখছি। আমি না দেখেও বুঝতে পারছি আপা আদনান ভাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর আদনান ভাই জীর্ণশীর্ণ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আপা তার উসকোখুসকো চুলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করছে,
“এতদিন ধরে আসছেন না কেন?”
“একটু সমস্যায় আছি৷ তোমার বাবার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছি। আগামীকাল থেকে তনুকে পড়াতে যাব।”
“সে নাহয় যাবেন। আপনার চেহেরার এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে আপনার? আর কী সমস্যায় আছেন?”
আপার চোখেমুখে চিন্তার রেখা।
আদনান ভাই জোরপূর্বক হেসে মলিন মুখে বলল,
“তেমন কিছু না। গরীব, বেকার মানুষের যেমন সমস্যা থাকে আর কি৷”
আপা আবার কোমল গলায় বলল,
“আপনি আমাকে বলতে চাইছেন না কেন? আমি কী এতটাই পর?”
আদনান ভাই আপার চোখের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ শান্তভাবে ওই শান্ত চোখে ডুব দিলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বিএ পাস করে দু’চারটে টিউশনি করছি। এতে কি আর পুরো সংসার চলে?”
সে সময় টিউশন স্যারের অত কদর ছিল না। বর্তমান সময়ের মতো বাড়িতে টিউশন দিয়ে এত ভালো স্যালারি জুটত না।
তারপর আবার কাতর হয়ে বললেন,
“বোনটাকে স্বামী ছেলেসহ তাড়িয়ে দিয়েছে। মা অসুস্থ। তার ওষুধ দরকার। ছোট বোনের স্কুলের বেতন, ফি দরকার। স্কুলে যেতে পারছে না। বাড়িতে চাল-ডাল নেই। এত অধম যে পরিবারের জন্য খাবারও জোগাড় করতে পারছি না। টিউশনি থেকে যা পাই অর্ধেক মাসেই শেষ হয়ে যায়। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজেকে অসহায় লাগছে। অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে।”
আপার চোখে জল চলে এল। আপা কিছু একটা বলতে এসেছিল। তার কোনো সমস্যার কথা। কিন্তু আদনান ভাইয়ের এত সমস্যা দেখে তার নিজেরটা আর বলা হলো না। আদনান ভাই মাথা নিচু করে শুকনো গলায় বলল,
“বাড়ি যাও। কেউ দেখলে তোমার সমস্যা হবে।”
আদনান ভাই আপাকে রেখে চলে যাচ্ছে। আপা পেছনে থেকে বলল,
“এসবের মাঝে আমার কী কোনো অবস্থান নেই?”
আদনান ভাই পেছনে ঘুরে মলিন হেসে বিমর্ষচিত্তে বলল,
“অভাব ভালোবাসায় ঘুণ ধরিয়ে দেয়। ভাবনাটা যখন এতগুলো মানুষকে নিয়ে, তখন নিজের জীবন, ভালোবাসা, নিজের চাওয়া পাওয়া তুচ্ছ মনে হয়।”
আদনান ভাই চলে গেল। আপার চোখের কোনে ফের জল চলে এল। আপা কিছু বলল না। চুপচাপ বাড়ি চলে এল৷ আমি তার পেছনে পেছনে।
দুদিন পর আপা তার সব জমানো টাকা নিয়ে ও বাড়িতে গেল। আদনান স্যারের বোনের স্কুলের বেতন আর কাকির ওষুধের টাকা দিয়ে এল কাকির হাতে৷ কাকি নিতে চায়নি আপা বলেছে ধার দিয়েছে সময় মতো নিয়ে নিবে। এ নিয়ে আদনান ভাই অনেক রাগারাগি করেন। পড়াতে এসে যাওয়ার সময় আমাকে বলল,”তোমার আপাকে ডাকো।”
আমি আপাকে ডাকলাম। আদনান ভাই গেটের সামনে জুতা পড়তে পড়তে আপাকে বলল,
“কাজটা তুমি ঠিক করোনি চারু।”
এই প্রথম আদনান ভাই আপাকে চারু বলল চারুলতার বদলে। আপা থমকে গেল। চোখ ভর্তি জল নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আদনান ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তার উদাস দৃষ্টি ছিল। তারপর দীর্ঘ দিন আদনান ভাইয়ের দেখা নেই৷ অনেক চেষ্টা করেও তার খোঁজ পায়নি আপা। আমি তার বাড়িতে গিয়েও কোন খোঁজ পাইনি।
একদিন সারাদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দায় আপা আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা দিয়ে একটা এম্বুলেন্স গেল। কেমন ভয়ানক তার শব্দ বুক কেঁপে ওঠল। বিকেলে বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। বারান্দায় যেতেই মসজিদের ইমাম সাহেব মাইকে এনাউন্স করছে একটি শোক সংবাদ!
আমি আপাকে চেপে ধরলাম। আপা শক্ত হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না। তার দৃষ্টিটাও অদ্ভুত। না কথা বলছে না কাঁদছে।
আদনান ভাইদের ছোট্ট উঠানে লোকজন জড়ো হয়েছে। তার অসুস্থ মা, বোন আর আত্মীয় স্বজনরা চিৎকার করে কাঁদছে। সাদা কাফনে একটা রক্তাক্ত শরীর ঢাকা৷ বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। কার জন্য আপার জন্য না আদনান ভাইয়ের জন্য? লোকজন বলছে তিনি রাস্তা পাড় হচ্ছিলেন একটা বাস এসে তাকে ধাক্কা দেয়। রাস্তার উপর পড়ার পরই মারা যান।
আপা ভেতরে যান নি। কাঁদেনও নি। বিরবির করে শুধু বললেন,
“অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন। একেবারে মুক্ত হয়ে গেলেন আদনান ভাই।”
আপা বাড়িতে চলে এল। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সারা দিন-রাত নিজের ঘরে পড়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে ডায়েরিতে কীসব লিখেন। আমি তাতে হাত দেই না। তাকে নিয়ে বাবা-মা বেশ চিন্তিত। ভালো পাত্র না পাওয়ায় আপাকে কলেজে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবা। কিন্তু আপার এ নিয়ে কোন মতামত নেই। আপার কী হয়েছে কেউ বুঝতে পারছে না। একদিন মা’কে দেখলাম আপার ডায়েরি পড়তে তারপর কী বুঝলেন জানি না। রাতে বাবার সাথে গম্ভীর পরামর্শ করলেন। আপাকে পরের দিন ফুপুর বাড়িতে পাঠালেন। এরপর আর আপা বাড়িতে ফিরেন নি। আপার জন্য বাবা সুপাত্র পাওয়ার পরেও আপা ফিরেন নি।
আপাকে যেদিন বলা হলো এখন তো তুমি অবসর
সময় কাটাচ্ছো, কিছুদিন তোমার ফুপুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। আপা বিনাবাক্য ব্যয়ে চলে যায় ফুপুর বাড়ি। সেখানে গিয়েও আপা চুপচাপ থাকতেন। বাবা আপার জন্য ভালো পাত্র পেয়েছে বলে খবর পাঠালে আপা ফুপুকে জানান সে বাড়িতে যাবে না। ফুপু এই নিয়ে ফুপার সাথে সলাপরামর্শ করল। ফুপুর ভাইয়ের মেয়ে বাড়িতে কেন যেতে চায় না পরামর্শ শেষে কারণ উদঘাটন করল ফুপা। ফুপা প্রাইমারি স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন। তার ধারণা আপা বিয়ে করতে চায় না, পড়াশোনা করতে চায়। তাই বাবার সাথে কথা বলে আপাকে কলেজে ভর্তি করে দিলেন। যদিও বাবা পাত্র হাতছাড়া করে মেয়েকে পড়াতে চান নি কিন্তু আপার অবস্থা আর সবার অনুরোধে মেনে নিতে বাধ্য হলেন। কলেজে ভর্তির পর আপা কিছুটা স্বাভাবিক হতে লাগল। ফুপুর বাড়িতেই থাকতে লাগল। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের টিউশন দিয়ে নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছিল। আদনান ভাইয়ের বাড়ির খোঁজ নিয়মিত রাখত। তার বড় বোন শ্বশুর বাড়ি ফিরে যায়, ছোট বোন স্কুলের ফাঁকে দু একটা বাচ্চা পড়িয়ে পড়ার খরচ জোগায়। আত্মীয় স্বজনদের সাহায্য সহযোগিতায় সংসারটা কোনো রকমে চলছে। আপা মাঝেমধ্যে গিয়ে জোর করে টাকা পয়সা দিয়ে আসে। এইচএসসি পাস করার পর আপা অল্প বেতনে একটা চাকরি পায়। সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। আপা তার মেধা আর পরিশ্রম দ্বারা অল্প সময়েই পদোন্নতি পায়। আদনান ভাইয়ের বোনের বিয়ে দেয়। যতদিন আদনান ভাইয়ের মা বেঁচে ছিলেন তার দায়িত্ব নিয়েছিল। সবাই অনেক চেষ্টা করে আপাকে বিয়ে দেওয়ার কিন্তু আপা রাজি হয়নি। আজ আপা আমাদের মহল্লার একজন সম্মানিত ব্যক্তি। কলেজে পড়ায়। মহল্লার সবাই তাকে আপা বলে সম্বোধন করেন। ২৫ বছর পরেও আপা সেই রূপবতী চারুলতাই রয়ে গেছে। তার চেহারার মোহনীয়তা কোনো অংশে কমেনি।১৭ বছরের মেয়েটা আজ ৪২ বছরে এসে পৌছেছে। আদনান ভাইয়ের মা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা রাখেনি। তিনি তার দুই সন্তান আহান আর আদিয়াকে দিয়ে বাড়িটা পূর্ণ করেছেন। তার দত্তক নেওয়া সন্তান। আপাকে যতবার দেখি ততই অবাক হই। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এভাবে সারাটি জীবন উৎসর্গ করে দেয়।
আপাকে মাঝেমাঝে প্রশ্ন করি, “আপা তুমি সুখী তো?”
আপা মুচকি হেসে তৃপ্তি নিয়ে বলে,
“যে আদনানের ভালোবাসা পেয়েছে, আদনানের ঘরে স্থান পেয়েছে সে অসুখী হতে পারে? আমার তো এটাই চাওয়া ছিল। সেটা পূর্ণ হয়েছে। আদনান আমার আর আমাদের সন্তানদের ছায়া হয়ে রয়েছে এই বাড়িতে।”
আপা মাঝ রাত্রিতে আদনান ভাইয়ের ডায়েরি খুলে বসেন যেটা আপা তার ড্রয়ারে লুকানো অবস্থায় পেয়েছিল। চোখে কাজল টেনে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে শেষ পাতাটা খুলে অপলক চেয়ে থাকবেন। যেখানে লিখা~
“প্রিয় চারুলতা, তোমাকে এ জীবনে আর পাওয়া হলো না। আমি পেতেও চাই না। আমি জানি তোমার বাবা তোমার জন্য ছেলে দেখছেন। সুপাত্র দেখে বিয়েও দিয়ে দিবে। আমার মতো বেকার ছেলে আর যাই হোক সুপাত্র হতে পারে না। তোমাকে না পেলেও আজীবন তুমি আমার প্রিয় রয়ে যাবে চারুলতা। প্রতিটি গভীর রাত তোমার নামে করে দিলাম। বড্ড ভালোবাসি চারুলতা। বড্ড ভালোবাসি।”
আপাও বিরবির করে বলবেন,”বড্ড ভালোবাসি।”
তারপর ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply