1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

# গল্পঃ # পাপ (২য় পর্ব), ( ৩য় / শেষ পর্ব) – – – © মাহবুবা আরিফ সুমি

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২২
  • ১৭৭ বার
#পাপ(২য় পর্ব)
তখন শীতকাল। স্কুল থেকে ফিরে গরম পানি দিয়ে গোসল করার অভ্যাস ছিল। আম্মা অসংখ্যবার নিষেধ করা সত্বেও সুযোগ পেলেই আমি সেই পানি গরম বসানো ও নামানোর কাজটি করাতাম মুর্শেদাকে দিয়ে ।
.. একদিন ওর হাত ফসকে সত্যি সত্যিই গরম পানির হাড়ি পড়ে গেল।
দিনটি ছিল জানুয়ারি মাসের দুই তারিখ। সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমার সামনেই ঘটেছিল ঘটনাটি।
পানির হাড়িটা ওর গায়ে পড়লে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতো সন্দেহ নেই। কিন্তু মুর্শেদার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। হাড়িটা সারাসরি ওর গায়ে পড়েনি। তবে বেশ কিছু পানি ছলকে ওর বুকে-পেটে পড়েছিল। ওর ছোট্ট কচি শরীরের চামড়া সাথে সাথে বিভৎসভাবে পুড়ে, গলে গিয়েছিল। অবস্থা দেখে আমরা সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। তবে লোক জানাজানির ভয়ে মুর্শেদাকে কিন্তু হাসপাতালে নেয়া হয়নি। আমার এক খালাতো ভাই ছিলেন ডাক্তার। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে সে সময় সদ্য পাশ করেছিলেন। তাকে খবর দেয়া হলো। তিনি এসে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ঔষধপত্র লিখে দিয়ে গেলেন। তিনদিন পর মুর্শেদার সেই ফুফুকে ডেকে এনে ওকে বিদায় দেয়া হয়েছিল। আসলে আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। আম্মা অবশ্য ওকে কয়েকমাসের ঔষধপত্র সেইসাথে বেশকিছু টাকাও দিয়েছিলেন। ওর পরিবারও ব্যাপারটা দুর্ঘটনা হিসেবেই মেনে নিয়েছিল। পরে মুর্শেদার খবর আমরা আর রাখিনি। আসলে ঘটনার মাস তিনেক পর সেই ভাড়া বাড়ি পাল্টে আমরা অন্যত্র নিজেদের বাসায় উঠেছিলাম। মুর্শেদাকে নিয়ে আমরা পরে খারাপ কিছু ভাবিনি। বিষয়টা মাথা থেকে একদম ঝেরে ফেলেছিলাম সবাই।
চিকিৎসার পর মুর্শেদা সুস্থ হয়েছে, ভালো আছে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম। সত্যি কথা বলতে সে ঘটনার পর মাঝে প্রায় বিশ বছর কেটে গেছে। ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
তবে.. এখন আমি নিশ্চিত মুর্শেদা আসলে পরে মারা গিয়েছিল।
শাপলা হঠাৎ মাথা নিচু করে দুই হাতে মুখ ঢাকল। ইলোরা চৌধুরীর মনে হলো মেয়েটি কাঁদছে।
একটু চুপ থেকে তিনি বললেন,
— এতদিন পর কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে মুর্শেদা সে ঘটনায় মারা গেছে? গ্রাম থেকে কেউ কি যোগাযোগ করেছিল?
— জি না।
— তাহলে? হতে পারে সে সুস্থ আছে, ভালো আছে। হয়তো বিয়ে শাদিও করেছে এতদিনে …।
শাপলা মুখ তুলে মৃদুস্বরে বলল,
— সেটা বলতেই আসলে আপনার কাছে আসা। তার আগে আপনাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।
শাপলা তার হাত ব্যাগ খুলে একটা সাদা রঙের খাম বের করল। খামের ভেতর দুটো ছবি। সে ছবি দুটো ইলোরা চৌধুরীর দিকে বাড়িয়ে ধরল।
ইলোরা ছবি দুটো হাতে নিলেন।
শাপলা নিচু গলায় বলল,
— ঘটনাটা বিশ বছর আগে ঘটেছিল। মুর্শেদার চেহারা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছুটা সন্দেহ ছিল। গত পরশু মায়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে এই ছবিটা খুঁজে পেলাম। প্রথম ছবিটা মুর্শেদার। আমার আম্মার সাথে তুলেছিল সেই সময়। দ্বিতীয় ছবিটা আমার মেয়ে তিতলির । সাথে আমি আর আমার স্বামী। দেখে আমার মাও ভীষণ অবাক হয়েছেন। আপনি কি আশ্চর্য ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন?
ইলোরা ছবি দুটোর দিকে তাকালেন। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
শাপলা ফিসফিস করে বলল,
আমার মেয়ের চেহারা কিন্তু আমার বা আমার স্বামীর চেহারার সাথে কোনো মিল নেই। তার চেহারা পুরোপুরি মুর্শেদার মতো। এমনকি ঠোঁটের কোণে থাকা তিলটা পর্যন্ত। গত পরশু ছবিটা দেখার পর ব্যাপারটা আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি।
শাপলা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। তাকে আবার অস্থির দেখাচ্ছে।
–আসলে মেয়ে পেটে আসবার পরই মুর্শেদাকে আমি হঠাৎ ঘন ঘন স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। স্বপ্নে সে নিজেই তার মৃত্যুর কথা জানাল।
— স্বপ্নে সে কথা বলে ?
— জি না। প্রথম দিকে সে স্বপ্নে কেবল বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। বছরখানেক হলো হাত পা নেড়ে নানা ইঙ্গিত করে। গত বছর ঠিক ওই সময়ই প্রথম আমি আপনার চেম্বারে গিয়েছিলাম। তবে কিছু বলতে পারিনি। আসলে প্রথম প্রথম আমার ধারণা ছিল পুরোটাই আমার মনের ভুল। তাই পাত্তা দেইনি তেমন। তবে এখন এই ছবিটি দেখার পর আমি নিশ্চিত এটা আমার মনের ভুল নয়। মুর্শেদা সত্যি সত্যিই তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়।
— কীভাবে?
— আমার ধারণা সে আমার মেয়েকে হত্যা করতে চায়। আর সেটা হবে ঠিক ওর মতোই আমার মেয়ের ছয় বছর বয়সে। তিতলি ঠিক ওর বয়সে পৌঁছালেই মুর্শেদা ওকে হত্যা করবে। কীভাবে ঘটনাটি ঘটবে আমি জানি না। হয়তো গরম পানি বা এ জাতীয় কিছুতে।
— এটা কি কেবল ধারণা?
— না, ঠিক ধারণা নয়। স্বপ্নে মুর্শেদা আমাকে এমনই ইঙ্গিত করেছে।.. আর আমার মেয়ে তিতলির জন্মদিন সামনে মাসে। নভেম্বরের উনিশ তারিখ তার ষষ্ঠ জন্মদিন। সময় বেশি হাতে নেই। আমাকে আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে হবে। আর এইজন্যই আমি আপনার কাছে এসেছি। ডাক্তার, ঔষধ পত্র এসবে কোনো কাজ হবে না। অন্য কোনোভাবে সাহায্য করতে পারলে বলুন।
শাপলা অস্থিরভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ওর কপাল থেকে দরদর করে ঘাম পড়ছে।
ইলোরা চৌধুরীকে হঠাৎ খুব চিন্তিত দেখাল। তিনি মুখে কিছু বললেন না। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ভাবনায় মগ্ন।
তাকে অনেকক্ষন চুপ থাকতে দেখে শাপলা উঠে দাঁড়াল।
— আমার মনে হচ্ছে আসলে কিছুতেই কিছু হবে না। শুধু শুধু আপনার সময় নষ্ট হলো। নিয়তির উপর ভরসা করা ছাড়া আর কিছু করবার নেই। আমি আসছি।
ইলোরা চৌধুরী ধীর গলায় বললেন,
— আপনি শুনতে আগ্রহী হলে আমি ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দিতে চাই। শুনতে চাওয়া বা না চাওয়া আপনার ব্যাপার। তবে আমার কথা মানতে পারলে আপনার নিজেরই লাভ। হয়তো এই সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তিও পাবেন।
শাপলা ধপ করে আবার চেয়ারে বসল। তবে তার চেহারার অস্থিরতা দূর হলো না।
চলবে–
( ৩য় / শেষ পর্ব)
ইলোরা চৌধুরী ধীর গলায় বললেন,
— আপনি শুনতে আগ্রহী হলে আমি ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দিতে চাই। শুনতে চাওয়া বা না চাওয়া আপনার ব্যাপার। তবে আমার কথা মানতে পারলে আপনার নিজেরই লাভ। হয়তো এই সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তিও পাবেন।
শাপলা ধপ করে আবার চেয়ারে বসল। তবে তার চেহারার অস্থিরতা দূর হলো না।
ইলোরা চৌধুরী একটু থেমে ধীরে ধীরে বললেন,
— আমার বিশ্বাস আপনি যা ভাবছেন সেটা ভুল। আমার ধারণা মুর্শেদা সে ঘটনায় মারা যায়নি। আপনি যা কিছু স্বপ্ন দেখছেন, ভাবছেন সেসব কিছু আপনার অবচেতন মনের ভয় হতে তৈরি, আপনার নিজের মনেরই ভাবনা।
শাপলা অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলল,
— কীভাবে এটা বলছেন?
— ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলছি। দেখুন চলার পথে আমরা প্রায় সবাই কিছু না কিছু ছোটো, বড়ো ভুল কিংবা অপরাধ করি । অনেক সময় তাৎক্ষণিক নিজের ভুলটা হয়তো ধরতে পারি না বা সেভাবে সেটার গুরুত্ব অনুভব করতে পারি না। কিন্তু পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় পর কখনো কখনো সেইসব ঘটনা মনে পড়ে প্রচণ্ড অনুশোচনা বা অপরাধবোধ আমাদের গ্রাস করে । কাহিনি বর্ণনার সময় আপনি কিশোরী নিজেকে আত্মকেন্দ্রিক, কঠিন হৃদয়ের একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তবে আমার ধারণা ছোটবেলা হতেই একটি কোমল, মানবিক মন আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনার পুরো কাহিনি আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। শুরুতে আপনি চরের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা ও লড়াইয়ের কাহিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, যে মানুষটি তাদের জীবনযাত্রার কষ্টকর দিকগুলো কখনো উপলব্ধি করেনি তার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, মুর্শেদা নামের মেয়েটিকে আপনি ঈর্ষা করতেন। কিশোরী বয়সে করা এই ঈর্ষাটা আপনি ইচ্ছে করে করতেন তা নয় । আসলে নিজের পরিবারে আপনার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল , সেখানে ওর হঠাৎ আবির্ভাব আপনি মানতে পারেননি। মা-বাবা মুর্শেদাকে বিশেষ স্নেহ, আদর করছে ব্যাপারটা আপনার ভালো লাগেনি। কখনো কখনো আপন ভাই -বোনের ক্ষেত্রেও এমন ঈর্ষা দেখা যায়। আপনার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছিল অসহায় মেয়েটার উপর। মেয়েটাকে আপনি নানাভাবে শাস্তি দিতে চাইতেন। কিন্তু এর পরিনতি বা ভয়াবহতা সম্বন্ধে আপনার ধারণা ছিল না । ফলে মুর্শেদা যখন গরম পানিতে আহত হলো, আপনি নিজেও সেটা মন থেকে মানতে পারেননি । শিশুটির পুড়ে যাওয়া শরীর এবং কষ্ট দেখে আপনার ভেতর প্রচণ্ড অপরাধবোধ তৈরি হলো।
আপনি বলেছেন পুরো ঘটনা আপনি প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন। আসলে আপনি ব্যাপারটা কখনোই ভুলে যাননি। আমাদের মন, মস্তিষ্ক থেকে তিক্ত স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে চায়। ভুলে থাকার চেষ্টা করে। এখানেও তাই হয়েছে। আপনি বছরের পর বছর ঘটনাটি ভুলে থাকবার ভান করে গেছেন কেবল।
আমার ধারণা ঘটনার অনেক বছর পর আল্ট্রাসনোগ্রামে যেদিন জানতে পারলেন আপনার গর্ভে একটি মেয়ে শিশু আছে ঠিক সেদিন থেকেই আপনি মুর্শেদা বিষয়ক এই স্বপ্নগুলো দেখা শুরু করেছেন । স্বপ্নে সে আপনাকে নানা কিছু ইঙ্গিত করছে। আসলে পুরোটাই ভ্রান্তি।
আসল ব্যাপার হলো আপনার গর্ভে একটি কন্যা শিশু আছে এটা জানার পরই মুর্শেদা নামের শিশুটির কথা আপনার আবার মনে পড়ল। এতদিন মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখা দুঃসহ স্মৃতি আবার জেগে উঠল। আপনার মনে জন্ম নিল ভয়। আপনার সন্দেহ হতে লাগল মুর্শেদা
সে ঘটনায় মারা গেছে। ঠিক তখন স্বপ্নেও মুর্শেদা আপনাকে সে রকম ইঙ্গিত দিলো। ফলে আপনি তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন ।
আসলে সেই ঘটনার সময় আপনি কিশোরী ছিলেন, এখন হয়েছেন মা। একজন মা হয়ে মুর্শেদার জায়গায় আপনি আপনার নিজের কন্যাকে কল্পনা করেছেন। আর তখনই আবার আপনার ভেতর তীব্র অনুশোচনা এবং প্রবল অপরাধবোধের জন্ম হয়েছে। নিজের সন্তানের দিকে তাকালেই অতীতে ঈর্ষার বশে করা ভুলটি আপনার মনে পড়ছে। আপনার নিজের মেয়েটির ক্ষেত্রে আপনি একজন মমতাময়ী নারী কিন্তু সেই আপনিই আরেকটি শিশুর ক্ষেত্রে জঘন্য অপরাধী । শিশুটির মৃত্যুও হয়েছে আপনারই দোষে। সেই নিষ্পাপ শিশুটির কথা মনে পড়ে নিজের সন্তানকেও আপনি সেভাবে ভালোবাসতে পারছেন না। আপনার মনে তৈরি হয়েছে নানা মানসিক চাপ ও দ্বিধা -দ্বন্দ । মূলত ঘটনাটির জন্য আপনি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারেননি।
এক সময় আপনার অবচেতন মন চেয়েছে অপরাধী আপনার কঠিন কোনো শাস্তি হোক। নিজের সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে বড়ো শাস্তি একজন মায়ের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
আপনি আপনার নিজের মনের ভাবনাই স্বপ্নে মুর্শেদার ইচ্ছে রুপে দেখেছেন।
তাছাড়া খেয়াল করুন, আপনি প্রথম যখন মুর্শেদাকে স্বপ্ন দেখেন সে সময় কিন্তু সন্তান সম্ভবা ছিলেন । এমননিতেও এ সময় দেহে নানা রকম হরমোনাল পরিবর্তন হয়। মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে।
তবে ব্যাপারটা কিন্তু এখন আর এত সহজ নেই। ঘটনা এখনই নিয়ন্ত্রণে না নিলে ধীরে ধীরে সেটা আরও জটিল হবে এবং এক সময় সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
— কীভাবে?
ইলোরা চৌধুরী একটু এগিয়ে এলেন শাপলার দিকে।
— আপনি স্বপ্নের মাধ্যমে ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছেন মুর্শেদা ইঙ্গিত করছে ওর বয়সে পৌঁছালে আপনার মেয়েটিরও একই রকমভাবে দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটবে। ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণে না নিলে যা হবে তা হলো, এক সময় আপনি নিজেই হয়তো মুর্শেদা রূপে নিজের অজান্তেই নিজের মেয়েটিকে হত্যা করবেন প্রতিশোধ নিতে।
আসলে আপনার দেখা স্বপ্নগুলো সাথে মুর্শেদার মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।.. মুর্শেদা প্রতিশোধ নিতে চাইছে না। প্রতিশোধ আপনি নিজেই আপনার নিজের উপর নিতে চাইছেন।
..আমার দৃঢ় বিশ্বাস মুর্শেদা মেয়েটি আসলে মারা যায়নি। সে বেঁচে আছে।
শাপলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ইলোরা চৌধুরী বললেন,
— কেন বলছি একথা সেটা এবার বলছি। আপনি বলেছেন আপনারা বাসা পাল্টেছিলেন মুর্শেদার গায়ে গরম পানি পড়ার তিন মাস পর। মেয়েটির মৃত্যু হলে বা এমন খারাপ কিছু ঘটলে কিন্তু এই তিনমাসের মধ্যেই খবর পাওয়ার কথা ছিল । আপনারা তা পাননি। নতুন বাসার ঠিকানা না জানলেও পুরোনো ভাড়া বাড়ি কিন্তু ওর ফুফু চিনত। সেখানেও তারা গিয়ে থাকলে সংবাদ পেতেন। তাছাড়া, মেয়েটির মৃত্যু হলে এত সহজে তারা আপনাদের ছাড়ত না বলেই আমার বিশ্বাস। আর এত বড়ো ঘটনা কিছু হলেও খবরাখবর আপনাদের কানে আসতই ।.. তেমন কিছু কি কানে এসেছিল?
শাপলা মাথা নাড়ল।
ইলোরা চৌধুরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
–তো আমরা ধরে নিতে পারি মেয়েটি বেঁচে আছে,সুস্থ আছে। এরপরও সন্দেহ থাকলে নিশ্চিত হতে আপনি ঐখানে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিতে পারেন।
শাপলা তাকিয়ে আছে। তাকে এখন কিছুটা শান্ত দেখাচ্ছে। সে বিড়বিড় করে বলল,
— কিন্তু, চেহারার মিলটা? এটার কী ব্যাখ্যা দিবেন?
ইলোরা চৌধুরী একটু হাসলেন।
— সেটা আপনার দেখার ভুল। ছবি দুটো আমি ভালো করে মিলিয়ে দেখেছি। দুজনের চেহারার মধ্যে আসলে কোনো মিল নেই। আপনার মেয়ে আপনাদের স্বামী স্ত্রীর মতোই দেখতে হয়েছে। যেহেতু ঐ ঘটনার সাথে আপনার মা জড়িত ছিলেন , ঘটনার জন্য তিনিও অপরাধবোধে ভুগতেন তাই তিনি আপনার কথায় প্রভাবিত হয়েছেন এবং চোখে ভুল দেখেছেন… আর কিছু নয়।
আমার ব্যাখ্যা কী আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য লাগছে?
শাপলা চুপ করে আছে। তার শরীর হাল্কা কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎ ইলোরা চৌধুরীকে হতভম্ব করে দিয়ে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
তিনি উঠে এসে শাপলার হাত ধরলেন।
নরম গলায় বললেন,
— এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আদালত কোনটা জানেন? সেটা হলো মানুষের নিজের বিবেক। সবাইকে ধোঁকা দেয়া গেলেও নিজের বিবেককে কখনো ধোঁকা দেয়া যায় না। বিবেকের কাছে একদিন মানুষকে ধরা পড়তেই হয়। হয়তো কিছু আগে কিংবা পড়ে।
.. তবে বান্দা যখন মন থেকে অনুতপ্ত হয় সৃষ্টিকর্তা তার বড়ো থেকে বড়োতম অপরাধও ক্ষমা করে দেন শুনেছি। আমার ধারণা তাঁর ক্ষমা আপনি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন।
শাপলা কান্না থামিয়ে উঠে দাঁড়াল।
— আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনি ঠিকই বলেছেন। মেয়ে জন্মাবার পর গত পাঁচ বছর এক রাতও আমি ঠিকভাবে ঘুমাইনি। যতবার ওর দিকে তাকিয়েছি মনে হয়েছে আমি একজন পাষান হৃদয়, নির্দয়, নিষ্ঠুর মানুষ।… আমি মহাপাপি ।
তবে বিশ্বাস করুন এই পাপ আমি ইচ্ছে করে করিনি।
ইলোরা চৌধুরী বললেন,
— আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
আশা করি রাখবেন।
— জি, অবশ্যই বলুন।
— মুর্শেদার ছবিটা আমি নিজের কাছে রাখতে চাই।
শাপলা চোখ মুছে হাসিমুখে বলল,
– আপনি দুটো ছবিই রাখতে পারেন।
শাপলাকে বিদায় দিয়ে ইলোরা চৌধুরী ছবির খামটি হাতে নিলেন।
তিনি নিশ্চিত আজ থেকে শাপলা আর কোনোদিন মুর্শেদাকে স্বপ্ন দেখবে না । হয়তো সে এরপর সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে যাবে । তবে, মেয়েটার মনের শান্তির জন্য , তার সুস্থতার জন্য আজ তিনি একটা মিথ্যে বলেছেন।
ইলোরা চৌধুরী খাম থেকে ছবি দুটো বের করে সামনের টেবিলে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখলেন। তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।
ছবির বাচ্চা মেয়ে দুটোর চেহারা হুবহু এক। দেখে মনে হচ্ছে একই বয়সের একই শিশু।
.. কী আশ্চর্য.. !
তিনি ছবি দুটো হাতে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললেন।
এই বিশাল পৃথিবীতে অলৌকিক, রহস্যময় অনেক কিছুই ঘটে থাকে। যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। এই মিলটাও তেমন একটি ঘটনা। কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা জানলেও এই অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা তার জানা নেই।
সমাপ্ত-

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..