টেবিলে বসলাম সবে মাত্র স্নান- পুজোর পর। এবার আমার লেখার সময়।সকলেই জানে সেটা। এখন ঘন্টা দুয়েক নো টক, নিতান্ত জরুরি দরকার না থাকলে।
অলিখিত নোটিশ এ বাড়িতে সকলে মানে গনে। কিন্তু আজ বড়ো এলোমেলো হাওয়া। লেখায় মন বসছে না। কালরাতে একটা গল্পের প্লট এসেছিল মাথায়। এই মুহূর্তে রাতের স্বপ্নের মত সেটা গায়েব। কবিতা না গল্প.. সেটাই তো মনে করতে পারছি না, শব্দ বন্ধে বাঁধব কি করে? আমার পুষ্প ভয়ে ভয়ে ঢোকে ঘরে ” বৌদি, কি কি পিঠে হবে বল। আজকের প্রয়োজন জরুরি, তাই ঢুকতে হল। নিয়ম ভঙ্গ হয়নি কিছু।” হেসে ফেলি। এমনিতে মেয়েটা স্মার্ট, তারওপর আমার মতো কলম- শ্রমিকের সাথে থেকে থেকে কথা গুলি বাঁধানো জবরদস্ত। রয়েছে ও তো কমদিন নয়। আমার রান্নার লোক ও নয়। বরং বলা ভালো আমার রান্নাঘরের শিল্পী। রান্না ওর প্যাশন। তাই ও ওর মর্জিমতো দেশি- বিদেশী ভালো মন্দ রেঁধে আমাদের খাওয়ায়। আমার রান্নার লোক অসীমা সাদাসিধে বাঙালি রান্নায় পটিয়সী।তা ছাড়া অনেক দিন আছে। ছাড়াবার প্রশ্নই নেই। তবে মানতেই হবে আমাদের রান্নাঘরে রেনেসাঁ এনেছে পুষ্প আর ওরই প্রভাবে আমাদের লাঞ্চ ডিনার বা ব্রেকফাস্টে প্রায়শই এনলাইটেনমেন্ট। অথচ এই বয়সেও এনজাইমের কোন হেরফের হয় না; না আমার বরের, না আমার।
আরেকটি মানুষও আমাদের সংসারে আসে যায়, যার কাজ অপরিহার্য হলেও ধরনটা অন্য। অন্য মানে পৈটিক সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়।
যাই হোক মেজাজ আজ আমার গরম। লেখার সময় পুষ্পর নিয়ম বর্হিভূত প্রবেশ। ভুরু কুঁচকে বলি, ” এ সময়ে নিয়মবহির্ভূত প্রবেশ কেনো? ” পুষ্প বলে নিয়ম ভাঙলাম কোথায়? জরুরি প্রয়োজন। তাই কনটেন্টমেন্ট জোনে ঢুকেছি। হায়রে করোনা শিক্ষিত, আধা শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এ’ একপ্রকার এনলাইটেনমেন্ট। ” বল কি বলবি। “
পুষ্পের ত্বরিত বাক্য বৃষ্টি, “নারকেল আনা হয়নি কাল বাজার থেকে। পয়সা দাও। ” অনেকটা অন্যমনস্ক আমি, লেখা নিয়ে বিব্রত। তর্কে যাই না, সাদা সাপটা প্রশ্ন,
” নারকেল দিয়ে কি করবি”? ” পিঠে। ” স্মৃতির তৎপরতা… আজ পৌষ সংক্রান্তি। তাই এতোটা এলোমেলো গঙ্গা সাগরের হাওয়া। পুষ্প কে টাকা দিয়ে রেহাই পাই। কিন্তু স্মৃতির হাত থেকে রেহাই পাই না। এবার পেনের তৎপরতা কাগজের গায়ে, বর্তমান নস্যাৎ, নস্টালজিয়ার লেপ মুড়ি দিয়ে অতীত এসে দাঁড়ায় গুটি গুটি পায়ে। আমি অতীতের রঙ-তুলির টানে বিভোর হয়ে কিছু দেখা চরিত্র আর ঘটনার গায়ে রঙ মাখাতে ব্যস্ত হই।
পৌষের মিষ্টি নলেন সকাল। জায়গাটা সিঁথি অঞ্চল, তখন অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা। প্রতিবেশীদের মাঝেআপনার চেয়ে আপনজনের মনোনীত
মনোভাব।আঠারো আর ছাব্বিশের সবে মাত্র গাঁটছড়া বাঁধা। অঘ্রাণ সেটা । পৌষের প্রিল্যুড।তখন নকশালদের রমরমা এই অঞ্চলে। বাতাস প্রায়ই বারুদের গন্ধে ঠাসা। আতংকের ঘোরাফেরা অলিগলিতে। বিকট আওয়াজ যখন তখন… বোমা বা বন্দুক। যত্রতত্র প্রায়শই লাশ।ভাশুর পুলিশ অফিসার। সুতরাং আমাদের বিয়ের আগে থেকেই সিঁথি থেকে আত্মরক্ষার্থে ফেরার।
অন্যায় নয় কিছু। ভারতের সংবিধানের পার্ট থ্রি তে একুশ নম্বর ধারায় জীবন ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। দুই ননদ বিবাহিতা। তাই দুজনের একাকী সংসারের যাত্রা- পালা। ভালোবাসা, মান-অভিমান খুনসুটি তে কেটে যেত বেশ। দক্ষিণ কলকাতার মেকি পরিবেশ থেকে আসা আঠারোর এক মেয়ে উত্তর কলকাতার উপকণ্ঠের পাড়া সূত্রে পারিবারিক পরিবেশ উপভোগ করত।
মেয়েটার শ্বাশুড়ী অকাল প্রয়াত আর শ্বশুর তার বিয়ের বছর চারেক আগে। তাতে খামতি নেই কিছু, বরের বন্ধুদের নানা ভূমিকা পালন দেখার মত। বাজার সারা।সময় কোথায় ঘরের লোকের অফিস আর ক্রিকেটের চক্করে!!শেখর এসে বলত, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি কেন? পায়ে আলতা পড়া এয়োস্ত্রীর কর্তব্য। বাবলু বলতো কি রান্না হলো আজ? তেতো আছে তো খোকনের ভাতের পাতে? বিকেলে বাড়ির রকে বন্ধু দের সাথে আড্ডা সংগে ঘটিগরম আর ঝালমুড়ি চানাচুর এর সংগত.. সে এক ডিলিয়াস সেশন। তারপর ছুটিছাটায় বাড়িতে বনভোজনের আবহাওয়া। ভজহরি মান্না বাপী… কি দুর্দান্ত যে রান্না.. আহা!! শীতকালে দুটো সুটকেস গোছানো থাকত ক্রিকেট প্লেয়ারের.. যাতায়াত হিল্লি- দিল্লি- বোম্বে.. লখনউ, এলাহাবাদ। মন খারাপ হত, কিন্তু অসুবিধা হতো না কিছু। ওর বন্ধু বাহিনী তখন পুরোপুরি কেয়ার টেকার। আর বাপের বাড়ি থেকে এসে থাকত মা বা দুই পিসির একজন, যারা বন্ধু বাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এবার আমাদের দুজনের সংসারের পরিসেবা কারিনীর কথা বলি। বিয়ে হয়ে গিয়ে দেখেছি মানুষ একা, পরিসেবার লোক চারজন। পরে সংকোচ কাটিয়ে বলি ওকে, ” চারের দরকার কি? ” উত্তর এসেছে ” একজনও থাকবে না বলছো? ” লজ্জা পেয়েছি। ঠিক তার আগের দিন চা ভিজিয়েছি কাঁচের কেটলিতে, পরে এক ড্রপ চাও পড়েনি নল বেয়ে। কি হাসি বাবুর কেটলির ঢাকনা খুলে… এতো চা- পাতা দিয়েছি দুকাপ চায়ের জন্য বড়োসড়ো টেনিস বল হয়ে নলের মুখে গেছে আটকে। এর কদিন আগে হিটারে ভাত চাপিয়ে চান করেছি মনের সুখে। ভাত সাদা নয় ব্রাউন। হাসিমুখে খেয়েছে সে। আজ কিন্তু আমি রান্নায় পাকাপোক্ত, সে ওর ধৈর্য্য গুণের জন্য।
যাক গে প্রথম দিকে যে পরিসেবাকারিনীর কথা বলেছি, তার নাম লক্ষীর মা। ওকে প্রথমে প্রথমে দাদা বলত, আমাকে বৌদি। পরে দাদা ডাক পাল্টেছে… ছেলে। আমি কিন্তু বৌদি থেকে গেলাম। পৌষ সংক্রান্তি গেল সবেমাত্র। ওর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। এমনিতেই তো ছেলের রুচি তার নখদর্পণে।সেই অনুযায়ী মেনু তৈরি পঞ্চদশ পদে পেটুক দামুর
জন্য।তারপর পিঠে পার্বন এলে তো কথাই নেই।ফর্সা দুধ পিঠে ,পেটমোটা পাটিসাপটা, রসালো রসবড়া, লালচে রাঙাআলুর পিঠে, পাতলা সরুচাকলি, মনোহারী চিতল পিঠে, গোকুলে বাড়া গোকুল পিঠে, মন মাতানো মালপোয়া.. কত কি, কত কি। ছেলের যত্নে আমার হিংসে যে একটু হত না, তা নয়। বাপের বাড়ির আদরের দুলালী মনে মনে ঠোঁট একটু ফুলত বটে। কিন্তু লক্ষীর মা তা বুঝত না। তবে এ ক্ষোভ আমার চলে গিয়েছিল আমার মেয়ে হবার সময়, তার যত্নের কারণে। তবে সেই মেয়ের মুখ সে দেখে যেতে পারে নি। তার আগেই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলেছিল ” ছেলে আমায় গুমা-হাবড়ায় রেখে এস। আমি ওখানেই মরতে চাই। “
জীবন পথে চলতে চলতে এমন অনেক চরিত্র দেখলাম, যারা মনে দাগ কেটে গেল। আবেগের আবেদন বড়ো সাংঘাতিক। কলমের ডগায় উগরে দিতে ইচ্ছে হয়। তাই তো আজো আমি খালি চরিত্র দেখে যাই।
ফিরে আসতেই হল বর্তমানে।অতীতের মধুর মেয়াদী বড়ো স্বল্প।রান্নাঘর থেকে পুষ্পর
করা পিঠে পুলির
আঘ্রাণ ভেসে আসছে। আমার একটা ছোটগল্প লেখা হয়ে গেছে।
Leave a Reply