সকালবেলা, বৃষ্টি পড়ছে। ইলোরা চৌধুরী তার চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে সেই বৃষ্টি পড়া দেখছেন। বাসার ঠিক সামনে রাস্তায় কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা একটা মেয়ে রিকশা থেকে নামল। মেয়েটি অস্থিরভাবে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। ইলোরা চৌধুরীর মনে হতে লাগল মেয়েটি তার কাছেই এসেছে। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি পেশায় একজন সাইকোলজিস্ট । মানুষের সমস্যার কথা শোনা ও সমাধান করা তার কাজ। তবে মাঝে মাঝে এসবকিছু থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করে তার । সপ্তাহ দুয়েক হলো তিনি বিশ্রামে আছেন। নিজের চেম্বারে বসাও বাদ দিয়েছেন । তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি । বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার ধৈর্য কমে যাচ্ছে বলে তার ধারণা ।
‘ আম্মা একজন মহিলা আসছেন। আপনেরে চায়।’
ইলোরা চৌধুরীর একবার ইচ্ছে হলো সাহায্যকর্মী মেয়েটিকে বলেন, তিনি এখন দেখা করবেন না। কিন্তু মত পাল্টালেন । এমন ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে যিনি এসেছেন তার প্রয়োজন হাল্কাভাবে নেয়ার উপায় নেই।
তিনি বেশ বিরক্তি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
তার ধারণা ঠিক। বসার ঘরে কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা সেই মেয়েটিই বসে আছে । দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স ত্রিশের আশেপাশে হবে হয়ত।
তাকে আসতে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।
ইলোরা মেয়েটাকে বসতে ইঙ্গিত করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
মেয়েটি হকচকিয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে সে বলল,
— আমার নাম শাপলা। প্রায় বছরখানেক আগে আমি একবার আপনার শান্তিবাগের চেম্বারে গিয়েছিলাম।
ইলোরা মেয়েটাকে ঠিক মনে করতে পারলেন না।
মেয়েটিকে হঠাৎ খুব অস্থির মনে হলো। সে কাতর গলায় বলল,
— আসলে সেবার আপনাকে আমি কিছু বলতে পারিনি। গতকাল আপনার চেম্বারে গিয়ে জানলাম আপনি সেখানে যাচ্ছেন না । এভাবে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত আসলে আমি নিরুপায়। একটা বিষয় আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই। প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। আমি অনেক কষ্ট করে আপনার ঠিকানা জোগার করেছি। আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।
ইলোরা মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। বেশ স্মার্ট, মোটামুটি সুন্দরী একটা মেয়ে। মাঝারি উচ্চতা , চেহারায় কেমন নিষ্পাপ বাচ্চা সুলভ ভাব আছে। মেয়েটি বলছে সে বছরখানেক আগে একবার তার চেম্বারে এসেছিল। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি । তার অস্থির ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে এবারও কিছু না বলেই সে চলে যাবে।
তার ভাবনা প্রমান করতেই যেন মেয়েটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল।
— আমি খুব লজ্জিত। আসলে এখন আমার মনে হচ্ছে আমার উচিত হবে সাইকোলজিস্ট নয় কোনো আলেমের শরনাপন্ন হওয়া।.. তওবা করা। আপনি কি এমন কাউকে চিনেন?
ইলোরা চৌধুরী মৃদু হাসলেন। এখন হঠাৎ তিনি মেয়েটির প্রতি মমতাবোধ করছেন । মেয়েটিকে তার সত্যিই অসহায় মনে হচ্ছে।
— তেমন কোনো আলেমের সাথে আমার পরিচয় নেই। তবে আপনি বলতে চাইলে আমি আপনার কথা শুনব, সাহায্য করতে চেষ্টা করব।
মেয়েটি ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল। তবে তার অস্থিরতা দূর হলো না।
— ভালো কথা আপনি কি বিবাহিত?
— আমার স্বামী দেশের বাইরে থাকেন । আমাদের একটা মেয়ে আছে। ওর নাম তিতলি সামনে মাসে সে ছয় বছরে পড়বে।
— আপনার সমস্যা কি আপনার মেয়েটিকে নিয়ে?
শাপলা কেমন চমকে উঠল। তার চোখে মুখে আতঙ্ক দেখা গেল ।
— ঠিক তা নয় ম্যাম । তবে ঘটনায় সাথে ওর যোগসূত্র আছে। .. পুরো ঘটনাটা শুনলে আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। তবে মূল ঘটনা বলার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক জিনিস বর্ণনার প্রয়োজন আছে। আশা করি লম্বা সময় নেয়ায় বিরক্ত হবেন না।
মেয়েটি তার কাহিনি বলতে শুরু করল।
***
আমি শাপলা। আমার জন্ম ময়মনসিংহ শহরে । জীবনের প্রথম চৌদ্দ বছর আমার সেখানেই কেটেছে। আমি মা- বাবার একমাত্র সন্তান। তাদের বিয়ের দীর্ঘ আট বছর পর আমার জন্ম হয়। আমার আগে বা পরে তাদের অন্য আর কোনো সন্তান জন্মেনি। অতি আদরের ফলেই হয়তোবা ছোটবেলা হতে আমি জেদি, একগুঁয়ে স্বভাবের ছিলাম। শহরে আমাদের বাসাটা ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের একদম তীর ঘেঁষে । ব্রহ্মপুত্র মরা নদী, এর দুই কূলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। আমাদের দোতলা বাসার খোলা জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যেত সরু নদীর ঐপারের বিস্তৃত বিশাল চর। বর্ষাকালে অবশ্য ভিন্নচিত্র । মৃতপ্রায় সেই নদীর বিশাল চর সে সময় প্রায় পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যেত । অবর্ননীয় কষ্ট, দুর্দশার মধ্যে সে চরে বসবাস করত হতদরিদ্র একদল মানুষ । খিদের জ্বালায়, দুই মুঠো ভাতের জন্য চরের গ্রামগুলো হতে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ভোরে কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নৌকা করে নদী পার হয়ে শহরে চলে আসত কাজের জন্য। পুরুষের পাশাপাশি খুব অল্প বেতনে প্রায় পেটে ভাতে নারী, শিশুরাও শহরে এসে বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করত। আমি দেখতাম, আমাদের বাড়িতে সারাদিনের জন্য রাখা ছুটা বুয়াগুলো দুপুরে খাবার জন্য যে ভাত পেত তা কিন্তু নিজেরা খেত না। দিন শেষে বিকালে থালায় করে বাড়িতে নিয়ে যেত পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে খাবে বলে। সম্ভবত সারাদিন শেষে কেবল ওই একবেলা মানে রাতে ওরা পুরো পরিবার ভাত খেত। চোখের সামনে দেখলেও এদের ভয়াবহ দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন ও বেঁচে থাকবার কষ্টকর লড়াইয়ের কাহিনি কিন্তু স্কুল পড়ুয়া কিশোরী আমার উপলব্ধির বাইরে , একদম অচেনা ছিল । সে সময় আমি কখনো এদের জীবন নিয়ে গভীরভাবে মাথা ঘামাতে বা অনুভব করতে চেষ্টাও করিনি।
তো একদিন আমাদের বাসায় কাজ করতে এলো চরের এমন হতদরিদ্র পরিবারের বছর ছয় বা সাতের একটি বাচ্চা মেয়ে। তাকে কাজে দিয়ে গেল তার এক ফুফু । সুন্দর, ফুটফুটে চেহারা মেয়েটির। তাকালে ভীষণ মায়াবোধ হয়। মেয়েটির নাম মুর্শেদা। ঐটুকু বাচ্চার কাজ করা দূরে থাক আসলে তখনও মায়ের আচল থেকে বেরোবারই বয়স হয়নি। ঐ বয়সটা কেবলই খেলার। নিজে মা হবার পর এখন বুঝি কতটা নিরুপায় হলে মা- বাবা ওইটুকু বাচ্চাকে কাজে পাঠায়। ওর ফুফু ওকে বাসায় রেখে চলে যাবার পর মেয়েটি কিন্তু একবারও কাঁদল না। আসলে দারিদ্র্যের চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই। অভাব ওকে ওই অতি অল্প বয়সে জীবনের কুৎসিত, কদর্য রূপগুলো চিনিয়েছিল হয়তো।
স্কুল পড়ুয়া আমি কিন্তু নিষ্পাপ, হতদরিদ্র ঘরের শিশুটির প্রতি সে সময় সামান্যতম কোনো মমতা অনুভব করিনি। বরং আম্মা, আব্বা ওকে আদর করতেন বলে আমি এক ধরনের তীব্র ক্ষোভ ও ঈর্ষা অনুভব করতাম ওর প্রতি। কেন যেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হতো ওকে। স্কুল থেকে ফিরে সবার আড়ালে লুকিয়ে মাঝে মাঝে কঠিন সব কাজের হুকুম দিতাম শিশুটিকে । যে কাজগুলো করবার মতো বয়স বা শারীরীক যোগ্যতা কিছুই ওর হয়নি। যেমন, মাঝে মাঝে চুলায় রাখা গোসলের জন্য করা গরম পানির বড়ো হাড়িটা ওকে দিয়ে নামাতাম। চা বানাতে পাঠাতাম। ঘর এলোমেলো থাকতে দেখলে বইপত্র ছুড়ে মারতাম ওর দিকে। এখন মনে পড়লে চোখে পানি চলে আসে, ছোট্ট মেয়েটি কী কষ্ট করেই না গলা সমান উঁচু চুলা হতে গরম পানির সেই বিশাল হাড়িটি কাঁপতে কাঁপতে নামাত।
মুর্শেদা আমাকে অসম্ভব ভয় পেত। পাছে আমার দেয়া বিচারে তার দুইবেলা খেতে পাবার এই নিরাপদ আশ্রয়টুকুও চলে যায় সেই ভয়েই হয়তো আমার করা অত্যাচারগুলোর কথা সে কখনো কাউকে বলত না।
শাপলা হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে গেল।
ইলোরা চৌধুরী বললেন ,
— মেয়েটি কতদিন ছিল ?
— তা প্রায় পাঁচমাস।
— তারপর? সে নিজে থেকেই চলে গিয়েছিল?
— জি না। সে ঘটনাটিই এখন বলব।
..তখন শীতকাল। স্কুল থেকে ফিরে গরম পানি দিয়ে গোসল করার অভ্যাস ছিল। আম্মা অসংখ্যবার নিষেধ করা সত্বেও সুযোগ পেলেই আমি সেই পানি গরম বসানো ও নামানোর কাজটি করাতাম মুর্শেদাকে দিয়ে ।
.. একদিন ওর হাত ফসকে সত্যি সত্যিই গরম পানির হাড়ি পড়ে গেল।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply