বাঙালীর প্রিয় কবি কাজী নজরুল বলেছেন, “যৌবনে দাও রাজটীকা”। কিন্তু, কোন বয়সের এই রাজটীকা? কবি তার বয়স বেঁধে দেননি। কারণ, বয়স যে কেবল সংখ্যামাত্র। সমাজে অনেক তরুণরা রয়েছে যারা বয়োবৃদ্ধদের থেকেও মানসিকভাবে পিছিয়ে আছে অথচ এমন অনেক ষাটোর্ধ রয়েছেন যারা তাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সমাজকে বদলে দিয়েছেন, হাতে তুলে নিয়েছেন নতুন নতুন উদ্যোগ, নব নতুন চিন্তা চেতনা।
কবি আলী মুহাম্মদ লিয়াকত এর দুর্দান্ত উদাহরণ। সরকারি চাকরির ইতি টেনে অবসর নামক শব্দের সাথে যখন বসবাস তখনই শুরু করেন এক নতুন অধ্যায়। লেখালেখির চাষ। মানুষ, প্রকৃতি, স্বদেশ, পারিপার্শ্বিকতা হয়ে উঠে খুব কাছের এবং ভাললাগা ও ভাল থাকার সম্পদ। এই সম্পদের বাহন হয়ে ওঠে কলম ও কাগজ । এভাবেই কবি পাঠক প্রিয় করে তুলে এনেছেন তাঁর একক ৪টি কাব্যগ্রন্থ অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বইগুলো লেখায় যেমন ঋদ্ধ তেমনি রয়েছে চমৎকার নামকরণের স্বার্থকতা। যেমন: ১) ঝরাপাতার কান্না, ২) পতিতা ও পতিত, ৩) প্রেমের কবিতা, ৪) নির্বাচিত কবিতা। একক গ্রন্থের পাশাপাশি রয়েছে আরো ৫টি যৌথ কাব্যগ্রন্থ।
কবি আলী মুহাম্মদ লিয়াকত তাঁর কবিতাদের ভিন্ন অর্থে ভিন্ন আয়োজনে সাজিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় “ফাগুন আগুনে সই” কবিতাচয়নে ফাগুন আর আগুন যে একই ধারার পথচরী তিনি তারই চমৎকার যুক্তি দেখিয়েছেন এই কবিতায়। তিনি বলেছেন-
“ভালোবাসা দিবসে তুমি এসেছো হে বসন্ত
তাইতো তোমায় পেয়ে হৃদয় মন প্রশান্ত
ফাগুনে আগুন জ্বেলে তুমি চলে এলে
দোহাই যেয়ো না তুমি কিছুই না বলে।”
অর্থাৎ কবি এভাবেই বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভালবাসা যখন আসে তখন মনে থাকে বসন্ত ও অফুরন্ত প্রেম আর ফাগুন মানেইতো বসন্তের আগমন। যেখানে থাকে শুধুই উষ্ণতা, আবেদন। তাই বসন্ত যেন চুপিসারে চলে না যায় সেটিই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কবি তাঁর “জ্যোতি” কবিতায় সমাজের মূর্খ জাতিকে অত্যন্ত চমৎকার করে কিছু পংক্তি দ্বারা তুলে ধরেছেন।
“মূর্খ আমি তারেই বলি
যে বোঝে না যুক্তি
জ্ঞান বিজ্ঞান ধার ধারে না
আঁধারে চায় মুক্তি।”
আসলে সমাজে কিছু বই পড়া সার্টিফিকেট অর্জনকারী বা লেখাপড়া না জানা অশিক্ষিত মানুষও রয়েছে যারা নিজের মতের বাইরে বের হতে পারেনা। নিজের মতকেই সর্বোপরি বলে মনে করেন। কবি তাদেরকেই তিক্ততার সাথে এভাবেই উল্লেখ করেন।
“ঈদানন্দ” কবিতায়ও কবি তাঁর সঠিক যুক্তি তুলে ধরেছেন। মানুষকে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আাসতে আহ্বান জানিয়েছেন।
“কল্যাণমূলক রাষ্ট্র যবে হবে বাংলাদেশে,
ঈদানন্দ আসবে সেদিন, ঘরে ঘরে হেসে।”
তিনি তাঁর লেখায় নতুন ধারার অবতারনা করে বেশ অনেকগুলো অণু-কাব্যও যুক্ত করেছেন। মাঝে-মাঝে ভালবাসার মানুষদের প্রতি অভিমান করে কখনোবা কষ্টের লাইন ছুড়ে দিয়েছেন। যেমনি “কষ্ট বড় কষ্ট” কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“কেউতো আসে না আজ
হাতে নিয়ে rose,
বুকে লাভ ডোজ দিয়ে
করে না propose !!!!!
কেউতো রাখে না খোঁজ
কত ভালো আছি,
তাইতো সে ভুলে গেছি
খেলা কানা-মাছি।”
কখনো কখনো বাস্তবতার নিরিখে তিনি বলেছেন, “নারীর সৌন্দর্য আর পুরুষের টাকা, এই দুটো ছাড়া দুনিয়া ফাঁকা।”
কথাটা শুনতে বেমানান মনে হলেও বাস্তবতা যেন সেদিকেই দৌড়াচ্ছে।
কবি লিয়াকত তাঁর আরো একটি অণু কবিতায় যে লাইনগুলো উপস্থাপন করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ।
“তোমার দেহ স্বর্ণ-খনি,
আমি কিছুই চাই না।
আয়নাতে খুঁজে দেখি,
মনটা কোথাও পাই না।”
বর্তমান সমাজে একে অন্যের প্রতি ভালবাসা মানে গাড়ী-বাড়ী, টাকা-পয়সা, ব্যাংক ব্যালেন্স। মানুষের মনের জায়গার যেন খুবই অভাব। তাই তিনি ধন-দৌলত বা দেহকে প্রাধান্য না দিয়ে মনটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
কবি স্বদেশ মাতৃকাকে তুলে এনেছেন অত্যন্ত মায়া-মমতা আর ভালবাসার মারফতে। তাঁর “মা মাটি ও স্বাধীনতা” কবিতা-ই এর উজ্জ্বল নিদর্শন।
“বাংলা আমার মা ও মাটি
বাংলা মায়ের কোল
বাংলা ভাষায় গানে গানে
দোলনাতে খাই দোল
মায়ের মুখে প্রথম শুনি
সোনামণি ডাক
মায়ের বুকে আদর সোহাগ
ছিলনাতো ফাঁক।”
————————————
————————————
“রাজপথ হয় রক্তে লাল
পলাশ শিমুল ফোটে
তাইতো সেদিন স্বাধীনতার
প্রথম সূর্য ওঠে।”
সত্যিই এক অসামান্য আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখার যাদুতে।
কবি আলী মুহাম্মদ তাঁর লেখার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার। তিনি একজন পরিপূর্ণ কবি হওয়া স্বত্ত্বেও নিজেকে কখনোই বড় করে তুলে ধরতে পছন্দ করেননি। তাঁর লেখা আরো একটি অসাধারণ অণু কবিতা যা নিজের মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট।
“কবিতা যতই লেখো,
হবে না সে রবি,
কলমের রেখাচিত্র তবু
কিছু কিছু হতে পারে,
পটে আঁকা ছবি।”
কবি নিজেকে বিশ্ব কবি রবি ঠাকুরের সঙ্গে তুলনা না করে খুব সামান্য একজন হিসেবে তুলে ধরেছেন। সামান্য আলো সঞ্চয় নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু না কিছু রেখে গেলেও যেতে পারেন সেই আশাই ব্যক্ত করেছেন তাঁর কবিতায়।
কবি আলী মুহাম্মদ লিয়াকত জীবনের যতই বিরাশি বসন্ত পেরিয়ে তিরাশিতে পদার্পণ করুন। জানুয়ারির আঠারো সে তো মিথ্যে নয়। তিনি আঠারোর কোঠায়ই থাকবেন আজীবন। লেখালেখির বয়সটাও যে এক যুবকের বয়স। সুতরাং রাজীটকা তো তাঁরই প্রাপ্য।
অবশেষে আরো একবার উচ্চারিত পংক্তিমালা, আলী মুহাম্মদ লিয়াকত- এক যুবকের নাম।
তারিখঃ ১০/০১/২০২২
রাতঃ ১:৩০ মি:
শেওড়াপাড়া, ঢাকা।
Leave a Reply